সুজন বড়ুয়া
ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়। এখন সন্ধ্যা, এটা তার অফিস টাইম। পেশায় তিনি একজন সাংবাদিক। সাধারণত সংবাদপত্রে পুরোদমে অফিস শুরু হয় অপরাহ্নের পর। চলে প্রায় গভীর রাত পর্যন্ত। সে হিসেবে ভর সন্ধ্যায় বাসার ছাদে হরিৎবরণবাবুকে বসে থাকতে দেখে আমার অবাক হওয়ারই তো কথা। এ সময় তাকে কখনো বাসায় পাওয়া যায় না।
হরিৎবরণ ঘোষাল আমার প্রতিবেশী। সাততলা ভবনের চতুর্থ তলায় মুখোমুখি বাসায় থাকি আমরা। আমাদের মোটামুটি ভালো জানাশোনা। কিন্তু আড্ডা-গল্প করার সময়-সুযোগ খুব একটা হয় না আমাদের। আমি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। যদিও আমার অঢেল সময়, হরিৎবরণবাবু তার বিপরীত। তিনি ব্যস্ত মানুষ। গভীর রাতে অফিস থেকে ফেরেন, তারপর খাওয়া-দাওয়া ঘুম বিশ্রাম মিলিয়ে সকালটাও প্রায় কেটে যায়।
কখনো কখনো ছোটেন সাংসারিক নৈমিত্তিক কাজে, কখনোবা আবার বাসায় বসে করেন কিঞ্চিৎ লেখালেখির কাজ। এদিকে আমার তখন দ্বিপ্রাহরিক ভোজন-বিশ্রামের সময়। জীবন-ছকের এই বৈপরীত্যে গল্প-আড্ডা তেমন না হলেও আমাদের দেখা-সাক্ষাতে সাধারণ কুশল বিনিময় হয় প্রায়ই। তার ওপর আমাদের দুই পরিবারের কর্ত্রীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আবার গলায় গলায়। ভালো-মন্দ খাবার বিনিময় থেকে শুরু করে তাদের মধ্যে নিয়মিত চলে সুখ-দুঃখের বার্তা বিনিময় পর্যন্ত। সুতরাং দুই পরিবারের সম্পর্ক মোটামুটি মধুর বলা যায়।
হরিৎবরণবাবু বয়সে আমার একটু বড়ো, সত্তর-ঊর্ধ্ব তার বয়স। শান্ত নিরিবিলি মানুষ। স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে তার চারজনের সংসার। ছেলে-মেয়ে বড়ো হয়েছে। মেয়ে মেডিক্যালে পড়া শেষ করে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চতর গবেষণারত। আর ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু বেকার। পুরো সংসার এখনো হরিৎবরণবাবুকেই টানতে হয়।
হরিৎবরণবাবু দেশের প্রবীণ সাংবাদিক। পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় ধরে এই পেশায় যুক্ত আছেন তিনি। কাজ করেছেন নানা দৈনিক পত্র-পত্রিকা, সাপ্তাহিকী সাময়িকী, অন লাইন নিউজ এজেন্সিতে। এখন একটি দৈনিক পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক তিনি। পত্রিকার বিভাগীয় পাতাগুলো চলে তার তদারকিতে। প্রতি সপ্তাহে উপসম্পাদকীয় পাতায় নিয়মিত তাকেও লিখতে হয় একটি কলাম। তার কলামটি খুব জনপ্রিয়। দেশ সমাজ সময়ের সত্য ভাষ্যে টাটকা স্বাদ থাকে তার কলামে। সরস তীর্যক তার লেখন ভঙ্গি। সব সময় সত্যের পক্ষে সোচ্চার তার কলম। কোনো প্রলোভনেই তিনি নিজেকে বিকিয়ে দিতে নারাজ। এই আপসহীনতার জন্য সব সময় স্বার্থবাদী চক্র ও প্রশাসনের বিরাগভাজন তিনি। সাংবাদিকতা পেশায় এমন মানুষ আজকাল বিরল। আমি তার লেখার ভক্ত। তাকে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখি। সত্যিকার অর্থে এক সরল সাদা মনের মানুষ তিনি।
সন্ধ্যার সময় আমি প্রায়ই একা ছাদে উঠে হাঁটি। এখন শরৎকাল। আজকের সন্ধ্যাটা বেশ উষ্ণ-গুমোট। তাই আগেভাগে উঠেছি শরীরটা একটু জুড়িয়ে নেব বলে। এ সময় ছাদে তেমন কেউ থাকে না। হরিৎবরণবাবুকে দেখতে পেয়ে আমি ধীর পায়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াই।— দাদা, নমস্কার, কেমন আছেন?
হরিৎবরণবাবু বসা অবস্থাতেই মুখ ঘুরিয়ে তাকান। বিমর্ষ তার চেহারা। তবু ম্লান হেসে পাশে বসতে ইশারা করেন।
আমি বসতে বসতে তার কথা ভাবি। তার শারীরিক নানা সমস্যা আছে জানি। নতুন করে গুরুতর কিছু হলো না তো? এমন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতেই হরিৎবরণবাবু বলে ওঠেন, আছি একরকম। কিন্তু মন তো ভালো নেই ভাই।
আমি এবার বলি, না মানে, দাদা, এ সময় তো আপনাকে বাসায় থাকতে খুব একটা দেখি না, অফিসেই থাকেন। তাই ভাবছি আজ কী হলো? ছুটি নিয়েছেন নাকি?
ছুটি— ছুটি— আপন মনে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বিড় বিড় করতে থাকেন হরিৎবরণবাবু।— তা এক রকম ছুটিই বলতে পারেন। এমন ছুটি আমার আর কখনো হয়নি।
আমি কেমন যেন অস্বাভাবিক কিছুর আভাস পেলাম। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই পেশাগত। হরিৎবরণবাবু সৎ সাংবাদিক। বর্তমানে মানুষের যে নীতি-নৈতিকতা আর দেশের যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এর মধ্যে সততার ধ্বজা উড়িয়ে চলা দুঃসাধ্য। সাধারণ আলাপচারিতায় আগেও দু’একবার এমন উষ্মা প্রকাশ করেছেন তিনি। এখনো সম্ভবত পেশাগত সমস্যায় আছেন। এসব ব্যক্তিগত বিষয়ে কৌতূহল দেখানো অনেকটা ভব্যতা বহির্ভূত। আমি নিজেকে সংযত করি, হালকাভাবে বলি, আজকালকার দিনে নিজের মতো করে ভালো থাকা কঠিন সাধনার বিষয়। যারা এ সাধনা করে তারা এখন নিঃসঙ্গ। বুঝতে পারি আপনিও অনেকটা নিঃসঙ্গ দাদা।
হরিৎবরণবাবু তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। অনেকক্ষণ মুখে কোনো কথা নেই তার। তারপর যেন গভীর মনস্তাপের সঙ্গে বলেন, আমি বড়ো নিঃসঙ্গ কামাল ভাই। একেবারে একা হয়ে গেছি। এ জীবনের ভার আর বইতে পারছি না।
আমি খানিকটা সহমর্মী হওয়ার চেষ্টা করি।— দাদা, আমি বুঝতে পারছি, আপনার জীবনটা এখন আগুনের নদীতে কাগজের নৌকার মতো।
হরিৎবরণবাবু এবার কেমন আপ্লুত হয়ে পড়লেন হঠাৎ। তিনি বলেন, দারুণ বলেছেন ভাই। আমার অবস্থা একদম তাই। কখনো তো বলার সুযোগ হয় না। কী হয়েছে আজ শোনেন।
বলেন দাদা।— আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকাই।
দুই
আমার জীবনটা একেবারে সাদা রাফখাতা, খোলা গল্পের মতো। এ গল্পে কোনো আলো-আঁধারি নেই, ধোঁয়াশা নেই। আমি মিথ্যা বলতে শিখিনি। কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিইনি। পথ চলতে শিখেছি সত্য ও সততার আলোয়।
জন্মেছিলাম রংপুরের এক অজপাড়া গাঁয়ে। স্কুল ছাত্র থাকতেই সাংবাদিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ছিলাম। শুরুটা দৈনিক আজাদের মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে। সে সময়েই স্বনামে আজাদে বড়ো বড়ো লেখা ছাপা হয়েছে। এভাবেই সাংবাদিকতা পেশায় ঢুকে পড়া। আবার বাম রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়েছিলাম সেই স্কুলে থাকতেই।
সাংবাদিকতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের। আমি চাকরি করেছি দৈনিক সংবাদে, সাপ্তাহিক একতায়, দৈনিক রুপালীতে। নিজে সম্পাদনা করেছি সাপ্তাহিক ‘চলতিপত্র’। নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি ‘মৃদুভাষণ’ নামের সাপ্তাহিকে। ‘দৈনিক মাতৃভূমি’ নামের একটি দৈনিকের সম্পাদনার দায়িত্বও আমি পালন করেছি। এখন আমি ‘আজকের সংবাদ’ পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক।
দেশের নানা পট-পরিবর্তন, আন্দোলন, গণআন্দোলন এবং রাজনৈতিক উত্থান-পতন প্রত্যক্ষ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার অবস্থান ছিল স্পষ্ট। স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছি, দেশের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেছি এবং সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছি। আমার এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে কোনো অবদান না রেখেও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট বাগিয়ে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন অনেকে। অথচ মুক্তিযোদ্ধা হয়েও ও-পথে হাঁটিনি আমি।
আমার পেশা আমাকে শিখিয়েছে— সত্য প্রকাশ করার অপর নাম সাহস করা আর ঝুঁকি নেওয়া। সত্য প্রকাশের স্বার্থে ঝুঁকি নিতে আমি কখনো ভয় পাইনি। ছাত্রজীবনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে করতে শিখেছি, কখনো কখনো নাম গোপন রেখেও কাজ করতে হয়। এই গোপন নাম ব্যবহার অন্য কোনো স্বার্থে নয়, বরং নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে। তা না হলে এরশাদের আমলসহ নানা রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় আমার এতসব লেখা সম্ভব হতো না। সাপ্তাহিক ‘যায়যায়দিন’ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যাদের লেখার কারণে তাদের একজন তারিখ ইব্রাহিম। ওই নামে আমিই লিখতাম এরশাদের কোপানল থেকে রক্ষা পেতে। ক্ষমতা ছাড়ার পর দু-একবার দেখা হলে অবশ্য এরশাদও ‘দেশি’ হিসেবে খাতির করেছেন আমাকে। আমার আরেকটি ছদ্মনাম ছিল ‘বিরস’।
রাজনৈতিক আদর্শবোধ ও সাংবাদিকতার নৈতিক সততা আমাকে ব্যক্তিগত সুখভোগের জন্য তাড়িত করেনি। আমার একটাই তাড়না—দায়িত্ববোধ। আমি জ্ঞানত কখনো দায়িত্ব পালনে অবহেলা করিনি। নিজের কাজে ফাঁকি দেইনি। খুব সাহসী মানুষ হয়তো আমি নই, তবু চোখ রাঙিয়ে কেউ আমাকে দিয়ে কোনোদিন কিছু লেখাতে পারেনি। দীর্ঘ সময় আমি লিখেছি সত্যের পক্ষে, মানুষের পক্ষে, দেশের পক্ষে। কিন্তু আজ, যখন নিজের জীবনকে দেখি, অনুভব করি— এ দেশে সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়।
দেশের প্রায় সবগুলো দৈনিক পত্রিকা এবং অনলাইনে আমার লেখা একসময় নিয়মিত ছাপা হতো। দৈনিক ‘জনকণ্ঠ’ যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তখন প্রথম পৃষ্ঠায় আমার লেখা মন্তব্য প্রতিবেদন ছাপা হতো। অথচ এখন কোনো কোনো পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে ছাপার জন্য অনুরোধ করেও ফল পাই না। আমার লেখা নাকি পাঠক আর সেভাবে ‘খায়’ না।
এক সময় কত খ্যাতিমান ব্যক্তি আমার লেখা পড়ে ফোন করে তারিফ করেছেন। অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের প্রশংসাও আমি পেয়েছি। রাজনীতিবিদ অলি আহাদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, লেখক অধ্যাপক শওকত ওসমান, ড. রঙ্গলাল সেন, অধ্যাপক ড. অজয় রায়ের মতো কতজনের প্রশংসা পেয়েছি। বিএনপির এক সময়ের মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়াও আমাকে লেখার জন্য স্নেহ করতেন। ওহ হ্যাঁ, বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সদস্যও সে তালিকায় আছেন। সঙ্গত কারণে তাদের নাম উল্লেখ করছি না। এখন অবশ্য এত সাধারণ বিষয় তাদের মনে থাকার কথা নয়। আজ আমার লেখা নাকি পাঠককে টানে না। হতেই পারে, বয়সের ভারে বুঝি আমার কলমের ধার কমে গেছে, লেখা হালকা হয়ে গেছে! তবে নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও আমার ধারণা আছে। আমি যে খুব কম জানাবোঝা একজন মানুষ, সেটা আমি খুব ভালো জানি।
আজকের সময়ে অবশ্য সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ অন্যরকম। অনেকেই সুবিধা, স্বার্থ, সামাজিক মর্যাদা বা আর্থিক স্বার্থের জন্য সত্যকে আড়াল করে লেখেন। আমি নাম আড়াল করলেও সত্য গোপন করিনি। তাই হয়তো দীর্ঘ পাঁচ দশকের বেশি সময় এই পেশায় কাটিয়ে সম্মানজনক বেতন-ভাতাও পাই না। নামে-বেনামে হাজার হাজার লেখা লিখেছি। সম্মানী কিন্তু পেয়েছি খুবই কম। কোনো কোনো পত্রিকা তো কয়েক বছর লেখার পরও একটা টাকা দেওয়ার গরজ বোধ করেনি। সেদিক থেকে অনলাইন মিডিয়াগুলো কিছুটা ভালো। তাও একটি বড়ো অনলাইন মিডিয়ার কাছে আমার এখনো মোটা টাকা পাওনা আছে।
‘আজকের সংবাদ’ পত্রিকায় কাজ করছি ৪ বছর হলো। এই সময়ে না হলো আমার পদোন্নতি, না বাড়ল বেতন। অথচ জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে প্রতিদিন। সংবাদপত্র আর কীভাবে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবে, ঘরের মধ্যেই যেখানে অনিয়ম।
বেতনের কথা প্রকাশ্যে বলা শোভন নয়। আমার বর্তমান বেতন শুনে বিব্রতও হতে পারেন অনেকে। আমি শুনেছি, আমার বিভাগীয় প্রধানের বেতন আমার প্রায় দ্বিগুণ। আহা, যদি ওই বেতনের একটি চাকরি পেতাম তাহলেও হয়তো সংসার চালানোর জন্য নিয়মিত ধার-দেনা করার পেশাটি আমাকে বেছে নিতে হতো না! অন্যসব খরচের হিসাব বাদ দিয়ে মাসে আমার একার ওষুধের ব্যয় ২০-২২ হাজার টাকা। বাড়িয়ে নয়, একটু কমিয়েই হয়তো বললাম! আমার আর্থরাইটিস, লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ কত যে রোগ! আর্থরাইটিস ও লিভারের চিকিৎসার জন্য কত যে ধারদেনা করতে হয়েছে। আমার ছেলেও অসুস্থ, ওরও নিয়মিত চিকিৎসাব্যয় আছে। তাই ধারদেনা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমি জানি জানতাম—সৎ সাংবাদিকতা, সত্য প্রকাশ মানে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া। সত্য লিখতে হলে ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য হারাতে হয়। তেমন স্বাচ্ছন্দ্য অবশ্য আমি চাইনি কখনো। তবে সারাজীবন হাত পেতে চলতে হবে এটাও চাইনি।
বিগত আওয়ামী সরকারের শাসনামলে নানা পরিচয়ে অনেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। একপর্যায়ে লাজলজ্জা ভুলে আমিও প্রধানমন্ত্রীর দরবারে সাহায্যের আবেদন করেছিলাম, কিন্তু কোনো ফল পাইনি। অনেক সাংবাদিক প্লট পেয়েছেন। আমি দুইবার আবেদন করেও সফল হইনি। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে বই লিখেও নাকি কতজন ভাগ্য বদলেছেন। অথচ স্বনামধন্য এক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আমার দুটি বইয়ের জন্য আমি দুই টাকাও রয়্যালিটি পাইনি। একেই বলে কপাল! তবে হ্যাঁ, একবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। ওই সফরের জন্য কিছু হাত খরচের টাকা আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা তো ওই কোট, প্যান্ট, জুতো কিনতেই শুধু শেষ হয়নি, আরো দেনা হয়েছে। ওই সুবাদেই আমার কোট-টাই জুতা কেনা! কিন্তু জীবনটা তো স্যান্ডেল পরেই কেটে গেল।
আমার জীবনে কোনো সাফল্যের গল্প নেই। সাংবাদিক হিসেবেও এ-ডাল ও-ডাল করে কোনো শক্ত ডাল আমি ধরতে পারিনি। শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে অবিচল অবস্থানের কারণে আমাকে আজও ‘আওয়ামী ট্যাগ’ দেওয়া হয়। কিন্তু আওয়ামী আমলেও কোনো বাস্তব পুরস্কার পাইনি। আমি না পেলাম একটি প্লট, না একটি ভালো চাকরি। বরং দীর্ঘ সময় চাকরিহীন থেকে বেড়েছে আমার ঋণের বোঝা। স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে পরিবারের দায়বদ্ধতা আমাকে প্রতিনিয়তই চাপের মধ্যে রাখে।
আমার সংসারে স্ত্রী ছাড়া দুই সন্তান। এক মেয়ে, এক ছেলে। ছেলেমেয়েরাও আমার মতো একটু বোকাসোকা। বর্তমান সময়ের সঙ্গে বেমানান। মেয়ে বড়ো। জীবনে কখনো কোনো পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেনি। ডাক্তার হয়েছে। বিসিএস পাস করে চাকরিও পেয়েছে। গ্যাসট্রোএনটোরোলোজিতে এমডি করতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে এসে ধরা খেল। সরকার বদলের পর বিভাগীয় প্রধানের কোপানলে পড়ে আমার মেধাবী মেয়েটি থিসিস পরীক্ষায় অসফল হলো। অথচ ও কোনো রাজনীতির সাতে-পাঁচে নেই। ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় অবশ্য পাস করেছে, এখন থিসিসের জন্য আবার অপেক্ষা। এর মধ্যে আবার কোন নিভৃত অঞ্চলে ওকে পোস্টিং দিয়ে দেবে, কে জানে!
আমার ছেলেটি বুয়েট থেকে এমএমইতে পাস করেছে। আমেরিকায় একটি বৃত্তি পেয়েও শারীরিক কিছু সমস্যার কারণে সময়মতো যেতে পারেনি। আমার ছেলেটি চার বছর বয়সে গুলেনবারি সিনডর্ম রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবনমৃত্যুর সঙ্গে কয়েক মাস পাঞ্জা লড়ে তবে বেঁচেছে। ওর ব্যয়বহুল চিকিৎসার ধকল আমি সয়েছি। বুয়েটে পড়া শেষে দেশে কত চাকরির পরীক্ষা দিয়ে পাস করেও এখন পর্যন্ত নিয়োগ নিশ্চিত হলো না। অপরাধ কি ওর নামের, নাকি বাবা হিসেবে আমার, ঠিক বুঝতে পারছি না।
আমি ক্ষুদ্র মানুষ। মনটাও হয়তো সংকীর্ণ। সেজন্য আমার প্রতি কেউ কেউ বিদ্বেষ পোষণ করতেই পারে। আমি কিন্তু কারো প্রতি সামান্যও বিদ্বিষ্ট নই। উপকার করার ক্ষমতা নেই বলে কারো অপকারের কথা আমি স্বপ্নেও ভাবি না।
এখন আমার দৈনন্দিন জীবন শুরু হয় ওষুধ খেয়ে, স্বাস্থ্য পরীক্ষা দিয়ে এবং ওষুধ কেনার টাকার চিন্তায়।
এর মধ্যে গত বছর সরকার পরিবর্তনের পর গণমাধ্যমের অবস্থা হয়ে পড়েছে আরো নাজুক। মন খুলে সমালোচনা করার কথা প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় নিজে বলেছেন। অথচ তার প্রেস বিভাগ মোটেও মনখোলা নয়। মিডিয়ার যারা নির্বাহী দায়িত্ব পালন করেন তারা সবাই আতঙ্কে থাকেন সব সময়। কখন না কোন খবর বা লেখার জন্য ফোন আসে। তুলে নিতে হয় লেখা বা খবর! এর মধ্যে আমার একটি লেখার জন্য ‘আজকের সংবাদ’ পত্রিকার অনলাইন বিভাগকে লালচোখ দেখানো হয়েছে।
সব মিলিয়ে পত্রিকায় আমার অবস্থা তাই খুবই নড়বড়ে। সজ্জন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক চাপ সইতে না পেরে আমার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছেন।
এই দুদিন আগে বাহারুল ইসলাম বাহার নামের এক লেখকের একটি লেখার জন্যও চোটপাট করা হয়েছে। সেই লেখায় আপত্তিকর কী লিখেছেন লেখক? লিখেছেন, ‘সেনাবাহিনী শেখ হাসিনাকে সামরিক হেলিকপ্টারে দিল্লি পাঠিয়েছে। আর শুধু পুলিশের গুলিতে নয়, মেটিকুলাস ডিজাইনের মাধ্যমে জঙ্গিরাও মানুষ হত্যা করেছে।’ এখানে অসত্য তথ্য কোথায়? শেখ হাসিনা কি হেলিকপ্টার ভাড়া করে গোপনে পালিয়েছেন? শেখ হাসিনার পুলিশ না হয় ছাত্র-জনতাকে হত্যা করলো, কিন্তু পুলিশ হত্যা করলো কে বা কারা? এইটুকু লেখার জন্যও সরকারের প্রেস বিভাগ থেকে পত্রিকার বিরুদ্ধে তোপ দাগা হয়েছে। বলা হয়েছে এমন লেখা মুদ্রণের জন্য দায়ী ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে হবে, অন্যথায় পত্রিকার লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
পত্রিকার ওই পাতা আমার নিয়ন্ত্রণাধীন। কর্তৃপক্ষ আঙুল তুলেছে আমার দিকে। প্রেস বিভাগ নাকি আরো বলেছে দায়ী ব্যক্তিকে তারা দেখে নেবে। সুতরাং পত্রিকা কর্তৃপক্ষ নিরুপায়। তারা অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটি মঞ্জুর করে দিল আমার।
আমি এখন কী করি? কোন পথে হাঁটি বলেন, ভাই?
হরিৎবরণবাবু একটানা তার জীবনের গল্প বলে থামেন।
আমি শুনতে শুনতে যেন বাকহারা। সাংবাদিকতা, মিডিয়া জগৎ, প্রেস বিভাগের নিয়ন্ত্রণ এসবই আমার জন্য নতুন বিষয়। এগুলোর দায়-দায়িত্ব ক্ষমতা আওতা কিছুই আমি ভালো জানি না। হরিৎবরণবাবুকে কী বলে প্রবোধ দেব তাও ভেবে পাই না। দেশের সাম্প্রতিক উচ্ছৃঙ্খল ঘটনাপ্রবাহে স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি অসাড় হয়ে পড়েছে কেমন। সাংবাদিকের ওপরও নির্যাতন! অনেকক্ষণ পর মিন মিন করে বলি, মনে হচ্ছে সত্য, সততা, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম এসবই এখন বায়বীয় ব্যাপার দাদা। আপনার মতো মানুষের সঙ্কট আরো বেশি। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। আপনি তো দেশের সম্পদ।
তিন
পরদিন এক আত্মীয়ের অসুস্থতায় আমি সারাদিন সপরিবার বাইরে ছিলাম। রাত নয়টার দিকে মগবাজারের বাসায় ফিরেছি। আধা ঘণ্টা পর বাসার কলিং বেল বেজে উঠল হঠাৎ। দরজা খুলে দেখি হরিৎবরণবাবুর স্ত্রী সুরেলা বউদি, উদ্বেগাকুল তার চেহারা। আমাকে দেখেই বলে ওঠেন, ভাই, আপনার দাদার তো কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আজ সকাল দশটার দিকে তার ফোনে একটা রিং আসে। ফোনের কথা শেষ হতেই অফিসে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়েছেন। দুপুরের পর থেকে তাকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি। তার ফোন বন্ধ। অফিসে যোগাযোগ করে জানা যায় তিনি অফিসে যাননি।
আমি অবাক হয়ে বলি, কী বলেন বউদি! গতকাল সন্ধ্যায় দাদা আমাকে বলেছিলেন তিনি ছুটিতে আছেন। অফিস থেকে তাকে নাকি বেশ লম্বা ছুটি মঞ্জুর করেছে।
তাহলে সকালে যে তিনি বললেন, অফিস থেকে ফোন এসেছে। যাওয়ার সময় আবার বলে গেলেন অফিসে যাচ্ছেন।— বউদির কণ্ঠ বেশ কাঁদো কাঁদো শোনাল।
আর কোথাও খোঁজ-খবর নিয়েছেন?
আর কোথায় খোঁজ নেব? তিনি তো অযথা কোথাও গিয়ে সময় কাটাবার মানুষ না। সারাদিন অপেক্ষা করতে করতে আমার ছেলে ও দেবর কিছুক্ষণ আগে রমনা থানায় গেল জিডি করার জন্য।— বউদি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তাদের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
আমরা সবাই গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এমন কী হতে পারে হরিৎবরণবাবুর? অফিস থেকে ফোন এসেছে, কিন্তু অফিসে যাননি, আবার ফোন বন্ধ, কারো সঙ্গে যোগাযোগ নেই— একেবারে নিখোঁজ। নানা জল্পনা-কল্পনার মধ্যে কেটে গেল রাত। ভালোমন্দ কোনো খবরই পাওয়া গেল না। পরের দিনেরও দুই প্রহর গড়িয়ে তিন প্রহর যায় যায়। এমন সময় হরিৎবরণবাবুর বাসায় উঠল কান্নার রোল।— আমাদের এ কী সর্বনাশ হলো রে।— সুরেলা বউদির আর্তচিৎকার।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাষ্ট্র হয়ে গেল মর্মান্তিক খবরটা। হরিৎবরণবাবু আর নেই। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে পাওয়া গেছে হরিৎবরণবাবুর মরদেহ। মেঘনা নদীতে একজনের মরদেহ ভাসতে দেখে স্থানীয় লোকেরা পুলিশকে জানায়। নৌ পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে তার ছবি তুলে ঢাকার রমনা থানায় পাঠায়। রমনা থানা থেকে ফোন এসেছে হরিৎবরণবাবুর ছেলে সুনিলয়ের কাছে।
আমি স্তম্ভিত। মেঘনা নদীতে হরিৎবরণবাবুর মরদেহ! ব্যাপারটা কি রহস্যজনক নয়? এটা কি আত্মহত্যা, না হত্যা? বলা হচ্ছে আত্মহত্যা। আত্মহত্যাই যদি করবেন মরার জন্য তাকে মেঘনা নদীর বুক বেছে নিতে হলো! একজন আপসহীন সাংবাদিকের এই পরিণতি! এভাবেই প্রাণ দিতে হলো হরিৎবরণবাবুকে! হায়, সৎ সাংবাদিকতা জগতের বিরল চিরহরিৎ বৃক্ষ! এটা তো পত্রিকার পাতা থেকে লেখা বা খবর তুলে নেওয়া নয়। জীবনের পাতা থেকে চিরতরে মুছে ফেলা। কোন ঝড়ে উৎপাটিত হলো এই বিরল বৃক্ষের মূল? সেই রহস্যাবরণ কি উন্মোচিত হবে কোনোদিন?
সুজন বড়ুয়া, শিশুসাহিত্যিক ও গল্পকার




