এখন সময়:সন্ধ্যা ৬:৩৮- আজ: রবিবার-২১শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৬ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-শীতকাল

এখন সময়:সন্ধ্যা ৬:৩৮- আজ: রবিবার
২১শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৬ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-শীতকাল

জলে জঙ্গলে (পর্ব-২)

মাসুদ আনোয়ার

 

৬ ডিসেম্বর রাজশাহী বোর্ডের রেজাল্ট আউট হলো। আমি কুমিল্লা বোর্ডের পরীক্ষার্থী। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলাম। যে কোনোদিন কুমিল্লা বোর্ডও ফল প্রকাশ করে দিতে পারে। তার আগেই পালাতে হবে। কিন্তু পালিয়ে যাব কোথায়?

কে যেন মন থেকে বলে দিল, ‘কেন, কাপ্তাই? সেখানে গোলাম মাওলা আছে না? শাজু বু’র জামাই।’

শাজু বু’ আমার মামাতো বোন। মায়ের জেঠাতো ভাইয়ের মেয়ে। বয়সে অনেক বড়। শাজু বু’র জামাই থাকেন কাপ্তাই। ওখানকার বড় মসজিদে ইমামতি করেন। ক্লাস এইটে যখন পড়ি, তখন একবার দেখা হয়েছিল। ভদ্রলোক আমার সাথে খুব হেসে টেসে কথা বলেছিলেন তখন। এতটা ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল যে, একদিন নিজের মনের গোপন ইচ্ছেটার কথাও জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ‘দুলাভাই, আমি বাড়ি থেকে চলে যেতে চাই। বাড়িতে ভালো লাগে না।’

 

এটা আসলেই আমার মনের গোপন ইচ্ছে ছিল। সে ছোট্টবেলা থেকেই। বাড়িতে থাকতে একদম মন চাইত না। নিজেকে মনে হতো বন্দি এক পাখির ছানার মতো। সারাক্ষণ ইচ্ছে হতো চলে যাই নানার বাড়িতে, নয়তো মায়ের কাছে।

গোলাম মাওলাকে ওই কথা বলার সময় শাজু বু’ও ছিল ওখানে ছিল। আমার কথা শুনে গোলাম মাওলা একটু চুপ করে যান। শাজু বু’ একটু হেসে বলেছিলেন, ‘মা না থাকলে ঘর ভাল লাগে না গো।’

গোলাম মাওলা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘হুঁ।’

শাজু বু’র মুখে শুনেছিলাম, গোলাম মাওলার নিজেরও মা নেই।

আমি বলেছিলাম, ‘দুলাভাই, আপনি আমাকে একটা চাকরি ধরিয়ে দেবেন। আমি চাকরি করে করে লেখাপড়া করব।’

গোলাম মাওলা আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। তারপর বলেছেন, ‘ঠিক আছে, তুমি আগে মেট্রিক পাস করে নাও। এরপর ইচ্ছে হলে কাপ্তাই যেয়ো। তখন দেখব কিছু করা যায় কি না। কিন্তু মেট্রিক পাস না করে বাড়ি থেকে বেরোবে না।’

সুতরাং বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাব, এ চিন্তা আসতে সবার আগে কাপ্তাই যাবার কথা মনে এল।

৮ ডিসেম্বর। শনিবার। সকাল থেকে এলাকায় বিশাল হৈ চৈ। মানুষের মধ্যে উত্তেজনার শেষ নেই। নূর নবী দরবেশের আজ দরিয়া ফেরানোর দিন। বিশাল এক কর্মীবাহিনী তৈরি হয়ে গেছে স্থানীয় মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক আর এলাকার ধর্মপ্রাণ মানুষদের নিয়ে। আছরের পর থেকে শান্তির হাটে ওয়াজ মাহফিল। শুনছি বড় বড় পাঁচ-সাতটা গরুও নাকি জবাই করা হবে। দরিয়াতে ছুড়ে ফেলা হবে অর্ধেক মাংস।

মাগরিবের নামাজের পর সে মাহেন্দ্রক্ষণ। সকাল বেলায় তেমাথার দোকানে গিয়ে এসব খবর শোনা গেল। দরিয়া কতটা ফিরবে, কিংবা আদৌ ফিরবে কিনা এই নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা। মানুষদের মধ্যে অতি বিশ্বাসী যেমন আছে, তেমনি নিম-বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসীর সংখ্যাও দেখছি কম নয়। মহাজন বাড়ির বদু কাকু তো কানেই তুলতে চাইছেন না এসব কথা। উলু মিয়ার চায়ের দোকানে বসে কয়েকজনকে নিয়ে আসর জমিয়েছেন তিনিও। ফুক ফুক করে কাঁচি সিগারেট টানতে টানতে বলে চলেছেন, ‘দূর মিয়া, তোমরা এসব বিশ্বাস করো। দরিয়া নূর নবী দরবেশের কেনা গোলাম তো, কইলেই সালাম দিয়ে ফিরে যাবে। যতসব বুজুরকি।’

একজন বলল, ‘বদুভাই, পীর আউলিয়া, গাউছ কুতুবদের অবিশ্বাস করতে নেই। আল্লাহ কার উছিলায় কী করেন, কেউ বলতে পারে না।’

‘দূর মিয়া!’ বদু কাকু সিগারেটের ধোঁয়ার মতোই উড়িয়ে দিলেন লোকটাকে। ‘নূর নবী দরবেশ তো চ্যাঙড়া পোলা। চ্যাঙড়া পোলা আবার পীর আউলিয়া, গাউছ কুতুব হয় নাকি? গাউছ-কুতুবের কথা যখন বলছ, তাহলে বায়েজীদ বোস্তামী, আমানত শাহ, মোহছেন আউলিয়া এদের দরবারে যাও। তাদের দোয়া পাও কিনা দেখ। নদী বাপ ডেকে ফিরে যাবে। কিন্তু তারা দোয়া করবেন তো? কার জন্যে দোয়া করবেন? আমরা তো সব পাপী বান্দা, আমাদের জন্যে দোয়া করে আল্লাহর কাছে শরমিন্দা হবেন নাকি তারা?’

কথাটা অনেকেরই মনে ধরল। ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ করে সাড়া দিল তারা। অনেকে অবশ্য চুপ করে রইল। তারা বোধ হয় একটু বেশি আশাবাদী। নূর নবী দরবেশের ওপর থেকে অত সহজে বিশ্বাসহারা হতে চাইছে না।

কিন্তু আমার তাতে কিছু আসে যায় না। আমি আজই বাড়ি থেকে পালাব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। নূর নবী দরবেশ যা-ই পারুক, আমাকে পরীক্ষায় পাস করাতে পারবে না। পারলে একটা অসহায়, প্রায় বাচ্চা ছেলের সামনে কাকতালীয়ভাবে কাঁথার গাঠরি পড়া নিয়ে এক দোকান লোকের সামনে অমন হ্যা হ্যা করে হাসতে পারত না।

দুপুর বেলা খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। রাতটা কাটালাম দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় বাড়িতে। পরদিন ভোরে উঠে যাত্রা শুরু করার কথা

ভোর না হতেই ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে ঠাহর করতে পারলাম না কোথায় আছি। তারপরই সব মনে পড়ে গেল একযোগে। আমি বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছি। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হতে পারে যে কোনো দিন। আমি পরীক্ষায় ভালো করতে পারিনি। ফেল করার মতো ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা ঘটলে যে কী হবে, সেটা কল্পনাও করতে পারছি না।

মনটা হঠাৎ করেই যেন কেমন হয়ে গেল। একটা অজানা আতঙ্ক এসে ভর করল। তলপেটে খালি খালি ভাব। শিরদাঁড়ায় অনিশ্চয়তার ঠাণ্ডা শিরশিরে অনুভূতি। কোথায় যাব? কী করব? আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, ক্লাসমেটদের প্রিয় সব মুখ ছেড়ে কোন অজানায় গিয়ে হাজির হবো আমি?

তবে বেশিক্ষণ থাকল না মনের এই বিষণ্ন ভাব। নতুন জীবন, নতুন মানুষ আর নতুন সব অভিজ্ঞতার লোভে আকুল হয়ে উঠল। মনে হলো, আজ থেকে শুরু হলো আমার সংগ্রামী জীবন। এই সংগ্রামে আমাকে জিততেই হবে। কল্পনায় নিজেকে দেখলাম, টগবগে এক তরুণ হিসেবে। দেখলাম, যেখানে যাচ্ছি সবাই আমাকে কেমন অবাক হয়ে বরণ করে নিচ্ছে, মেনে নিচ্ছে আমার শ্রেষ্ঠত্ব। দেখলাম, কোনো এক সহৃদয় মহাপ্রাণ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেছে আমার। আমার চলা ফেরা, কথা বলার ভঙ্গি আর কাজকর্ম দেখে মুগ্ধ ওই ভদ্রলোক আমাকে নিয়ে গেলেন নিজের সাথে, তার বাড়িতে।…..তাঁর রয়েছে এক সুন্দরী মায়াবতী কিশোরী মেয়ে, আমরা দু’জন এক সাথে পড়াশোনা করি, কথা বলি, আর মাঝে মধ্যে বিরল কোনো মুহূর্তে একে অন্যের দিকে তাকাই চোরা চোখে, নিজেকে হারাই, চোখাচোখি হতেই দারুণ লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিই, মনের গহীনে একে অন্যকে ভালবাসি পাগলের মতো।

….তারপর স্বপ্ন আরো এগোয়….মান-অভিমান, মুগ্ধতা, ভুল বোঝাবুঝি…..

সকালে উঠে চিতই পিঠে খেয়ে আত্মীয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। তারা বলল, আবার যেন যাই। আমি মনে মনে হাসি। তোমরা কি জানো, আমি কোথায় যাচ্ছি? আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। একদিন মানুষ হয়ে, আরো অনেক লেখাপড়া শিখে, অনেক টাকা-পয়সা নিয়ে ফিরব। সেদিন আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে সবাই অবাক হয়ে। আমার দিকে চাইবে প্রশংসার দৃষ্টিতে। ছোটরা শ্রদ্ধা করবে, আর বড়রা সমীহ করবে।

আত্মীয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পূর্বদিকে এগিয়ে চললাম নদীর দিকে। ঘাটঘরে গিয়ে নৌকোয় চড়ব। সাথে কোনো মালপত্র নেই। আছে শুধু একটা খাতা। কবিতার খাতা। ফাইভ থেকে লেখা সব কবিতা নোট করেছি ওই খাতায়। ওই খাতা আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয়। আমি যেখানে যাব, সেখানে সবাই যখন দেখবে আমার কবিতা, অবাক হয়ে যাবে। তারপর অনেকক্ষণ পরে একজন অনেক সম্মানের সাথে বলবে, ‘আপনি একজন কবি?’

কবি হওয়া অনেক বিশাল ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীম উদদীন… একদিন ছাত্ররা সবাই পরীক্ষার খাতায় ব্যাখ্যা লিখবে, আলোচ্যাংশটুকু কবি মাসুদ আনোয়ারের….কবিতা থেকে নেয়া হয়েছে। এখানে কবি বলেছেন যে,…..

একঘণ্টা পরে নৌকোয় চড়লাম। পুবের দরিয়া ঠাণ্ডা। মেঘনার মতো রাক্ষুসী টাইপের নয়। ডিসেম্বরের সকাল। মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে উত্তুরে বাতাস বইছে। নৌকোর গায়ে এসে লুটিয়ে পড়ছে ঢেউ। কল কল ছল ছল….। দক্ষিণে সাগর। ঘোলাটে পানি আর ধূসর আকাশ মিশে গেছে দিগন্ত রেখায়। নৌকোর গলুইয়ে দাঁড়িয়ে তাকালাম পশ্চিমে। বুকের ভেতর হু হু করে উঠল। আমার আজন্ম পরিচিত ভূখণ্ড। আমার গ্রাম, স্কুল, খেলার মাঠ। আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাচ্ছে। সজীব স্পষ্ট গ্রামের গাছপালা আস্তে আস্তে সবুজাভ, তারপর নীল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। আকাশ নেমে এসেছে নিচের দিকে। মিশে যাচ্ছে গাছপালার সাথে। কখন আসব আবার? মনে পড়ল বন্ধুদের কথা। সেবক, সাকী, পান্না, মাওলা, বাহার, পারভেজ, নোমান…ওরা সবাই রয়ে গেছে। ওরা থাকবে। কেবল আমাকেই চলে আসতে হলো ওদের ছেড়ে। আগামীকাল আকবর হাটে ওরা সবাই একত্র হবে, আড্ডা মারবে…আমাকে পাবে না। তা নিয়ে অবশ্য খুব একটা মাথাও ঘামাবে না। একটা আড্ডায় সবাই সবদিন হাজির নাও থাকতে পারে। কিন্তু ওরা তো জানবেই না যে, আমি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছি।

হালের গোড়ায় বসা মাঝির মনে হঠাৎ যেন ফুর্তির আমেজ লাগল। বাদাম খাটিয়ে দিয়েছে বাতাসে। উত্তুর-পশ্চিম কোণা থেকে বয়ে আসা বাতাসে পেট ফুলিয়ে উড়ছে। নৌকো এগিয়ে চলেছে সীতাকুণ্ডের দিকে।

…..আল্লা আল্লা আল্লা আল্লা……মাঝি চেঁচিয়ে উঠল আচমকা। সাথে সাথে নাইয়াদের কোরাস, তার সাথে গলা মেলাল যাত্রীরাও…..এ এ এ……..লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাছুলুল্লা……

মজা লাগল দারুণ। এমন আর কখনো দেখিনি। আমাদের চারদিকে পানি। বাতাসে দুলছে। উত্তরে-দক্ষিণে-পুবে পশ্চিমে যেদিকে তাকাও, আকাশ মিশে গেছে পানির সাথে। গভীর দরিয়ার বুকে কাঠের তৈরি একটা নৌকো কেমন তর তর করে এগিয়ে চলেছে। যাত্রীরা কথা বলছে, গান গাইছে, বিড়ি টানছে। কেউ  কেউ উদাস চোখে তাকিয়ে আছে নদীর ঢেউয়ের দিকে। কেউ উৎফুল্ল, কারো চোখে বিষাদ, কেউ নির্লিপ্ত।

আর আমার চোখে স্বপ্ন। ভবিষ্যতের স্বপ্ন। নতুন দেশে নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হওয়ার স্বপ্ন, নিজেকে সফল একজন মানুষ হিসেবে দেখার স্বপ্ন।

 

কাপ্তাই পৌঁছলাম বিকেল প্রায় তিনটার সময়। শীতের দিন। সূর্য হুড়মুড় করে নিচে নামতে শুরু করেছে। বাস থেকে নেমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। বাস যেখানে থেমেছে সেটা ছোট একটা রাস্তার মতো। একদিকে দোকানপাট, আরেকদিকে খালি। ডানে বাঁয়ে সামনে পেছনে তাকালেই পাহাড়। মানুষজন খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। সরু রাস্তা বেয়ে পুবদিক থেকে পশ্চিম দিকে এগিয়ে আসছে গাছ বোঝাই ট্রাক। গোঁ গোঁ শব্দ শুনে মনে হচ্ছে বেশ কষ্ট হচ্ছে ট্রাকগুলোর বোঝা পিঠে নিয়ে ছুটতে। উত্তর পাশের দোকানপাটে মানুষজন কেনা কাটা করছে। খুব বেশি ভীড় নেই। ভারী ছিমছাম মনে হলো কাপ্তাই শহরটাকে। ভালো লাগছে। কিন্তু একই সাথে বিষণ্নতায় ভরে উঠছে মন। কালও এসময় আমি বাড়িতে ছিলাম। তখন ছিল বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার উত্তেজনা আর উদ্বেগ। আর এখন উত্তেজনা নেই, মনের ভেতর জমে উঠতে শুরু করেছে দুশ্চিন্তা। অনিশ্চয়তার উদ্বেগ। সূর্য পশ্চিমে পাহাড়ের আড়ালে চলে যাবার তোড় জোড় করছে। পাহাড়ের নীল অবয়বে ধূসর ছায়া। অন্ধকার হতে শুরু করেছে। কেমন যেন ধোঁয়া উড়ছে পাহাড়ের গা থেকে। পুবদিকে কাছের টিলা-টক্কর ছাড়িয়ে আরো দূরে আমার নজর। দিগন্তের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত নীলের বেড়ার মতো অগণিত পাহাড়ের সারি। খুব হৈ চৈ-ও শোনা যাচ্ছে সেদিক থেকে। এক সাথে অনেক মানুষের চিৎকার। যাব নাকি ওদিকে? কী হচ্ছে দেখে আসব?

সূর্য ডোবার আর বেশি বাকি নেই। কাপ্তাই শহরের আগা-মাথা কিছু চিনি না। সুতরাং লোভ সামলাতে হলো। আগে গোলাম মাওলার বাসা খুঁজে নিই। অবশ্য খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট হবে না। কারণ তিনি তো কাপ্তাই বড় মসজিদের ইমাম। বড় মসজিদের সামনে গেলেই হবে। একটু পরেই তো মাগরিবের নামাজ শুরু হবে। তিনি ইমামতি করবেন। মসজিদের  সামনে গিয়ে দাঁড়ালে নামাজ শেষ করে বেরিয়েই আমাকে দেখবেন। আমিও দেখব।

একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, বড় মসজিদটা কোন দিকে?’

‘বড় মছিদ?’ লোকটা এমন ভাবে তাকাল যেন আমি এক অদ্ভুত কথা জানতে চেয়েছি। আর সে যেন বড় মসজিদ কথাটাও এই প্রথম শুনল। পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করে ফস করে ম্যাচ জ্বালাল। তারপর ধরাতে ধরাতে বলল, ‘জানি না।’ ভুস করে ধোঁয়া ছাড়ল। ‘বাড়ি কোঁতায়?’

পরিচয়ের আগেই যদি কেউ হুট করে জানতে চায়, বাড়ি কোথায়, সে লোককে পাত্তা দেয়ার দরকার নেই। এটা খুব সহজ ব্যাপার। তাছাড়া লোকটা বলছে বাড়ি কোঁতায়? ‘কোঁতায়’ মানে কী? কেমন একটা বিশ্রী ভঙ্গি। যেন ঠাট্টা করল?  সুতরাং ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সামনে হাঁটতে শুরু করলাম।

কিন্তু অবাক কাণ্ড! লোকটা দেখি পেছন থেকে ডাকতে শুরু করেছে, ‘এই এই হুন হুন…এই পোয়া?’

এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। কলেজে ভর্তি হবো কয়েকদিন পরে। অপরিচিত লোকদের মুখে ‘আপনি’ শুনতে চাই। আর এই লোক তো সাধারণ লেবারার শ্রেণীর, সে আমাকে ‘তুই-তোকারি’ করবে আর আমি যে এখন আর নেহাত ছোট নই, সেটা খেয়াল না করে ‘পোয়া’ ডাকবে, এটা পছন্দ হলো না।

‘কী হয়েছে?’ রুখে দাঁড়ালাম। লোকটার দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে বললাম, ‘অভদ্রের মতো কথা বলছেন কেন? ভদ্রতা কাকে বলে জানেন না?’

‘কী কইলি?’ লোকটার চোখ সরু হয়ে উঠল। ‘এই খাড়া।’ আমার দিকে আসতে শুরু করল।

অপমানে কান লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু ভয়ও পেলাম। আমার সরু লিকলিকে হাত-পা। লোকটার দিকে তাকালাম। বেশ ষণ্ডা-গুণ্ডা টাইপ চেহারা। থাপ্পড় একটা দিলে মনে হয় স্রেফ উড়ে যাব, খুঁজেও পাওয়া যাবে না আমাকে। তবু গ্যাঁট হয়ে দাঁড়ালাম। কী করতে পারবে ও?

লোকটা কাছে এসে দাঁড়াল। আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখল। তারপর হাসল একটু। ‘নতুন আইছ কাপ্তাই?’

যাক, ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’তে উঠেছে। গলার স্বরও কিছুটা নরম শোনাল।

‘হ্যাঁ। কিন্তু আপনি আমাকে ‘তুই’ করে বলছেন কেন? আমি কি বাচ্চা ছেলে?’

‘কার কাছে আইছ? কে আছে এখানে? দেখে তো মনে হয় বাচ্চা ছেলে।’

‘না, বাচ্চা ছেলে না। আমি এসএসসি  পরীক্ষা দিয়ে এসেছি।’

‘মানি?’

‘মানে হলো মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে এসেছি। কিন্তু আপনি আমার সাথে এরকম করছেন কেন?’

‘মেট্টিক! পাস কইরছ? কও কী?’

‘কেন, বিশ্বাস হয় না। আপনি আমাকে তুই করে কথা বলেন কেন? আপনি করে বলবেন।’

‘আইচ্ছা, আইচ্ছা।’ লোকটা হাসল খিক খিক করে। ‘তয় এখন কই যাইবান? বাড়ি কই?’

এবার বাড়ির কথা বললাম। লোকটাকে দমিয়ে দিতে পেরে ভালো লাগছে। একজন ব্যক্তিত্ববান মানুষের মতো আচরণ করতে পেরেছি। আমার ব্যক্তিত্বের কাছে হেরে গেছে একজন অশিক্ষিত লোক। সমীহ করে কথা বলছে এখন। ভাল লাগছে খুব।

‘চা খাইবান? চলেন, চা খাই…..’ হঠাৎ আপ্যায়ন করতে শুরু করল লোকটা। কিন্তু আমি রাজি হলাম না। বললাম, ‘না, আমি চা খাই না। ধন্যবাদ।’

লোকটা পীড়াপীড়ি করল না। ‘কই যাইবান এখন? রাতে থাকনের জায়গা আছে?’

‘আছে। আমার দুলাভাই আছে। কাপ্তাই বড় মসজিদের ইমাম সাহেব,’ সগর্বে জানালাম।

এবার যেন লোকটাকে একটু ভয় পেয়েছে মনে হলো। ‘বড় মছিদের ইমাম সাব আপনার দুলাভাই। দূর, আগে কইবান না? শোনেন, উনি তো কাপ্তাইয়ের ভেতর থাকেন। আমনে রিসিপশন গেটে ঢুকে…না, চলেন তো আপনাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিই…চলেন চলেন….’

রিসিপশন গেট মানে অভ্যর্থনা ফটক। পরে জেনেছি, রিসিপশন গেটের ভেতরেই মূল কাপ্তাই শহর। গেটের বাইরে জেটিঘাট, নতুন বাজার, রুফ লাইন…এসব হয়েছে পরে। কাপ্তাই বাঁধ মূল শহরে। নিরাপত্তার কারণে জনসাধারণের অবাধ যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা হয় রিসিপশন গেটের মাধ্যমে। চাইলেই আপনি হুট করে ভেতরে ঢুকতে পারবেন না। রিসিপশন গেটের সেন্ট্রিদের কাছে গিয়ে পরিচয় লিপিবদ্ধ করিয়ে ভেতরে ঢোকার উদ্দেশ্য এবং কার কাছে যাবেন, এসব নানা ফিরিস্তি দিয়েই ঢুকতে হবে।

যাহোক, লোকটার সাহায্য পেয়ে সুবিধে হলো খুব। ওর প্রতি আর রাগও রইল না। ভাবলাম, বেচারা অশিক্ষিত মানুষ। ব্যবহার শিখবে কোত্থেকে? শিক্ষিত সমাজের আদব-কায়দাও জানে না, কারণ কখনো শিক্ষিত মানুষের সাথে মেশেনি হয়তো।

অথচ অশিক্ষিত হলেও কেমন আন্তরিক! চা খাওয়াতে চাইল। আর এখন না চাইতেই সাহায্য করছে কাপ্তাইয়ের ভেতরে যাওয়ার ব্যাপারে। সত্যিই ওর সাহায্য না পেলে দারুণ বেগ পেতে হতো। শেয়ারের টেক্সিতে তুলে দেয়ার আগে বলল, ‘যেখানে টেক্সি থামব, ওখানেই বড় মছিদ। কাউকে জিজ্ঞেস করলে দেখাই দিবে হুজুরের বাসা।’

আমি হাসিমুখে কৃতজ্ঞতা জানালাম। বললাম, ‘ভাই, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ’

লোকটা হাত বাড়িয়ে দিল। হ্যান্ডশেক করবে। আমি একটু ইতস্তত করে হাত বাড়ালাম। লোকটা আমার হাত মুঠোয় নিয়ে মৃদু চাপ দিল। ‘কাইলকা বেড়াইতে আইসেন জেটিঘাট। আমার নাম অলি, অলি আম্মত। যে কাউরে জিগাইলে দেখাই দিব।’ হাসল লোকটা।

‘ঠিক আছে,’ হাত টেনে নিলাম। লোকটার হাসি ভালো লাগল না। কেমন বিশ্রী দেখতে।

সালাম দেয়ার ভঙ্গিতে কপালে হাত ঠেকাল লোকটা। তারপর হাসিমুখেই বলল, ‘আল্লাহ হাফেজ…’

টেক্সি ছেড়ে দিল। এগিয়ে চলল দক্ষিণ দিকে। প্রশস্ত রাস্তার দু’পাশে দেখার মতো দৃশ্য। পুবদিকে কাপ্তাই হ্রদ, পাহাড়, সবুজ গাছপালা; পশ্চিমেও তাই। নীলপাহাড় আর সবুজ বৃক্ষশ্রেণী। পাগলের মতো দু’দিকে দেখার চেষ্টা করছি। পনের ষোলো বছরের জীবনে এমন দৃশ্য তো আর দেখিনি।

কিন্তু সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে অনেক আগে। শীতসন্ধ্যায় ধোঁয়া উড়ছে পাহাড়ের গায়ে। ধোঁয়া নয় আসলে, কুয়াশা। এরই মধ্যে মোড় ঘুরল টেক্সি। আচমকা বাম দিকে চোখে পড়ল অগাধ পানির আধার আর ডানপাশে রাস্তা থেকে বহু নিচে বাড়িঘরের সারি। পানি আর রাস্তার কোল ঘেষে স্লুইস গেটের মতো। একটা দুটো নয়। আচ্ছা, এটা কী? গেটগুলো কিসের? চিন্তা করতে করতে পাথরের ফলায় লেখাটা চোখে পড়ল, ‘মেন ড্যাম : প্রধান বাঁধ।’

ধীরে সুস্থে বিজলী বাতি জ্বলে উঠতে শুরু করেছে চারদিকে। মাগরিবের আজান শোনা গেল দক্ষিণ দিক থেকে। নিশ্চয় বড় মসজিদের আজান। মন ভরে উঠল হঠাৎ আনন্দে। নিশ্চয়তার আনন্দ। একটু পরেই দেখা হতে যাচ্ছে দুলাভাই গোলাম মাওলার সাথে। বড় মসজিদে নামাজ পড়াতে আসবেন তিনি। ইমাম না?

টেক্সি থামল বড় মসজিদের কাছাকাছি এক জায়গায়। সবাই নেমে পড়ল। নামলাম আমিও। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিল মসজিদটা। তারপর টেক্সি নিয়ে চলে গেল ফের যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে।

 

মাসুদ আনোয়ার, কথাসাহিত্যিক

আন্দরকিল্লা প্রকাশনার ২৮ বছর আগামীর পথ ধরে অনাদিকাল

রূপক বরন বড়ুয়া আমি মাসিক ‘আন্দরকিল্লা’ কাগজের নিয়মিত পাঠক। প্রতিবারের মতো হাতে নিলাম এবারের দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে ঢাকা জুলাই ২০২৫ সংখ্যা, হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখতেই

জলে জঙ্গলে (পর্ব-২)

মাসুদ আনোয়ার   ৬ ডিসেম্বর রাজশাহী বোর্ডের রেজাল্ট আউট হলো। আমি কুমিল্লা বোর্ডের পরীক্ষার্থী। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলাম। যে কোনোদিন কুমিল্লা বোর্ডও ফল প্রকাশ

স্বপ্নে গড়া অবয়ব

সৈয়দ মনজুর কবির   মনটা যখনই কেমন অজনা বিষণ্নতায় ছেয়ে যায় তখনই কেয়া জানালার ধারে এই চেয়ারটাতে এসে বসে। আজ অবশ্য অন্য একটা কারণ আছে

অন্তহীন সুড়ঙ্গ

সুজন বড়ুয়া   কবর থেকে বেরিয়ে মহিম অশরীরী রূপ নিল। সঙ্গে সঙ্গে গত কয়দিনের সব ঘটনা একে একে মনে পড়ে গেল তার। ফার্স্ট সেমিস্টারের পর

রাত যখন খান খান হয়ে যায়…

মনি হায়দার   চোখ মেলে তাকায় সোাহেল হাসান। প্রথম দৃষ্টিতে সবকিছু অচেনা লাগে। কোথায় এলাম আমি? উঠে বসতেই মনে পড়ে গতরাতে অনেক ঝক্কি আর ঝামেলার