হাফিজ রশিদ খান
চীনের ভিন্নমতাবলম্বী ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সমালোচক, কবি ও চিত্রশিল্পী গাও শিংজিয়ান সুইডিশ একাডেমি ঘোষিত বিশে^র কথিত সবচে’ মর্যাদাবান সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন ২০০০ সালে। উল্লেখ্য, তিনিই প্রথম কোনো চীনা লেখক যিনি নোবেলে বরেণ্য হলেন। সুইডিশ একাডেমি গাও-এর নোবেলপ্রাপ্তির অনুকূলে যে-মূল্যায়ন হাজির করেন, তাতে বলা হয় : ‘গাও-এর তীব্র অন্তর্দৃষ্টি ও ভাষাগত স্বকীয়তা চৈনিক সাহিত্যকে একটি নতুন পথের দিকে ধাবিত করেছে।’ গাও-এর যে-উপন্যাসটি নোবেলজয়ে তাঁকে সামনে এনে দেয়, সেটি হলো ৪৫৩ পৃষ্ঠার ‘সৌল মাউনটেইন’ বা হৃৎপাহাড়। উপন্যাসটি এক তীর্থযাত্রার আখ্যান নিয়ে রচিত। যেখানে জীবন ও নাটকের, কল্পনা ও স্মৃতির মধ্যে রয়েছে বিভেদের স্পষ্ট সীমারেখা। ব্যক্তিমানুষের সাংগ্রামিক জীবনের প্রতি গাও-এর অদম্য পক্ষপাত এখানে সাবলীলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর অন্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে আছে : শেলটার দ্য রেইন (১৯৮১), অ্যাবসোলিউট সিগনাল (১৯৮২), দ্য বাসস্টপ (১৯৮৩), ওয়াইল্ডম্যান (১৯৮৫), ডার্ক সিটি (১৯৮৮), ডেথ সেকটর (১৯৯১), আ টেল অব সাংহাইজিং (১৯৯২), ডায়ালগ অ্যান্ড রেটোরিকেল (১৯৯২), উইকেন্ডস কোয়ার্টার (১৯৯৯), নাইটহক, নকটারনাল ওয়ানডার্ড (১৯৯৯), ¯েœা ইন অগাস্ট (২০০০)।
চীন সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মতের মিল না-হওয়ায় ১৯৮৭ সালে তিনি স্বদেশ ত্যাগে বাধ্য হন। ১৯৯৭ সালে ফরাসি সরকার তাঁকে নাগরিকত্ব প্রদান করে। ১৯৮৬ সালে চীনা কর্তৃপক্ষ তাঁর নাটক ‘দ্য আদার শোর’-এর প্রদর্শন নিষিদ্ধ করে। যেটির বিষয়বস্তু হলো ব্যক্তিমানুষের অদম্য জীবনভাষ্যের যশোগাথা। ‘দ্য আদার শোর’ নিষিদ্ধ হবার পর থেকে তাঁর পরবর্তী সাহিত্যকর্মগুলোও সে দেশে নিষিদ্ধের তালিকায় চলে আসে। ফলে ১৯৮৭ সালে গাও শিংজিয়ান ফ্রান্সে রাজনৈতিক শরণার্থীরূপে পাড়ি জমাতে বাধ্য হন। এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। উল্লেখ করা দরকার, ২০০০ সালে নোবেল পাওয়ার সম্ভাব্য তালিকাটি বেশ চমকপ্রদ ও দীর্ঘই ছিল। গাও-সহ আরো যাঁরা ওই তালিকায় ছিলেন, তাঁরা হলেন : হুগো ক্লাউস (বেলজিয়াম), অ্যালিস মুনরো, মারগারেট এটওড (কানাডা), উইলিয়াস ট্রেভর (আয়ারল্যান্ড), সালমান রুশদী (ভারতীয় বংশোদ্ভূত), বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপল (ত্রিনিদাদ), মারিয়ো ভারগাস ইয়োসা (পেরু), আমোস ওজ (ইজরায়েল), চিনুয়া অ্যাচেবে, বেন ওকরি (নাইজেরিয়া), জেএম কোয়েটজি (দক্ষিণ আফ্রিকা), জন অ্যাশবেরি, ফিলিপ রথ, জয়েস ক্যারল ওয়াটেস, নরম্যান মেইলার (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)।
প্রবাসী চীনা সাহিত্যিক গাও শিংজিয়ানকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়াতে চীন সরকার তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয় : ‘নোবেল পুরস্কার প্রদানের বিষয়টি এখন উগ্র রাজনৈতিক ভাবদর্শনেই ব্যবহৃত হচ্ছে। শিংজিয়ান-এর মতো একজন ভিন্নমতাবলম্বীকে নোবেল পুরস্কার দেওয়াতেই এর যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল।’ তাদের মতে, ‘চীনের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনেকদিনের। পুরোনো ও নতুন চীনাসাহিত্যে পাথিতযশা কবি ও সাহিত্যিকের অভাব নেই। তারপরও ফ্রান্সে বসবাসকারী গাও-এর মতো একজন ভিন্নমতাবলম্বীকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এতে করে পুরস্কারটি এখন নিরপেক্ষতার গ-ি পেরিয়ে পশ্চিমা রাজনৈতিক ভাবাদর্শে চালিত হচ্ছে বলেই মনে হয়’। অপরপক্ষে নোবেল পুরস্কার প্রদানকারী রয়েল সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সেক্রেটারি হোরেস ইংডাহল এক সংবাদ সম্মেলনে চীন সরকারের ওই প্রতিক্রিয়ার জবাব দেন এই বলে যে, ‘গাও একজন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার। সবচে’ বড় কথা, তিনি এমন একজন লেখক যাঁকে বিশ^ব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা দেয়া যায়। বিশে^র সব পাঠকের কাছেই তাঁকে উপস্থাপন করা সম্ভব। ইংডাহল আরো বলেন, আমাদের রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক কোনো পক্ষপাত বা ভেদবুদ্ধি নেই। আমরা কেবল লেখকের সৃজনশীলতাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি।’
১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় গাও ছিলেন শ্রমিক মহল্লার বন্দিশিবিরে। ওই সময়ে তিনি রাগে-ক্ষোভে তাঁর অনেক পা-ুলিপি পুড়িয়ে ফেলেছিলেন বলে কথিত আছে। চীন ছেড়ে বহু দুর্গম পাহাড়-অরণ্য ডিঙিয়ে ফ্রান্সে রাজনৈতিক শরণার্থী হন। তাঁর জীবনের সে এক রুদ্ধশ^াস কাহিনি। ১৯৮৯ সালে চীনের তিয়েন-আনমিন স্কোয়ারে গণতন্ত্রকামী প্রতিবাদী সমাবেশে গুলি চালানো হলে চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে পাকাপাকিভাবে সংস্্রব পরিত্যাগ করেন গাও। এবং ওই ঘটনার ওপর ‘প্রকৃত প্রেক্ষাপট’ নামে তাঁর একটি লেখা প্রকাশিত হলে চীন সরকার সে দেশে তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। সমালোচকদের দৃষ্টিতে তাঁর রচিত নাটক ও উপন্যাস চীনা সাহিত্যে নবদিগন্তেন সূচনা করেছে। শুধু কালির আঁচড়ে জীবন এঁকে এই কৃতিত্বের অধিকারী হওয়া সহজ কোনো বিষয় নয়। গাও-এর রচনাধারার অভ্যন্তরে রয়েছে ধ্রুপদি চীনা অপেরা, লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রভাব।
১৯৪০ সালে চীনের দক্ষিণ-পূর্ব জিংয়ালি প্রদেশে গাও শিংজিয়ান-এর জন্ম। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে প্রথমে ফরাসি ভাষা শিখে নিয়ে সার্বক্ষণিক লেখক এবং ফরাসি ‘আভাগার্দ’ (সংক্ষেপে ফরাসি এই শব্দটির অথর্ : অগ্রপ্রহরী বা অগ্রদূত। মূলত মানুষ ও তার শিল্প-সংস্কৃতি বা সামাজিক কর্মকা- যা প্রচলিত নিয়মানুযায়ী নয়, যে-কাজ পরীক্ষমূলক ও ভিত্তিগত) থিয়েটারের সক্রিয় কর্মীর জীবনে বেছে নেন। গাও শিংজিয়ান মূলে একজন চারুশিল্পী। আকাশের আদিগন্ত নীল, নিসর্গের মনমাতানো উত্থান, মানুষে-মানুষে সংগ্রাম তাঁর তুলির ছোঁয়ায় পেয়েছে ভিন্নতর স্বাদ ও মর্যাদা। গাও বলেন : ‘আমি একজন চিত্রশিল্পী। লেখালেখিটা আমার কাছে অনেকটা শখের মতো। সম্ভবত সে কারণেই নোবেলপ্রাপ্তিতে বিস্মিত গাও বলে ফেলেন : ‘এটি একটি অলৌকিক ঘটনা’! তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমি অত্যন্ত ব্যক্তিগত জীবনযাপনে বিশ^াসী। রাজনীতি বা সাহিত্যচর্চা যা-ই হোক না কেন, আমি কোনো দল বা মতবাদের অনুবর্তী নই বা এসবের সঙ্গে যুক্ত নই। তিনি জাতীয়তাবাদ এবং দেশেপ্রেম ঘরানার একজন লেখক হিশেবে নিজেকে তুলে ধরতে পছন্দ করেন।
তাঁর নোবেলপ্রাপ্তির কালেই সচেতন পাঠকের মনে প্রশ্ন উঠেছিল, চৈনিক কবি বেই দাও, মিলান কুন্ডেরা, চিনুয়া অ্যাচেবে, ভিএস নাইপল-এর মতো অনন্যসাধারণ সাহিত্যিকদের আকাশচুম্বী অবদানকে পাশ কাটিয়ে সুইডিশ একাডেমি কি পশ্চিমাবিশ^ ও চীনের মধ্যে বিবদমান রাজনৈতিক বিবেচনাকেই সামনে নিয়ে এলো গাও শিংজিয়ানকে পাদপ্রদীপের সামনে এনে? তাদের মতে, গুটিকয় ব্যতিক্রম বাদে নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের শিকেটি ছিঁড়ে চলেছে বরাবরই মধ্যমসারির কবি-লেখকদের ভাগ্যে। প্রকৃতই সাহিত্যপ্রেমীদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এমন সব মহান সাহিত্যিকের মুখোচ্ছবি, যারা তাদের অসাধারণ সৃজনকুশলতার গুণে জীবদ্দশাতেই রচনা করেছিলেন অমরত্বের দিগবলয়। কিন্তু তারা অনেকেই নোবেলে ভূষিত হননি। নোবেলে সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তনের (১৯০১) পরবর্তীকাল থেকে ওইসব মহতেরা কোন্ সেই অন্ধ দ্বৈপায়াননীতির গিলোটিনে বলি হলেন তা আজও মালুম হয় না সকলের। যদি নোবেল না-পাওয়াজনেদের নামের একটি সংক্ষিপ্ত শুমার করা হয়, সম্ভবত অনেকের চক্ষু কপালেই উঠবে। নিচের নামগুলোর আপাতত বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এরা কেউই সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারটি পাননি। অথবা বলা যায়, গুণবিচারী সুইডিশ একাডেমি তাদের হাতে নোবেল গছানোর জন্যে তাদের তেমন কোনো কৃতীকর্ম খুঁজে পাননি! সংক্ষেপে তারা হলেন : লিও তলস্তয়, হেনরি ইবসেন, স্ট্রিন্ডবার্গ, এমিল জোলা, টমাস হার্ডি, হোর্হে লুই বোরহেস, মান্দেলাস্তাম, জেমস জয়েস, জোসেফ কনরাড, মার্শেল প্রুস্ত, গারসিয়া লোরকা, রাইনার মারিয়া রিলকে, বারটোল্ট ব্রেশট, ইতালো কালভিনো, ডি এইচ লরেন্স, ফ্রানজ কাফকা, ম্যাকসিম গোর্কি, আনা আখমাতোভা, অডেন, গ্রাহাম গ্রিন, মিলান কুন্ডেরা প্রমুখ প্রোথিতযশা সাহিত্যিক। নোবেল প্রবর্তনের প্রথম বছরে সাহিত্যে পুরস্কারটি পেলেন এক অজ্ঞাতকুলশীল ফরাসি লেখক শালি প্রুধোম। যখন সারাদুনিয়া ভেবেছিল মহান তলস্তয়ই হবেন এই পুরস্কারে প্রথম গ্রহীতা। এই হঠকারী বিবেচনায় ক্ষুব্ধ হয়ে খোদ সুইডেনেরই ৪২জন কবি-লেখক তলস্তয়-এর কাছে খোলা চিঠি লিখে জানালেন তাঁদের শরমিন্দা ও বেদনার্ত হবার কথা। ওদিকে তলস্তয়কে ও-ব্যাপারে জিগ্যেস করা হলে তিনি নির্লিপ্তভাবে জানালেন, নোবেল পুরস্কার তাঁর কাছে ’নাথিং বাট ইভিল’। তাঁর এ মন্তব্যে ক্ষিপ্ত হলেন নোবেল কমিটির তৎকালীন কর্তাব্যক্তি হলস্টর্ম। সাংবাদিকদের কাছে তিনি তলস্তয়কে মনোনীত না-করার ব্যাখ্যা দিলেন এভাবে : He was not awarded the Nobel Prize for he had no commitment to Christinity.নোবেল পুরস্কার প্রদানের পেছনে কত গলি-ঘুপচির কত ব্যাখ্যা-বাখান যে আছে, এই উক্তিতে তার কিছুটা নিশ্চয় মালুম হলো। খ্রিস্টধর্ম ও খ্রিস্টীয় মতবাদও এখানে হামাগুড়ি দিয়ে সকলের অজান্তে ঢুকে পড়েছে সে বহু আগেই। ২০০০ সালের তালিকা থেকে পরবর্তীকালে ভারতীয়-নেপালি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ভিএস নাইপল বা বিদ্যাধর সূর্যপ্রসাদ নাইপল (১৯৩২-২০১৮) ২০০১ সালে এবং ২০১০ সালে পেরুর নাগরিক মারিয়া ভারগাস ইয়োসা (জ. ১৯৩৬) নোবের পুরস্কার লাভ করেন।
হাফিজ রশিদ খান, কবি ও প্রাবন্ধিক




