মহীবুল আজিজ
উজানিপাড়া থেকে বেরিয়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়ালে একদিকে বৌদ্ধ মন্দির এবং অন্যদিকে ডন বোসকো স্কুলের চুড়ো এই দুই দর্শনীয় বিষয় খানিকটা মনোযোগ মুহূর্তে কেড়ে নিলে ছোট অভিযাত্রীদের সারিটি আমরা দেখতে পাই পেছন থেকে। সমুখভাগটা ততক্ষণে মন্দিরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলেছে। তা হোক তবু চৈত্রমাসের শেষ দিনে এমন দৃশ্য অপ্রত্যাশিত নয়। সামনে আরও দু’টো দিন। মাঝখানের দিনটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ— সাংগ্রাই, জলের উৎসব। কিন্তু আরও যে-দৃশ্য এমন জনবিরল সকালবেলা আমাদের বিস্মিত করে এর নান্দনিকতা দিয়ে সেটির জন্য না কিরণ বড়ুয়া না আমি দু’জনের কেউই প্রস্তুত ছিলাম। একটি কিশোর, সম্ভবত মুরংপাড়া থেকেই বেরিয়েছিল। কত হতে পারে বয়স, তেরো কি চৌদ্দ। আসলে বয়স আমাদের বিস্ময়ের কারণ না, এই বয়সে তার পরনের কঠিন চীবরই বিস্মিত করে আমাদের। হয়তো তার বাবা-মা জীবনের কোনো ভয়ংকর দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার মানসে তাদের এই সন্তানটিকে অব্যবহিত ভিক্ষুত্বের মানস করেছিলেন কিংবা হয়তো কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ছেলেটির পিতা নিজের অপূরণীয় মনস্কামনাকে সন্তানের দ্বারা পরিপূর্ণ করতে চেয়েছেন। অথবা এসবের কিছুই নয়, সবটাই ভগবান বুদ্ধের প্রতি তার পিতামাতা কিংবা অভিভাবকের প্রদত্ত নৈবেদ্য।
বিস্ময় সামলে নিয়ে কিরণকে বলি, সত্যি এমন দৃশ্য এই প্রথম দেখলাম আমি। কিন্তু তেমন দৃশ্যে অনভ্যস্ততা নেই তার। বললো, দেখো বৌদ্ধ ধর্ম এমনই এক ধর্ম যেখানে চোখের
সামনেকার সাদামাটা দৃশ্যের আড়ালে থাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অসাধারণ প্রেক্ষাপট। কেউ কী ভাবতে পারে একজন দস্যু কিংবা একজন ঝাড়ুদারও অর্হৎ হতে পারেন! বস্তুত জীবনের প্রকৃত সাধনার গুণে সবই সম্ভব। বললো কিরণ এমন কিশোরেরা বান্দরবানের এই জনপদে মোটেও দুর্লভ নয়। মুরং, পাংখোয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো, খিয়াং এইসব নৃগোষ্ঠির এমনকি বাঙালিদেরও অনেকেই তার চেনা যাদের পরিবারের কেউ না কেউ শ্রমণত্ব নিয়েছে অল্প বয়সে। মাত্র কয়েক দিন আগেই বান্দরবানের প্রধান সড়কে অবস্থিত তার ‘সুন্দর আর্ট’ থেকে এক খিয়াং লোক তার কিশোর শ্রমণ-পুত্রের একটি বিশাল প্রতিকৃতি বাঁধাই করতে দেয়। চীবর পরিহিত ছেলেটির হাতে অভিধর্মের প্রচ্ছদটি অনেকটা দূর থেকেও চোখে আটকায়। ততক্ষণে সে পূর্ববর্তী অভিযাত্রিকদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। আমার লক্ষ্য মূলত সাংগ্রাই। ক’টা দিন হাতে রেখে মোটামুটি মূল উৎসবের তিনটে দিনকেই উপভোগ করবার জন্য নাগরিক উন্মাদনা আর কোলাহলকে সরিয়ে রেখে ঢুকে পড়েছি পাহাড়ের জীবনে।
কিরণের বাসাটা বালাঘাটায়। উছালা ভান্তে প্রতিষ্ঠিত টিলার চুড়োর চমৎকার ক্যাংয়ের সামনেকার চাতালে দাঁড়িয়ে একবার দৃষ্টি দিলেই তার একতলা ঘরটা। সীমানা দেওয়ালের চারপাশ ঘিরে ঝোপঝাড়, গুল্ম আর ঔষধি গাছপালার ভিড়। এরিমধ্যে সাংগ্রাইয়ের বহুবর্ণিল প্রতিফলন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে এবং বিশেষ করে একবার যদি চূড়োর ক্যাংয়ে ওঠা যায় তাহলে মনে হবে কোনো এক জাদুবলে পূর্বপ্রান্তের এই পাহাড়ি জনপদ সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জীবনমানচিত্রে রূপ নিয়েছে। তা এখনকার ধূলোমলিন ক্ষুধাজর্জর বিবর্ণ জীবনের বাস্তবতা নয়। কিন্তু আবার সেখান থেকে নেমে এলে দেখা যাবে, একেবারে রাস্তার মুখেই হয়তো তাঁতে তৈরি অসম্ভব সুন্দর থামি পরনে প্রাকৃতিকভাবেই সুন্দর কোনো নারী বসে রয়েছে তার বাঁশঝাড়ে জন্মানো গোটাকয় বাঁশকড়ুল নিয়ে। সেগুলো বিক্রি করা গেলে সেই টাকা দিয়ে সে তার শিশুর জন্য বাজার থেকে কিনে নেবে দৈনন্দিন খাবার। কোনো বৃদ্ধা বসেছে ক’টা পাকা পেপে নিয়ে। কেউবা হাতে বানানো তৈজস। দেখেই ঝটিতি পথকাটা পর্যটকদের মনোহরণ ঘটে এবং তারা হয়তো চট করে কিনেও নেয়। দিনের পর দিন এই চিত্র অভিনীত হয়েই চলেছে। হ্যাঁ, সাংগ্রাইয়ের মূল অনুষ্ঠানের আরও একটা দিন বাকি থাকলেও আমি বিকেলে একবার চুড়োয় উঠবো। দেখবো পরদিনকার প্রস্তুতির জন্য সকলেই চমৎকার সব পোশাকে সাজতে শুরু করেছে। এমনিতেই পাহাড়ে হওয়ার জন্য কিনা কে জানে, প্রকৃতির আশ্রয়েই তাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা বলেই তাদের কণ্ঠও প্রকৃতির পাখিদের মতো সুরবান্ধব। কোনোরকম রেওয়াজ-চর্চা ছাড়াই তাদের কণ্ঠে তাদেরই ভাষার গানগুলো আশ্চর্য সুরেলা ঝংকারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তেমনই তাদের নাচও। যেভাবে বেড়ে ওঠে প্রকৃতির নিসর্গ-পাহাড়-নদী ঠিক সেভাবে সেখানকার মানুষ তারাও। তাই হয়তো তাদের উৎসবগুলিতে পোশাকআশাক, সংগীত আর নৃত্যের এমন অনিবার্য সংযোগ।
কিরণ বড়ুয়া ওর ‘সুন্দর আট’-এর দিকে পা বাড়ালে আমি এসে পড়ি ক্য সা মং-এর বাসায়। সাংগ্রাই এলে কিরণের ব্যস্ততাও বাড়ে। প্রায় সকলেরই মনে তখন একটা ভিন্ন আমেজ। হ্যাঁ, সাংস্কৃতিক চেতনার বিষয়টা অনস্বীকার্য কিন্তু একটা নিরাভরণ ধর্মীয় ভাবও এই সময়টাতে অনেকের মনোযোগ কেড়ে নেয়। তখন তারা বুদ্ধের বিভিন্ন আসন, মুদ্রা কিংবা প্রতিকৃতির ছবি ক্যানভাসে আঁকিয়ে বাঁধাই করে নেয়। টাঙিয়ে রাখে ঘরে। বহুকাল আগেকার কথা, আমি জানতাম না বুদ্ধের একই হাত ও আঙুলের এত বিবিধ মুদ্রা হতে পারে কিন্তু কিরণের কাছেই সেসব জানা গিয়েছিল। তারপর ক্য সা মংয়ের সঙ্গে একবার গেলাম থানচিতে এক বৌদ্ধমন্দিরে। মায়ানমারের এক শ্রমণ এসেছিলেন শুভেচ্ছা সফরে। কিরণের মতো তাঁর কাছ থেকেও জানলাম সেসব। আমাকে অবাক করে দিয়ে বিদেশি শ্রমণ তাঁর কাপড়ের থলে থেকে একটা ছবি বের করে দেখান— বিখ্যাত হলিউডি নায়ক রিচার্ড গেয়ারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটিতে ভান্তের ছবি। সেই রিচার্ড, আমাদের টগবগে তরুণ দিনের ‘ব্রেথলেস’ রিচার্ড কিংবা জুলিয়া রবার্টসের সঙ্গে হৃদয়কাঁপানো সেই ‘প্রিটি উওম্যান’। জানতাম না রিচার্ড গেয়ার বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। যাহোক, সাংগ্রাইয়ের মূল উৎসবের দিন ক্য সা মংকে আর পাওয়া নাও যেতে পারে কিন্তু ওর বাসায় একবেলা না খেলে তার ঠেলা আমাকে সামলাতে হবে অনেকটা দিন। পাহাড়ে এলে আমি নিজের সমতলীয় ব্যাকরণ ভুলে যাই। থাকবো পাহাড়ে আর ভাবভঙ্গি দেখাবো ধোপদুরস্ত প্রতিষ্ঠিত সামাজিক শ্রেণির তা হওয়ার নয়। ক্য সা মংয়ের ঘরের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বৌদির রান্না জুমের আঠালো বিনি চালের ভাত কি নাপ্পিদেওয়া খাইস্যা কি মেটে আলু ও ছুরি শুঁটকির ঝোল-ঝোল তরকারি দিয়ে ভরপেট খেয়ে যখন বারান্দায় শুয়ে পড়বো দিবানিদ্রার উদ্দেশে তখন আরও খানিকটা উজিয়ে নিকট পর্বতের ছায়া চাদরের মতোন ঢেকে দেবে শরীর। গাঢ় ঘুমে সন্ধ্যা হয়-হয় এমন সময়টাতে মনে হবে আমি সমস্ত মানবসংযোগের অতীত অন্য এক জীবনগণ্ডির বাসিন্দা। ক্য সা মং-এর বাসা থেকে রাতের পৃথিবী দেখবার জন্য বেরোবার মুহূর্তে সে যখন খানিকটা দোচুয়ানির আমন্ত্রণ করবে তখন আমার শহুরে ভদ্রলোকি পোশাকটা রাখতেই হবে খুলে এবং এই স্বল্প আচ্ছন্নতা নিয়ে পাহাড়লাগোয়া হ্রদের পাড় ধরে হেঁটে হেঁটে আমি আর ক্য সা মং চলে যাবো আরও দূরে বমপাড়ার দিকে যেখানে হয়তো পরিচিত লনচেও পরিবারের লোকেরা মাচাংয়ের ওপরে আয়োজন করছে সন্ধ্যা-উত্তর চন্দ্রিমাযাপনের পর্ব। আলোছায়ার মধ্যে পরস্পর পরস্পরের মুখগুলি ঠিকই দেখতে পাবে কিন্তু সেই ছায়ায় নিশ্চয়ই কে পাহাড়ি কে সমতলি তা দুষ্পাঠ্যই থেকে যাবে। অবশ্য আমার সম্মানে মারমা, বম এবং আমার তংঞ্চগ্যা বন্ধুরা কথা বলবে আমারই ভাষায়।
ক্য সা মংয়ের বাসার কাছেই একটা সীমানাঘেরা মাঠে যুবক যুবতীদের ভিড় দেখে উৎসাহের বশে এগিয়ে গেলে দেখতে পেলাম একটা বড় ব্যানারে মারমা এবং ইংরেজিতে শিরোনামের মতো লেখা— রি লাং পোয়ে মানে জলোৎসব। মূল সাংগ্রাইয়ের উপলক্ষ্যে করণীয় বিষয়গুলো সুন্দর হস্তাক্ষরে কেউ লিখে রেখেছে। সংলগ্ন ক্লাবঘরের মতো একটা ঘরও রয়েছে যেখান থেকে ভেসে আসছিল সম্মিলিত নারীকণ্ঠের মিষ্টি একটা সুর। কণ্ঠের যৌথতা সত্ত্বেও শোনাচ্ছিল মিহি আর নমনীয়— সাংগ্রাই মা, নি নি ইয়া ইয়া, রিক জেইকে পামি, ও এমে গ্রি রো, লাগে লাগে… ইত্যাদি। অবর্ণনীয় এক ভালোলাগায় ভরে ওঠে চারদিক। নমনীয় মসৃণ কিন্তু জোরালো সেই সুরের তরঙ্গ আমাকে ছুঁয়ে আমার দেহে আবছা কম্পন জাগিয়ে যেন ছুটে যায় অদূরের রাধাচূড়ার ঝোঁপের দিকে। ছুটে গেলে রাধাচূড়ার পাতাগুলো ঝিরিঝিরি দোলে। সেই দোলা গায়ে নিয়ে ঝোঁপে বসে থাকা একটি দোয়েল মুহূর্তে উড়াল দেয় আরও গভীর অরণ্যের দিকে। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে অদূরের নদীর ভেতর থেকে রোদের প্রেক্ষাপটে একটি মাছের লাফ দিয়ে ওঠা আমি না দেখে পারি না। কেননা শহরে এমন একটি মুহূর্ত কখনও জীবন আমাকে দেয় নি, দেয় না এবং দেবে না। তবে কী সম্মিলিত সেই সুরের কম্পন নদীর বুকেও পৌঁছে যাচ্ছে। হতে পারে তারাও জানে আসন্ন জলোৎসবের কথা। এখানে আমি অনাহুত আগন্তুক নই বলে ছোট্ট মিলনায়তনের ভিড়ের মধ্যে গিয়ে একটি চেয়ারে বসে পড়লেও কেউ বলে না, কী চাই, কাকে চাই! বরং আমাকে বসতে দেখে দুই শিল্পী-বোন রূপশ্রী ও নিরূপা নেওয়ার এগিয়ে এসে কুশল জানতে চায়। ওদের বাবা নেপালি এবং মা মারমা। ওদেরই কাকা অরুণ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী। বছরচারেক আগে মারা গেছে হার্টঅ্যাটাকে।
বান্দরবানের তরুণ শিল্পীরা সাংগ্রাইয়ের আবাহনে সাড়া দিয়ে উদযাপনের সমস্ত আয়োজনে ব্যস্ত। তারই অংশ ছিল মিলনায়তনের সম্মিলিত রিহার্সালপর্ব। সেই সম্মিলিত গানেরই একটি আগুয়ান আমার কানে বাজে। কিন্তু শুধু গানই নয় আরও উপাদান থাকে আয়োজনের। রাজবাড়িতে খাজনা আদায়ের আনুষ্ঠানিকতা একটি অনুশাসনিক অধ্যায় হলেও তাতে বাহারি ঝলমলে পোশাক সাজসজ্জা আলোকোদ্ভাস ফুলের সমাহার সবই এক অন্যরকম নান্দনিকতার প্রকাশ যা আমাদের প্রচলিত অভ্যেসে খানিকটা ভিন্নতাধর্মী মনে হলেও এই জনপদের অবারিত জীবনস্রোতের স্বাভাবিক রূপ এই অকৃত্রিমতাই। হ্যাঁ, যাকিছু ধর্মীয় অনুষঙ্গ বলে মনে হবে দূরত্ব থেকে, একটু নিকটে এসে একটু সংলগ্নতা জাগিয়ে দেখলে বোঝা যাবে সেসবও আসলে জীবনের থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয় বরং খুবই জীবনানুগ সেসব প্রসঙ্গ। বুদ্ধস্নান কিংবা মোমবাতির প্রজ্জ্বলনে যে-পবিত্রতা ও আলোকোজ্জ্বলতার প্রতীকতা তা হয়তো পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই লক্ষ করা যেতে পারে। হতে পারে সেসবের প্রকাশ ও যাপন ভিন্ন কিন্তু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একই। যে-মোম হানুকায় বা ইয়োম কিপুরে নিরন্তর জ্বলে, জ্বলতে জ্বলতে একসময় নিভে যায় আলোকের জেগে ওঠার মধ্য দিয়ে সেই মোমই কী এখানেও এই পাহাড়ের জীবনগভীরে আলোকের আহ্বান করে না! যে-বুদ্ধস্নান পবিত্রতার বার্তাবাহী সেই স্নানের কথাই কী মহাভারতে দ্রোণাচার্য বলছেন না ভীমকে যখন ভীম তাঁর প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করে নিয়ে আসছিলেন পূর্বসাগরতীরে! মাত্র গতকালই যে-মারমা দম্পতিকে দেখলাম সন্ধ্যার আবছা আলোয় রেগেখ্যঙের জলে স্নান করছে নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে পুরুষটির সারা গায়ে ছিল তার শিশুটির দৈনন্দিনতার চিহ্নসমূহ এবং নারীটির গায়ে জুমপ্রক্রিয়ার পাহাড়ে ওঠানামার স্মারক। নদীর জল তা সে যদি দূষিতও হয় তারা কী তাতে স্নান করে আবার এক আরম্ভের সূচক নিয়েই কী তীরে উঠে আসে নি নদী থেকে!
এই ফুল এই গান আর এইসব কণ্ঠের সজীবতা সাক্ষী মেনে আমি যখন একটা চেয়ারে বসে পড়ি তখন একটি মারমা মেয়ে মারমা ভাষায় অনুপম এক গান গাইতে শুরু করেছে। গানের কোনো কথাই তেমন জানা নেই, বাণীভঙ্গি দূরের কথা কিন্তু মনে হতে থাকে সেই গান সমস্ত প্রকৃতি ছুঁয়ে দূরের আাকশের দিকে ছুটতে শুরু করেছে মেঘকে আলিঙ্গন করবে বলে। হ্যাঁ, কতকাল আগে এমন অনুভবের কথাই গাঢ় জীবনানুরাগে লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন কালিদাস। নিশ্চয়ই মেয়েটির গীত গানটি প্রেমেরই হবে। গাওয়ার সময় তার সারা অবয়বে মায়াময় এক অব্যাখ্যেয় হাসির দ্যুতি ছড়ায় এবং সামনে বসে থাকা অনানুষ্ঠানিক দর্শকদের চোখেমুখেও একটা আভা লক্ষ করা যায়। গানের মারমা কথাগুলো মনে রাখবার চেষ্টা চালাই কখনও অর্থোদ্ধার করা যাবে এমন প্রত্যাশায়— রাং থেইমা খেঅয় ম্যা রো, তং পয় পুঙ্ নি রে… শেষের ‘রে’ ধ্বনিটায় খানিকটা জোর এবং প্রলম্বনের আবেগ যেন মেয়েটির হৃদয় ফুঁড়ে বেরোয়। চেনাজানা নেই তবু গানের সঙ্গে সঙ্গে গানের মাধ্যম মেয়েটিকেও ভালো লাগে এক অন্য অনুভূতিতে। মনে হয় যেন সে এক চিরন্তন আবেগের মানব-প্রতিনিধি। নিশ্চয়ই তার আবেগার্দ্র সুরে প্রেমিক হৃদয়ের আর্তি ফুটে উঠছিল। একটু ধাতস্থ হয়ে আশেপাশে চোখ দিতেই প্রথমবার নিজের উপস্থিতি সম্পর্কে আমার মনে জেগে ওঠে এক আকস্মিকতার উপলব্ধি। দর্শকের মধ্যে একমাত্র বাঙালি আমিই। যদিও আমার উপস্থিতি নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না। এখানকার নৃগোষ্ঠী এই জনপদের সমন্বয়ধর্মিতাতে বহুকাল থেকেই অভ্যস্ত বোঝা যায়। কিন্তু কোণের দিকটাতে আমারই মতোন একটা চেয়ারে বসা জনৈকা শাড়িপরিহিতার ওপর চোখ পড়তেই মুহূর্তে একটা অকথিত বিস্ময়ের বোধ আমার সমস্ত সত্তায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং সেই বিস্ময় আমার দৃষ্টি থেকে কোনোভাবেই আড়াল করা সম্ভব হয় না আমার পক্ষে। আমি প্রথমে পলকমাত্র মহিলাকে দেখি এবং তারপর তাকিয়েই থাকি নিষ্পলক।
একদৃষ্টে চেয়ে থাকাটা যে ঠিক ভব্যতার পর্যায়ে পড়ে না সেটা বুঝতে পেরে মুহূর্তে নিজেকে আমি সামলেও নিই কিন্তু আড়চোখে অনিয়মিত বিরতিতে তাকে জরিপ করতে থাকি। মহিলার সামগ্রিক উপস্থিতিতে একটা ব্যতিক্রম স্পষ্ট। তাকে মারমা বলেই মনে হয়। যদিও প্রথম-প্রথম মারমা, ত্রিপুরা, তংঞ্চগ্যা সবই আমি গুলিয়ে ফেলতাম। পরে জানলাম, মেয়েদের ক্ষেত্রে তাদের পরিধেয়র বিশেষত্ব তাদের পরিচিতির এক ধরনের সূচক। অন্যতর নৃবৈশিষ্ট্যগুলো ক্রমে আমার জানা হয়। কিন্তু মহিলার ক্ষেত্রে যা অনন্য, তিনি শাড়িপরিহিতা। বাঙালি রমণির পরিধেয়ধারী মারমা রমণি সত্যিকার অর্থে সেই প্রথম আমার চোখে পড়লো। কিন্তু বিস্ময়ের তাও কারণ নয়। আমার মনে হতে থাকে তাকে আমি অবশ্যই কোথাও দেখেছি, এবং দেখেছি খুব কাছে থেকে। একজন মানুষ এতটা পরিচিত না হলে আমার মনের মধ্যে তার উপস্থিতি এতটা আলোড়ন জাগিয়ে তুলতো না। দেখে তার বয়সটাও আন্দাজ করা দুরূহ। চল্লিশ থেকে পঞ্চান্ন এর মধ্যবর্তী যে-কোনো একটা সংখ্যাই হতে পারে তার বয়স। মোটকথা তার বয়সের বিষয়টা একটা প্রাথমিক প্রপঞ্চের মতোই ঠেকে আমার কাছে। মহিলা কী বুঝতে পারে আমি তাকে আড়চোখে দেখছি কিংবা তার উপস্থিতি আমার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে এবং আমার মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে বাড়তি একটা আবেগ। সেটা হতে পারে, কেননা, দুয়েকবার তার সঙ্গে আমার চকিত দৃষ্টি-বিনিময় হয়ে যায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এবং হয়তো (বা সেটা আমারই ব্যক্তিগত ধারণা) তার মধ্যেও আমাকে নিয়ে চলছিল ইতস্তত কোনো ভাবনা।
সহসা আমার মধ্যে একটা পর্বান্তর ঘটলে আমি নিজেকে আবিষ্কার করি অন্য কালের প্রেক্ষাপটে এবং অন্য এক স্থানে। আমার বাবা তখন দোহাজারি কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার এবং আমরা সেখানকার বিখ্যাত জমিদার ভগীরথ হাজারীদের ভাড়াটে। থাকি জামিজুরি বাজারের লাগোয়া পুকুরের উল্টোদিককার একটি বাসায়। দোহাজারি থেকে বাবার কর্ম ও ভ্রমণ সূত্রে আমরা তখন একেকসময় একেকদিকে চলে যেতাম। কখনও কাঞ্চননগর সাতকানিয়া আনোয়ারা কখনও কক্সবাজার এবং কখনওবা কাপ্তাই বান্দরবান। ঝটিতি একটা তরঙ্গের ধাক্কা আমি টের পাই করোটিতে যখন দেখতে পেলাম ১৯৬৮ সালের কোনো এক তপ্ত দিনে আমি এবং আমার ভাই আমরা এসে দাঁড়িয়েছি বান্দরবানে, বাবার সঙ্গে এবং রাজবাড়ির অতিথি হয়ে। হ্যাঁ, সেখানেই অপরূপা একটি মারমা মেয়ে শরবত খেতে দিয়েছিল আমাদের। কলেজপড়ুয়া সেই মেয়েটির স্নিগ্ধ মুখশ্রী বহুকাল গেঁথে ছিল আমার মনে। বয়সে আমার চাইতেও হয়তো বছর দশেকের বড়ো ছিল মেয়েটি। তাহলে দর্শকসারিতে আসীন মহিলাটি কী তিনিই। খুব কাছ থেকেই একদিন তাকে দেখেছিলাম এবং পুরো একটা দিবাভাগ রাজবাড়িতে কাটানো আমাদের সময়টাতে মেয়েটিও ছিল খুব কাছাকাছি। হতে পারে বয়সের দৈর্ঘ্য আর সময়ের চাপ তার চেহারায় ভিন্ন মাত্রা এনে দেয় কিন্তু কোথাও তবু একটা খটকা লেগে থাকে। নাহ্, মহিলার চোখ আর সেদিনকার সেই মেয়েটির চোখ এক নয়। বর্তমানের নারীটির চোখ খানিকটা গোলাকার এবং আমার শৈশবে দেখা মেয়েটির চোখের চাইতে সেই চোখ আকারেও খানিকটা বড়োই। শৈশবের মেয়েটির চোখ ছোট কিন্তু তার চাহনি ছিল দারুণ তীক্ষ্ম আর আকর্ষণীয়। এক অদ্ভুত অব্যাখ্যেয় অনুভূতির স্রোতে আমি ঘুরপাক খেতে শুরু করি এবং অচিরে সমাধান খুঁজে পাই না।
আবারও আড়চোখে দেখতে গিয়ে মহিলার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়ে যায় এবং আমি নিশ্চিত তিনি আমাকে একটা নির্লজ্জ লোক ভাবতে আরম্ভ করেছেন। ভেতরে ভেতরে একটা আশঙ্কাও আমাকে চেপে ধরে, এমন যদি হয়, চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমাকে সরাসরি তিনি অভিযোগের স্বরে বলে ওঠেন: আপনি কী আমাকে স্টকিং করছেন— তাহলে আমার পক্ষে উত্তর দেওয়াটা নিঃসন্দেহে দুরূহ হয়ে পড়বে। বয়সে তিনি আমার চেয়ে অন্তত বছর দশেকের বড়োই হবেন কিন্তু ঐ যে বললাম তার মধ্যে একটা রহস্যময় সতেজতা আছে যেজন্যে সহসা তার বয়স আন্দাজ করা মুশকিল। কিন্তু করোটিতে জিজ্ঞাসার খোঁচা চলতেই থাকে, কোথায় তাকে দেখেছি। দেখেছিলাম কী আদৌ! যদি না-ই দেখে থাকি তাহলে তার উপস্থিতি আমার সত্তায় এমন আলোড়ন তুলছে কেন! একটা বিষয় নিশ্চিত, নিয়মানুযায়ী যাকে প্রেম বলে সেই প্রেমে আমি পড়ি নি। ওদিকে মারমাভাষী তন্বী ওর গান শেষ করে ফের দর্শকের সারিতে এসে বসে। ডন বোসকো’র চার্চে দুপুর ১টার ঘণ্টা বাজে শুধু একবার। রাতে ক্য সা মংয়ের বাসায় খেতে যাবো কিন্তু দুপুরে খাবো কিরণ বড়ুয়ার সুন্দর আর্টের লাগোয়া লাবলু’স কিচেনে। ওকে সেইমতো বলে দেওয়া হয়েছে আগেই। শঙ্খনদীর চাপিলামাছ ভাজা, দেশি মুরগির লাস্সো, ঙাপ্পি দিয়ে মেটে আলুর তরকারি, পাহাড়ি সব্জি আর জুমের চালের ভাত।
ঠিক তখন আচমকা যে-ঘটনা ঘটে তার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত থাকি না। ডন বোসকোয় একটা ঘণ্টা পড়ে থেমে গেলে একটা চিল নদী পেরিয়ে হয়তো চিম্বুকের ঠাণ্ডা পরিমণ্ডলের দিকে উড়ে চলে যায় শীতলতার খোঁজে। তা-ও মুহূর্তের ঘটনা। একটি মারমা কবিতা আবৃত্তি করবার জন্য যাকে ডাকা হয় তার নাম এশানি প্রু। মেয়েটি চেয়ার ছেড়ে উঠবে। আমি আরও একবার শাড়িপরিহিতা সেই মারমা (অথবা অন্য কোনো নৃগোষ্ঠির) মহিলার দিকে তাকাই। ঝাঁঝাঁ রোদের ভেতর দিয়ে নদীর ওপারের অরণ্য একটা শীতল প্রত্যাশার মতো প্রতিভাত হতে থাকলে আমি আচমকা বিভোরতায় পড়ে যাই। হয়তো কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে বর্তমানের চেতনতায় প্রত্যাবর্তনের। কিন্তু ফেরা হয় না। একটা দুঃস্বপ্নতাড়িত বাস্তবতা পুরো এলাকা ও পরিস্থিতিকে গ্রাস করলে আমরা উপস্থিত সবাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি। একটা অতিপ্রাকৃত গল্পের মতো কয়েকটা সেকেন্ড দ্রুত অস্থির গতিতে সবকিছু ওলটপালট করে দিলে আমি কেবল ধোঁয়া শব্দ আর আর্তচীৎকারের মধ্যে আবিষ্কার করি সদ্য অতীত হয়ে যাওয়া অল্প আগের বর্তমান থেকে ছিটকে আসা নিজের অক্ষত সত্তাকে। প্রথমটায় মনে হয়েছিল কোথাও কোনোকিছুর রিহার্সাল বা আসন্ন উৎসবসংশ্লিষ্ট কোনো অনুষঙ্গ কিন্তু তখনই র্ধ র্ধ শব্দে কারও তীব্র বেগে ছুটে যাওয়া পদশব্দ পাই। সেই শব্দ এক নয়, একাধিক মানুষের পায়ের। তাতে ভারী জুতোর শব্দও প্রবল। মনে হচ্ছিলো কারা ছুটে আসছে আমাদেরই দিকে অনুষ্ঠানের মূল জায়গাটাতে আর একই সমান্তরালে ঠাস্ঠাস্ শব্দে ফাটে বোমা। হয়তো হাতবোমা কিংবা ককটেল।
মুহূর্তেরও ভগ্নাংশকালে দেখি আসন্ন উৎসবানুষ্ঠানের শিল্পী ও দর্শক প্রায় সকলেই সচীৎকার এদিকে-ওদিকে ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে যে যেদিকে পারছে ছুট লাগাচ্ছে। নিজের সংবিৎ বা বিবেচনাবোধকে সক্রিয় করবার সামান্যতম চেষ্টা না করে আমিও ছুট লাগাই একদিকে। হয়তো সজোর শব্দের বিপরীতেই আমি দৌড়াই নিজের সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধিকে তাৎক্ষণিক কাজে লাগিয়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যে আপাত নিস্তব্ধতা নামে চারদিকে কিন্তু লোকেদের অস্থির কণ্ঠস্বর বাজে নিকটে ও দূরে। হকচকিত অবস্থা থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে আপাত নিরাপত্তার বোধে পরিস্থিতি অনুভবের প্রচেষ্টা চালাতে হয় আমাকে। কেননা, পাহাড়ে এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন এটাই প্রথম। গোটা আশির দশকে শহরে আমাদের জীবন কেটেছিল এক ভয়ংকর সশব্দ-বারুদবাস্তবতার মধ্যে। তখনও আমরা পাহাড়ে আসতাম একটুখানি প্রশান্তি ও উপশমের আশা নিয়ে। আমাদের জানা ছিল শহর বিস্ফোরণের উন্মুখতায় টগবগ ফুটলেও একমাত্র পাহাড়ই জোগান দিয়ে যেতো নিরুত্তেজ অবকাশের। রিহার্সালের জায়গাটা থেকে যন্ত্রচালিতের মতো আমরা যারা দ্রুত সরে পড়ি তারা আসলে একই সঙ্গে বিভিন্ন দিকে ছুটে গিয়েছিল। নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা মনোহারি দোকানের পেছন দিককার খানিকটা আয়তাকার প্রাঙ্গণের মতো জায়গায় যেখানটা আবার সেই দোকানমালিকেরই বসতবাটি ও রাস্তাসংলগ্ন দোকানের সংযোগস্থলও।
আমাদের আগুয়ান দেখে অন্তপুর থেকে মধ্যবয়সী এক মহিলা, হয়তো তিনিই দোকানমালিকের স্ত্রী, একটা কাঠের চেয়ার আর একটা টুল এগিয়ে দেন আমাদের দিকে। বিপদগ্রস্তকে সহায়তা দেবার প্রসন্নতা তার চোখেমুখে। আর তখনই আমি পুনরায় অবাক হই এবং লক্ষ করি শাড়িপরিহিতা রমণিটি আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো। মহিলার উদ্যোগে তিনি এবং আমি আমরা দু’জনেই বসে পড়ি, মুখোমুখি এবং পারস্পরিক নৈকট্যে। আর ছিল একটি কিশোরী। নয়/দশ বছরের মেয়েটিকে আমি দেখছিলাম মাঠের এদিকে-ওদিকে। ওর হাতে একটা ডালা এবং ডালার মধ্যে ক্যাংওয়াপ্যাং বা সাংগ্রাই ফুল। সাংগ্রাই উৎসবের মূল ফুল সেগুলো। দেখতে নাগেশ্বরের মতোন। অনেকেই সাংগ্রাইয়ের উপলক্ষ্যে এই ফুল কিনে নেয় সযত্নে। মালা কিংবা তোড়া বানায়। অনেকেই শ্রদ্ধা জানাবার উদ্দেশে বুদ্ধমূর্তির সামনে অর্ঘ্য দেয়। সত্যি বলতে কি এবারে এই উপদ্রুত ক্ষণেই আমি মহিলাকে একেবারে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই। দেখেই বোঝা যায়, আমার মতো তিনিও ভয়ে-আতঙ্কে সিঁটিয়ে পড়েছেন। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি খানিকটা নিচুস্বরে বলতে থাকেন, কেএনএফ, কেএনএফ! কিন্তু আমার তা কোনোভাবেই বোধগম্য না হলে আমি তাকে প্রশ্নের মত বলি, কিছু বলছেন আমাকে? অনেকটা ঘর্মাক্ত কপালটা শাড়ির আঁচল দিয়ে একটুখানি মুছে নিয়ে তিনি শব্দ থেকে বিস্তারিত বাক্যের দিকে এগোন—
: সম্ভবত কেএনএফের সঙ্গে পুলিশের লেগেছে। কেনেএফ মানে হলো কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। বেশ কয়েক বছর আগেই ওদের সংগঠনটা হয়েছে। মাঝখানে একটু চুপচাপ ছিল। এখন হয়তো আবার ওরা ওদের শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছিল।
তার কথা থেকে যতটা আঁচ করতে পারি, নিশ্চয়ই তিনি বান্দরবানেরই স্থানীয় কেউ হবেন। যদিও তার শাড়ি পরিধানের ব্যাপারটা আমার কাছে অমীমাংসিত রহস্যই থেকে যায়। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের কথা আমিও শুনেছি। ২০০৮ সালের দিকে নাথান বমের নেতৃত্বে দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। কিন্তু আজকের মতোন কখনও এতটা ভীতির মুখোমুখি হই নি আমি এই জনপদে এসে। ততক্ষণে অবশ্য কোলাহল থেমে গেছে। হতে পারে ওরা কিছুটা অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। মনোযোগ আকর্ষণের জন্যও কোনো-কোনো দল এরকম ঘটনা ঘটাতে পারে। সেটা জানা যাবে কিছুটা সময় গেলেই। এমনও হতে পারে পুলিশের কাছে ওদের সম্পর্কে কোনো আগাম সংবাদ ছিল। সন্দেহজনক হিসেবে তাদের ধরতে গেলে তারা ককটেল চার্জ করে পালিয়ে গেছে। সবকিছুই আসলে অনুমাননির্ভরতায় সাময়িক। ছোট্ট মেয়েটিকে সাহস জোগাবার জন্য অথবা পূর্বপরিচিত বলে অনুমিত মহিলার সঙ্গে আলাপের সংযোগসূত্র হিসেবে দুম্ করে বলে বসি, বেচারির ফুলবিক্রি আজ মাঠে মারা গেলো! আমার কথার সূত্রেই শাড়িপরিহিতা মহিলা কোনোরকম বিশেষ টান বা বিকৃতি ছাড়াই বিশুদ্ধ বাঙালি উচ্চারণে কিংবা তার চাইতেও চমৎকার ভঙ্গিতে বলতে থাকেন—
: ভয়ের কিছু নেই। বান্দরবানে সচরাচর এরকম কোনো ঘটনা ঘটে না। এটা হয়তো একদম ব্যতিক্রম কিছু।
বলেই ছোট্ট মেয়েটার কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে কিছু ফুল তিনি তুলে নেন এবং হাতের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে দাম জিজ্ঞ্যেস না করেই মেয়েটিকে দিলে মেয়েটির চোখেমুখে যুগপৎ আনন্দ ও কৃতজ্ঞতার চিহ্ন ফুটে ওঠে। মেয়েটিকে তিনি মারমা ভাষায় কিছু বললে সেও তার জবাব দেয় তার মাতৃভাষায় এবং বুঝতে পারি মেয়েটির কৃতজ্ঞতাসূচক ধন্যবাদের জবাবে তিনিও কিছু একটা বলেছেন প্রসন্নতাসূচক প্রকাশ হিসেবে। এবারে মহিলাটি আমার কাছে আরও বিস্ময়ের কারণ রূপে দেখা দিলেন। নিঃসন্দেহে তিনি মারমাই। একইসঙ্গে তাঁর বাংলাভাষিতাও উল্লেখ করবার মতো। অর্থাৎ তার মধ্যে বাঙালিত্বের সূত্রিতা অনিবার্যভাবেই বর্তমান। ততক্ষণে আমার মধ্যে থেকে সংকোচের ভাবটা কেটে গেছে এবং উদ্দীপনা যুক্ত হয়েছে তাতে। তাছাড়া তার বাংলা কথনভঙ্গির সাবলীলতা আমার মধ্যে এক ধরনের আত্মীয়তাবোধের জন্ম দেয়। মনের ভেতরকার সমস্ত উৎসাহ ও কৌতূহলকে একটুও গোপন না রেখে আমি বলেই ফেলি—
: আপনাকে মাঠের ওখানটায় দেখেই মনে হচ্ছিলো কোথাও কী দেখেছিলাম আগে কখনও! খালি মনে হচ্ছিলো খুব কাছে থেকে আমি আপনাকে দেখেছিলাম কিন্তু কোনোভাবেই সেটা মনে করতে পারছিলাম না। আমি দুঃখিত, আপনাকে অনেকবার আমি খেয়াল করছিলাম, আপনি হয়তো ভাবছেন, লোকটা এমন হ্যাংলা কেন, বারবার তাকাচ্ছে আমার দিকে! আসলে আমি কোনোভাবেই বুঝতে পারছিলাম না ঠিক আপনাকেই আমার এতটা চেনা কেন মনে হচ্ছে!
আমার কথা শেষ হতে না হতেই অকস্মাৎ একটা হাসির উচ্ছ্বাস মহিলার সারা অবয়বে এবং সেই প্রকাশ এতটাই আন্তরিক যে আমি কিছুক্ষণ আগেকার ভীতিকর ঘটনাটিও প্রায় ভুলে বসি মুহূর্তের জন্য। অবশ্য নৈকট্যের যে-আবহ এরিমধ্যে ঘটে গেছে সেই অবকাশে তিনি আমার স্মৃতিপরিবৃত্তের ধর্তব্যের আওতায় আসতে শুরু করেন। তথাপি ঠিক কোন্ শক্তির ধাক্কায় পুরনো কোনো স্মৃতি, যদি আদৌ তেমন কিছু থাকে, হঠাৎ আলোর ঝলকানি নিয়ে উচ্ছ্রিত হয়ে উঠবে কে জানে। আমার এইসব অদ্ভুত ভাবনাকে অকস্মাৎ চূর্ণ করে দিয়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞ্যেস করেন—
: ‘মেঘের অনেক রং’ সিনেমাটা দেখেছেন?
প্রশ্নটা প্রথমটায় আচমকা ও আলটপকা মনে হলেও তাতে থাকে বজ্রচেরা স্ফূর্ততা। আর সেই শব্দের ধাক্কায় ঘটে এক আশ্চর্য উদ্ভাসন। যেন সত্যিই কোথাও কোনো অলৌকিক দরজার বদ্ধ কপাট খুলে গেছে। মন্ত্রচালিতের মতো বলি—
: হ্যাঁ, অবশ্যই দেখেছি।
জোর দিয়ে বলবার কারণ ছিল। ছবিটি আমার তিনি-তিনবার দেখা। প্রথমবার ১৯৭৩ সালে যখন আমি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। বাবা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন আলমাস-সিনেমা হলে। বলেছিলেন, এটি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ছবি। এরপর দেখি ১৯৯১ সালে ‘বাঘা বাঙালি’ ‘ওরা ১১ জন’ ‘সংগ্রাম’ এরকম মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি ছবি একসঙ্গে। আর শেষবার দেখি ১৯৯৫ সালে ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজে। বাংলাদেশের বিজয় দিবস উদযাপন করছিলাম আমরা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা ‘কেম্ব্রিজ বাংলাদেশ সমিতি’র ব্যানারে। সেখানেই এক ভদ্রলোক যাঁকে আমি একটু এড়িয়েই চলতাম বিশেষ কারণে। কিন্তু তিনিই স্বেচ্ছা-উদ্যোগে সেই অনুষ্ঠানে তাঁর সংগ্রহে থাকা ‘মুক্তির গান’ এবং ‘মেঘের অনেক রং’ এই দু’টি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। পরে জানা গেল সেই ভদ্রলোক নুরুল উলা’র আত্মীয়। সেই নুরুল উলা যিনি তাঁর একটি ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন ১৯৭১-এর কালরাত্রির সেই ভয়ংকর জগন্নাথ হলের হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যাবলি। সেটা বিস্তারিত জেনেছিলাম রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘স্মৃতি : ১৯৭১’ পড়ে যেখানে তিনি বলছিলেন কীভাবে জানলায় বিশেষভাবে আঠা দিয়ে কাগজ লাগিয়ে কেবল ক্যামেরার যান্ত্রিক চোখটাকে বসিয়ে তিনি ধারণ করেন সেই মারণযজ্ঞ। তাঁর ধারণকৃত সেইসব দৃশ্যাবলিই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ধারণকৃত প্রথম চিত্রাবলি। পরে বিদেশি সংবাদ-প্রচারমাধ্যমেও সেসব প্রচারিত হয়েছিল। উলা সাহেব পরবর্তীতে সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সল ইন্সটিটিউটে শিক্ষকতা করেন অনেকটা কাল।
কাজেই বলতে পারি ‘মেঘের অনেক রং’ আমার অনেকটাই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আর আশ্চর্য এ কাকতাল! কেএনএফ বিস্ফোরিত ককটেলের দৃশ্য যেন আমাকে নিয়ে যায় মহিলা উচ্চারিত তিনটি শব্দের এক ভয়ংকর ইতিহাসের মধ্যে। হ্যাঁ, মেঘের অনেক রংয়ের একটি মাত্র রংই তখন দ্রুত ভেসে আসে। এসে আমার অতীতের সমস্ত বাস্তব প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত বাস্তব আর মহিলার কথিত বাস্তব সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলে দেখতে পাই অনেক ধোঁয়া আর গুলি আর চীৎকারের মধ্যে এক রমণি ঝাঁপ দিচ্ছে চলন্ত ট্রেনের নিচে। যে কিনা পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিতা হয়েও বেঁচেছিল এবং একটি সন্তানও ছিল তার। মিষ্টি সেই ছোট্ট ছেলেটার নামটাও আমার স্মৃতিতে খচিত থাকে— আদনান। আদনান আর তার মা রুমা। রুমাই আত্মহত্যা করে যখন দেখলো তার ডাক্তার স্বামী অন্য এক রমণির সঙ্গে দিন কাটাচ্ছে। হতে পারে সবাই এবং ডাক্তার স্বয়ং ধরেই নিয়েছিল, রুমার মৃত্যু ঘটেছে হানাদারদের হাতে। ডাক্তারকেও ভোলা হয় না আমার। ডাক্তার ওমর যিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এবং ছিল একটি পাহাড়ি মেয়ে। হ্যাঁ, সেই মেয়েটাই যে প্রথমে পিতৃপরিচয় খুঁজে পাওয়া আদনানকে মেনে নিতে অপারগ হয়, সে-ই পরে অনুতপ্ততায় ছুটে যায় মনের দুঃখে অনির্দেশ্য গন্তব্যের দিকে ছুটে যাওয়া, এমনকি তারই মায়ের মতো ট্রেনের নিচে আত্মহত্যা করতে উদ্যত হওয়া ছেলেটির খোঁজে। আদনানকে সে-ই বাঁচায় আত্মহত্যার হাত থেকেও। সঙ্গে ছিল তার ডাক্তার বন্ধু ওমরও। ১৯৭১ সালের পটভূমিটি দ্রুত আমার করোটিতে জলভ্রমির মতো একবার ঘুরপাক খেলে মুহূর্তে সেটা সামলে নিয়ে আমি তাকাই মহিলার দিকে—
: আমি মাথিন, মাথিন সারখি আমার নাম, ‘মেঘের অনেক রং’ ছবির সেই মাথিন আমি।
সেখানটায় আকস্মিক বজ্রপাত কিংবা ভূকম্পেও আমি ততটা অবাক হতাম না যতটা হই ১৯৭৩ সালে দেখা মুক্তিযুদ্ধনির্ভর প্রথম সিনেমার নায়িকা মাথিনকে এতটা নিকট সান্নিধ্যে আবিষ্কার করে। বিস্ময়বিস্ফোরিত আমার চোখ অনেকটা স্বয়ংক্রিয় ধরনে শাড়িপরিহিত মাথিনের পূর্বাপর পুনরায় জরিপ করে নিতে গেলে এই প্রথম লক্ষ করা গেল তাঁর ঘাড়ের ওপর একটা গুচ্ছের আকারে বাঁধা চুলে গোঁজা একটি কাইংগোয়া পাইং, সাংগ্রাই ফুল। অবাক ব্যাপার, ফুলটি আগেও ছিল, যখন তাঁকে প্রথম দৃষ্টিগোচর করি তখন থেকেই সেই ফুল তাঁর চুলে ছিল অথচ আমার চোখে পড়লো তাঁর আত্মপরিচয় ঘোষণার মুহূর্তটিতে। চারদিকে সাদা পাপড়িঘেরা মাঝখানকার হলুদ বৃত্তটি সূর্যের মতো উদাত্ত হাসছিল চুলে তাঁর ঘাড়ের ওপর। সেই হাসিই কী আমি দেখি সিনেমায় ক্লোজ শটে যখন মাথিন তাঁর চুলের গোড়ায় একটি একক ফুল গেঁথে মায়াময় চাহনিতে তাকিয়েছিলেন ডাক্তার ওমরের দিকে, ক্যামেরার দিকে এবং নিশ্চয়ই পরিচালকের দিকে। এবারে আমার করোটির দেয়ালে কেউ পেরেক দিয়ে একটা বাঁধাই-করা ফ্রেম গেঁথে দেয়। সেই ফ্রেমে ফুল আর মাথিনের হাসি একাকার হয়ে যায়। অভিভূত আমি জিজ্ঞ্যেস না করে পারি না—
: আপনার চুলে সেদিন একটা সুন্দর ফুল গুঁজে আপনি তাকিয়েছিলেন ক্যামেরার দিকে আর সেই ক্লোজ শটটা গোটা পর্দাজুড়ে আপনার সেই হাসি নিয়ে ভেসে উঠেছিল। তাই না?
আমার কথা শুনে চোখেমুখে মুগ্ধতাছড়ানো মাথিন বললেন—: একদম সঠিক বলেছেন।
: সত্যি বলতে কি এখন মনে হচ্ছে আপনার ঐ ছবিটাই আমার বার-বার মনে উঁকি দিচ্ছিলো যখন আপনাকে দেখছিলাম। আর সেদিনকার আপনি খুব যে বদলেছেন তা কিন্তু মনে হয় না।
: হ্যাঁ, আরও অনেকেই কিন্তু দেখলে আমাকে বলে, আপনাকে যেন কোথায় দেখেছিলাম। যারা বলে আমি বুঝতে পারি তারা নিশ্চয়ই মুক্তিযুদ্ধের এই ছবিটাতেই আমাকে দেখেছিলেন, বাস্তবে না। কিন্তু সময় তো আর থেমে নেই। অনেক কিছু বদলে গেছে। আমার নিজের জীবনটাও দারুণভাবে বদলে গেছে আর সেই বদলটার শুরু সেই ১৯৭২ সালে, ‘মেঘের অনেক রং’-এর সময় থেকেই।
মাথিনের কথায় আমার সংবিৎ ফেরে এবং আমার মনে হতে থাকে, আসলেই তো আমি এবং হয়তোবা মাথিনও দাঁড়িয়ে রয়েছি অন্য এক বাস্তবের মধ্যে। যে-বাস্তবের ঘূর্ণিতে দাঁড়িয়ে আমি সেদিন সেই সিনেমা দেখেছিলাম তা থেকে আমরা কত দূরেই না সরে এসেছি। অনেক সত্যই আমাদের মন-মস্তিষ্ক গ্রহণ করতে না চাইলেও আমরা প্রতি মুহূর্তে আমাদের স্থিরতার মধ্যেই ভিন্ন-ভিন্ন প্রজন্ম ও চেতনার গতিশীল পরম্পরার মুখোমুখি হয়ে চলেছি। এর হয়তো থাকতে পারে কোনো সামাজিক-দার্শনিক বিশ্লেষণের অবকাশ কিন্তু আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের সেই জটিলতার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ার সুযোগ ও পরিস্থিতি কোনোটাই না থাকায় শেষ পর্যন্ত আমি ফুলের ফুল্লতা ও সৌন্দর্যের দিকেই ঝুঁকে পড়ি। ছোট্ট মেয়েটির ডালায় অবশিষ্ট আরও দু’টো কাইংগোয়া পাইংয়ের একটি হাতে নিয়ে আমি এগিয়ে দিই মাথিনের দিকে। বয়সে তিনি আমার অনেকটাই বড়ো তাই দিদি সম্বোধন করি—
: দিদি, আমার এই উপহার আপনাকে দিলাম। ১৯৭৩-এ আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম। আজ সেই দেখার জয়ন্তী হোক।
শুনে মাথিন দৃৃষ্টিতে আলোর উদ্ভাস দিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানান। তাঁর বাড়ানো হাতের কব্জিতে চকচক করে একটি সরু স্বর্ণের চুড়ি এবং তাঁর তর্জনি ও মধ্যমায় দু’টি আংটির একটিতে এমারেল্ড এবং অন্যটিতে রুবি বসানো, সবুজ এবং লালের অর্থপূর্ণ সংস্থান। চারপাশটা ততক্ষণে নিরব হয়ে এসেছে। সেই নিরবতা রৌদ্রদগ্ধ ঝাঁঝাঁ দুপুরের জনবিরলতার। নিশ্চয়ই লোকেরা ঘরে-ঘরে দুপুরের খাবার আর বিশ্রামের আয়োজনে ব্যস্ত। আমাদেরও ওঠার সময় হয়। দোকানমালিকের মাঝবয়েসী মহিলাটি সম্ভবত মাথিনের চেনা। তাঁরা মারমা ভাষায় পারস্পরিক বাক্যবিনিময় করে। ফুলের মেয়েটির ডালা থেকে শেষ ফুলটি নিজের জন্য নিয়ে আমি তাকে কিছু টাকা দিলে চোখেমুখে তৃপ্তি ছড়িয়ে সে দোকানের সামনেকার বড়ো রাস্তার দিকে চলে যায়। তখনও আমার মনের অনেক জিজ্ঞাসার সমাধান মেলে না। কেন মারমা মাথিনের পরিধেয় থামির পরিবর্তে বাঙালি মেয়েদের শাড়ি সেটা আর জানা হয় না। হয়তো আমার মনের সেই সংশয় ও প্রশ্নসূচকতার দিকটি তাঁকেও ভাবিত করেছিল। নইলে আচমকা তিনি বলে বসতেন না—
: আমার কিন্তু আরেকটা পরিচয় আছে।
শেষবারের মতোন বিস্ময় আমাকে দখল করে। জানি না মাথিন কোন্ পরিচয়ের ইঙ্গিত দেন। হ্যাঁ, তাঁর বসবাস, পেশা, পরিবার এইসব নিয়ে নিশ্চয়ই অনেক কিছুই জানার থেকে যায়। বিশেষ করে এরকম একজন সেলিব্রেটি, অন্তত আমার নিকটে তিনি সেটাই, তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ ও কৌতূহল থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আকস্মিক পরিচয়ের সূত্রকে অবলম্বন করে তাঁর সমস্ত বৃত্তান্ত জেনে ফেলবার প্রচেষ্টাকে আমার ঠিক সভ্য আচরণ বলে মনে হয় না। তাই নিজেকে নিবৃত্ত রাখি। আমার শুধু একটাই জানার ছিল, কেন তাঁর পরনে থামির পরিবর্তে শাড়ি। উঠে যাওয়ার মুহূর্তে মাথিনের কোমল অথচ স্পষ্ট উচ্চারণ আমার করোটিতে ধাক্কা মারে—
: আমার নাম এখন রীণা চৌধুরী। সেদিনকার মাথিন এখন রীণা চৌধুরী।
: তাই নাকি!
যুগপৎ বিস্ময় এবং তৃপ্তির আনন্দ আমার মধ্যে। আরও আশ্চর্য অপেক্ষা করে আমার জন্য। সেদিনকার সিনেমার ডাক্তার ওমর পরবর্তীতে তাঁর জীবনচিত্রেরও নায়ক। আর সিনেমার সেই ডাক্তার ওমর এলাহী বাস্তব জীবনেও চিকিৎসকই। তার মানে দাঁড়ালো সিনেমার সেই মাথিন বাস্তবে এখন রীণা চৌধুরী এবং মিসেস ওমর এলাহী। আমি জানতে না চাইলেও পরিচয়ের সূত্রে বিশেষ করে আমার দিদি সম্বোধনের আন্তরিকতায় মাথিন-ই নিজে থেকে তাঁর সম্পর্কিত তথ্য একটু একটু করে প্রকাশ করতে থাকেন। ততক্ষণে থামির পরিবর্তে তাঁর শাড়ির নৃতত্ত্ব আমার কৌতূহল মিটিয়েছে। তাঁদের মূল নিবাস বান্দরবানে হলেও মাথিনের পিতা জাতিতে নেপালি এবং মা মারমা নৃগোষ্ঠির। আর তিনি থাকেন বর্তমানে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে যেখানে তাঁর স্বামী, ‘মেঘের অনেক রং’-এর নায়ক ডাক্তার ওমর এলাহী একজন নামকরা চিকিৎসক। মাথিন কিছুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছেন দেশে। ক’দিন পরেই ফিরে যাবেন লন্ডনে।
আমরা দু’জনেই বড়ো রাস্তায় উঠে যাই। কেএনএফের উত্তেজনার আর কিছুই টের পাওয়া যায় না। রোদ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করেছে। লাবলু’জ কিচেনে হয়তো চাপিলা মাছ, লাসসো আর মেটে আলুর তরকারি রান্না করে উ চাও প্রু লাবলু অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমি যাবো বাম দিকে, মাথিন ওরফে রীণা চৌধুরী যাবেন ডান দিকে। আমার হাতে যে-ফুল তাঁর হাতেও সে-ফুল— ক্যাংওয়াপ্যাং, সাংগ্রাইয়ের ফুল। তিনি যখন শেষবার আমার দিকে তাকান তখন সূর্যের আলো তাঁর ফর্সা ঘাড়ের ওপর চুলের গোছার মধ্যে গোঁজা একটি একক ফুলের মধ্যে পড়ে এবং যেন ‘মেঘের অনেক রং’-এর মাথিনকেই আমি পুনরায় দেখতে পাই। সিনেমার পরিচালক হারুনুর রশিদের দিকে ক্যামেরার দিকে এবং সমস্ত সিনেমাদর্শকের দিকে তাঁর সেই মোহময় তাকানো একই মুগ্ধতাছড়ানো ও আকর্ষক। সেই একই দৃষ্টি— পার্থক্য শুধু স্থান কাল আর পাত্রে।
মহীবুল আজিজ, কবি ও কথাসাহিত্যিক




