ফাহমিনা নূর
বিকেলটা যখন অনেকক্ষণ থমকে থেকে হঠাৎ সন্ধ্যা নামানোর পাঁয়তারা করছিলো তখনই এক ঝাঁক টিয়ে পাখির ট্যাঁ ট্যাঁ আওয়াজ শোনা গেলো। তারা উত্তর-পশ্চিম দিক হতে উড়ে দক্ষিণে যাচ্ছিলো। দক্ষিণে আছে ‘তুমুল’ পাহাড়। তুমুল নামটা বারেকের দেয়া। পাহাড়গুলোর আসল নামটা তার ভালো লাগে না, নাম আসলে নেইও, এলাকার নামেই তাদের ডাকা হয়। এ নিয়ে পাহাড়গুলোর কোনো জাত্যাভিমান নেই। ওরা জানে এ শহরের অন্যান্য পাহাড়ের মতো একদিন তারাও কাটা পড়বে সরকারের বিধি নিষেধ অমান্য করে সরকারি দপ্তরের দেখতে না পাওয়া নাটকের মধ্য দিয়ে। তাদের নাকের ডগায় ঘটবে এইসব হত্যাযজ্ঞ যা তারা জানবে না। কথা হচ্ছে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখিগুলো যে কাক নয় সেটা জানান দেয়ার জন্যই বোধকরি ঐ ট্যাঁ ট্যাঁ রব। এ এলাকায় টিয়েপাখি সব সময়ই ছিলো। আগে পাহাড় বেশি ছিলো, পাহাড়েই লোকচক্ষুর অন্তরালে তাদের জীবনচক্রের অবসান হতো। বেলকনিতে দাঁড়ানো বারেকদের সাথে তাদের দেখা হতো না। এখন পাহাড়গুলো পাতলা হয়েছে তাই জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়েই তারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে।
আবার সন্ধ্যার আগেই ফিরে যায় তাদের যৎসামান্য বেঁচেবর্তে থাকা আদিম ডেরায়। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বারেক পরপর দুটো মন্ ড শেষ করে কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবনা সহযোগে। শেষের সিগারেটের বাটটা টবে গুঁজে দিতে দিতে বারেক ভাবে কাজটা ঠিক হচ্ছে না। লোপা দেখলে খিঁচখিঁচ করবে। সেটা অবশ্য সয়ে গিয়েছে, তবে আজ মনে হয় না লোপার এসব দিকে নজর যাবে। আজ বারেক শাশুড়ি হারা হয়েছে। কালরাতে লোপা হাসপাতাল থেকে ফিরেছে চোখ ফুলিয়ে, অবস্থা সুবিধার নয় তখনই বুঝেছিলো। কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি, লোপার সাথে সাতদিনের বেশি হয়ে গেলো কথা বন্ধ। ব্যাপক কোনো ঝগড়াঝাটি নয়, তুচ্ছ কোনো বিষয়ে কথাকাটাকাটির জের। এসব ক্ষেত্রে লোপাই শেষমেষ সন্ধি করে, এবার তা হলো না। লোপা হাসপাতাল, ডাক্তার এসব নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সন্ধি করার অবকাশ পায়নি। দুর্যোগে অবশ্য শরণার্থী মানুষেরা পরষ্পর কাছাকাছি আসে। মৃত্যুতো একরকম দুর্যোগই।
ভোরবেলা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই লোপা টের পেয়েছিল অন্তিম খবরটা এবার শুনতে হবে। চুপচাপ শুনলো। কালরাতে ঘুমটা ঠিকমতো হয়নি, বারবার ভেঙে যাচ্ছিলো। মাথাটা ভারি হয়ে আছে। ঠিকমত শোকাচ্ছন্নও হতে পারছে না, মনে হচ্ছে অনেক কাজ। বাবা একরকম একাই, দু’বোন দেশের বাইরে। ভাই আর ভাইয়ের বউটা কিছুটা ছাড়াছাড়া, যেন তারা কক্সবাজার আর বাবা মা সেন্টমার্টিনের দূরত্বে কেউ। মা বিহীন জীবনে বাবার ছেঁড়াদ্বীপবাসী হতে দেরী হবে না। এসব কথা গত ক’দিন ধরেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো, কাউকে বলা যায় না এমনকি বাবাকেও না। বাবা বুদ্ধিমান মানুষ, বোঝেন নিশ্চয়ই, বহু বিচিত্র মানুষ ঠেঙ্গিয়েই জীবনের এ পর্যায়ে এসেছেন। পুত্র আর পুত্রবধুর মাথায় কী চলছে না বোঝার কথা নয়। তবে আশার কথা হলো তিনি কারও কাছে কিছু আশা করেন না। রাতুলের আর তার বৌয়ের ব্যাপারটা মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ার পরপরই বোঝা যায়নি।যথেষ্ট ভেঙে পড়েছিলো রাতুল নিজেও। কিন্তু যুঝতে যুঝতে লোপার মা যখন অনেকটা হাল ছেঁড়ে দিয়েছিলেন আর ডাক্তাররা কোনো আশার বাণী শোনাচ্ছিলেন না তখন থেকেই তাদের এই গা ছাড়া ভাবটা দেখা গেল। শেষ পর্যন্ত লড়াই জারি রাখার মত মনোবল সবার থাকে না। গাড়িতে উঠতে উঠতে লোপা ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে। আর বারেক দেখে তাকে অনেকটা খবর পাঠিকাদের মত নিরাসক্ত কন্ঠে মায়ের মৃত্যু সংবাদ দিয়েই লোপা বেরিয়ে গেল। তাকে একবার সাথে যেতে বললোও না, তার জন্য অপেক্ষা করাতো দূরের কথা। হালকা অপমান লাগলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় বারেক সেটা গায়ে না মাখার সিদ্ধান্ত নিলো। আস্তে ধীরে নাস্তা করে সে-ও একটা ট্যাক্সি নিয়ে রওয়ানা দেয়। কিন্তু যাবে টা কোথায়! শাশুড়ি আম্মাকে কি বাসায় আনা হয়েছে না কি এখনও হাসপাতালের ফর্মালিটিস সারা হয়নি! বারেক ভাবে। শ্বশুরবাড়ি আর হাসপাতাল যদিও কাছাকাছি। ভাবতে ভাবতে শ্যালককে একটা ফোন দিলো। গত সাতটি বছর ধরে আজকের এই মৃত রমণী তাকে অকৃপণভাবে মাতৃস্নেহ দিয়ে গেছেন। বারেকের সেকথাটাই মনে আসে এবং নিজের মায়ের মুখটা মনে করতে গিয়ে একটা কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো সাদাকালো বোঝা যায় কি যায় না এমন একটা মুখ মনে আসে। নিজের মায়ের স্মৃতি বলতে ঐ ছবিটাই।
যে কোনো আচার আনুষ্ঠানিকতা বারেকের কাছে ক্লান্তিকর মনে হয়, এমনকি সেটা যদি সৎকারও হয়। ভিড়বাট্টাও বেশিক্ষণ সয়ে নেয়া যায় না। তাই দাফনের পর সে আর শ্বশুরবাড়িমুখো হয়নি, কবরস্থান থেকে সোজা নিজ ঘরে ফিরে আসে। লোপা কি তাকে খুঁজবে? এমন একটা প্রশ্ন মনে উদিত হতে চাইলে বারেক অচিরেই তাকে বিনাশ করে দেয় এই ব’লে যে, লোপা এখন ঐ বাড়ির বড় মেয়ে হওয়ার দায় সামলাতে ব্যস্ত এবং অতি অবশ্যই সেই ব্যস্ততার ফ্রিকোয়েন্সিতে বারেক নেই।
দীর্ঘদিন ধরে লোপার মা ক্যান্সারে ভুগছিলেন জরায়ুর ক্যান্সার ছড়াতে ছড়াতে ফুসফুস পর্যন্ত গিয়েছে। কাটাছেড়া করেও শেষ রক্ষা হয়নি। বাদ জোহর দাফন সম্পন্ন হয়, পরবাসরত কন্যাদ্বয়ের জন্য অপেক্ষা করা গেল না। তাদের একজন আবার আদৌ আসতে পারবে কিনা তার-ই নিশ্চয়তা নেই। তাই অপেক্ষারও মানে নেই। ঘর ভর্তি মানুষ, দুপুরে তাদের খাওয়াতে গেলে লোপার চোখ বারেক নামের কাউকে খোঁজে। নেই, থাকে না। এইসব বেদনাদায়ক সময়গুলোতে লোপা জানে বারেক নামের মানুষটা তার ভার লাঘব করার জন্য পাশে থাকে না। সাত বছর ধরে সংসার নামক একটা ভ্যাক্য়ুামে ধূলিকণার মতো ভাসতে ভাসতে লোপা জেনে গেছে মানুষ মূলত একা। স্টিলবেবি জন্ম দেয়ার পরও শারীরিক কিছু জটিলতার কারণে তাকে হাসপাতালে আরও কিছুদিন থাকতে হয়েছিলো। সে সময়ও লোপা অনুভব করেছিলো জগত সংসারে কিছু যন্ত্রণা থাকে যা কেবল নিজের করেই পাওয়া। আজ এ বেলা খাওয়া দাওয়ার পর কিছুটা ফুরসত পাওয়া গেলে মায়ের বিছানায় শুয়ে লোপা আবিষ্কার করে এমন একটা দিনে লোপা মায়ের কথা ভাবছে না, ভাবছে নিজের কথাই। অথচ কী অমানুষিক খাটুনিটাই না খাটলো গত ক’দিন। মায়ের জন্য শোক করবে না কি স্বস্তিবোধ করবে সে উপসংহারেও পৌঁছানো যায় না। মায়ের কষ্টটা সহ্য করা যাচ্ছিলো না। আজ মা’কে মাটির নিচে শুইয়ে রাখা হলো, দিনেদিনে মায়ের শরীরটা মাটির সাথে মিশে যাবে। মায়ের পরিচিত ঘ্রাণটা এখনও জীবন্ত, স্মরণ করতে গেলে ঘ্রাণটা নাকে এসে লাগে। ইদানীংকার অসুস্থ শরীরের ঘ্রাণ নয়। শৈশবের মায়ের ঘ্রাণ, যেটা দুপুরে বুকের কাছে শুয়ে থাকার সময় প্রাণ ভরে নিতো। লোপা টের পেলো বালিশটা আবার ভিজে যাচ্ছে।
তাহলিল পড়তে পড়তেই লোপা শুনতে পায় রাতুলের বউ এমি কাউকে ফোনে বলছে, ” রাতে লোপা আপুর বাসা থেকে খাবার পাঠাবে। আপনি আজ আর না পাঠান, খামোখা নষ্ট হবে। ”
লোপার ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়, মুখে কিছু বলে না। ফোন রেখেই অবশ্য এমি এগিয়ে আসে, জানায়, “বারেক ভাই ফোন করেছিলেন, বললেন রাতের খাবার পাঠাচ্ছেন।” বলেই বুদ্ধিমতী এমি দ্রুত লোপার সামনে থেকে সরে যায়। মুখটাকে যথাসম্ভব নির্বিকার রেখে লোপা শ্যালকপত্নীর সাথে বারেকের বোঝাপড়াটা বোঝার চেষ্টা করলো। শঙ্কিত হবার কিছু নেই, বারেককে সে চেনে। তার নারী প্রীতি নেই, থাকলেও তা ধর্তব্যে পড়ার মত নয়। কিন্তু খাবার পাঠাবে মানে কী! আম্বিয়ার মা’র এতটা এলেম নেই যে কোনো গাইড লাইন ছাড়াই কাজটা করতে পারবে। নিশ্চই বারেক কোথাও খাবার অর্ডার করেছে। কোথায় করা হলো, মেনু কী, পরিমাণ কত কিছুই কি আলাপ করার মত ছিল না! আলাপ ছাড়া এসব কাজ হয় না আবার চাইলে আলাপ ছাড়াই জগতের সকল কর্মকান্ড সম্পাদন সম্ভব। আর এসব অবজ্ঞা বারেক জেনে বুঝেই করছে। তাকে যে অগ্রাহ্য করা হলো তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার তাগিদে। অথবা বিষয়টি ঠিক এমনও নয়, অবচেতনের গ্রাহ্যতা বা অগ্রাহ্যতা এভাবেই হয়তো ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র আচরণে অজান্তেই প্রস্ফুটিত হয়। আর এসবই যখন ভাবতে থাকে তখন লোপার মনে হয় না যে সকালবেলা বারেককে ফেলে হনহন করে বেরিয়ে আসাকেও ‘অগ্রাহ্যতা’ নাম দেয়া যায়।
অনেক রাতে বারেক এসে আবার বেলকনিতে দাঁড়ায়। তখন এটা অন্যরকম, অন্যরকম মানে দিনের চাইতে ভিন্ন রকম। আশেপাশের দালানগুলোকে মনে হচ্ছে অশরীরী পাহারাদার যাদের ছায়া আছে, কায়া নেই। দূরে কোনো এক বাসা থেকে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। লোপা বাসায় নেই, বারেক চাচ্ছিলো রাতের খাওয়া শেষে সাথে ফিরুক। খুব ক্যাজুয়েলি একবার জিজ্ঞেসও করেছে ফেরার ব্যাপারে। অসম্মতি জানালো, অসম্মতি বলতে সে তার বাবার সাথে ক’টা দিন থাকতে চায়। এরপর হালকা দু’য়েকটা কথা। এতে আর কিছু না হোক টানা ক’দিন কথা না বলার ফলে যে বরফের চাঁইটি ক্রমশ পুরু হয়ে উঠছিলো তার প্রাথমিক স্তরটি ভাঙলো। রাস্তার নিয়ন আলোয় বারেকের চোখ সরু হয় সে পাশের টবে রঙ্গন গাছের দিকে তাকায়। আবছায়া ঝোপ ছাড়া কিছু দেখা যায় না। চোখের আন্দাজে বারেক দু’ আঙ্গুল বাড়িয়ে ঝোপের তলা থেকে সিগারেটের বাট দু’টো বের করে। বারেকের ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটে ওঠে, বিয়ের পর যখন লোপা খোঁপা করতো তখন এভাবেই দু’আঙুলের আগায় চুলের ঝোপ থেকে খোঁপার কাটা বের করে আনতো। এখন অবশ্য লোপা খোঁপা করে না। কোমর ছাপানো চুল উঠে এসেছে পিঠের উপর। একটা হেয়ার ক্লিপ দিয়েই তাকে শাসনে রাখা যায়। সিগারেটের বাট দু’টো রেলিঙের উপর রাখে, ঘরে ঢুকে বিনের ভেতর ফেলে দেবে। আজ ফেরার সময় লোপা দোতলা থেকে নেমে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিলো। সিগারেটের বাট যথাস্থানে ফেলে দেয়ার মানে তাই বারেকের তরফ থেকে লোপাকে বলা ‘থ্যাঙ্ক ইউ’।
চতুর্থদিন এক আড়ম্বরপূর্ণ ভোজের আয়োজন শেষে সকল অতিথি অপসৃত হলে লোপার বাবা বারেককে নিজ কামরায় ডেকে নেন। তার কিছুক্ষণ পরই কামরাটিতে শব্দবিহীন যে বজ্রপাত হয় তার জন্য বারেকের কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিলো না। এই বৃদ্ধ মহাশয়কে সে সজ্ঞানে এড়িয়ে চলে। সেল্ফমেইড মানুষ ব’লে একটা সম্ভ্রম কাজ করলেও বারেক ভুলতে পারে না পিতার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও লোপা যখন বারেককেই বিয়ে করার দৃঢ় সিদ্ধান্তের কথা জানায় তখন এই ভদ্রলোক বারেককে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ‘ফকির’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কথাটি ভুলতে না পারলেও ও নিয়ে বারেকের অন্তরে কোনো জ্বালা যন্ত্রণা নেই। কারণ কথাটির মাঝে সত্যতা ছিলো না। ‘ফকির’ বলতে তিনি যা বোঝাতে চেয়েছিলেন বারেকের অবস্থা তেমন করুণ ছিলো না। হয়তো তার অবস্থা লোপার মতো কন্যার পিতার প্রত্যাশার সাপেক্ষে যথেষ্ট ছিলো না। বিয়েটা নির্বিঘ্নে হয়ে গেলেও বারেক বুঝে নিয়েছিলো এই ভদ্রলোকের সাথে তার একটা সম্মানজনক দূরত্ব রেখে চলতে হবে এবং সে তা-ই করে এসেছে। কিন্তু আজ যখন ভদ্রলোকের পেছন পেছন বারেক তাঁর কামরায় ঢুকছিলো তখন সদ্য জীবনসঙ্গীকে হারানো এই বুড়ো মানুষটার জন্য এক দরদীয়া আকাশ তার অন্তরে লীন হয়েছিলো যেমনটি হতে পারে কোনো পিতার জন্য কোনো এক পুত্রের অন্তরে।
শ্বশুরমশাই যখন বারেকের শরীর-স্বাস্থ্য আর চাকরি- বাকরির খোঁজখবর নিচ্ছিলেন তখনও বারেক ভাবছিলো মানুষটা বোধয় সঙ্গ লোভেই তাকে আটকে রেখেছে। কিন্তু যখনই তিনি বললেন, “তোমার আর লোপার মধ্যে সমস্যা কী আমাকে একটু বুঝিয়ে বলো। ” তখন বারেকের ভেতরটা একটু নড়েচড়ে উঠলো। কিছু না বলে বারেক তাকিয়ে থাকে।
ঃ লোপা যে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে সেটা তুমি জানো?
বারেক মৃদু মাথা নাড়লো কি নাড়লো না বোঝা গেলো না। সে এ কথারও কোনো উত্তর দিলো না তবে তার মুখ দেখে বোঝা গেলো ফ্ল্যাটের বিষয়টি সে জানে না।
ঃ সে পাহাড়তলীতে একটা দু’কামরার ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছিলো প্রায় সাত আট মাস আগে, মাত্র তিনটা কিস্তিতে টাকা শোধ করলো বলে ভালো দামে পেয়েছে। যার কাছ থেকে নিয়েছে তাকে আমি চিনি। গতকাল সে ফ্ল্যাটের চাবি পেয়েছে।
একটু থেমে যোগ করলেন-
ঃ তুমি ভেবো না ফ্ল্যাট কেনার টাকা তাকে আমি দিয়েছি। আমি দিলে তাকে ফ্ল্যাটই দিতাম তবে কোনো ভদ্র-সভ্য জায়গায়, আরেকটু ভালো মানের। সে গত ক’মাসে তার সমস্ত গয়না বিক্রি করেছে, এফ ডি আর ভেঙেছে। মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা পেয়েছিলো সেটাও সে এখানে ঢুকিয়েছে। রেজিস্ট্রেশনের সময় কিছু কম পড়লো, সে টাকাটা আমার কাছ থেকে নিয়েছে ধার হিসেবে। তার আগে আমার মেয়েটা একটা এক কামরার ঘর ভাড়া নেয়ার জন্য সারা শহর ফ্যা ফ্যা করে ঘুরেছে।
‘আমার মেয়েটা’ বলার সময় তিনি কি গলায় একটু বেশি জোর দিয়েছেন! যেন হালকা স্বরে ভারী তথ্য দেয়ার মতো করে বোঝাতে চাইলেন তাঁর মেয়েটা এখন বারেকের কেউ নয়।
তিনি ব’লে চলেছেন।
ঃ নিজের বেতনের আওতায় একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়ার জন্য তস্য থেকে তস্য গলি চষে বেরিয়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের পরিত্যক্ত ছাদঘরে গিয়ে আশ্রয় খুঁজেছে। কোন দুঃসহ বেদনা বুকে চেপে রেখে সে এসব করেছে সে সম্পর্কে আমাকে কোনো ধারণা দিতে পারো?
ঃ আপনাকে সে এসব ঠিক কখন বলেছে?
পাল্টা প্রশ্ন ক’রে বারেক মুখ খোলে।
ঃ আমাকে সে কিছুই বলেনি। জানাজানি হওয়ার ভয়ে ঘোরাঘুরি করার সময় এমনকি গাড়িও সে নেয়নি। সিফাতের কাছে ভাড়া বাসা খোঁজার কথা শুনে ওর মাধ্যমে আমিই ফ্ল্যাট কেনার পরামর্শ দেই। একা একটা মেয়ের জন্য ভাড়া বাসার চাইতে নিজস্ব ফ্ল্যাটে থাকা অপেক্ষাকৃত কম অনিরাপদ। তবে সে ওরকম একটা জায়গা বেছে নেবে সেটা বুঝতে পারিনি।
সিফাত নামটা শুনে বারেকের ভেতরটা তিতকুটে হয়ে ওঠে, মনে হয় গলায় কষ জমতে শুরু করেছে। আঁচ করছে তার সাথেই লোপা সম্ভবত তাদের ব্যক্তিগত বিষয় শেয়ার করছে তাই সে হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা। সিফাত লোপার ফুপাতো ভাই। ওরই বয়সী। তাকে লোপার বাবার ডান হাতও বলা যায়। তাঁর ব্যবসার খুঁটিনাটি এখন তার হাতে। তাঁর অফিসেই বসে। রাতুলের ব্যাবসায় মন নেই ব’লে বাবা এর ওপর নির্ভরও করেন। সেটা সমস্যা নয়, লোপার বিষয়ে তার নাক গলানোটাই বারেকের শিরপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখ চালু ছেলেটাকে বারেকের পছন্দ হয় না, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি চালাক মনে হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে লোপাই মাথায় ঘুরছে। সে এমন অদ্ভুত আচরণ করে কেন! বারেক অসহায় বোধ করে। দৃশ্যত লোপার সাথে তার কোনো সমস্যা নেই।
বারেকের অস্থিরতা কখনোই প্রকাশ্য নয়। লোপাদের বাসা থেকে বেরুনোর সময় বারেক ইচ্ছে করে গাড়ি নেয় না। তার হাঁটতে ইচ্ছে করছে, হাঁটতে হাঁটতে এমন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে যেখানে পৌঁছানোর পথ কখনও ফুরোয় না।
অজানা কোনো গন্তব্যে নয় বারেক এসে পৌঁছায় নিজের ঘরে কিন্তু ঘর তাকে শান্ত করতে ব্যর্থ হয়। সব কিছু শেষ হয়ে যাবার মতো কিছু ঘটেনি তবু এতটা নিঃস্ব লাগছে কেন তার উত্তর খুঁজে পেতে হলে লোপার সাথে খোলাখুলি কথা বলা দরকার। অথচ সেটাই হয়ে উঠছে না। কিছু ডালিম ত্বকের উপর সুন্দর, ভেঙে দিলে পোকা খাওয়া নষ্ট কোষ বেরিয়ে পড়ে, সে সম্ভাবনা নাকচ করা যাচ্ছে না।
বারেক ভাবতে থাকে। বারেকের ঘাম হয়। বারেকের বারবার পিপাসা পায়। মনে হয় ছাদে গেলে ভালো লাগবে। খোলা ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে মনে হয় ঘরই ভালো ছিলো।
সে কি লোপার উপর অবিচার করেছে? অবহেলা? অনাদর? লোপার এমন মনে হয়! লোপাতো তাকে চেনে, বোঝে, তবু কি সে আলাদা হওয়ার কথা ভাবছে! বারেক জোরাজুরি করার মতো মানুষ নয়, লোপা সেটা জানে। সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে বারেক কখনও পিছু টেনে ধরবে না। আগ বাড়িয়ে কোনো সিদ্ধান্ত তো দূর, নিজ থেকে কোনো প্রশ্ন করাও তার ধাতে নেই। লোপা জানে, লোপা সব জানে। লোপা এ-ও জানে বারেকের অন্তর সেই ক্ষীণ সলিল ধারার মতো যার কোথাও যাওয়ার তাগিদ নেই কেবল যেতে হয় ব’লে যাওয়া। তার সাথে কিছু জুড়ে গেলে ফেলে দিতে পারে না, ছেড়ে গেলে ধরে রাখতে জানে না।
ব্যর্থতার দায়টুকু কেবল তার স্বভাবের, তার অন্তর্মুখীতার। হৃদয় তার মোম মাখানো কাগজ, কলমের কালি ওখানে বসে না কিন্তু প্রগাঢ় ছাপ ফেলে যায়।
এক দুঃসহ ক্লান্তি লোপাকে ঘিরে ধরেছে। অনেক কাজ বাকি। কলেজের ছুটি শেষ হয়ে আসছে কিন্তু কোনো কাজই গোছানো হলো না। ঘরে বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাজের বাইরে শরীরটা হয়েছে বাড়তি উপদ্রব, কিছুতেই সহযোগিতা করছে না। ব্যাংকে যেতে হবে, কিছু কেনাকাটাও বাকি। বেরুনোর প্রস্তুতি নিতে গিয়েও বারবার ফিরে আসছে বিছানায়। কিছু জিনিস গোছাতে বাসায় যাওয়া দরকার। বারেকের বাসাকে এখনও অবচেতনে নিজের বাসা ভাবছে, সুক্ষ্ম মন তা ধরে ফেলে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। লোপা ম্লান হাসে, মৃদু শ্বাস ফেলে ঘরের বাতাসে। বারেককে একটা কথা বলা খুব জরুরি। খুব শীঘ্রই সে নিজের ফ্ল্যাটে উঠে যাচ্ছে, শুধু তা-ই নয় কথাতো আরো আছে। কোন কথাটি আগে বলা উচিত তা ভাবতে ভাবতে লোপার চোখ বুঁজে আসে। পর্দা টানা ঘরের মোলায়েম আলোয় বেডসাইড টেবিলের উপর রাখা একটা ফ্ল্যাটের চাবি আর একটি প্র্যাগনেন্সি টেস্ট স্ট্রিপ পরষ্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ফাহমিনা নূর, কবি ও গল্পকার




