গৌতম কুমার রায়
পরিবেশ সংরক্ষণের কাজ সঠিকভাবে করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়। সরকারী আদেশ বহাল আছে “ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ।” তবুও বাজারে চলছে, কেন? বসতির ড্রেন-নালা বাড়ি, দোকান, কারখানার বর্জ্য জল ও পদার্থ নদীতে যাবে কেন? বৃষ্টির জল টানার জন্য নদী, শাখানদী, নালা। পৃথিবীর জলাবর্তের অংশ। জল-বৃষ্টি-মাটি ও মানুষের পিপাসা পূরণ করে। অতিরিক্ত জল সাগরে ফিরে যায় নদী বেয়ে। নদী পুষ্ট হয় উপনদী, শাখানদী, নালা ও ড্র্রেনের জলে। এখন নদীর বুক বাঁধ ব্লকের জন্য গলা চেপে ধরা হয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই সামান্য জলে দেশের নদী-নালা ফুঁসে ওঠে কেন ? মাটি প্লাস্টিক, আবর্জনা ও কংক্রিট চাপায় জলাধারগুলো। পুরো বর্ষাতেও মাটির গর্ভে জলের জন্য হাহাকার। দিন-দিন নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভের জলস্তর।
বুক ফোলা বালুর টিউমারে নাব্যতা কমছে নদীর। নদীতে অনেক মানুষ সেপটিক ট্যাংক তৈরি করে, সেখানে সোক পিটের ব্যবস্থা থাকে না। কলকারখানার কোন বর্জ্য পরিশোধন করা হয় না। এসব বর্জ্য ড্র্রেন হয়ে নদীতে গিয়ে পরে। নদী বাঁচে না তাকে বাঁচতে দেওয়া হয় না। নদী না বাঁচলে দিনেদিনে যে সমুদ্রও নিঃশেষ হয়ে যাবে। বাতাসে মিথেন, কার্বনডাইঅক্সাইড, কার্বনমনোক্সাইড, হাইড্রোফ্লুরোকার্বন, হাইড্রোক্লোরোফ্লুরোকার্বন ও জলীয়বাষ্প ইত্যাদির মতো বিষ চালান দেওয়া হচ্ছে বর্জ্যরে পঁচনে, দহনে ও জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে। এগুলো ‘গ্রিনহাউস’ গ্যাস নয় আদৌতে তা পৃথিবীকে গরম করার অনুসঙ্গ। জীব বিশেষ করে মানুষ প্রতি মুহূর্তে, সেই অনুসঙ্গ রসদ নিয়ে হেঁটে চলে নিজেকে পোড়াতে। শিল্প বিপ্লবের পরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১.১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। গত বছর তা ছুঁয়েছে ১.৫৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। ‘রিডিউস’ ‘রিইউজ’ ‘রিসাইকেল’ তত্ত্ব এসব স্থানে প্রয়োগ হয় না। এ জন্যই বাড়ছে উষ্ণায়ন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতা। যে কারণে মরছে মানুষ, অর্থনৈতিক আয় কমতে কমতে বাড়ছে দারিদ্র্যতা। এই হারে পরিবেশ দূষণ বাড়তে থাকলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে বর্তমান সভ্যতার অনেকটা।
আমাদের দেশের আবহাওয়া আগে ছিল নাতিশীতোষ্ণ প্রভাবপন্ন। বিগত সময় ধরে উষ্ণতা বৃদ্ধির লক্ষণে প্রতীয়মান হয়, এখন তা আগের অবস্থায় আর নেই। এখন আমাদের আবহাওয়া চরম মৌসুমী ভাবাপন্ন। এই জন্য বাতাসে বেড়েছে তীব্র তাপ প্রবাহ। বাতাসে উষ্ণতার কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে ধূলিকণার পরিমাণ। ধূলি বাতাস এখন নিত্য দিনের ঘটনা। বাতাসের ভাসমান ধূলি-সীসকণা নিঃশ্বাস ও খাবারের মাধ্যমে সোজা চলে আসছে মানুষের শরীরের ভেতর। এতে বাড়ছে অসুস্থতা। তাপের বিরূপ প্রভাবে আমাদের শিল্প, কৃষি, খাদ্য উৎপাদন কমে আসছে। মানুষের স্বাস্থ্য, খাদ্য এবং কর্মসংস্থানের বিষয়টিতে বাড়ছে ঝুঁকি। একটি সমীক্ষায় দাবী করা হয়েছে যদি প্রকৃতিতে ১ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপ বাড়ে, তবে অর্থগত উৎপাদন কমে ২ শতকরা। উষ্ণতা বাড়ার কারণে চাপ পড়েছে আমাদের বিদ্যুৎ এর উপর। অব্যাহত বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে নগরের চেয়ে গ্রামিণ মানুষদেরকে বিদ্যুৎ হতে বঞ্চিত বাখা হয়।
প্রকৃতিতে যে ভাবে জলবায়ুগত ঝুঁকি উঁকি দিচ্ছে তাতে জীব তথা মানুষের টিকে থাকাটা হয়ে পড়েছে নিতান্তই প্রকৃতির উপর। মানুষের নিজের এবং প্রযুক্তি কৌশলটুকুও তার থেকে হাতছাড়া হে গেছে বলে মনে হয়।
পরিবেশ বিজ্ঞানের “মাইক্রোক্লাইমেট” বলে একটা কথা আছে। এই তত্বে মানুষ গরমে অতিষ্ঠ হয়ে দূরে পাহাড় বা বনে গিয়ে একটু স্বস্তি খোঁজে। পরিবেশের এই স্বস্তিই মাইক্রো ক্লাইমেট। সমুদ্রে যে ‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’ সৃষ্টি হয়েছে তাতে মুখ্য ভূমিকা নিচ্ছে পৃথিবীর কয়েকটি জনবহুল দেশ। চীন ও বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষ। নদীগুলোর অন্যতম হল চীনের ইয়াংৎসি এবং ভারতের গঙ্গা যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। প্রতি মুহূর্তে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে টন টন প্লাস্টিক ও বর্জ্য। সাথে পলিও। যে জন্য বাড়ছে ‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’এবং উষ্ণতা। জলের অভাবে নদীগুলো মরতে বসেছে। আমাদেরকে ফাঁকা জায়গায় গাছ লাগাতে হবে, নদীর পাড়ে গাছ লাগাতে হবে। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে জনসংখ্যা এবং পরিবেশ সুরক্ষার তক্মা জেনে জীবন স্টাইলে পরিবর্তিত ধারায় জীবন যাপন করতে হবে। এই পরিবর্তনে উপলক্ষ্য হয়ে উঠতে পারে একমাত্র গাছ। অর্থাৎ মানুষ বনের হোক, মানুষ বৃক্ষের হোক, তা মানুষের প্রয়োজনে।
গৌতম কুমার রায়, গবেষক, উদ্ভাবক ও পরিবেশ বিজ্ঞানী।




