এখন সময়:বিকাল ৪:২৯- আজ: শুক্রবার-৭ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২২শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:বিকাল ৪:২৯- আজ: শুক্রবার
৭ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২২শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

ডরোথি জুল্লের নির্বাচিত কবিতা ও সলিমুল্লাহ খান

মুহাম্মদ ইসহাক

জার্মান কবি ডরোথি জুল্লে’র লেখা বাংলাদেশের  তরুণ প্রজন্মের কাছে অনেকটা অপরিচিত ছিল। তাঁর চিন্তা -ভাবনা ও সাহিত্যের বিচরণ অসাধারণ। বিদেশি লেখকের লেখা আমাদের পাঠকমহলে আলোচনা ও পড়তে সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশের লেখক সলিমুল্লাহ খান। লেখক সলিমুল্লাহ খান ভিনদেশী কবি ডরোথি জুল্লে’র কবিতা নিয়ে ‘আল্লাহর বাদশাহি’ নামে প্রথম অনুবাদ করেন ১৯৯৮ সালে। এ গ্রন্থে ডরোথি জুল্লের ষাটটি কবিতা অনুবাদ করা হয়েছে। প্রতিটি কবিতার শব্দচয়ন ও ভাবার্থ বাংলা সাহিত্যে নবদিগন্তের দাগ টানে। তেমনি এ বইয়ের কবিতায় ফুটে উঠেছে এভাবে-

 

মানুষজন যেসব জায়গা ছেড়ে গিয়েছিল

পাখিরা আবার বাসা বাঁধছে এখানে সেখানে। আমার দেশে

এই গরম মৌসুমেই গড়ে উঠল একটা গাঁ।

বুলডোজার পৌঁছার আগেভাগেই

বসল ঝরনা একটা গির্জার চৌমাথায়

খোঁড়াখুড়ি চলতেই থাকল বিনা উপদ্রবে।

(পিতৃভূমির প্রশস্তি, পৃ. ৭৩)

কবিতায় মনের আনন্দ -বেদনা ও প্রত্যাশার আলো প্রতিফলিত হয়। জীবন ও বাস্তবতার উপর ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি শুনা যায়। কবিতায় মানুষের অধিকার ও দাবির কথা বলা যায়। বিদ্রোহ ও বিপ্লবের কথা কবিতায় ফুটে ওঠে। সাহিত্যের আসরে পাঠকদের মনের তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম ভূমিকা পালন করবে এ বইয়ের কবিতাসমূহ। সত্য ও সাহসের বাণী লক্ষ্য করা যায় কবিতার চরণে।

 

বন্ধুরা অঁকে ডাকে নিনো

মেয়াদ আদ্ধেকমতন খাটার পর

বলে জেলখাটার কথা

অদের দরকার কায়াটা অঁর

শেষ করে দেয়া।

নিনো বলে জেল দুই কিসিমের

এক জেলে আছে সেলের চার দেয়াল

জানালার গরাদ বালতি আর হাওয়ার গুলগুলি

ইতি আদি বলে

হিশাব করেছে অঁ।

(আন্তনিয়ো গ্রামসির দুই কারাবাস, পৃ ৮৬)

 

উপরের অসাধারণ পঙক্তিগুলো কবি ডরোথি জুল্লে লিখেছেন। ইউরোপ মহাদেশের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হচ্ছে জার্মানি। তিনি জার্মান দেশের সুপরিচিত কবি। ডরোথি জুল্লে একজন কবি, ধর্মজ্ঞানী ও বিদ্রোহী। তিনি জার্মানির কোলন শহরে ১৯২৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর  জন্মগ্রহণ করেন। খ্রিস্টান ধর্মের তত্ত্ব অনুসন্ধান ছিল কবি জুল্লের সাধনার বিষয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক  ছিলেন। তিনি কবিতা চর্চা করতেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি দেশ-বিদেশে ভ্রমণে যেতেন। জ্ঞানজগতের সৃষ্টির রহস্যে অধীর আগ্রহ কবির লেখায় জানা যায়।

কবি ‘বেঁচে থাকার সুখ’ কবিতায় লিখেছেন,

রহস্যঘেরা সোনালি সবুজ গাছ

ছেড়ে যেতে তোকে করছে কে

আর পার্শিং দুই মিসাইলের

নৈপুণ্য উন্নতির মাপে

মিলিয়ে কেনই বা দেখতে হবে তোকে

আহা বুঝতে পারিস না তুই

সুখ আমার সাধ্যের অতীত

ভয় আমার শ্বাসের অধিক

সুখ আমার বাড়ায় আমাকে

মাত্র নিজের বাঁচা বাঁচতে পারি না তাই (পৃ. ৩০)

 

কবি ডরোথি জুল্লের সাথে লেখক সলিমুল্লাহ খানের দেখা মিলে ১৯৯৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। লেখক সলিমুল্লাহ খান জার্মান কবি ডরোথি জুল্লের কবিতার বই অনুবাদ করেন। ১৯৯৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ‘আল্লাহর বাদশাহি’ নামে প্রথম প্রকাশ পায়। বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ পায় ফেব্রুয়ারি ২০১২ সালে। দীর্ঘ ১৪ বছর  বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়। বাংলা ভাষা অনুবাদের জন্য ডরোথি জুল্লের কবিতার এদেশের পাঠকদের কাছে পরিচিতি হয়ে উঠেছে। ভিনদেশী লেখককে সহজেই চেনা হয়ে উঠে না। আমাদের মতো তরুণ পাঠকদের জন্য বইটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ডরোথি জুল্লের কবিতাগুলো ভাবনা ও চিন্তার বিষয়। তিনি ‘পাঁচশত বাহাত্তর’ কবিতায় লিখেছেন,

 

ওদিকে আমার নিজের দেশে

কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটেনি একচুলও

স্বাধীন গণতান্ত্রিক সমাজ আমার দেশে

মানুষের কর না দেবার অধিকার নাই (পৃ. ৩৭)

 

বইটি পাঠ করলে খ্যাতিমান কতিপয় লেখক, দার্শনিক ও সমাজচিন্তকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। বিশ্বের খ্যাতিমান পরিচিত মহাত্মা নোম চমস্কি, ফ্রয়েড   ও জাক লাকাঁ। মহাত্মা লালনের দেখা মিলে বইয়ের প্রার্থনা অংশে। বইটি পাঠ করলে কবি ডরোথি জুল্লের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে সংক্ষেপে ধারণা পাওয়া যায়। দেশে দেশে যুদ্ধ, হিংসা, মারামারি ও প্রতিহিংসার আগুনে মানবজীবন বিপর্যস্ত। তখনই যুদ্ধের বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছেন ডরোথি জুল্লে। তিনি ‘কি কারণে রাক্ষস চাই আমাদের’ কবিতায় লিখেছেন,

 

১৯৭৪ সাল থেকে ন্যাটোর মহড়ায় নতুন কা-

পুবদিক থেকে আমাগো হামলা করতেছে বিদেশি বাহিনী

এ রকম হামলা ঢের কতবার হয়েছে অতীতে

দেশের না খাওয়া বেকার মজুরের দল

এবার এগিয়ে এসেছে হেগোর সমর্থনে

যে কোন পরিস্থিতিতে আমাগোর লড়তে প্রস্তুত থাকার

যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায়

এ বস্তু আনকোরা নতুন। (পৃ. ৩৪)

 

ডরোথি জুল্লের পরমাণু যুদ্ধবিরোধী শান্তি আন্দোলনে ও সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বকে শান্তিময় পরিবেশে বসবাসের পক্ষে দৃপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করেন। বিশেষ করে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ আন্দোলনে, নিকারাগুয়ার সান্দানিস্তা বিপ্লবের পক্ষাবলম্বনে আন্দোলন, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ আন্দোলন ও আমেরিকার নানা প্রকার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন। তিনি কবিতায় লিখেছেন,

 

হেলান দিয়ে আছে গাছে

বন বেচা শেষ

জমি লগ্নি হয়ে গেছে

পানিতে বিষ

বৃষ্টিতে মরে পাখি

অক তাক করে কেউ

কাল বনের দিকে মুখ করে। বেটা হাত উঠায়

এখনো লোপ পায়নি অই বন। (শান্তি ৩, পৃ.৫৬)

 

মার্কিন মুলুক প্রবাস জীবনে সলিমুল্লাহ খান ডরোথি জুল্লের কবিতা পড়েন এবং পরে অনুবাদ করেন। কবি ডরোথি জুল্লের লেখালেখির হাত অনেক শক্তিশালী। তিনি ত্রিশটির মতো বই লিখেছেন। এ বইয়ের শেষের দিকে কবি ডরোথি জুল্লের বইয়ের একটি গ্রন্থপঞ্জি রয়েছে।  কবি ডরোথি জুল্লের জীবনাবসান হয় ২০০৩ সালের ২৭ এপ্রিল। জার্মানির গোপিংগেন নামক জায়গায় মৃত্যুবরণ করেন। বইটি পাঠ করার পর অনেক অজানা বিষয়ও সহজে জানা যায়।

 

কবি ‘বেটা এলা যে বেলা ৪’ কবিতায় লিখেছেন,

সক্রাতেস

রোজা লুকসেমবুর্গ

গাঁধি

যাও বেটার তুলনা কর গিয়ে আর আর মহাত্মার লগে

পাশ করবে।

আরো ভালো হয় অবশ্য

যদি বেটার তুলনাটা মার খোদ

তোমার আপন লগে। (পৃ.৪৩)

 

অন্যদিকে  সলিমুল্লাহ খানের বেশ কয়েকটি বই রয়েছে। লেখক সলিমুল্লাহ খান ২০২১ সালের মার্চ মাসে ফিনল্যান্ডের কবি পেন্টি সারিকস্কির কাব্যগ্রন্থ ‘উহারা বাতাসে : কবিতা ১৯৫৮-১৯৮০’ অনুবাদ করেন। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছে ফিনিশ কবিতাকার পেন্টি সারিকস্কিকে পরিচয় করে দেন।

যা বই পড়ুযা লোকজনের কাছে সাহিত্যের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়। অনুবাদ করেছেন ‘সক্রাতেসের তিন বাগড়া'(২০০৫)। এছাড়া আরো অনেকগুলো বই রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:- উৎসর্গ : পরিবার প্রজাতি রাষ্ট্র (২০২৩), ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়: ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা (২০২৩), প্রার্থনা (২০১৯), আহমদ ছফা সঞ্জীবনী (২০১০), স্বাধীনতা ব্যবসায় (২০১১), আদম বোমা (২০০৯),  এক আকাশের স্বপ্ন (১৯৮১) ও বাংলাদেশ:  জাতীয় অবস্থার চালচিত্র (১৯৮৩) ইত্যাদি। তিনি অনেকগুলো বই সম্পাদনা করেছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন গবেষণামূলক জার্নাল ও নানান পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন।

 

বইটির শেষের দিকে সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে আলাপ নিয়ে দীর্ঘ একটি সাক্ষাৎকার রয়েছে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন লেখক ও সাংবাদিক শামস আল মমীন। এ আলাপে লেখক সলিমুল্লাহ খানের নানান বিষয়ের চিন্তা -ভাবনা ও বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন  বিষয় দারুণভাবে বর্ণনা পাওয়া যায়। সাক্ষাৎকারটি সলিমুল্লাহ খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়া ইয়র্ক শহরে থাকাকালীন সলিমুল্লাহ খান দিয়েছিলেন। ২০০০ সালের ২৭ এপ্রিল এ সাক্ষাৎকার দেন।

শামস আল মমীনের এক প্রশ্নের উত্তরের সলিমুল্লাহ খান বলেন, “আমার মতে কবিতায় যদি মানুষের দরকারি কথাগুলো না বলা যায় তাহলে কবিতা লেখার দরকার কি? জুল্লের কবিতায় আমার প্রাণের কতাবার্তা কিছু আছে। আমি যদি কবি হতে চাইতাম তাহলে কোন ধরনের কবি হতে চাইতাম তার নমুনা হিশাবেই আমি এটা পেশ করেছি।” আমি ডরোথি জুল্লের নির্বাচিত কবিতা : আল্লাহর বাদশাহি বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।  আমি উক্ত বই ও লেখকের সাফল্য কামনা করছি।

 

সলিমুল্লাহ খান, আল্লাহর বাদশাহি: ডরোথি জুল্লের নির্বাচিত কবিতা, আগামী প্রকাশনী, দ্বিতীয় সংস্করণ : ফেব্রুয়ারি ২০১২, প্রচ্ছদ : শিবু কুমার শীল   পৃ.১৩৬, মূল্য :২৮০ টাকা।

 

 

মুহাম্মদ ইসহাক, শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাহিত্য-গবেষণার আলোকবর্তিকা

শাহেদ কায়েস   আহমদ রফিক (জন্ম: ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-মৃত্যু: ২ অক্টোবর ২০২৫) বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুবনে আহমদ রফিক একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে

অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

আন্দরকিল্লা ডেক্স \ চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের আত্মজীবনী ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

ফেরা

সৈয়দা মাসুদা বনি   নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন   রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু! মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে

চিরহরিৎ বৃক্ষের গল্প

সুজন বড়ুয়া   ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়।