মুজিব রাহমান
“ভবিষ্যতে কখনোই এমন কোনো সময় আসবে না যে-সময়ে আমরা আমাদের মুক্তির পথ করে নিতে পারবো। চ্যালেঞ্জটা এ-মুহূর্তে, সময়টা সবসময়Ñ এখনই।”
এমনই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন বর্ণবাদবিরোধী, সুযোগের সমতায় বিশ্বাসী সদা সক্রিয়তাবাদী আফ্রো-অ্যামেরিকান আমৃত্যু লড়াকু কলমযোদ্ধা জেমস বল্ডউইনÑ তাঁর ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত সাড়াজাগানো প্রবন্ধগ্রন্থ Nobody Knows My Name: More Notes of a Native Son প্রবন্ধগ্রন্থের Faulkner and Desegregation শীর্ষক প্রবন্ধে।
১৯২৪ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে, হার্লেমে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অ্যামেরিকার সর্বজনবিদিত ও সর্বাধিক সংস্কৃতিমান কৃষ্ণাঙ্গ এই লেখক। ১৭ বছর বয়সে দেশ ছেড়ে প্যারিসে পাড়ি জমিয়েছিলেন বল্ডউইন। তাঁর পিতার রিরংসা এবং অমিতাচারি জীবন যাপন বল্ডউইনের ভারসাম্যপূর্ণভাবে বেড়ে উঠার পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করেছিল। স্রষ্টার কাছে নতজানু হবার আগে বাবার কাছে নতজানু হতে বাধ্য করা হতো তাঁকে। যা বল্ডউইন করতে চাইতেন না। দীর্ঘ ধারাবাহিক সংঘাতের পর বল্ডউইন বাবাকে পরিত্যাগ করে এক চোটে স্রষ্টার কাছে আসতে পেরেছিলেন। বেঁচে উঠেছিলেন। তাঁর মনে হতো তাঁর ভেতর একটা কিছু মারা যেতে বসেছে। দীর্ঘ এক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে ধর্ম ও বিশ্বাস অর্জন করতে হয়েছিল তাঁকে।
১৯৫০-এর দশকের আফ্রো-অ্যামেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনাভিজ্ঞতার প্রতিবিম্ব হয়ে আছে যে-দুজন পোড়খাওয়া লেখকের রচনাবলি, তাঁরা হচ্ছেন যথাক্রমে জেমস বল্ডউইন এবং রাল্ফ এলিসন। তাঁদের রচনায় এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, আফ্রো-অ্যামেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের সমস্যা ও সংকট কোনো অতি উচ্চাকাক্সক্ষাজনিত সমস্যা বা সংকট নয়, এটি হচ্ছে তাঁদের পরিচয়-সংকট। বল্ডউইন এবং এলিসনের সাহিত্যকর্মে চিত্রিত চরিত্রাবলি এই পরিচয়ের সংকটে জর্জরিত ও সংক্ষুব্ধ। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘অন্য দেশ’ নিউইয়র্ককে ঘিরে আবর্তিত এক উপন্যাস, যে উপন্যাসে হার্লেমের সমাজবাস্তবতা বিধৃত হয়েছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র রুফাস স্কটের আত্মহননের ইতিবৃত্তের ভেতর দিয়ে বল্ডউইন তখনকার ‘হার্লেম’ ব্যক্তির বিকাশের পথে, প্রেম-ভালোবাসার পথে কতোটা মরণঘাতী বাধা ছিলো তা দারুণ মুন্সিয়ানায় তুলে ধরেছেন।
জেমস বল্ডউইন ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস, আত্মজৈবনিক Go Tell It On the Mountain-এর জন্যে সমধিক প্রসিদ্ধ। এ-উপন্যাসে ১৪ বছর বয়সী তরুণের আত্মজ্ঞান এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের গল্প বর্ণনা করা হয়েছে। লেখক এ উপন্যাসে তাঁর নিজের আনুপূর্বিক শেকড় অনুসন্ধান করেছেন। ন্যায়বোধকে পঙ্গু বানিয়ে দিতে যে সমাজ যাচ্ছেতাই নিষ্ঠুর ও নির্লজ্জ কাজে নিরত ছিল, সে সমাজের জাতিগত অসাম্যের বিরুদ্ধে এক তীব্র ও শক্তিমান প্রতিবাদের অন্যনাম ছিলÑ বল্ডউইনের ক্ষুরধার লেখনি ও অকুতোভয় কণ্ঠ। আফ্রিকান আমেরিকানদের প্রতি ন্যায়ানুগ আচরণ ও যথাযথ মানবিক বিচার নিশ্চিত করার সনির্বন্ধ আহ্বান ও অনুরোধ ছিল তাঁর প্রতিটি লেখায় ও বক্তৃতায়। যে-সমাজের তিনি একজন সে-সমাজের সত্য ও বাস্তব পরিস্থিতি নিরাপসভাবে পাঠকের কাছে উন্মোচিত করে দিয়েছিলেন বল্ডউইন ইতিবাচক পরিবর্তনের দুর্মর আকাক্সক্ষায়। যে-কারণে ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে নাগরিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন বক্তা হয়ে উঠেছিলেন জেমস বল্ডউইন।
জেমস বল্ডউইন অক্লিষ্টকর্মা লেখক। মহামন্দার সময়ে (১৯২৯-১৯৩৯) হার্লেমের দুর্দশাগ্রস্ত প্রতিবেশ-পরিবেশে তাঁর বিপন্ন বেড়ে ওঠা। পিতামহের দাসত্বের ক্ষত ছিল তাঁর মনে। হাই স্কুলে পড়াকালীন কিশোর যাজক হিসেবে কাজ করেছেন Fireside Pentecostal Assembly-তে। ১৯৪২ সালে হাই স্কুল উত্তীর্ণ বল্ডউইনকে নানা ধরনের ছুটকো কাজ করতে হয়েছে। কখনও বাসনকোসন-তৈজসপত্র পরিষ্কারের কাজ করেছেন, কখনও বা অফিসে অফিসে ফুটফরমাশ খেটেছেন।
নিজদেশ অ্যামেরিকা নয় পরদেশ ফ্রান্স তাঁকে সবচেয়ে বেশি সম্মান প্রদর্শন করেছিল। মার্কিনি কোনো বড় সাহিত্য পুরস্কার জোটেনি তার বরাতে। অন্যদিকে ফ্রান্স তাঁকে তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফরাসি সাম্মানিক সাহিত্য পুরস্কার Commander of the Legion of Honor ভূষিত করেছিল জেমস বল্ডউইনকে।
অজস্র প্রতিবন্ধকতা ছিল তাঁর পায়ে পায়ে। কবির কথায়:
“I am… listening to my own demons and no one else’s, and I am going to keep working until they have all said what it is they are trying to tell me-and you. I am not going to stop until the last voice within me has been stilled
কবি তাঁর অন্তর্গত শক্তিতে পথ চলেন। বিবেকের স্বর স্তিমিত না হয়ে আসা পর্যন্ত পথচলাতে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
‘আমার বাবার অন্ত্যেষ্টি-অনুষ্ঠান’ প্রবন্ধে বল্ডউইন দুটি আপাতবিরোধী ধারণা হৃদয়ে ধারণ করতে বলেছেন।
তাঁর ভাষায়:
‘The first idea was acceptance, the acceptance, totally without rancor, of life as it is, and men as they are: in the light of this idea, it goes without saying that injustice is a commonplace. But this did not mean that one could be complacent, for the second idea was of equal power: that one must never, in one’s own life, accept these injustices as commonplace but must fight them with all one’s strength.’
এবং অবিচারের বিরুদ্ধে এ-যুদ্ধটি যে হৃদয় থেকে, ভেতর থেকে শুরু হবে সে-কথাও স্পষ্ট করেই বলেছেন বল্ডউইন।
মৃত্যুতে, যা-ই হোক না কেনো, প্রিয় হার্লেমে ফিরে এসেছিলেন কবি। তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর জন্মভিটার কাছেই কয়েকটি বাড়ির অদূরে। পাঁচ সহস্রাধিক শোকার্ত অনুগামী সে-দিন একত্র হয়েছিল সেই মানুষটির শেষ স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাতে যাঁর সম্পর্কে ঊ.খ উড়পঃড়ৎড়ি বলেছিলেন:
বল্ডউইন এমন এক সক্ষমতা ধারণ করতেন যে, তিনি কেবল একজনকে প্রশ্ন উত্থাপনের উপযুক্ত করেই গড়ে তুলতেন না, তাকে বাস্তবতা দেখার মতো করে দেখার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারতেন।
বল্ডউইন প্রায়শই বলতেন:
“Trust life, and it will teach you, in joy and sorrow, all you need to know.
জেমস বল্ডউইন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী এক বিশ্বনাগরিক। তিনি মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের মতই বিশ্বাস করতেনÑ পৃথিবীর এক জায়গায় করা অন্যায় পৃথিবীর সকল স্থানের ন্যায় ও ন্যায্যতার জন্যে সমান হুমকি।
আমার অনূদিত জেমস বল্ডউইনের নি¤েœাক্ত কবিতায় প্রোথিত শোকাবহ উচ্চারণ বিশ্বভ্রাতৃত্বের হৃদয়মথিত সম্প্রসারণ বললে অত্যুক্তি হবে না।
বোমায় বিধ্বস্ত প্রতিটি গ্রামই আমার নিজের শহর
প্রত্যেক মৃত সন্তান আমার সন্তান।
প্রত্যেক শোকার্ত মা আমার মা।
প্রত্যেক কান্নাজর্জর পিতা আমার পিতা।
ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া প্রতিটি বাড়ি
আমার বাড়ি যেখানে আমি বেড়ে উঠেছিলাম।
সীমান্তের এপার-ওপার লাশ বহনরত
প্রত্যেক ভাই আমার ভাই।
যে-বোন কখনও বাড়ি ফিরবে না
সে-বোনের জন্যে প্রতীক্ষারত প্রত্যেক বোন
আমার বোন।
এই জনতার প্রত্যেকেই আমাদের
ঠিক আমরা যেমন তাদের।
আমরা তাদের-
এবং তারাও আমাদের।
মুজিব রাহমান, কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক




