মোস্তফা হায়দার
‘আয় রে আমার শেফালী ফুল
বকুল লতা
কনকচাঁপা
আয় রে আমার শুয়োর ছানা
হারামজাদা’
কবিতার মতো সত্য আর সত্যের মতো কবিতা লেখার সাহস সবার থাকে না। কবিতাকে প্রেমজুয়াড়ির নেমন্তন্য আসর বানানোর সংখ্যাই আজ বেশি। কিছু কিছু কবি আর শিল্পীর দেশপ্রেমের কল্যাণে শব্দবাক্যের চমৎকার খেল নিয়ে সময়ের বিপরীত স্রোত নিতে সাহস জোগায়।
কবি আসাদ চৌধুরী’র কথা বলছি। এ কবির বুকের পাটাতন মাপার যন্ত্র দরকার ছিল। কবিদের শক্তির কাছে অস্ত্রের শক্তি পর্যন্ত হাউমাউ করার কথা। সব স্বৈরশাসন তন্ত্রের প্লেট জুড়ে আজ পা চাটা কবিদের আনাগোনা। অথচ ‘তবক দেয়া পান ‘ খ্যাত কবি আসাদ চৌধুরী নিজেকে সাধারণ মানুষের কাতারে গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা এক অসাধারণ কবি।
যে দেশে উন্নয়নের ট্রেনে চড়ে মানুষ বাতাসে হাহুতাশ করছে, আড়ালে আবডালে কেতাদুরস্ত হয়ে সময় পার করছে, সে দেশে নিত্যপণ্যে নিয়ে কথা বলতে যাওয়া মানে উন্নয়নের বিরোধিতার নামান্তর।
কবির ব্যথিত কলম বাক্যের দ্বারস্থ হতে করে নি কসুর। কবি বলেন –
দ্রব্য বড়ো সুখের জিনিস
দ্রব্যগুণে পাথর গলে,নীতি গলে,
বিবেক-বিবেচেনাগুলো বিড়াল হয়ে
চাটতে থাকে রাঙা চরণ,
(বস্তুত এই অভাব নিয়ে-মেঘের জুলুম পাখির জুলুম )
শিল্পের তাঁবুর নিচে না বসে এ কবি সরল বাক্যে গরল পৃথিবীর পথ দেখিয়েছেন বারবার। কবি মনে করতেন, তিনিও এ সমাজের নাগরিক। তাঁর যাপনের ধরনও এর বাইরে নয়। মনুষ্য সমাজে বসবাস করা মানুষের সংখ্যাই যেখানে নগণ্য সেখানে এ কবি একজন মানুষ হতে চেয়েছেন। কবির ভক্ত হৃদয়ের ফ্লুঝুরিতে আবেগভরা প্রশ্নের সাথে কিছু ব্যতিক্রম প্রশ্নই যেন কবিকে ভাবতে বসিয়েছে। কবি বলেন –
যে নারী আবেগভরে চেয়েছিলো
মজার উত্তর,
সে এখন বলে,
“দ্রব্যমূল্য নিয়ে একটি পঙক্তি লেখা কি কঠিন, কবি?”
(প্রশ্ন- যে পারে পারুক)
কবি ভক্তের মুখে বসে মানুষের কথাই বলবার চেষ্টা করেছেন। মানুষের ন্যায্যতা নিরূপন করার শক্তি কবির নেই বা থাকতে পারে তবে কবির তলোয়ারের নিচে সব শক্তি পরাভূত হতে বাধ্য! কবি আসাদ চৌধুরী সময়ের কাছে নতজানু থাকতে চেয়েছেন। চোখে দেখা বিশ্বাসের খেরোখাতায় এঁকে দেয়া বারুদের ফুলকি যেন মানুষের হয়ে থিতু। কবির ভাষায়-
দাম বাড়ে চাউলের, তেলের নুনের
দাম বাড়ে ওষুধের, মানুষ খুনের,
বাড়ি ভাড়া বেড়ে যায় মর্জি-মতন,
রিকশার ভাড়া শুনে মূর্ছা-পতন।
————-
————-
মানুষের দাম,কমে প্রতি বছরই
বাঙালির দাম নেই পঁচাত্তরেই।
(দাম বাড়ে- মেঘের জুলুম পাখির জুলুম)
একটি জাতির দাম কত নিচে নেমে পড়েছে অথবা কত নির্মমতার ছায়ায় ভেসে পঁচাত্তর হয়ে গেলো ইতিহাসের দলিল। যে দলিলটি লেখা হয়েছে লাল রঙের তুলিতে। মানুষের আস্খার চেয়ে একজন নেতার নেতৃত্বে দাঁড়ানো মাত্র সময়কে খুঁড়ে খুঁড়ে তছনছ করে দিয়ে বিশ্বের দরবারে জাতিকে বানিয়ে দিয়েছে নির্লজ্জ! তবে মুদ্রার অপরপিঠে সময়কে বিগ্রেবিগলিত করে অবিশ্বাসের স্বৈরদ্যুতির ছায়া দেখতে পাওয়াকেও তখন নির্মমতার দুর্ভিক্ষ বলা হয়েছে।
একটি জাতির জন্মের পরিচয়ে বেড়ে উঠতে না উঠতে সময় যখন কলঙ্কিত হতে চলেছে তখন লেখক বা কবি মাত্রই সোচ্চার হতে বাধ্য! তবে তা কত জনই বা পেরেছে খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসতে! সময়ের বিপরীত স্রোতে দাঁড়াতে বা হাঁটতে না জানা লোকের সংখ্যাই সবসময় বেশি ছিল। তবে সে সময়ে কবি আসাদ চৌধুরী অনেকটা ব্যতিক্রম ছিলেন।
তার ‘চোর’ শিরোনামীয় ২য় কবিতাটি প্রথম কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। যে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল কলঙ্কিত এক পঁচাত্তরের গিলাপ হাতে। যে গিলাপের একদিকে ছিল আলোর বিচ্ছুরণ, অন্যদিকে ছিল স্বৈরছায়ার অবিশ্বাসিত্রোস্ত স্রোত। সে সময় তিনি লিখেন-
ধরুন যারা করছে চুরি গরিব লোকের খাদ্য
রোগের অষুধ,ল্যাংয়ের ত্যানা, ফুর্তি করার বাদ্য
ছেলের পড়া,মেয়ের বিয়ে,বৌ ঝিয়ারির গয়না
ধারের জমিন, দরিয়ার মীন,সাধের খাঁচার ময়না,
(চৌর-২- তবক দেয়া পান)
একজন কবি আর একজন নবীর সাদৃশ্য যখন আমরা খুঁজতে যাই তখন সত্যের কাছাকাছি যেতে হয়। কবিদের সত্যবাদী হতে হয়। তবে সত্যবাদী হয়ে থাকতে না পারলে তারা হয়ে যায় সময়ের মিথ্যে দালাল ও প্রতারক। তারা তথাকথিত কবি হতে পারলেও নবীর সত্যবলার পয়গামি সাদৃশ্য বা সাযুজ্য হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করে। সে জায়গায় কবি আসাদ চৌধুরী স্বাধীনতাউত্তর আর স্বাধীনতা পরবর্তী কোনোটাতেই নিজেকে আড়াল করেন নি। সত্যের নির্মমতাকে আপন করে নিয়ে মানুষের পক্ষে থাকার কবি হতে চেষ্টা করায় এ প্রজন্মও তাঁকে লুফে নিয়েছে মনের কাবায় স্থান দিয়েছে।
কবির আফসোসের জায়গায় পাঠক মাত্রই সূত্র খোঁজবেন। কারণ তিনি রেখে গেছেন যাত্রার পদচিহ্ন। কবির ভাষায়-
আমাদের এমন নসিব
পানিও আগুন হ’য়ে ছুটে আসে দ্রুত;
শতবার রিফু-করা
মানুষের আশা,স্বপ্ন,সাধ
ছিঁড়ে খুঁড়ে খায়।
(আমাদের এমন নসিব-মেঘের জুলুম,পাখির জুলুম)
পান খাওয়া ঠোঁটে প্রেমের বাক্যের আস্ফালন ঘটায় স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যতিক্রম এ কবি ‘তবক দেয়া পান’ খ্যাত হয়ে পান খাওয়া ঠোঁটে এঁকে গেছেন দ্রোহযন্ত্রণার সূত্রাবলি। এঁকে গেছেন মানুষের কথা, মানুষের অধিকারের কথা, মানুষের বিশ্বাস পুনর্জন্মের কথা, অনিয়ম অনাচারের কথা, সচেতনতার কথা। আগুন জ্বালাবার কথা। কবির ভাষায়–
এ – সময়, এ পৃথিবী দুর্বৃত্তের হাতের মুঠোয়
কোণ-ঠাসা মানুষেরা আলোকিত সৎ মানুষেরা
অন্ধকারে দমবন্ধ হয়ে শুধু ছটপট করে
ক্ষমতা ও দাপটের বেপরোয়া প্রদর্শনী চলে।
(মজাহারের উদ্দেশে-ঘরে ফেরা সোজা নয়)
ষাটের দশকের সাহিত্যে একজন প্রাণ ভোমরা বলা যেতে পারে এ কবিকে। এ কবির কবিতার বাক্যগুলো একদম সরল ও প্রাঞ্জলভাষায় নির্মিত। এতো সরলবাক্যে তিনি এঁকে গেছেন সময়ের অযাচিত কা-ের বিষয়ে গরল চিৎকার, আগুন জ্বালাবার তন্ত্র। বিশ্বাসের ছায়ায় এঁকে গেছেন ‘সত্যের ফেরারী ‘ কবিতা। কবির ভাষায়-
কোথায় পালালো সত্য?/ দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো/ রেস্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে,/ গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,/ টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে,/ নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।/ গুড়ের কলসি, বিষের কৌটো,/ চিনির বয়াম, বাজারের ব্যাগ,/ সিগারেট কেস, পানের ডিব্বা,/ জর্দার শিশি, লক্ষ্মীর সরা,/ নকশী পাতিল, চৌকির তলা,/ সবি খুঁজলাম, খুঁজে দেখলাম নেই তো!/ সাংবাদিকের কাঠের ডেস্কে,/ কাগজে, কেতাবে, পুঁথিতে, কলমে,/ ইনজেকশনে, দাদের মলমে,/ ভ্যানিটি ব্যাগে বা পকেটে, আঁচলে/ ড্রয়ারে, ব্যাংকে, আয়রণ সেফে/ সত্য নামক মহান বস্তু নেই তো!/ কবিতায় নেই, সঙ্গীতে নেই/ রমণীর চারু ভঙ্গিতে নেই/ পাগলের গাঢ় প্রলাপেও নেই/ নাটকের কোন সংলাপে নেই/ শাসনেও নেই, ভাষণে নেই/ আঁধারেও নেই, আলোতেও নেই/ রেখাতেও নেই, লেখাতেও নেই,/ উত্তরে নেই, প্রশ্নেও নেই/ লেবাসে নেই, সিলেবাসে নেই/ পারমিটে নেই, বোনাসেও নেই/ হতাশায় নেই, আশাতেও নেই/ প্রেম-প্রীতি ভালোবাসাতেও নেই/ এমন কি কালোবাজারেও নেই/ কোথায় গেলেন সত্য?/ যেতে যেতে মধ্যযুগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে/ মধ্যযুগ/ মুখ চুন করে/ দুহাতে পাঁজর চেপে/ ফিরে যাচ্ছে নিজ অন্ধকারে।/ নীল গগনের ললাটে চন্দন ছিল,/ সেখানে হংসমিথুন নয়/ বীরদর্পে পাক খাচ্ছে/ কয়েকটা শকুন/ কাকাতুয়ার মতন অনর্গল কলকল,/ ‘ক্ষমতা, ক্ষমতাৃ’/ যেতে যেতে/ হঠাৎ কী মনে করে/ ফিক করে হেসে/ মধ্যযুগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে।/ কে দেখেছে, কে দেখেছে,/ দাদারা দেখেছে/ দিদিরা দেখেছে (সত্য ফেরারী- তবক দেয়া পান)
এ কবিতাটি এতোটাই জীবন্ত যে, যতদিন এ দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী মানুষের অধিকার সঠিকভাবে প্রতিস্খাপন হবে না ততোদিন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে রিনিঝিনি ঝঙ্কারে সুর তুলবে, এগিয়ে যেতে সাহস জোগাবে। পঁচাত্তর সালে প্রকাশিত একটি বইয়ের এ কবিতা তখনকার কিসের দিকে মিন করেছে তা পাঠকমাত্রই ভাবতে হবে। সময়ের পঞ্চাশ বছর শেষে এসেও আজো মানুষের ‘সত্য ফেরারী’কবিতার দ্বারস্থ হতে হচ্ছে।
কবি আসাদ চৌধুরী র কবিতার কাছে নতজানু হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। ভেতরের শক্তিমজ্জা দলবেঁধে ওঠে এসে জড়ো হতে শেখায়। কবিরাই পেরেছে কালে কালে মানুষের কথা বলতে, অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলতে। মানুষের পাগলামি আর ল্যাংটামিও কবির পছন্দ ছিল না। বাঁচতে না জানা লোকের সমাজ একবির পছন্দ ছিল না। ‘শস্যের বোতাম’ খোলা এ কবির জানা ছিল, বিশ্বাস ছিল বলতেই হবে।
বলতে না পারলে অথবা না বললে সে হয়ে থাকবে জন্ম-অপরাধীর মত! তাই কবি প্রতিবাদের ভাষায় নতুন যোজন ঘটিয়ে বলেছেন-
মানব-সভ্যতা -আমি যাই সভ্যতার নামে আমি অনেক দেখেছি
আর নয়,যাই।
সুখ-যার জন্য মানুষের এতো পাগলামি, এতো হ্যাংলামি, না, না
আর নয় আমি যাই।
তিমিদের অসহায় আত্মহত্যা আমি আর সইতে পারি না।
( যে- পারে,পারুক আমি পারবো না- যে পারে পারিক)
এ কবি পারবে না বলে সব বলতে বলতে পথ হেঁটেছেন। পানখাওয়া ঠোঁটে গেয়ে গেছেন মানবতার গান,সাম্যের গান। বিষাদের সব প্লেটে কাব্যিক জলের ধারা বইয়ে দিয়ে এ কবি চির নমস্য হয়ে থাকতে পেরেছেন বলে স্বাধীনতা পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। নিজেকে চিনতে পারায় আজন্ম পাপের কাছে নতজানু না হতে পারায় সময়ের গ-রা কবিকে বঞ্চিত করেছে তার সুন্দর পরিভাষা থেকে!
মোস্তফা হায়দার, কবি ও প্রাবন্ধিক




