এখন সময়:দুপুর ১২:২৬- আজ: সোমবার-৩রা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৮ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:দুপুর ১২:২৬- আজ: সোমবার
৩রা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৮ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

ট্যাক্সি ড্রাইভার- আবদুলরাজাক গুর্নাহ্

ভাষান্তর: জ্যোতির্ময় নন্দী

 

[তানজানিয়ার লেখক আবদুলরাজাক গুর্নাহ্ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান বিগত ২০২১ সালে। ১৯৪৮-এ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জাঞ্জিবার দ্বীপে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি শরণার্থী হিসেবে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। এখন পর্যন্ত তানজানিয়ার এই সাহিত্যিক ১০টি উপন্যাস এবং কয়েকটি ছোট গল্প লিখেছেন। শরণার্থীদের জীবনের পরতে পরতে যে ঘাত-প্রতিঘাত, তা তাঁর লেখনিতে ফুটে উঠেছে। বর্তমানে কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গুর্নাহ্  মূলত ইংরেজি ভাষাতেই সাহিত্যচর্চা করেন। মোট ১০টি উপন্যাস ও একটি ছোট গল্পের সংকলন রয়েছে তাঁর। এর আগে ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ‘প্যারাডাইস’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্যের মর্যাদাপূর্ণ বুকার পুরস্কার জেতেন তিনি।]

 

আমার মনে হয়, আমি যে ওর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি সেটা সে খেয়াল করেছিল, কিন্তু তার নিজের কোনো কারণে সে সেরকম কোনো ভাব দেখাল না। আমি গাড়িটার খোলা পেছনের দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। সে তার হাতের পত্রিকাটা ভাঁজ করে নিয়ে, গভীর অপছন্দের চোখে আমার দিকে একনজর তাকিয়ে দরজা দিয়ে সেটা বাইরে ফেলে দিল। আমি ঠাই দাঁড়িয়ে রইলাম, আমার শরীর আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছিল গভীর বিস্ময়ে। হয়তো এটা তার ঠিক অপছন্দের ভাব নয়, বরং অস্তিত্বের অবিরাম একঘেয়েমি-জনিত অনিবার্য হতাশায় বিরক্তিমাত্র– একটা অপ্রীতিবোধ। কিন্তু সেটাকে অপছন্দ বলেই মনে হচ্ছিল। সে তার থুতনিটা সামান্য উঁচিয়ে বলল, আমার উদ্দেশ্যটা কী জানাতে। তাকে হোটেলের নামটা বললাম। সে এমনভাবে মাথা নাড়ল, যেন সেটার তেমন কোনো গুরুত্ব নেই, যেন সে আশা করেছিল আমি কোনো অসম্ভব গন্তব্যের নাম বলব। আমি গাড়ির সামনের দিকে তার পাশের সিটে গিয়ে বসলাম, একটা জন্তুর মোকাবেলার দুঃসাহস নিয়ে, কিন্তু সেইসাথে আমার এ উপস্থিতিতে তার রাগ হওয়ার

 

সম্ভাবনাগুলোও মাথায় রেখে। তার কাছটায় বসেছি যাতে সে দেখতে পায়, আমাকে সে প্রথমে যতটা ভেবেছে আসলে আমি ততটা অপছন্দের পাত্র নই। তার রাগ হয়েছে কিনা বোঝার ব্যাপারটা কী করে এড়াব, সেটাই বুঝতে পারছিলাম না।

গাড়ির আসনটা ছিল শক্ত আর জায়গায় জায়গায় দলা পাকানো (আর সবুজ)। এটার ভাইনিলের আপহোলস্টারি বয়সের ভারে ফেটে গিয়েছিল। তার ধারালো কিনারার কোণাগুলো কুঁচকে গিয়েছিল কাঁচা চামড়ার মতো এবং ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ঝাঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় আমার শার্টের মধ্যে দিয়ে সেগুলো আমার গায়ে বিঁধছিল। গাড়িটার ড্যাশবোর্ডে ছিল ফাঁকা সব ফোকর আর জট পাকানো তার, যেখানে যেখানে হয়তো থাকার কথা ছিল লাইটার বা রেডিও বা গ্লোভ-কম্পার্টমেন্ট। অথবা সেগুলো হয়তো পুরো খালিও ছিল না, যেহেতু তাদের কোণগুলোতে ঠেসে রাখা ছিল নলের মতো করে পাকানো কাগজের রাশি, এবং ব্যবহারে ব্যবহারে জীর্ণ বিবর্ণ হয়ে যাওয়া একটা ন্যকড়া ঝুলছিল একটা ফোকরের মধ্যে দিয়ে।

লাঞ্চ-টাইমের ট্রাফিকের ভিড়ে আমাদের গতি যখন ঢিমে হয়ে গেল, সে আমার কোলের ওপর রাখা ব্রিফকেসটার দিকে তাকাল। তারপর সে চোখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকাতে লাগল, আর আমি ভান করতে লাগলাম যেন ব্যাপারটা খেয়ালই করিনি। ‘কোত্থেকে আসছেন আপনি?’ সে জিজ্ঞেস করল, প্রশ্নটা যাতে বেখাপ্পা না শোনায় এজন্যে কণ্ঠস্বরকে মোলায়েম করে, কিন্তু তারপরও তাতে এমন একটা ভাব দিতে পারল যেন সে রাগে গজরাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সে এমনভাবে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করল যেন আমি তার সেটা জিজ্ঞেস করার অধিকারের ব্যাপারে মতভেদ পোষণ করব। ‘উনাটোকা ওয়াপি?’১ আবার সে ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ির গতি আবার বাড়িয়ে দিল। তারপর সিটের পেছনে হেলান দিয়ে তার ভাঁজ করা কনুইটা রাখল গাড়ির জানলার ওপর। সে ছিল রোগা এবং স্নায়বিক ধরনের। উপেক্ষা বা তাচ্ছিল্যের আশঙ্কায় তার চেহারাটা চুপসে গিয়েছিল। অথবা হয়তো অমনটা ভাবছিলাম, তার প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্যে মুখ ঘোরাতে ঘোরাতে। সরে সরে যেতে থাকা তার মুখে কঠোরতা আর নিগ্রহের ছাপ দেখে মনে হচ্ছিল, খুব বিপজ্জনক জীবনযাপন করে সে। হয়তো নিজের যন্ত্রণাকে চাপা দিতে ইচ্ছাকৃতভাবেই নির্মমতাকে  ব্যবহার করতে সে সক্ষম হয়ে উঠেছে।  আমার এ কৌতূহলের জন্যে আমার ভয় আর বিতৃষ্ণা হতে লাগল। চাইছিলাম, যাত্রাটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ হোক। প্রথম সেই তেতো চাউনিটা দেখেই আমার কেটে পড়া উচিত ছিল। সে আবার ব্রিফকেসটার দিকে তাকাল, এবং সেটাকে আমার আত্মম্ভরিতার প্রকাশ মনে করে বিদ্রুপের মতো হাসির একটা আভাস তার মুখের ওপর দিয়ে খেলে গেল। ওটা ছিল শক্ত ধারালো হাতল আর অকেজোপ্রায় জিপ লাগানো সস্তা একটা প্লাস্টিকের জিনিস, যেটা অল্প কয়েক মাসের বেশি টিকবে না বলে ধরে নিয়েছিলাম, এবং যেটা এমন তীব্র নিরীক্ষণের যোগ্যতা রাখে না।

‘কোথা থেকে?’ সে আবার জিজ্ঞেস করল, এবার কেসটার দিকে ইশারা করে সেটাকে তার অবগতির আওতায় আনতে। বললাম, ‘উইনগেরেজা৪ থেকে।’ আমি কথা বলছিলাম ভদ্রভাবে, অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে, এসব কথাবার্তায় আমার কোনো আগ্রহ নেই সেটা দেখাতে।

নাক দিয়ে হালকা ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করে সে বলল, ‘ছাত্র?’

সে বোঝাতে চাইছিল, আমি তাদের একজন কিনা যারা ভালোর জন্যে দুনিয়ার পথে বেরিয়ে পড়েছিল আর এখন ঘরে ফিরে যাচ্ছে শুধুমাত্র কিছু গপ্পোগাছা আর একটা সস্তা ব্রিফকেস নিয়ে। আমি কি সেসব ব্যর্থদের একজন, যারা লজ্জাকরভাবে নিচু শ্রেণির কোনো কাজকর্ম করেছে আর দেশের সবাইকে লিখে পাঠিয়েছে অন্তহীন লেখাপড়ার আর সুসময়ে ছোটখাট একটা সম্পদ আনতে পারে এমনতরো সব চতুর ব্যবস্থাপত্রের ভুয়ো কাহিনি? হাঁচোড় পাচোড় করে কী জবাব আমি খুঁজে বের করি তা লক্ষ্য করতে করতে তার চেহারা ছিল বিদ্বেষের খুশিতে ভরা। যখন সে আবার চলার দিকে মন দিল, আমি আশা করেছিলাম সে আমাকে বলবে যে, অন্যেরা সবাই বাইরে চলে যাওয়ার পর তার তরুণ বয়সে তার শিক্ষকরা আর ওস্তাদরা তার ওপর অনেক আশা রাখা সত্ত্বেও তাকে পেছনে পড়ে থাকতে হয়েছিল এবং একটা অসুস্থ পরিবারের দেখাশোনা করতে হয়েছিল। তাকে জানালাম, আমি একজন শিক্ষক, এবং সে আবার নাক দিয়ে আওয়াজ করল, এবার কোনো অস্পষ্টতার বালাই না রেখে। শুধু এটুকুই?

লাঞ্চ-টাইমের মানুষের ভিড় তাদের চিরন্তন তাড়াহুড়োয় স্রোতের মতো রাস্তা পারাপার করছে, গাড়িচালকদের সামান্যতম ইতস্তততার সুযোগ নিয়ে। এসব স্বাধীনতার মোকাবেলা করতে গিয়ে ট্যাক্সিচালকটি যখনই তার সামনেকার কোনো গাড়ি পথচারীদের অবকাশ দিচ্ছিল চালকের ভালোমানুষিতার সুযোগ নেয়ার, তখনই সে ঝুঁকে পড়ে হর্ন চাপছিল। গাড়িগুলোর মধ্যে দিয়ে ধীরেসুস্থে হেঁটে যেতে যেতে খুব উৎসাহের সঙ্গে গালগল্প করতে থাকা কিশোরবয়সী ভারতীয় স্কুলছাত্রদের একটা দল তার কাছ থেকে পেল হর্নের তীব্র দীর্ঘ বিস্ফোরণ আর খারাপ গালাগাল। নোংরা টোকাইয়ের দল। কী নিয়ে খেলছে ওগুলো? ট্রাফিক সবচেয়ে বেশি ছিল ডাকঘরটার কাছে। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল দলে দলে মানুষ। তাদের মধ্যে শার্ট আর টাই পরা কেউ কেউ ছুটছিল তাড়াহুড়ো করে। সবাই ব্যস্ত ব্যস্ত ব্যস্ত। আবার কেউ কেউ ধীরেসুস্থে হাঁটছিল, ফুটপাতের পসারীদের নকল আর নীরেস সব পসরা দেখতে দেখতে।

‘উইনগেরেজা,’ গানের সুরে কথাটা বলে সে বাঁয়ে ডকের দিকে মোড় নিল, যেখানে আমার হোটেলটার অবস্থান। ‘উইনগেরেজা,’ সে আবার বলল, ‘অনেক টাকার খেলা আর আরাম আয়েশের জায়গা।’

‘তুমি কখনো ওখানে গেছ?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, এবং আমার নিজের কানেই আমার অবিশ্বাসটুকু শুনতে পেলাম। তুমি? অবিশ্বাস সেই বেহায়া আর বেহেড সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে নিতে এতসব সংগ্রামের পর ওই হতচ্ছাড়া জায়গাটা সম্পর্কে এমন গা-ছাড়া মন্তব্য শুনতে পাওয়ার। আরাম আয়েশের জায়গা।

সামনে সামনে চলতে থাকা একটা জলবাহী ঠেলাগাড়িকে রাস্তা থেকে সরানোর জন্যে ট্যাক্সিচালক ভেঁপুতে নির্মমভাবে চাপ দিল। মনে হল, মিনিটখানেকের মতো সে একদম হারিয়ে গেল জলবিক্রেতার অস্তিত্বের মোকাবেলায়। ডান বাহুটা গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে বের করে দিয়ে সে এমনভাবে পানিওয়ালার দিকে দোলাচ্ছিল আর চেঁচাচ্ছিল, যেন যেকোনো মুহূর্তে সে গাড়ি থেকে বাইরে লাফিয়ে নেমে জলের ক্যানভর্তি পুরো ঠ্যালাগাড়িটাই উল্টে দেবে। ডক শ্রমিকরা যারা রাস্তার ধারের স্টলগুলো থেকে তাদের দুপুরের খাবার কিনছিল, এবং যারা ছিল পানিওয়ালার খদ্দের, তারা উৎফুল্লভাবে ট্যাক্সিচালকের দিকে চেয়ে হাত নাড়াচ্ছিল। সে ক্ষিপ্রবেগে ঠেলাগাড়িটার পাশ কাটিয়ে তার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল এবং যাওয়ার সময় লম্বা করে একটা হর্ন দিয়ে গেল।

‘ইংল্যান্ডে তোমার আত্মীয়স্বজন আছে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। আমি কল্পনা করতে পারছিলাম না যে, একটা ঝরঝরে ট্যাক্সি চালিয়ে জীবনধারণ করা এমন বদমেজাজি একজন মানুষের সেই আরাম আয়েশের জায়গায় একটা দুর্গন্ধযুক্ত বিছানায় একটা রাত কাটানোর আর সকালের প্রাতরাশের দাম দেয়ার মুরোদ আছে।

‘আমি সেখানে থাকতাম,’ কথাটা বলে সে আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসল। আমরা ততক্ষণে প্রধান রাস্তা ছেড়ে এসেছি আর এগিয়ে যাচ্ছি ডকের গুদামগুলোর এবং লোকো-ইয়ার্ডের পেছন দিয়ে। হোটেলে পৌঁছার আগটাতে এটাই শেষ পথটুকু। ক্রমশ উঁচিয়ে ওঠা আর খানাখন্দে ভর্তি আর রেললাইনের জন্যে খাড়া জাঙ্গাল ওঠানো রাস্তাটার দিকে তাকে নজর রাখতে হচ্ছিল। সে কথা বলতে শুরু করেছিল, কিন্তু রাস্তার সমস্যাগুলো আসছিল একটার পর একটা বড় বেশি তাড়াতাড়ি। সে মাথা নাড়ল, নিজের কাহিনিটা বরবাদ করার ইচ্ছে নিয়ে। হোটেলটা যেখানে ছিল সেখানে সেটার অবস্থান ভাবাটাই পাগলামো বলে মনে হচ্ছিল। ইয়ার্ডের অন্যদিকটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি আর শ্রমিকদের আবর্জনা। কিন্তু হোটেলটা ওখানেই ছিল, ডকের সামনেই, যেখানে রেললাইনগুলো ছড়িয়ে গেছে এলোমেলো জটলায়, আর রাস্তাটা ফুরিয়ে গেছে আরেকটু এগিয়েই।

‘আমার একজন মালায়া২ ছিল, ওই ইউরোপীয় বেশ্যাদের একজন। সে আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল, এবং ফ্রান্সে, এমনকি অস্ট্রেলিয়াতেও। আমরা সবজায়গায় গিয়েছি। সে-ই সবকিছুর দাম দিয়েছে। আপনারা লোকের কাছ থেকে এসব গল্প শোনেন আর ভাবেন ওরা মিথ্যে বলছে, ইউরোপীয় বেশ্যাদের স্বপ্ন দেখছে যাদের অনেক টাকা আছে অথচ ঘটে বুদ্ধি বলতে কিছু নেই। আমিও তেমনই ভাবতাম, যতক্ষণ-না আমার মালায়ার সঙ্গে দেখা হল।’ ততক্ষণে সে হোটেলের বাইরেটায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার গাড়িটা নিউট্রাল গিয়ারে কাঁপছিল। ‘স্লিম। সে আমাকে ডাকত স্লিম,’ ভাড়ার টাকা নিতে নিতে সে বলল, আর কথাটা মনে করে তার মুখ ভরে গেল হাসিতে। ‘আসলে আমার নামটা হল সলিম। আমি সবসময় ডাকঘরের পাশের ওই ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে থাকি। যেকোনো সময়ে আমাকে পাবেন।’

হোটেলটা আমি খুঁজে পেয়েছিলাম দৈবাৎ। ইমিগ্রেশান অফিসারটা আমাকে বুঝিয়ে বলেছিল যে, আমার ফর্মে এদেশে আমার কোনো ঠিকানা না দেখালে সে আমাকে এন্ট্রি পারমিট দিতে পারবে না। কথাটা সে বলেছিল ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গীতে, কারণ পাসপোর্টে আমার জন্মস্থান দেখে সে খুব উৎসাহের সঙ্গে জাঞ্জিবার নিয়ে কথা বলছিল, যেখানে তার নিজেরও আত্মীয় স্বজন আছে। সে আমাকে হোটেলের একটা তালিকা দেখিয়েছিল, বলেছিল — যেটা ইচ্ছে পছন্দ করে নিন। আপনাকে ওখানে থাকতে হবে না। শুধু ফর্মটা ভরার জন্যে। তাই আমি একটা বেছে নিলাম, এবং বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে শুধু এই একটা নামই আমার মনে পড়ল। এটার দুরধিগম্যতা, কর্মসময়ের বাইরে লোকো-ইয়ার্ডটা আর ওয়্যারহাউজগুলোর ভীতিকর নিঃস্তব্ধতা ঠিক যেন আমি যেমনটা চেয়েছিলাম তেমনই, যেহেতু এখানে কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে না, যেমনটা হয়তো আসত যদি আমি শহরের অন্যপাশে ক্যাসিনো আর পুল-সাইড কম্বো-সহ ঝাঁ-চকচকে প্রাসাদোপম হোটেলগুলোর একটাতে থাকলে।

তাই পরদিন সন্ধ্যায় হোটেলটার রিসেপশনিস্ট যখন জানাল কেউ একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, একটু অবাক হলাম। অবশ্যই এটা ছিল সলিম। সে যে আসতে পারে সেটা আমার মাথায় খেলেনি, কিন্তু এখন তো সে এখানেই। মনে হল, আমি সারাক্ষণই জানতাম যে সে আবার আসবে। তার পরনে ছিল সাদা সাদা ফুল আর নৌকার নকশা কাটা একটা খাটো হাতা রেশমি সবুজ শার্ট, যেটার বুকপকেট থেকে উঁকি দিচ্ছিল তার সানগ্লাসের একটা ডাঁটি। তার কর্ডুরয় জিন্সটা ছিল কোমরে ঢিলে, এবং জড়ো করে একটা বকলেস আঁটা বেল্ট দিয়ে বাঁধা। সে জোরাজুরি করে আমাকে দিয়ে একটা ড্রিঙ্ক কেনাল, এবং বারম্যানকেও একটা কিনে দেওয়াল। বারটা ছিল প্রায় ফাঁকা। যে-বেলজিয়ান দম্পতি এ হোটেলের মালিক, তারা তখন সেখানে একজন বান্ধবীকে আপ্যায়ন করছিল, এবং অন্যান্য লোকের মধ্যে তারাই কেবল ওখানে ছিল। ‘জঁ সঁ ইমপসিবল– এই লোকগুলো অসহ্য,’ তাদের অতিথি বিরক্তির সঙ্গে বলল, অবিচলিত নিশ্চয়তায় কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে তুলে। সে সুসজ্জিত, ছিপছিপে গড়নের, বছর চল্লিশের একজন মহিলা, আত্মসম্মানবোধে মসৃণ চকচকে। সলিম একমুহূর্ত এ তিন ইউরোপীয়ের দিকে তাকাল, যেন ওরা কী বলছে সে বুঝতে পেরেছে, কিন্তু ওরা তাকে খেয়াল করল বলে মনে হল না।

‘সে আমাকে এটা কিনে দিয়েছিল, আমার মালায়া,’ নিজের চকচকে শার্টটা আলতোভাবে উঠিয়ে নীল রঙের কর্ডুরয় জিন্সের আরো বড় একটা অংশ চিমটি দিয়ে ধরে সলিম বলল। সে হাসছিল, কিন্তু এবার বিদ্রুপ করে নয়, এবং বারম্যানকেও দলে টানতে কোনো দ্বিধা করল না। ‘ও কিভাবে আমাকে খুঁজে পেল জানতে চান?’ আমি আর বারম্যান দুজনই সম্মতিসূচকভাবে মাথা না নাড়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করল। ‘আচ্ছা, তাহলে শুনুন। উত্তরের উপকূলে তুম্বিলি হোটেলের বাইরে সে আমার ট্যাক্সি ভাড়া করেছিল। হোটেলটা আপনারা চেনেন? আমি তাকে ওটার প্রবেশপথের কাছে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, যেন সে কারো জন্যে অপেক্ষা করছে। হোটেলের চাকররা আমাদের ড্রাইভে ডেকে নিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত সাধারণত এরা হোটেলের বাইরে আসে না। ওরা এই বেবুনগুলোকে কী পরায় দেখেছেন? ওগুলোকে ওরা ওখানে নিয়ে আসে পাহাড় থেকে, আর তারপর তাদের হলদে নালপোশ আর কালো বো-টাই পরিয়ে দেয়। তারপর ওই পোশাকের জন্যে টাকা দিতে ওদেরকে বাধ্য করে। আমি সেটা জানি।’ বারম্যানের পরনে ছিল শাদা শার্ট, কালো বো-টাই, এবং তার পেটের কাছটায় বাঁধা ছিল একটি হলুদ অ্যাপ্রন, এবং সম্ভবত তার এ পোশাকের জন্যে তাকেও দাম দিতে হয়েছে, কিন্তু এতে তার কোনো অস্বস্তি হচ্ছে দেখানোটা সে চেপে যেতে পারল।

‘সে যাই হোক,’ সলিম বলে চলল, ‘আমার মনে হল সে ওখানে কারো জন্যে অপেক্ষা করছে তাকে তুলে নেয়ার জন্যে। কিন্তু তারপরও আমি ভাবলাম একবার চেষ্টা করে দেখি। সে খুব অল্পবয়সি ছিল না, তবে তেমন বেশিবয়সিও ছিল না। সে আমার কথা একটুক্ষণ শুনল। জানেন, আমি তাকে যখন সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় সব ঘুরে দেখানোর সেই গৎ বাঁধা কথাগুলো বকবক করছিলাম, সে একটুক্ষণের জন্যে মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনে, তারপর গাড়িতে উঠে পড়ল। আমি তাকে নিয়ে সারাদিন ঘুরলাম, সেই মালিন্দি, ওয়াইটামু, টাকাউঙ্গু পর্যন্ত। আমি তাকে ওই জায়গাগুলো সম্পর্কে সবকিছু বললাম। আমার মন চাইলে বা সে কঠিন কোনোকিছু জিজ্ঞেস করলে কিছু কিছু কথা বানিয়ে বানিয়েও বলছিলাম। সন্ধ্যাবেলা আমি তাকে যখন হোটেলে ফিরিয়ে আনছিলাম, তখন সে আমাকে সমুদ্রের ধারে টেনে নিয়ে গেল এবং আমরা সেখানে ওটা করলাম। বালুর ওপর, খোলা আকাশের নিচে, একজোড়া কুকুরের মতো। তারপর রোজ এরকম হতে লাগল। আমি তাকে সকালবেলা তুলে নিতাম, বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতাম, নানান গল্প বলতাম, তারপর অন্ধকার হয়ে এলে সী-বিচে নিয়ে যেতাম। এভাবে কযেকদিন যাওয়ার পর সে আমাকে তার সঙ্গে উলায়া যেতে বলল। সে-ই সবকিছু ঠিক করল। টিকেট, পাসপোর্ট। সবকিছুর দাম দিল সে-ই।’

‘সমুদ্রের ধারে তোমার কাজ নিশ্চয় খুব ভালো হয়েছিল,’ আমি বললাম, নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু বলার জন্যেই বলা। কারণ আমি বিশ্বাস করিনি যে, অমন দৈবাৎ পরিচয় হওয়া একজন মহিলা সলিমের মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো বিপদের আশঙ্কা করেনি। আর তা ছাড়া আফ্রিকান পুরুষাঙ্গের জন্যে উন্মত্ত ইউরোপীয় লালসার আরেকটি কাহিনি শোনার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। বারম্যান নিঃশব্দে হাসতে লাগল, আর সলিম একে একে আমাদের দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে একটু আঘাত পেয়েছে বলে মনে হল।

‘আমাকে স্লিম বলে ডাকুন,’ সে বলল। তারপর সে তার গ্লাসটা খালি করে আমার দিকে সামান্য ঠেলে দিল। ‘বিদেশি টাকা ভাঙালে সেটা তেমন বেশি কোনো টাকা নয়। আপনারা সেটা জানেন। আর সে যাই হোক, টাকা কিন্তু তার প্রচুর ছিল।’

আমি তার ড্রিঙ্কের দাম চুকিয়ে দিয়ে, ওখানে বসে তার মালায়ার আরোকিছু গল্প শুনলাম। বিবাহবিচ্ছিন্ন হওয়ার পর নিজের ভাগের টাকাটা পেয়ে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দেশভ্রমণের। সলিমকে সে তার জন্মস্থান লিভারপুলে নিয়ে গেল, যেখান থেকে তাকে শিশুবয়সেই সঙ্গে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গিয়েছিল তার বাবা-মা। সলিমের জন্যে ব্যাপারটা কি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল? মহিলাটির জন্যে? সলিম কাঁধ ঝাঁকাল। মহিলাটি সবকিছুর ব্যবস্থা করেছে, সলিমকে বিভিন্ন জিনিস দেখিয়েছে, এবং খানকিটা রোজ রোজ সেক্স করতে চাইত, এমনকি কোনো কোনোদিন দু-তিনবারও। ওটা অবশ্য কঠিন ছিল না। তারা ওখানে কয়েক সপ্তাহ ছিল। সলিম সেখানে কাছেপিঠে থাকে এমন দুজন বন্ধুও বানিয়ে ফেলল। দুজনই মুসলিম, একজন সোমালির, আরেকজন মরিশাসের। তারা তাকে শেখাল কিভাবে ভাতা নিতে হয়। তখন সে আর তার মালায়া একটা বিলাসী জীবন যাপন করত। ইংরেজ সরকার বড় নির্বোধ। লিভারপুল কালো মানুষে ভর্তি — আচাঁছা বদমাশ সব। ওরা ওদের যা ইচ্ছে তাই করে, আর সরকার শুধুমুদু তাদেরকে টাকা দেয়। ইংরেজ মহিলারা সারাক্ষণ তাকে ছুঁয়ে দেখত, তার চুলে হাত বোলাত, তার গা-ঘেঁষে বসত আর তাকে ড্রিঙ্ক কিনে দিত। এর কয়েক মিনিট পর আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম। বললাম, আমাকে কয়েকটা চিঠি লিখতে হবে।

পরদিন সন্ধ্যায় সে আবার এল, আরেকটা ফুলছাপ শার্ট পরে। আমি রিসেপশনিস্টকে বলে রেখেছিলাম, সলিম এলে যেন আমি নেই বলে জানানো হয়। কিন্তু সম্ভবত সে অন্য কোনো আনুগত্যের বন্ধনে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল, যা আমি বুঝতে পারিনি। ভাবলাম, রিসেপশনিস্টের ডেস্কের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কাঁধের ওপর দিয়ে সলিমের দিকে একটা কথা ছুঁড়ে দিয়েই বোধহয় চলে যাব। কিন্তু দেখলাম, ডেস্কে আজ নতুন একটা তরুণ কাজ করছে। ‘এটা কিনেছিলাম অস্ট্রেলিয়ায়,’ সলিম বলল তার গায়ের শার্টটা দেখিয়ে। ‘ফ্রান্স থেকে আমরা ওখানে গিয়েছিলাম। বেটি। তার নাম ছিল বেটি। আসলে নামটা ছিল বেথানি, কোনো ধরনের একটা ধর্মীয় নাম, কিন্তু সে নিজের নাম বেটি-ই বলত। আপনি কাল রাতে কোনো ক্লাবে যেতে চান? আপনি তো আরো একরাত এখানে থাকছেন, তাই না? মাজেঙ্গোর ওদিকে একটা চমৎকার জায়গা আছে। এসব টুরিস্টদের আবর্জনা নয়। কাল আমরা ওখানে যাব। অস্ট্রেলীয় মহিলারা সবসময় এটা চায়, কিন্তু তাদের পুরুষগুলোর কোনো নিয়োগে৩ নেই। তাই ওদের মেয়েছেলেগুলো সবসময় গরম হয়ে থাকে। কামের আগুনে জ্বলছে। আর ওদের সঙ্গে গেলে আমার মালায়া কিছু মনে করত না।’

এছাড়াও সে আরো অনেককিছু বলল– তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্যে ওই মহিলারা যেসব ব্যবস্থা করেছিল আর পরে কেমন নির্লজ্জভাবে তাকে ফেলে চলে গিয়েছিল, সেসবের বিস্তারিত বর্ণনা।

‘তোমাকে এখানে আবার ফিরিয়ে আনল কে?’ শেষপর্যন্ত আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাহিনিটার সমাপ্তি টানার আশায়।

‘খেলা তো একসময় তো বন্ধ করতেই হয়,’ সে ঘৃণার সঙ্গে বলল, ‘আর আপনার নিজের মানুষদের কাছে ফিরে আসতে হয়। অন্য সব জায়গায় শেষপর্যন্ত আপনি তো একটা ভাঁড় হয়েই বেঁচে থাকবেন।’

বিদায় নেয়ার জন্যে এটাকেই সর্বোত্তম মুহূর্ত মনে হল, কিন্তু সলিম সম্পূর্ণ ব্যবসার মনোভাব নিয়ে আমাকে নাছোড়বান্দার মতো আটকে রাখল। সে আমার হাতের কব্জিটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কতক্ষণ ধরে রইল, এবং তারপর আমার টাকায় আরেক দফা পানীয় পরিবেশনের অর্ডার দিল। বারম্যান ড্রিঙ্ক সার্ভ করে বিলে আমাকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়ে ফিরে গেল, সলিম যে আমার হাত ধরে আছে সেদিক থেকে তার চোখ খুব সাবধানে সরিয়ে রেখে। বারে তখন আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। পানীয় আমাদের সামনে চলে আসার পর সে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগল। আমার কব্জির যেখানটায় সে ধরেছিল, সেখানকার মাংসে একটা ঠান্ডা বৃত্ত রেখে গেল সে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হলাম। দেখলাম, সে আমাকে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু তারপর আবার মন বদলে ফেলল। ‘আপনার ড্রিঙ্কটার কী হবে? অসুবিধা নেই, আমিই খেয়ে নেব। তাহলে আপনার সাথে কাল দেখা হচ্ছে,’ সে বলল। ‘ক্লাবটার কথা মনে আছে, নাকি ভুলে গেছেন?’

সে আবার এলে আমি কী করব সে-ব্যাপারে সারাদিন কিছু না ভাবার চেষ্টা করলাম। দিনটাকে আমি আলাদা করে রেখেছিলাম আমার গত সপ্তাহের কয়েকটা পরিদর্শন আর সাক্ষাৎকারের কিছু নোট টুকে রাখার জন্যে। কিন্তু মাথার মধ্যে সলিমের আসার সম্ভাবনা গজিয়ে রেখে কাজটা করা এক অসম্ভব গোছের ব্যপার হয়ে দাঁড়াল। নোট টুকে রাখার কাজটার মধ্যে কোনো বিশেষ সুখ বা কষ্ট নেই, মনোযোগ নষ্ট করার বা উত্তেজিত করে তোলার মতোও কিছু নেই। এতে শুধু দরকার এমনসব ঘটনার ব্যাপারে ক্লান্তিকর মনোযোগ, যেগুলোর প্রভাব ইতোমধ্যেই কেটে গেছে। সন্ধ্যের দিকে আমি নিজের মনকে বোঝালাম যে, আমার অত নিটপিটে হওয়াটা বোকামিমাত্র। আমি এসেছিলাম পান্ডু কাসিম নামে স্বল্পপরিচিত একজন কবির ব্যাপারে কতটুকু জানা যায়, সে-ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে। গত শতকের শেষের দিকে তিনি এখানে বাস করতেন। আমি ভাবছিলাম তাঁকে নিয়ে কিছু করা যায় কিনা, এবং সে-ব্যাপারে মাজেঙ্গোর ওপাশের নৈশ ক্লাব আমাকে কোনো সাহায্য করতে পারবে কিনা। কিন্তু সলিমের সাথে গেলে তাতে কোনো ক্ষতি তো হবে না, বরং হয়তো কিছু কাজে আসতেও পারে। পান্ডু কাসিমের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে গিয়ে আমি তেমন কৌতূহলোদ্দীপক কোনো তথ্য পাইনি। একটা নাইট ক্লাব, সলিম যেটার গুণকীর্তন করছে, হয়তো আমাকে তা দিতে পারবে। আমি নিজে কখনো গন্তব্য হিসেবে অমন জায়গা বেছে নেব না, এবং আমি এটুকু বলে সন্তুষ্ট হব যে, শহরটির তেলতেলে তলপেটের সঙ্গে কোনো পরিচয় ছাড়াই এটাকে আমি ভালোভাবে চিনি। তবে পরিচয় হলেও সেটা কিঞ্চিৎ বমনোদ্রেক ছাড়া আর কী-ই বা ক্ষতি করতে পারে। আমি সলিমের বন্ধুচক্রে অন্তর্ভুক্ত হতে চাইছি না, যারা সব সলিমের মতোই লোম খাড়া করে দেয়া গোছের লোক হবে বলেই আমার মনে হচ্ছিল। তবে কিনা ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে আমার তখন আর দুদিন মাত্র বাকি। এটুকু সময়ের মধ্যে আমার অত বেশি ক্ষতি হতে পারে বলে মনে হল না। নোটগুলোকে আরো একটু অপেক্ষা করতে হবে, এবং আমাকে হয়ত একটা একঘেয়ে সন্ধ্যা কাটাতে হাস্যকরভাবে ভোলাভালা মহিলাদের ওপর যৌন বিজয়ের কেচ্ছাকাহিনি শুনে। কিন্তু সেটা কি সলিমকে তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা আর নিজেকে তার রাগ আর বিদ্বেষের পাত্র করে তোলার চেয়ে শ্রেয় নয়?

তাই সলিম যখন এসে পৌঁছল, আমি তখন তার সঙ্গে বেরুনোর জন্যে তৈরি। আমি এমনকি এমনটাও ভাবতে শুরু করেছিলাম যে, তার গল্পগুলোর সত্যতার ব্যাপারে সন্দেহ করার জন্যে আমাকে শাস্তি দিতে সে হয়তো আসবেই না। ওপরতলা থেকে যখন নেমে এলাম, সে তখন গাড়ির মধ্যে মুখ ভার করে বসে ছিল। বিড়বিড় করে আমাকে সালাম জানিয়ে সে গাড়িতে স্টার্ট দিল। এমন চমৎকার স্বাগত সম্ভাষণ আমার ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলল অশুভ আশঙ্কায়। কেন আমি স্রেফ তাকে চলে যেতে বললাম না? ফাঁকা চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি সেদিকে কোনো মনোযোগ না দিয়ে, যদিও আমরা কোথায় আছি সেটা আমার ভালো জানা ছিল। কিন্তু আমার মনোযোগ নিশ্চয় অন্যত্র সরে গিয়েছিল, কারণ হঠাৎ করেই আমি বুঝতে পারলাম যে, সলিম সড়কটি থেকে পাশের একটা খানাখন্দময় আর আলোহীন রাস্তায় নেমে গেছে। চারপাশ থেকে ঝোপঝাড়গুলো আমাদের ওপর চেপে আসছিল। গাড়ির আলোর আনুভূমিক রশ্মিগুলো অনুভূতিটাকে আরো কষ্টকর করে তুলছিল। মনে হচ্ছিল, আমরা যেন মাটির নিচে দিয়ে চলছিলাম। এটা ছিল একটা স্নিগ্ধ, ফুরফুরে হাওয়ার সন্ধ্যা। কিন্তু এই সুড়ঙ্গটার মধ্যে বাতাস ছিল ভাপ আর ভেজা মাটির গন্ধে ভর্তি। সলিম আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালে দেখতে পেলাম, সে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। ‘আর খুব বেশি দেরি নেই,’ কথাটা বলে সে গুনগুন করে সুর ভাঁজতে লাগল। রাতের আঁধারে একটা কুকুর ডেকে উঠল এবং এক মুহূর্ত পর অন্ধকার ঝোপগুলো আলোড়িত হল কিছুর চলাচলের শব্দে। পরের মুহূর্তেই সলিম গাড়িটাকে জোর করে একটা ছোট ঢিপির ওপর নিয়ে গিয়ে তুলল এবং বিশাল বিশাল কালো গাছের ঘেরার মাঝখানে একটা সাফ করা জায়গায় গিয়ে ঢুকল। ওখানে বাড়িগুলোর একটার বাইরে আরেকটা গাড়ি পার্ক করা ছিল। ওখানে নিশ্চয় আরো তিন-চারটি বাড়ি ছিল, কিন্তু এত অল্প আলোতে সেটা ঠিকমতো বলতে পারা সম্ভব ছিল না। সলিম তার গাড়িটা অন্য গাড়িটার পাশে নিয়ে গিয়ে পার্ক করল।

ক্লাবটা দেখা গেল মাটি আর কঞ্চির তৈরি একটা বাড়ির সামনের কামরা, কেরোসিন বাতিতে স্বল্পালোকিত। আরো দুজন লোক আগে থেকেই সেখানে ছিল, এবং তারা উঠে দাঁড়িয়ে এমনভাবে আমাদের স্বাগত জানাল যেন আমাদের অপেক্ষায় ছিল। ‘ইনি উইনগেরেজা থেকে এসেছেন, আমাদের মেহমান,’ সলিম দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল।

লোক দুটোর একজনকে মনে হল সলিমের বয়সী, এবং চেহারাটাও একই রকমের মারমুখী ধরনের। অন্যজন বয়সে ছোট এবং আকারে বড়। সে যখন আমার দিকে তাকাল তখন তার মুখে একটা চাপতে না পারা ব্যাঙ্গের হাসি খেলে যেতে দেখলাম। তার নাম ছিল মজিদ। বয়সে বড় লোকটার নামটা আমি প্রথমে ঠিক রাখতে পারিনি। (পরে দেখা গেল তার নামটা হল বূদা)। এমনকি আমরা এবড়োথেবড়ো পুরোনো টেবিলটা ঘিরে বসার আগেই মজিদ বিয়ারের জন্যে হাঁকাহাঁকি শুরু করল। পেছনের কক্ষটি থেকে দেখা দিল অনিশ্চিত মধ্যবয়সের এক মহিলা। তার পরনে ছিল বহুব্যবহারজীর্ণ এবং বগলের নিচে কালো ছিট পড়ে যাওয়া একটা আঁটসাঁট জামা। তার মাথা ছিল একই কাপড়ে বানানো একটা ওড়নায় ঢাকা। তার কোমরে জড়ানো ছিল একটা রঙচটা কাঙ্গা। কয়েক মুহূর্তের উদ্দাম হাসিঠাট্টার পর এবং কিছু জোর করা উল্লাস প্রদর্শনের পর মহিলাটা আবার বেরিয়ে গেল আমার আমুদে বন্ধুদের অর্ডার দেয়া খাবার তৈরি করতে।

টেবিলের ওপর ছিল সব খালি বিয়ারের বোতল, এবং সেগুলো সেখানে থেকে যাবে মদ্যপায়ীদের পানবীরত্বের ট্রফি হিসেবে। মজিদ আর অন্য লোকটির হাতে ছিল দুটো আধখালি বোতল, যেগুলো থেকে তারা মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছিল, ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে বিয়ারে ফেনা তুলে নিজেদের ঠোঁটে বোতলের মুখ উপুড় করে। বোতলগুলো ছিল বড় বড়। কোনো গ্লাস কিন্তু চোখে পড়ছিল না। সলিম যখন ক্লাবে যাওয়ার কথা বলেছিল তখন আমি অন্যকিছু ভেবেছিলাম, এরকম জঙ্গলের মধ্যে একটা অন্ধকার বাড়ির কথা ভাবিনি, যেখানে পুরুষমানুষরা গোপনে মদ্যপানের জন্যে সমবেত হয়।

‘ওরা আরোকিছু নিয়ে আসবে,’ আমাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গীতে বূদা বলল। তার ভাবসাব ছিল যেন সে কোনোমতে রাগ চেপে রেখেছে, আর সলিমের মুখে যেমনটা দেখেছি সেরকম তারও গোমড়া মুখে ছিল ফুলতে থাকা বিদ্বেষের ছাপ। হয়তো মদ্যপানের কারণেই এটা হয়েছিল। এরকম একটা মুসলিম শহরে, যেখানে ধরা পড়ে যাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী, সেখানে নিজের পছন্দমতো কিছু করা অসম্ভব এবং কাউকে মদ্যপায়ী হতে হলে মদ জিনিসটার বাপারে তাকে সিরিয়াস, এমনকি তীব্রভাবে আসক্ত হতে হবে। হয়তো এই স্বেচ্ছাচারিতা বা নিয়মবিরুদ্ধতাই তার মনে নিজের প্রতি একটা ঘৃণা জাগিয়ে তুলেছে, অথবা অভাবের একটা সংস্কৃতিতে হাতের কাছে ধ্বংসাত্মক যে-বিষই পাওয়া যায় তা-ই গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তাই এই বেদনার ছাপ ফুটিয়ে তুলেছে। অথবা এর পেছনে ছিল অপ্রশমিত কোনো অনুতাপ যা এধরনের মানুষগুলোকে সব বাধানিষেধ সত্ত্বেও মদ্যপানে প্রণোদিত করে। আমি কী করে জানব?

‘দেখতে পাচ্ছি তোমরা কেউ আজ মাগরেবের নামাজে যাওয়ার পরোয়া করছ না,’ তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের সুরে সলিম বলল, টেবিলের ওপর খালি বোতলগুলোর দিকে ইশারা করে।       বাকি দুজন তার এই ব্যঙ্গবিদ্রুপে অট্টহাস্য করল এবং সলিমও মৃদু হাসল দ্বিধান্বিতভাবে, চেপে রাখা ঠোঁট দুটো ঈষৎ ফাঁক করে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন সে জ্বলছে।

বূদা ছিল বেঁটে আর গোলগাল গড়নের, মানে মোটাই বলা যায়। কিন্তু তার শরীরটাকে বেশ আঁটসাঁট আর শক্তপোক্ত দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যেন তার এই শারীরিক স্থূলতা শুধুমাত্র কোনো ভোগবিলাসকে প্রশ্রয় দেয়ার কারণে নয়, বরং তার চেয়ে বেশি কোনো হিসাব-নিকাশ করে করা। কথা বলার আগে সে ভুরু কুঁচকে আমার দিতে তাকাল, খেলাচ্ছলে, দানব সাজার খেলা। ‘আমাদেরকে উইনগেরেজার খবর বলুন। এটা কি সত্যি যে ওখানে জলের তলা দিয়ে ট্রেন চলে?’

‘এই গাঁইয়াটার কথা শুনুন,’ সলিম চিৎকার করে বলল। তুমি কখনো আন্ডারগ্রাউন্ডের কথা শোননি?’

তোমার কথা শুনে এই ইংরেজ ভদ্রলোক ভাববেন আমরা সবাই তোমার মতন অজ্ঞ,’ মজিদ বলল, কন্ঠস্বরে সৌজন্যের ন্যূনতম আভাস ছাড়াই।

ভেতরের কামরা থেকে ছেঁড়া আর ময়লা খাটো জামা পড়া একটা মেয়ে দু বোতল বিয়ার নিয়ে বেরিয়ে এল। তার চোখ দুটোর দৃষ্টি ছিল তীব্রভাবে শূন্য, কিছুটা মনোযোগ দিয়ে তাদের সামনে যা পড়ছে তার মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে থাকা। মেয়েটা বিয়ারের একটা বোতল আমার সামনে রাখল। সে যখন সামনে ঝুঁকল, তখন তার বগলের নিচে জামাটার একটা ছেঁড়ার মধ্যে দিয়ে দেখতে পেলাম, তার দেহ তরুণ এবং পরিপূর্ণ। সে অন্য বোতলটা সলিমের সামনে রাখল, এবং সলিম তার পাছা চাপড়ে দিলে সে ভুরু কুঁচকে ছিটকে সরে গেল।

‘আজিজা, উলায়া থেকে আসা আমাদের বন্ধু তোমাকে চান,’ দুটো জোর দমকে হেসে উঠে মজিদ হঠাৎ বলে উঠল।

মৃদু কৌতূহল নিয়ে আমার দিকে তাকাল মেয়েটি। তারপর সে ওখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, যেন এর পর কী ঘটতে যাচ্ছে তা দেখার জন্যে।

‘ওর সঙ্গে যান,’ সলিম বলল, একটা লাশের মতো আমার দিকে দাঁত কেলিয়ে। আমি মেয়েটিকে আবার ভুরু কুঁচকাতে দেখলাম।

আমি মেয়েটার দিকে, তার ধারালো মুখাবয়ব আর তন্বী তরুণ দেহের দিকে, তাকালাম, এবং সেখানে প্রতিরোধের কোনো চিহ্ন দেখতে পেলাম না। আমি  না-বোধকভাবে মাথা নাড়লে সে মুখ নিচু করে ফেলল। তারপর পেছন ফিরে চলে যেতে লাগল ভেতরের কামরার দিকে। মজিদও বেশ আত্মম্ভরী চালে তার পায়ে পায়ে যেতে থাকায় সে ইতোমধ্যেই তার জামা টেনে ওপরের দিকে তুলছিল। বূদা অমায়িক হেসে ইংল্যান্ড সম্পর্কে আমাকে নানারকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগল। সেগুলোর বেশির ভাগের জবাব দিল সলিম, মাঝে মাঝে আমার সম্মতিসূচক দু-একটা কথা আদায় করে। আমার মনে হল, এক পর্যায়ে আমি এমন এক তীব্র স্বর শুনতে পেলাম যেটাতে কেরোসিন বাতিটির শিখাটা পর্যন্ত দপ কর উঠল। মনে হচ্ছিল, মজিদ ভেতরে গেছে অনেকক্ষণ, এবং যখন সে বেরিয়ে এল তার চেহারাটা জ্বলজ্বল করছিল, তার তেলেতেলে মুখ চকচক করছিল স্বাস্থ্যের আভায়।

‘কাজ করে তেষ্টা পেয়ে গেছে,’ তার রেখে যাওয়া বোতলটার দিক হাত বাড়াতে বাড়াতে সে বলল। বোতলটা উপুড় করে অবশিষ্ট সব মদ গলায় ঢেলে একটা বিজয়ের হাসি দিয়ে সেটা নামিয়ে রাখল। ‘আমার মনে হয়, এবার ইংরেজ সাহেবের পালা।’

ওরা আজিজাকে ডাক দিল এবং একটু পর সে চলে এল। তা চোখের দৃষ্টি আগের মতোই তীব্রভাবে শূন্য, মুখটা ভার হয়ে আছে। আমি এদের জন্যে বিয়ারের অর্ডার দিলাম, এবং সলিমকে বললাম, তার বিয়ার পান শেষ হলে আমি বেরিয়ে যেতে চাই। বূদা জিজ্ঞেস করল, আমরা যে-খাবারের অর্ডার দিয়েছি তার কী হবে। আমি বললাম, আমার কাজ আছে। মেয়েটা বিয়ার নিয়ে আসার পর বূদা উঠে দাঁড়িয়ে হালকা পায়ে তার পেছন পেছন ভেতরের ঘরে চলে গেল।

‘কী কাজ?’ মজিদ জিজ্ঞেস করল, তার মুখে হাসির কোনো চিহ্ন নেই। ‘আপনি মেয়েছেলেদের পছন্দ করেন না? ওখানে ভেতরে গিয়ে কাজ করুন। নাকি আপনি মেয়েছেলেদের পছন্দ করেন না? ওর সঙ্গে মেয়েটার করার কোনো কাজ নেই,’ থুতনি তুলে সলিমের দিকে ইশারা করে মজিদ বলল। ‘তুমি ওকে কী করেছ?’

সলিম তার বোতলে লম্বা একটা চুমুক দিল। ‘আমি একটা বিয়েতে যাব,’ বোতলের পানীয়টা শেষ করে সে বলল। ‘তাই আমরা তোমাদেরকে তোমাদের নোংরা খেলায় রেখে চলে যাচ্ছি।’

‘তুমি ওকে কী করেছ, নোংরা দুশ্চরিত্র কোথাকার?’ মজিদ জিজ্ঞেস করল, তার জীবনের এক সেরা আনন্দে দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে।

আমরা বিয়ের অনুষ্ঠানটায় গিয়ে পৌঁছলাম ঠিক সে-সময়টাতেই, যখন বরকে নিয়ে তার পরিবার আর বন্ধুদের শোভাযাত্রা কনের বাড়ির দরজায় এসে পৌঁছাচ্ছে। খুব রোগা এবং দেখতে একই রকম দুজন অল্পবয়সী বাদক কঠিন নিরাবেগ চেহারায় তাদের ঢোল দুটো বাজিয়ে চলেছিল, অত সব গোলমালের মধ্যে তাদের চোখ দুটো ভেতরের দিকে নিবদ্ধ। তালপাতা দিয়ে বানানো ধনুকাকৃতি খিলান দিয়ে বাড়িটি সাজানো, এবং সামনের দেয়ালটিকে জড়িয়ে চলে গেছে রঙিন আলোর একটি মালা। বাড়িটার ভেতর থেকে মহিলাদের গানের শব্দ শোনা যাচ্ছিল, বাড়ির দরজায় বর এসে পৌঁছার পর যা রূপান্তরিত হয়ে গেল উল্লসিত উলুধ্বনির হঠাৎ বিস্ফোরণে। চারদিকে মানুষের ভিড় জমে গেল। বরের উদ্দেশ্য চেঁচিয়ে নানা রগরগে মন্তব্য করছিল ওরা, আর তারপর বরকে ভেতরে বরণ করে নেয়ার পর ফেটে পরল প্রচণ্ড উল্লাসে। বিয়ের ভোজের যে-খাবার আসছে বলে ওরা জানে, তার খোঁজে ছেলেপিলেদের চোখ চারপাশে ঘোরাঘুরি করতে শুরু করেছে। সলিম উপহাসের ভঙ্গীতে নাক দিয়ে শব্দ করল। বলল, ‘যে মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে, সে আমার স্ত্রীর পক্ষের আত্মীয়দের একজন।’

তার যে একজন স্ত্রীও থাকতে পারে, সেটা আমি ভাবিনি। ‘বেথানির সঙ্গে চলে যাওয়ার আগে তুমি বিবাহিত ছিলে?’ সে যখন আমাকে হোটেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম। নামটা সুন্দর। ভাবছিলাম, কোথায় ওটা ব্যবহার করা যায়।

সে বলল, ‘হ্যাঁ।’ আমরা যাচ্ছিলাম লোকো-ইয়ার্ডের দিকে চলে যাওয়া স্বল্পালোকিত রাস্তাটি দিয়ে, কিন্তু এমনকি অত কম আলোতেও তার চেহারায় আমি রাগ আর বিদ্বেষের ছাপ দেখতে পাচ্ছিলাম। ‘তার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে অনেকদিন আগে।’

জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি তার কারণেই ফিরে এসেছ?’

সে মুখ টিপে হাসল। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে, ভাঙা রাস্তাটির ওপর গাড়ির গর্জনের মধ্যে সে বলতে লাগল। ‘শেষে সে আমাকে কিছু একটা দিল। সেই মালায়া। তার সাথে সঙ্গম করার সময় রক্ত বেরিয়ে আসত। সে আমাকে এক ডাক্তারের কাছে পাঠাল। ডাক্তার বলল ওটা কিছুই না। কিন্তু বেটি বলল আমি তার কাছে থাকতে পারব না। আমি জানি না জিনিসটা কী, কিন্তু কোনো মেয়েছেলের সঙ্গে সঙ্গম করলেই আমার রক্ত বেরিয়ে আসে।’

হোটেলের বাইরে গিয়ে থামার আগপর্যন্ত আমরা নির্বাক গাড়ি চালিয়ে গেলাম। গাড়ি থেকে নেমে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ফিরে আসার পর তুমি এখানে কোনো ডাক্তারের কাছে গিয়েছ?’

‘কিসের ডাক্তার? এখানে কোনো ডাক্তার নেই,’ সে বলল, সামনের দিকে তাকিয়ে। তারপর সে আমার দিকে মুখ ফেরাল একটা লাজুক, ভদ্র হাসি নিয়ে। ‘কাল আমাকে আপনার সঙ্গে নিয়ে যান। আমি সেখানে একজন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করব। আমাকে নিয়ে যান। আপনি যা যা চাইবেন সব আমি করব।’ সে আমার দিকে ঝুঁকে এল, ওই অদ্ভুত অতিমাত্রায় উত্তেজিত মুখে তার হাসি এখন নিজেকে তুলে ধরল মিনতির সঙ্গে।

সে পরদিন আমাকে বিমানবন্দর নিয়ে যাওয়ার জন্য এল, যদিও আমি নিজেই যাওয়ার ব্যবস্থা করে নেব বলে তাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম। সে কথা বলতে লাগল তার স্বভাবগত বিদ্বেষ আর ঔদ্ধত্য নিয়ে, চোখে যা-ই পড়ছিল তাকে উপহাস, ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে। এমনকি যখন আমি তাকে বললাম যে, সে আমাকে নামিয়ে দিয়ে যেন চলে যায়, তারপরও সে গাড়িটা পার্ক করে হাতে একটা গোটানো পত্রিকা নিয়ে আমার পাশে পাশে হাঁটতে লাগল।

 

‘এ ধরনের একটা অ্যাটাচি কেসের দাম কত পড়ে? পরের বার আমার জন্যে একটা নিয়ে আসবেন। অথবা আমার জন্যে একটা পাঠিয়ে দেবেন, এবং আপনার টাকাটা যাতে পেয়ে যান সেটা আমি নিশ্চিত করব। ওই ধনদৌলতের দেশে আমার টাকা যে আপনার লাগবে, তা নয়। যদিও শিগগিরই এসব খেলাধূলা বন্ধ করে আপনি ঘরে ফিরবেন, সে বলল। ‘সবাইকে ফিরতে হয়, নয়তো তারা বিদেশে বিভুঁইয়ে একটা ভাঁড়ে পরিণত হয়।’

আমি তার সঙ্গে করমর্দন করে আমার সঙ্গে স্থানীয় মুদ্রায় যত টাকা ছিল সব তাকে দিয়ে দিলাম। সে নোটের বড়সড় তাড়াটির দিকে অবাক চোখে তাকাল। বললাম, ‘আশা করি, তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে।’

‘আপনি কিসের কথা বলছেন?’ দাঁত কেলিয়ে হেসে সে জিজ্ঞেস করল। টাকাটা পকেটে রাখতে রাখতে সে বলল। ‘পরের বার আপনি অবশ্যই থাকবেন,’ সে বলল। তারপর সে চলে গেল, একবারও পেছনে ফিরে না তাকিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে।

…………………………………………………………।।

১আফ্রিকার সোয়াহিলি ভাষায় এর মানে হল– ‘কোথা থেকে আসছ’।

২সোয়াহিলি ভাষায় এর মানে হল– ‘বেশ্যা’ বা ‘পতিতা’।

৩সোয়াহিলি ভাষায়– ‘যৌনকামনা’।

 

 

 

জ্যোতির্ময় নন্দী, কবি ও অনুবাদক

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাহিত্য-গবেষণার আলোকবর্তিকা

শাহেদ কায়েস   আহমদ রফিক (জন্ম: ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-মৃত্যু: ২ অক্টোবর ২০২৫) বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুবনে আহমদ রফিক একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে

অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

আন্দরকিল্লা ডেক্স \ চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের আত্মজীবনী ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

ফেরা

সৈয়দা মাসুদা বনি   নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন   রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু! মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে

চিরহরিৎ বৃক্ষের গল্প

সুজন বড়ুয়া   ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়।