গৌতম কুমার রায়
পরিবেশ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছেই। পরিবেশের অনন্ত রহস্য আজও উন্মোচনের মাঝ প্রান্তে আসা সম্ভব হয় নাই। আসলে প্রকৃতি সময়ের পারদে বৈশিষ্ট্যের রূপ ও পদ্ধতিতে বদল আনছে। যা জীবের পক্ষে এই পরিবর্তিত অব্যাহত ধারা মোকাবিলা করা কিংবা তা বেয়ে সরস পিছু পিছু এগিয়ে যাওয়াটা দূরূহের। যে জন্য নিরন্তর খামখেয়ালিপনায় বর্তমান সময়ে প্রকৃতি এবং পরিবেশ নিয়ে শংকিত মানবতাবাদীরা, প্রকৃতি ও পরিবেশবাদীরা, বিজ্ঞানীরা, জনস্বাস্থ্যের লোকেরা, প্রগতিবাদীরা এমনকি প্রতিক্রিয়াশীলেরাও। পরিবেশ চিন্তার মানুষদের কর্মকাণ্ড দেখে বলতে ইচ্ছে করে” আমার প্রকৃতি-আমার পরিবেশ। কি চেয়েছি আর কি পেলাম। সাধের প্রদীপ জ্বালাতে গিয়ে নিজেই আমি পুড়ে গেলাম।’
প্রসঙ্গ গাছ বা বন অথবা বৃক্ষ। যাই বলি না কেন, তাদের জীবন আছে। যে সত্যটা প্রথম সামনে আনেন স্যার জগদিশ চন্দ্র বসু। বৃক্ষ জীবের জন্য ফুল ও ফল দেয়, অক্সিজেন দেয়। ছায়া দেয়, মায়া দেয়। বাসস্থান দেয়, আশ্রয় দেয়। অনেক গাছই চলতে ও বলতে পারে না। আবার এ কথাও বলা যায় গাছের যে জীবন বার্তা আছে সেটা মানুষ কখনও বুঝতেই পারে না। তবে সম্প্রতি সময়ে গবেষণা বলছে গাছের অনুভূতি শক্তি আছে এবং সেটা নিবেদিত। কিন্তু তা মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা অনুমেয় হলেও কীট পতঙ্গের কাছে উপলদ্ধি মূলক বিষয়। যে কোন বিরুপ পরিবেশে গাছেরা আর্তনাদ করে। সে আর্তনাদ প্রকৃতি নিবিষ্ট হলেও মনুষ্য চেতনার আড়ালে। তারা জীবন চলতে কষ্ট ও ব্যাথায় হয়তোবা আনন্দেও অতিসুক্ষ্ম আলট্রাসাউন্ড প্রকাশ করে। তবে সেই আর্তনাদ মানুষের কানে আসে না। কেননা মানুষের এই ক্ষুদ্রাকার সাউন্ড শোনার সক্ষমতা নেই। মজার বিষয় হলো এই আলট্রা সাউন্ড অনুধাবন করতে পারে পতেঙ্গেরা। সম্প্রতি গবেষণা করে এমনই ফলাফল দিয়েছেন দু’ইসরাইল গবেষক। ই-ফাইল জার্নালে তারা তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছেন, কোন উদ্ভিদের উপর ধারালো অস্ত্রের আঘাত কিংবা গাছকে সমূলে উপড়ে ফেললে গাছেদের দেহ হতে এক ধরণের আলট্রাসাউন্ড নির্গত হয়। আমরা জানি কোন গাছের তলায় ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করলে গাছের মধ্যে ভয় কাজ করে। গবেষণা আরও বলছে তীব্র খরা কিংবা দীর্ঘদিন জলের অভাবে গাছের শরীর হতে এমন আলট্রাসাউন্ড বের হয়। তবে জীবের মধ্যে বোধ-বুদ্ধি সম্পন্ন জীব হিসেবে মানুষ এমন অনুভূতি অনুধাবন করতে অক্ষম, কেননা মানুষ সাধারণত ২০ হতে ২০,০০০ হাজ কম্পন পর্যন্ত শব্দ শুনতে পারে। গাছেদের এই অনুভূতিক কম্পন শব্দ মাত্রা ২০,০০০ হার্জেরও বেশি বলে তা মানুষ শুনতে পারে না। বলা চলে গাছেদের আলট্রাসাউন্ড মাত্রাকে মানুষ নাগালে নিতে পারে না। তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইজ ফ্যাকাল্টির লাইফ সায়েন্সের অধ্যাপক ইয়োসি ইয়াভেল এবং লিলাচ হাদানির গবেষণা বলছেন, কেবলমাত্র ক্ষুদ্রাকৃতির পতঙ্গেরা এই আলট্রাসাউন্ড বুঝতে পারে, সুন্দর পরিচর্যা বা যত্ন নেওয়া গাছেদের চেয়ে অযত্নে লালিত গাছগুলো হতে এই কম্পন ও শব্দ এসে থাকে। তারা আরও দাবী করেছেন যে যত্নবান গাছ বা সুস্থ সতেজ গাছে কীটপতঙ্গ ডিম দেয়। দুর্বল অর্থাৎ কম্পন সৃষ্টিকারী গাছে পতঙ্গেরা ডিম দেয় না। আমরা জানি পিঁপড়ার ঘ্রাণ শক্তি প্রখর। তেলাপোকা এবং ঘাসফড়িং এর কথা যদি বলি তবে, এঁদের প্রতিটির চোখ সংখ্যা ৪০০০ এরও বেশি থাকে। এত চোখ নিয়েও এঁরা ভালো দেখতে পারে না। এমনকি অল্প আলোতে এঁরা দেখতে অক্ষম। যখন এঁরা দেখতে পারে না তখন চলার সুবিধার্থে ওরা নিজে থেকে শব্দ কম্পন তৈরী করে। এই শব্দ কম্পনের প্রতিধ্বনি নিয়ে চলতে পারে। আমরা জানি এই কীটপতঙ্গ ছাড়া বাদুড় এই কম্পন শুনতে পারে। বাদুড়ের শ্রবণ শক্তি প্রখর। বাদুড়ের চাল-চলন নির্ভর করে শব্দের অনুভূতি দিয়ে। বাদুড় নিশাচর প্রাণি। ওরা রাতের আঁধারে খাবার খুঁজতে দূরে যায়। এদের দৃষ্টিশক্তি খুব শক্তিশালী। এঁরা মুখ দিয়ে অতিশব্দ তরঙ্গ বা আলট্রাসাউন্ড সামনে পাঠায়। ওরা ঐ শব্দের প্রতিধ্বনি ফিরে এলে আর সামনে এগোয় না। ওরা ভাবে সামনে কোন বাঁধা আছে। যদি গাছের কথায় ফিরি তবে, আফ্রিকার আমাজান জঙ্গলে মা গাছের বীজ পড়ে যে গাছের জন্ম হয়, মা গাছ তার সন্তান গাছের জন্য মূলের মাধ্যমে খাবার সরবরাহ করে থাকে। এই ভাবে এখানে মা এবং সন্তান গাছের মধ্যে নিবিড় অনুভূতি কাজ করে চলেছে।
মানুষ ২০ হতে ২০,০০০ হার্জর কম-বেশি কম্পনে গাছেদের অনুভূতিতে আনতে পারে না কিন্তু বাদুড়েরা তাদের শ্রবণ কম্পনের সাহায্যে দিক নির্ণয় করে বিশেষ করে রাতে চলাফেরা করে থাকে। বাদুড় হলো প্রকৃতির অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন প্রাণি। বাদুড় শব্দের উপর নির্ভর করে নিজস্ব উদ্ভাবনে দিক নির্ণয় করে চলে থাকে। বিশ্বে প্রায় ৯০০ প্রজাতির বাদুড় আছে, যার বেশীরভাগই পতঙ্গভূক। ওদের নিজেদের সৃষ্ট কম্পন মাত্রা ২০ হতে ২০,০০০ হার্জর শব্দের চেয়ে আরও বেশি। ওদের সৃষ্ট শব্দ সামনের কোন অবকাঠামো কিংবা অন্য কিছুতে বাঁধা পেয়ে তা প্রতিধ্বনিত হয়। ঐ শব্দ কম্পন প্রতিধ্বনিত হয়ে নিজের কাছে অনুভূত হলে, ওরা বুঝতে পারে সামনে ওদের চলার পথটা ওদের জন্য বাঁধা আছে। তাই এঁরা ঐ বাঁধা পেরিয়ে সলল পথ খুঁজে চলতে পারে অনায়াশে। যদি বিদ্যুৎ এর তারের কথা বলি, তা অত্যান্ত মসৃণ এবং সরু। ওখানে বাদুড়ের শব্দের কোন কঁম্পন বাঁধা পায় না। সুতরাং তা প্রতিধ্বনিতও হয় না। কিন্তু বিদ্যুৎ এর খুঁটি তুলনামূলক মোটা হওয়ায় সেখান থেকে কম্পন বাঁধা পেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে থাকে। সে জন্য বাদুড় বিদ্যুৎ এর খুঁটিতে মারা না গেলেও তারে জড়িয়ে মারা যায়। এমনি করে বাদুড় এবং পতঙ্গ কেবল গাছের আলট্রাসাউন্ড বুঝতে পারে। এক্ষেত্রে মানুষের সক্ষমতা অচল।
গৌতম কুমার রায়, গবেষক, উদ্ভাবক ও পরিবেশ বিজ্ঞানী।




