তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী
হাঙ্গেরির কথাসাহিত্যিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই সাহিত্যের সোনার হরিণ মর্যাদাপূর্ণ ‘নোবেল’ পুরস্কার জয় করায় তার প্রতি সাহিত্যবোদ্ধাদের প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে তার উপন্যাস বিশ্বের অভিজাত সব বইবিপনী কেন্দ্রের শীর্ষ বিক্রী তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। তিনি নোবেল পেয়েছেন মূলত, ‘তার মনোমুগ্ধকর ও দূরদর্শী শিল্পকর্মের জন্য, যা মহাপ্রলয়ঙ্করী ভয়ের মধ্যেও শিল্পের শক্তিকে প্রতিবিম্বিত করে’। এখন প্রশ্ন হলো, কি সে শিল্পের শক্তি? – যা তার সৃজনকর্মে উদ্ভাসিত এবং যার জন্য তাকে বলা হয়, মহাকাব্যিক লেখক। উত্তরটা এককথায় দিতে হলে আমাদের বলতে হয়, তার অভিনব শৈলীর পাশাপাশি দার্শনিক গভীরতাই তার শিল্পের শক্তি, যা তিনি অর্জন করেন জীবন বাস্তবতার কষ্টি- পাথর ঘষে। এর খোঁজ পেতে পাঠককে হাঁটতে হয় অস্বস্তিকর অস্বস্তির অন্ধকার সুরঙ্গ পথে, এ সুরঙ্গের কোন এক পর্যায়ে হয়তো পাওয়া যায় আলোর রেখা ! কিন্তু তা কোথায় পাঠকের তা জানা নেই– এই-ই হলো লাসলো ক্রাসনাহোরকাইর সাহিত্য।
দক্ষিণ-পূর্ব হাঙ্গেরির এক ছোট্ট শহর গিউলায় জন্ম ১৯৫৪ সালের ৫ জানুয়ারি জন্ম নেয়া ৭১ বছর বয়সী লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, যিনি আইনজীবী পিতা ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘সামাজিক নিরাপত্তা প্রশাসক’ মায়ের সন্তান এবং নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিলেও এক পর্যায়ে তিনি জীবনের বাস্তবতার স্তরকে স্পর্শ করতে নিছক খেয়ালের বশে তিন’শ গরুর নাইট ওয়াচম্যান, খনি শ্রমিকের কাজ, জ্যাজ ব্যান্ডে পিয়ানো বাজিয়ে, ৬টি গ্রামের সংস্কৃতি কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক, সামরিক বাহিনীতে যোগদান- ইত্যকার বিচিত্র কাজেরও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, যার ফলশ্রুতিতে তাঁর লেখায় মানব জীবনের অস্তিত্বের অস্বস্তি, দুঃস্বপ্ন ও বিষন্নতার নানা বিষয়-আশয় অন্বেষণ মুখ্য হয়ে উঠে। তিনি মানব জীবনের কঠোরভাবে রক্ষিত গোপনীয়তা, দার্শনিক জিজ্ঞাসা, অস্তিত্বের অস্বস্তি, ভয় তথা অন্ধকার দিককে উন্মোচিত করে আলোর পাদপ্রদীপে এনে অসহায় মানুষগুলোকে আলোর ঝর্নাধারায় অবগাহন করাতে চেয়েছেন। ‘প্যারিস রিভিউ’ এ ডাস্টিন ইলিংওয়ার্থ বলেছেন, ‘লাসলো ক্রাসনাহোরকাই এর নেশা বা আচ্ছন্নতা গোপন জিনিসের প্রতি, যেগুলো মানুষের জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক হিসেবে বিবেচিত ‘।
দুই ডজনেরও বেশি বই লিখেছেন লাসলো। প্রবন্ধ ও ছোটগল্পও লিখেছেন অনেক। তবে উপন্যাস তাঁকে এনে দিয়েছে খ্যাতির গৌরব। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো– সাতান্তঙ্গ, দ্য মেলান্কলি অব রেজিস্ট্যান্স, ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার, সেইয়োবো দেয়ার বিলো, ব্যারন হেন্কহেইমস হোম কামিং, ডেসট্রাকশন অ্যান্ড সরো বিনিথ দ্য হেভেন্সঃ রিপোর্টাজ, দ্য ওয়াল্ড গোজ অন, স্পেডওয়ার্ক ফর আ প্লেস, চেজিং হোমার, আ মাউন্টেইন টু দ্য নর্থ, হারশট ০৭৭৬৯’ ইত্যাদি।
লাসলোর প্রথম উপন্যাস ‘সাতান্তাঙ্গো’ (শয়তানের নাচ) প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। এতে তুলে ধরা হয়েছে, প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলের একটি পরিত্যক্ত সমবায় খামারে দরিদ্রসীমার নীচে বসবাস করা নিঃস্ব কিছু মানুষের জীবন চিত্র, যারা সমাজতন্ত্র পতনের ঠিক পূর্ব-মুহুূর্তে স্বপ্নভঙ্গ, অনিশ্চয়তা ও হতাশার মধ্যে দিনাতিপাত করছিল। অবশ্য তাদের সাথে ছিল এস্তিকে (ঊংঃরশব) এর মতো ছোট মেয়ে, নির্মমতা তাকে পরাভূত করলেও তার ভেতর রয়ে যায় নিষ্পাপ দৃঢ়তা। এ উপন্যাসটি প্রকাশের পর পরই এটি হাঙ্গেরি সাহিত্য জগতে আলোড়ন তুলে। এ উপন্যাসকে ভিত্তি করে ১৯৯৪ সালে ৭ ঘন্টা দৈর্ঘেরএকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন হাঙ্গেরির খ্যাতিমান পরিচালক বেলা তার। পরবর্তীতে ইংরেজিতে অনূদিত হলে ‘সাতান্তাঙ্গা’ ২০১৩ সালে ‘বেস্ট ট্রান্সলেটেড বুক অ্যাওয়ার্ড (ফিকশন)’ ও ২০১৫ সালে ‘ম্যানবুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ’ অর্জন করে। এই উপন্যাস তার মনোবল এতোই বাড়িয়ে দেয় যে, এটি প্রকাশের সময় থেকেই তিনি স্বাধীন লেখক জীবন বেচে নেন।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের পরবর্তী উপন্যাস দ্য মেলান্কলি অব রেজিস্ট্যান্স (প্রতিরোধের বিষণ্নতা) ১৯৮৯ সালে হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় প্রকাশিত হয়, যার ইংরেজি অনুবাদ বেরুয় ১৯৯৮ সালে। ৩০০ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির পুরোটাই একটি মাত্র বাক্যে লেখা, ভাবা যায়!! খ্যাতনামা সিনেমা নির্মাতা বেলা তার এটিকে ২০০০ সালে চিত্ররূপ দেন। পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত হাঙ্গেরিয়ান ছোট শহর কার্পাথিয়ান ঘিরে ভৌতিক কল্পকাহিনি ও নাটকীয়তায় ভরা এ উপন্যাসে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের চিত্র আঁকা হয়েছে। এতে দেখা যায়, শহরে একটা ভৌতিক সার্কাস পার্টি ঢুকে পড়ে, যাদের সাথে রয়েছে একটি বিশালদেহী মৃত তিমি এবং এক রহস্যময় প্রিন্স- যাকে কেউ দেখেনি, তবে ভয় পায়। এ সুযোগে অনেকে প্ররোচিত হয়ে নৈরাজ্য-সহিংসতা শুরু করে। নৈরাজ্য, সহিংসতা, অরাজকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, সেনাবাহিনীও ব্যর্থ হয়। ফলতঃ স্বৈরাচারী অভ্যুত্থানের পথ তৈরি হয়। এ উপন্যাসের একটি চরিত্র ঠধষঁংশধ (ভালুশকা)- সে বিশ্বাস করে পৃথিবীর বিশৃঙ্খলার মধ্যেও এক ধরনের শৃঙ্খলার বন্ধন আছে, যদিও সেই বিশ্বাসই শেষ পর্যন্ত তাকে শেষ করে দেয়। এই উপন্যাসে লেখক চমৎকারভারে দীর্ঘ বাক্যের গদ্য ফর্মেটে শৃঙ্খলা- বিশৃঙ্খলার নৃশংস দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তুলেছেন, যা থেকে কেউই মুক্ত নয়।
ক্রাসনাহোকাইয়ের উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়। এটি ইংরেজিতে অনুদিত হয় ২০০৬ সাল। এই উপন্যাসের মূল চরিত্রে আছেন এক আর্কাইব কর্মচারী, যিনি জীবনের অন্তিম পর্যায়ে নিউইয়র্কে পাড়ি জমাতে মনস্থির করেন। এই উপন্যাসটি লেখার সময় এক পর্যায়ে তিনি লক্ষ করেন, এতে তিনি নিজেকে উপস্থাপন করে আত্মবিধ্বংসী পথে অগ্রসর হচ্ছেন, তখন তিনি উপন্যাসটির কাঠামোই বদলে ফেলেন।
২০০৮ সালে প্রকাশিত হয় লাসলোর উপন্যাস ”সেইবো দেয়ার বিলো’। এতে তিনি নিবিড় নৈকট্যে যুক্ত হন এশীয় শিল্প ও দর্শন তথা বৌদ্ধ ভাবনার সাথে। তিনি বলেন, শিল্প হলো আমাদের নিয়তিস্বরূপ হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতির প্রতি মানবিকতার অসাধারণ প্রতিক্রিয়া। এটি এমন এক সীমানার অপর প্রান্তে রয়েছে, যেখানে আমাদের অবিরাম থমকে যেতে হয়।
লাসলোর উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘ব্যারন হেন্কহেইমস হোম কামিং’ (ইধৎড়হ ডবহপশযবরস’ং ঐড়সব পড়সরহম) একটা গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস, যা ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি এটিকে তার জীবনের সর্বোত্তম ও সবচেয়ে রসাত্মক কাজ হিসেবে বিবেচনা করেন। এতে তিনি সাহিত্যের প্রথাগত ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন। এতে দেখা যায়, ব্যারন আর্জেন্টিনা থেকে বাড়ি ফিরে তার শৈশবের প্রণয়ীর সঙ্গে মিলিত হতে চাইলেও বিশ্বাসঘাতক দান্তের কারণে তা দূর-আস্ত হয়ে ওঠে।
লাসলোর সর্বশেষ কাজ হলো ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘হারশট ০৭৭৬৯’। একে জার্মান সাহিত্যের একটা অনন্য উপন্যাস হিসেবে গণ্য করা হয়। এর গল্পে জার্মানির ছোট্ট শহর থুরিঙ্গেনের সামাজিক অরাজকতা, জ্বালাও- পোড়াও ও হত্যা ঘটনা পরম্পরা তুলে ধরা হয়েছে। এটি মূলতঃ এক গ্রাফিতি পরিষ্কারককে নিয়ে লেখা, যে তখনকার জার্মান চ্যান্সেলর মের্কেলেকে বিশ্বের পরিণতি বিষয়ে একটি চিঠি লিখে সতর্ক করেছিল। চার’শ পৃষ্ঠার এ বইটিও একটি মাত্র যতিচিহ্ন ‘দাঁড়ি’ দিয়ে শেষ করা হয়। চলিত বছর বইটি সুইডিশ ‘কুলতুরহুসেট সিটি থিয়েটার আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ লাভ করার পর তার নাম নোবেল শর্টলিস্টের শীর্ষে চলে আসে।
লাসলো ক্রাসনাহোরকাইর প্রায় প্রতিটি লেখা অ্যাবসার্ডিটি ও অদ্ভুত বিষয়বস্তুর ঘেরাটোপে আঁটসাঁট বাঁধা হলেও পরিশেষে তা মানব জীবনের অস্তিত্বের অস্বস্তির অনিবার্য পরিণতির দিকে ধাবমান। তাকে আপাতদৃষ্টিতে অপ্রাকৃত বিষয়বস্তু, একই কথার পুনরাবৃত্তি, ধৈর্যচ্যুতি, অতিরঞ্জনদুষ্ট মনে হলেও গভীর চিন্তা, নিঃসঙ্গ অনুসন্ধানে তিনি বাক্য গড়েন নীরব মাত্রা গুনে, যা প্রার্থনার মতো দীর্ঘ, আবেদনময়ী, ছায়াময় ও সুশৃঙ্খল এবং অনিবার্য ভাবে সৃজনশীলতা নীরব প্রদীপ জ্বালানো। সাহিত্যে তিনি আসলে ‘একটি একেবারে মৌলিক শৈলী গড়ে তুলতে চেয়েছেন’- ২০১৪ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর এ ইচ্ছার কথা জানানও। ক্রাসনাহোরকাই’র লেখা যতই দুর্বোধ্য, জটিল ও বিরক্তিকর দীর্ঘ হোক না কেন- সাহিত্য সন্ধিৎসু পাঠকদের জন্য তিনি এক পরম আরাধ্য ‘উত্তর- আধুনিক’ সাহিত্যিক– যিনি নিজে এক গভীর অস্তিত্ববাদী দ্বন্ধের মধ্যে অবস্থান করেন।
তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কবি।




