গোপন গল্প
বিটুল দেব
সব মানুষের কোন না গোপন গল্প থাকে
যে গল্প বুকে চেপে রেখে
নিজেকে নিজে গল্প বলে
নিজের গল্পে নিজে শ্রোতা হয়ে-
কখনো হাসে কখনো অজোরে কাঁদে
তবুও বাঁচিয়ে রাখে পরম মমতায়
গোপন গল্প গোপন রাখতে রাখতে
হঠাৎ নিজেও গল্পের ভেতর গোপন হয়ে যায়
======================
আমি আসি আমার নিয়মে- মোহিনী মোহন
আসাদ মান্নান
আমি কিন্তু খড়কুটো কিংবা কোনো ঝরা পাতা নই,
যে ঝড়ে বা দমকা হাওয়ায় উড়তে উড়তে দূরে চলে যাবো;
না, আমি তেমন কোনো পরজীবী আগন্তুক নই ;
আমার অস্তিত্বে আছে একটা বিশাল
মহীরুহ,
যার মূল অনেক গভীরে,ফুলে ফলে পল্লবিত এক
শ্যামল আকাশ জুড়ে যার আছে বহু ডালপালা;
তার নামে গৌরবের যত কথা, যত চিত্রগাথা
রিসেট বাটন চেপে যে চায় মুছিয়ে দিতে তাকে
সে এক মুখোশধারী প্রতারক বসন্তের পাখি!
আজন্ম শত্রুর সঙ্গে বারবার যুদ্ধ করে আমি
এতদূর এসে আজ একটা দুঃস্বপ্ন দেখে থেমে যাবো?
না, আমি থামার জন্য রক্তে ভেজা মাটিতে নামিনি,
এ মাটি আমার প্রাণ — নিরঙ্কুশ আত্মপরিচয়,
তার বুকে পরগাছা! উপড়ে ফেলে সামনে যেতে হবে —
চূড়ান্ত যুদ্ধের ডাক এসে গেছে নতুন প্রত্যয়ে:
মৃত্যু আসে তার মতো– আমি আসি আমার নিয়মে।
==============================
আজ আর গান নয় হে বৃক্ষ
তাপস চক্রবর্তী
হে বৃক্ষ— এই মধ্যাহ্নে গান নয় আজ
দেখো তোমার সংসারে সুরের প্রহেলিকা ছুঁয়ে যায়
কতিপয় হত্যাবৃত্তের কোলাহল।
কি নির্মম! আমি-তুমি-আমরা অনায়াসে ভাগ করি
তোমার শিকড়ে বসে মাটি ধর্ম আর রাষ্ট্র…
তাই এখন ওখানে বাতাসে ওড়ে ভীষম ভীষম কান্না
তোমার কোটরে উঠানে জমে ওঠে সারমেয় হিংসার জল।
তবুও গ্রাম প্রধানের চোখে বাড়ে ক্ষেতের উর্বরতা
মাটির শরীর ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়ে পাখিদের মতো
কিছু না বলা ব্যথা।
যদিও এখন এখানে বৃষ্টিতে অনুর্বর রুটি রুজি
ফুলের অমৃত ঘ্রাণে— বান খুঁজে মৃত মানুষের ছবি
পিঁপড়ের ক্ষুধার্ত চোখে এখন ব্যর্থতার পাণ্ডুলিপি।
জমে ওঠে ক্রন্দনরত পতাকায় মানুষের কোরাস নৃত্য।
তবুও বলি; আজ আর গান নয় হে বৃক্ষ
দেশজ একমুটো সংগীত ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হয় মানুষে অন্তরে
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…
=========================
পাখির ঠোঁটে ভাগফল
সাজ্জাদুর রহমান
সাদা মেঘের মৃত্যুর পর
স্মৃতির ফ্রেমে আঁকা হয় নক্ষত্র গাছ
একটি পাখি সবচেয়ে উঁচু ডালে বসে
নিচে তাকিয়ে ভাগফলের সংখ্যা খোঁজে
চেপে ধরে নিরীক্ষার চিত্রলিপি
চেঁচিয়ে ওঠে জিরো পয়েন্ট-লাইটপোস্ট
ঘর্মাক্ত পাখি ঘাম মুছে তাকিয়ে দেখে
যোগ-বিয়োগের ঘরে দুঃখবন্দি শূন্যতা
নিজেকে ভারি করবার জন্য
নষ্টের ভিড়ে পইপই করে খোঁজে বোধের অক্ষর
অথচ সমস্ত অক্ষর সাবান মাখছে
মৃত মেঘের নিথর শরীরটাতে
সকলে দেখে সেই দৃশ্য
পাখিটির ঠোঁটে ভাগফলের আগুন চিৎকার।
============================
নারীকে নদী ভাবি আর জননী ‘বাংলাদেশ’
সুশান্ত হালদার
কবিতা লিখি বলেই
দগদগে ঘা নিয়ে তেড়ে আসে শামসুর রাহমান
প্রবল প্রতিঘাতে তুলে আনি হুমায়ুন আজাদ
তাতে নিজেই চুরমার করে তুলি শ্মশ্রুমণ্ডিত রবীন্দ্রনাথ
এতে গাঁটছড়া বাঁন্ধে আমাদেরই নজরুল জীবনানন্দ দাশ
কবিতা লিখি বলেই
সাতচল্লিশ উড়িয়ে ছেড়ে দিয়েছি বাহান্নর মাঠ
একাত্তর খেলে খেলে পলাশের বুক যেন বিষাদসিন্ধুর কায়কোবাদ
তাইতো মরমী হিয়ার মাঝে…
তোলপাড় করে হাফিজের মতো রফিক আজাদ
কবিতা লিখি বলেই
নারীকে নদী ভাবি জননী আমার ‘বাংলাদেশ’
ভুলে যদি যায় এই দেশ অবারিত সবুজ ফসলের মাঠ
আষাঢ়ের যত মেঘ-বৃষ্টি-রোদ হিজল শিউলী পলাশ
নটেশাক আর কলমীলতা হেলেঞ্চা কচি-দূর্বা মুথাঘাস,
মনে রেখ ওগো ইরাবতী ফেরদৌস কালিকাপ্রসাদ হরগঙ্গা
ভুল-জন্মে আফসোস করি নাই যখন মরে গ্যাছে আমার প্রেয়সী ‘শীতলক্ষ্যা’!
একজন অপুরুষ যোদ্ধার গল্প
হোসাইন আনোয়ার
অ্যাকুরিয়ামে গৃহপালিত সমুদ্র দেখে দেখে
যে পুরুষ ঠিকানা হারিয়ে ফেলে
সে পুরুষ পুরুষ নয়
পুরুষ নামের কলঙ্ক।
পাতা ঝরার শব্দ শুনে
যে পুরুষ পালায় খরগোসের মত
সে কি পারে গভীর কুয়াশা ঘেরা
বহুভঙ্গিম কোনো সমুদ্র পাড়ি দিতে?
ধ্বংসলীলা দেখেও যে পুরুষ জাগেনা চৈতন্যে
সে তো নপুংশক। অপুরুষত্ব বিদ্যমান তার দেহে।
মাছ ধরার জাল বুনেও তিনি
স্বপ্নের চাষাবাদ করতে জানেন না।
অথচ,
ঢেউয়ের ঐশ্বর্য কেটে কেটেই
পৌঁছাতে হয় স্বপ্নের ঠিকানায়।
==========================
নদী ও আমি
কিঙ্কর কামরুল
বয়ে যাওয়া শান্ত নদীটাও একদিন
উত্তাল সমুদ্রে গিয়ে মিশে।
নীরব এক জলধারা
যে প্রথম স্পর্শ করেছিল আমাকে
শ্রাবণের হিমেল বর্ষায়।
সে কোমল স্পর্শ নিয়ে
আমি আজও বসে থাকি নদীর ধারে,
গুনি তার নিত্য চলমান ঢেউ।
মন্দ লাগে না
বরং স্নিগ্ধ সেই জলে
আমি আমার অতীত ভাসিয়ে দিয়েছি।
আমার কাছে এখন দু’টি পথ
একটি নদী, আরেকটি আমি।
কাকে বেছে নেবো?
উত্তরটা নদীর কাছেই আছে।
===============================
সাংসদ ও কবি
রফিক আনম
সংসদে আইন বাঁধে সংসদ সদস্য
সময়ের প্রয়োজনে সুরক্ষার স্বার্থে
চাষি শস্য রক্ষা করে ঘেরাবেড়া দিয়ে
সাংসদ নিজেরে বাঁচায় কালাকানুনে
নিজের কল্যাণে যত নিচে নামা যায়
তত নিচে নামতে দেয় আইনের রজ্জু,
নিজের পায়ের তলে আইনের সিঁড়ি
বেয়ে বেয়ে শীর্ষে উঠে ধরা ছোঁয়া মানা
এক কামারের বেটা অগ্নিপোড়া কবি
হাতুড়ি পিটিয়ে ভাঙে আইনের ধারা
দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি কবিরা সহে না
তালের হাতুড়ি তোলে বেতালে ঘোরায়
সহসা গুড়িয়ে যায় সংসদের ছাদ
কবি আইন রচিতে নয় ভাঙতে আসে
=================================
চোখের আঙ্গিনায় মায়া কানন
অনন্ত রিয়াজ
আমি আমার একজনই কোন অংশীদার নেই
তুমিও একটা আমার অন্তরে ফলজ বৃক্ষ আম কাঁঠাল
চন্দ্রমল্লিকা ফুলের সৌরভ,
হৃদয়ে স্নিগ্ধা দোয়েল পাখি, সারাদিন হৈ চৈ
ঝড়ের গতিবেগে মেঘ ছড়ায় শ্রাবণের বারি ঝরে।
ভালবাসায় প্রতিদ্বন্দ্বী নেই দুজনের মাঝে
সমান্তরালে জোয়ার ভাটায় নদী সাম্পান বায়,
কেউ দ্যাখেনা দ্যাখে পৃথিবীর চাঁদ তারা সূর্য
আর আমার মনের ঘরে রঙ তুলিতে ছবি আঁকে
পানকৌড়ি চাতক শ্যামা দোয়েল দেবদাস পার্বতী
সুদূরের অনামিকা।
যে পথ হাঁটতে বাকী ছিল আবার সে পথে
যাত্রা হলো শুরু চলার পথ হোক দুজনের সহজ সরল,
আকাশে মেঘের পরশ না থাকলে বৃষ্টি হয়না
আমাদের এখানে জয় পরাজয় নেই বৃষ্টির ছন্দে
পথ চলব দুজন।
মেঘের বাড়ি আমার ঠিকানা পাতাবাহারের বেরা
দুর্বাঘাসের লাল গালিচায় শিশির ভেজা সকালে
অনামিকার পায়ের চিহ্ন দেখে দুচোখের ব্রুর ফাঁকে
চাঁদ রাতে বাতায়ন মেলে আমার ঘুম ভাঙ্গে এবং
দেখি চোখের আঙ্গিনায় স্নেহের মায়া কানন।
===============================
আষাঢ় এলো রূপো বেশে
আব্দুস সাত্তার সুমন
কালিমাখা মেঘের দেশে
আষাঢ় এলো রূপো বেশে
মেঘের দেশ উঠলো হেসে
বর্ষা এলো অবশেষে।
আষাঢ় মাসে বর্ষা আনে
ফলমূল আউশ ধানে
শ্রাবণ ধারা প্লাবনে
আকাশ কালো মেঘের পানে।
পরিচিত রূপ হারিয়ে
নীল আকাশে মেঘ দাঁড়িয়ে
সবুজ অরণ্যে হাত বাড়িয়ে
নবজীবন যায় ছড়িয়ে।
সকাল সন্ধ্যা বৃষ্টি পরে
খেয়া পারাপার বন্ধ করে
কৃষাণ ফিরে আপন নীড়ে
রহমতি ফোঁটা অঝোর ঝরে
গরম কমায় আষাঢ় মাসে
ভরা মৌসুম দুই মাসে
আষাঢ় শ্রাবণ ভালোবাসে
গ্রামবাংলায় ছুটে আসে।
—————————————
অপারগ ব্যর্থকথন
সুরাইয়া চৌধুরী
বোধোদয় হবেনা জেনেও
অহেতুক অঞ্জলি পেতে
চাতকের জলবৃষ্টি চাই।
নিমীলিত ধ্যানে বসে
শিলালিপি পাঠ করি,
প্রাচীন বৃক্ষের বাকল ছুঁয়ে
বার বার পৃষ্ঠা উড়াই।
দীর্ঘকায় নদীগ্রন্থ পাঠ করি
শিকস্তি পয়স্তি কেচ্ছা শোনাই।
গ্রহের অনুগ্রহে জোয়ার ভাটা
সুতো কেটে ক্লান্ত ফিরে যায়।
অপারগ মনোবেদনা নিয়ে
বৃক্ষরা তখনও পাতা ঝরায়।
একনবতি মেঘেদের কাছে
শেষ বৃষ্টির জলটুকু চেয়ে
অযথা তখনও ভিক্ষাবৃত্তি করি।
শূন্যতা ও একাকিত্ব ঘিরে ধরে
হিসেবের গরমিলে উড়ে যায়
যাবতীয় জলজ ধ্যান জ্ঞান,
সজনে খেতের সজিব মাটিও
অন্ত:সারশূন্য বিবর্ণ হলুদ।
—————————————–
বটবৃক্ষের ছাতা
মোঃ আসিফ ইকবাল
বাবা মানে সাগরের বিশালতা
বাবা মানে অবাধ স্বাধীনতা,
বাবা মানে ইচ্ছের পূর্ণতা
বাবা মানে আনন্দের কথা।
বাবা মানে বন্ধনের সত্তা
বাবা মানে মায়ায় একাগ্রতা,
বাবা মানে বটবৃক্ষের ছাতা
বাবা মানে জীবনের শুভ্রতা।
বাবা মানে ভরসার আস্থা
বাবা মানে হাজারো কবিতা,
বাবা মানে জীবনের নির্ভরতা
বাবা মানে স্বপ্নে স্বয়ংসম্পূর্ণতা।
বাবা মানে সত্যিকার প্রেরণাদাতা
বাবা মানে শিক্ষায় শ্রেষ্ঠতা,
বাবা মানে বন্ধুত্বের সৌন্দর্যতা
বাবা মানে জীবনের অপরিহার্যতা।
বাবা মানে লক্ষকোটি আনুষ্ঠানিকতা
বাবা মানে সাগরের বহতা
বাবা মানে সুখময় বাস্তবতা
বাবা মানে পিতৃত্বের মহানুভবতা।
বাবা মানে হারানোয় শুন্যতা
বাবা মানে হৃদয়ের ব্যাকুলতা,
বাবা মানে ভালোবাসায় অপূর্বতা
বাবা মানে শাসনের ত্রাণকর্তা।
বাবা মানে জীবনরাজ্যের সততা
বাবা মানে আমাদের সফলতা,
বাবা মানে হৃদয়জুড়ে তীব্রতা
বাবা মানে আমাদের শ্রেষ্ঠকথা।
বাবা মানে বিবেকের হৃদ্যতা
বাবা মানে আমাদের ছায়ালতা,
বাবা মানে কৈশোরের সত্যতা
বাবা মানে আমাদের উন্নয়নকামিতা।
বাবা মানে দরদের সখ্যতা
বাবা মানে জীবনের মান্যতা,
বাবা মানে দিনরাত্রির প্রিয়তা
বাবা মানে আমাদের গল্পকবিতা।
—————————–
————————–
বৃষ্টিভেজা স্মৃতি
টিপলু বড়ুয়া
বৃষ্টিভেজা স্মৃতির কথা
মনে পড়ে সারাক্ষণ,
বৃষ্টির রিনিঝিনি শব্দ শুনে
নেচে উঠে বৃষ্টিভেজা মন।
বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে
পাড়া থেকে পাড়ায়
মিছিল হয়েছে কত।
বৃষ্টি দিনের কত বর্ষা পেরিয়ে-
বৃষ্টিভেজা শৈশব হয়েছে গত।
বৃষ্টিভেজা মেঠো পথে
হাঁটু সমান কাদায় হেঁটে হেঁটে
শৈশব গেল বন্যার জলে ভেসে।
থৈ থৈ করে বন্যার জলে
ভেসে গেল গ্রামগুলো,
কাগজের নৌকায় ভাসিয়ে
দিয়েছি শৈশব স্মৃতিগুলি।




