এখন সময়:বিকাল ৩:৫৬- আজ: বৃহস্পতিবার-৬ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২১শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:বিকাল ৩:৫৬- আজ: বৃহস্পতিবার
৬ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২১শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

প্রেম ও ফুল- সুয়ানি সুকণ্ঠা

ভাষান্তর : সাদাত উল্লাহ খান

 

একটা ফুল আমি হাতে নিয়েছি। বাগানের বাইরের ঝোপের মধ্যে লাল ও সাদা ফুয়েঙফা ফুল বেড়ে উঠছে। আমি প্রতিদিন বারান্দা থেকে ভোগেনভেলিয়া ফুল দেখতে পছন্দ করি। সূর্যালোকের সাথে এসবের একটা সংলাপের সূত্রপাত হয়েছে। বাঁশঝাড়ের সূক্ষ্ম তীক্ষ্মতার চমৎকার ডালপালা রয়েছে। আপনি যদি চৈনিক ব্রাশ পেইন্টিংয়ের সাথে এগুলোর তুলনা করতে চান, মনে হয় আপনি একটা সর্বশ্রেষ্ঠ তুলনা দেখতে পাবেন। কারণ ফুয়েঙফা ফুলকে মনে হতে পারে সস্তা কাগুজে ফুল।

এটা আমাকে মাঝেমধ্যে স্মরণ করিয়ে দেয়, শাশ্বত যৌবনের উচ্ছ্বাসে ভরপুর রূপসী রমণীর কথা। একবার যখন দ্রুত পূর্ণ প্রস্ফুটিত হয়, শাখাপ্রশাখা থেকে ফুয়েঙফা ফুল ঝরে পড়ে এবং বাতাস এগুলোকে পুকুরে ছুড়ে মারে।  এসব ঝাঁকে ঝাঁকে পড়তে থাকে, সম্পূর্ণ বিবর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এবং পানির অন্ধকারের গভীরে তলিয়ে যায়।

 

 

ফুয়েঙফা ফুল যখন পূর্ণ প্রস্ফুটিত হয়, ধীরে ধীরে রঙ ফ্যাকাশে থেকে ঘন কালো হয় এবং ভিতরে পুংকেশর ছোট ছোট সাদা বিন্দুর মতো ছড়িয়ে যায়। ঠিক যেমন আল্লাহ চাঁদবিহীন রাতের আকাশে সাদা রঙে রঞ্জিত তারার সাথে ফুলের হৃদয় ফোঁটায় ফোঁটায় ছড়িয়ে দিয়েছে।

 

আমার বিস্ময় হয়, তোমার ছোট ছোট সাদা বিন্দু ছাড়া তুমি এখনো এতো সুন্দর হতে পার, ফুলের মধ্যে তোমার ফুল নিয়ে? আমি ফুলের কুড়ি টুকরো টুকরো করছিলাম, একটা একটা করে ফুলের পাপড়ি ছিড়ছিলাম। এক প্রকারের নির্দয় নির্মমতায়। আমি জিনিষটার সূক্ষ্ম লাবণ্যের বিষয়ে বিন্দুমাত্র বাড়তি চিন্তা করি নাই। একাকী হৃদয়ের প্রতি প্রকৃতির সান্ত্বনার উপহার হল ফুল। এমনকি আমি সর্বশেষ কয়েকটি পাপড়িও ছিঁড়ে চূর্ণবিচূর্ণ করি। আমার সাদা আঙুলে ফুলের রমণীয়তা শুকনো রক্তের রূপ নেয়।

ঝলমলে লাল পাপড়িসহ আর একটি ভোগেনভেলিয়া ফুল আমি হাতে তুলে নিই। এই ফুলটিকে সযত্নে টিস্যুপেপার দিয়ে মুড়িয়ে নিই এবং আমার ব্যাগের ভিতর রাখি। বাসের মধ্যে সারাক্ষণ আমার আকাঙ্ক্ষা হতো ব্যাগটা খুলে ফুলটা দেখি যদি কনুইয়ের ঠেলাঠেলিতে পিষ্ট হয় অথবা কামুক কেউ একজন ভিড়ের মধ্যে আমার দিকে চাপ দেয়ার সুযোগ খোঁজার কারণে ফুলটা ভেঙে যায়, যতক্ষণ না আমি তাদের সাথে শারীরিক সংস্পর্শ বন্ধে ব্যাগটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করি।

 

আমি যখন গন্তব্যে পৌঁছে, বাস থেকে নেমে যাই এবং হাঁটতে শুরু করি। এমনভাবে হাঁটতে থাকি যেন আমার পায়ে অদৃশ্য পাকা আছে যা মাটির উপরে দ্রুতগতিতে উড়ে যেতে সাহায্য করেছে। ঠিক যেন রেনেসাঁসের চিত্রের দেবতাসম। কোমল সাদা পাতাগুলো আমার ইচ্ছানুসারে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। তবে এসব আমার হৃদয়ে কোনো দাগ কাটেনি। কারণ অনেক আগে থেকেই এসব সর্বদা আমার ছিল, অপেক্ষারত আমার প্রেমিকের সাথে, এমনকি আমি বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে।

 

আমার মনের মধ্যে অতীতের দৃশ্যাবলি হঠাৎ উদিত হয়। সিনেমার দৃশ্যাবলির মতো যেন ইতিমধ্যে সম্পাদিত এবং অনুক্রম অনুসারে সাজানো। মন যা স্মরণ করতে চায় না, আমার মন সতর্কভাবে সেসব দৃশ্য বাদ দিয়েছে, রেখেছে শুধু চমৎকার দৃশ্যাবলি।

 

 

আমি ছিলাম আমার অন্তরঙ্গ প্রেমিকের বাহুতে আবদ্ধ। আমার মানুষটির আছে একই সুন্দর শরীর যেমন অধিকাংশ মানুষের থাকে। তবে আমার অন্তরঙ্গ প্রেমিক বলে সে অন্য যে কোনো পুরুষের চেয়ে সুন্দর, পৃথিবীর যে কারো চেয়ে বিস্ময়কর। আমরা বিশ্বাস করতে চাই অন্তরঙ্গ প্রেমিক কি বলে। আমি কি একজন সিনেমা সম্পাদক নই এবং এটা কি আমার অধিকার নয় আমার কাহিনির সাথে মানানসই বিষয়বস্তু বাছাই ও সম্পাদনা করা?

 

তার কাধ দুটো প্রশস্ত এবং তার কাধ দুটোকে প্রধানত আমার মগজবিহীন মাথার বালিশ হিসেবে ব্যবহার করি। পক্ষান্তরে আমার মুখ দিয়ে অর্থহীন কথার খই ফোটে —-প্রেমের কথা এবং অন্য মিথ্যাকল্পনা যা শুধু কবিতায় অথবা শিল্পীর আঁকা অবাস্তব ফুলের আলোকভেদ্য পাপড়িতে বিদ্যমান। এসব বাষ্প বা মেঘমালার মতোই অবাস্তব।

 

আমি তার দিকে মুখ ঘুরাই। না, সে সরে যায়নি তবে সে মুখ নিচু করে এবং তার ঠোঁট দিয়ে আমার ঠোঁট খোঁজে। যখন আমাদের ঠোঁটে ঠোঁট লাগে, মনে হয় স্বয়ং আমি আকাশে উড়ে চলছি। যদি দুনিয়া এখনো দাঁড়িয়ে থাকত, সেটা হতো আমাদের চুম্বন দেখার জন্যই।

 

আমি তার মুখের দিকে তাকাতে চেয়েছিলাম তবে আমার অন্তরের গভীরে কিছু একটা আমার চোখ বন্ধ রাখে। এই মুহূর্তে আমি ছিলাম একজন অন্ধ বালিকা।

আমি তার আদর ছাড়া কিছুই অনুভব করিনি। আমি তার ঠোঁট অনুভব করি। তাতে এতো উষ্ণতা ও আরাম পাই, আমি নিজেকে এমনই চাপ দিই যেন দু’জন মিলেমিশে একজনেই পরিণত হই। আমি তার শ্বাস-প্রশ্বাসে সিগারেটের গন্ধ পাই এবং তার বগল থেকে এক ধরনের পুরুষ ওডিকোলন মিশ্রিত সুগন্ধি আর তার নিজের পুরুষালি ঘ্রাণ আসে। এটা যাহোক না কেন, এটা ছিল ছিল তার সুগন্ধ এবং এটা আমি ভালোবাসি। আমার সকল চেতনা উধাও হয়ে যায়।

 

তার কপালে আমি আঙুল বুলাই, ঘামে সিক্ত, ঈগল পাখির ঠোঁটের মতো তার নাক আর চিবুক, তাতে আছে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির হুমকি। আমাদের ঠোঁটে ঠোঁট লাগানোর সঙ্গেই এসব খোঁজে দেখি। আমি নিজে যতক্ষণ না দুর্বল হই আমার কোমল জিহ্বার কাতুকুতু অনুভব করি। তার প্রতি আস্থা রেখে নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া কিছুই করিনা যতক্ষণ না আমার হৃদয়ে তার হৃৎকম্প অনুভব করি।

তার পিঠ ও বুক থেকে ঝরা ঘামে আমি পুরো ভিজে যাই। তার কাছ থেকে আমি নিজের শরীর টেনে আলাদা করি এবং একটা ছোট সাদা পাখা দিয়ে বাতাস করি। হংকংয়ে কোনো চৈনিক চিত্রশিল্পী আনাড়িভাবে একটা পাহাড়ের ছবি অঙ্কন করেছেন, পাহাড়ে দুটো গাছ আছে। লোকটি অবশ্যই কোনো শিল্পী ছিল না তবে সেটা তেমন একটা মন্দ নয়। বাস্তবিক পক্ষে, ঠিক এই সময়ে এটাই তাকিয়ে দেখছি।

 

চিত্রশিল্পী পাহাড়টা দেখিয়েছেন সম্পূর্ণ নগ্ন এবং বৃক্ষহীন। শূন্য আসমানের বিপরীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে দেখতে অদ্ভুত ধরনের ঝোপ এবং গাছের নিচে একটা পস্তরখণ্ডের উপর হেলান দিয়ে একজন মানুষ এক প্রকারের বাঁশি বাজাচ্ছে। যদি আপনার পছন্দ হয়, কল্পনা করতে পারেন মানুষটা তার প্রেমের বালিকার জন্য অপেক্ষা করছে। বালিকাটি আসতেও পারে, অথবা নাও আসতে পারে, অথবা আপনি যা ইচ্ছা ভাবতে পারেন।

 

তখন ছিল তীব্র গরম, বাতাস বন্ধ করার মতো অতিমাত্রায় গরম এবং পাখাটি গরম বাতাসকে খানিকটা ঠান্ডা করার দিকে মোড় নেয় এবং পুনরায় গরম হয়। উত্তরাঞ্চলের সংগ্রান উৎসবের কথা আমার মনে পড়ে। আমার জীবনে এমন সময় কখনও আসেনি; তবে আমার শরীর নিয়ে কখনো বলবতী ছিলাম না। তীব্র ঠাণ্ডা লাগা থেকে নিজেকে সামলাতে হতো।

 

সুতরাং আমি কখনো পিছনে ফিরে যাইনি। যাই হোক, কেন আমি যেখানে আমার অন্তরঙ্গ প্রেমিক আছে এই গুমোটভরা ছোট কামরার বাইরে যেকোনো জায়গায় যেতে চাই? যদি কামরাটি ছোট হয় আমরা কেন দুঃখ করব, যখন আমাদের হৃদয় কবির দেখা স্বপ্নের যেকোনো স্বর্গে পাখা নিয়ে উড়ে যেতে পারে? আমার বন্ধু আন্গকার্ন কালাইয়ানাপঙসি কিন্নারি আঁকতে পছন্দ করে, কিংবদন্তির পাখি, ঋজু পাহাড়ের মুখ ও ফ্যাকাসে চাঁদের পশ্চাৎপটের বিপরীতে খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় বসে আছে। আমার প্রায় ইচ্ছা হয় এসব ছবি কাছে পেতে, উড়ে গিয়ে প্রেমের কিন্নারি বোন, স্বপ্ন ও প্রিয়জনের সাথে কথা বলি।

 

আমি সেসব পুষ্প তাদের পাহাড়ের আনাচকানাচ থেকে তুলে আনতে চাই, স্বপ্ন থেকে শিল্পী বিস্ময়কর পুষ্প অঙ্কন করেছেন —–আমিও গোপনে এমন স্বপ্ন দেখি।

 

আন্গকার্ন —-আমার বন্ধু আন্গকার্ন, যে নিজের রচনার প্রশংসা করতে পছন্দ করে; আন্গকার্ন একজন কবি।

 

এক স্বপ্ন থেকে অন্য স্বপ্নে লাফ দেয়া থেকে আমি নিজেকে টেনে আনি।

আমার প্রেমিকের গাঢ় বাদামি নয়নযুগল কোমলভাবে আমার দিকে তাকিয়ে দেখে। আহ্, প্রেম, এটা কতই না মধুর! আমার নিজের কোনো কথা নাই। আমি সর্ব উৎকৃষ্ট যা করতে পারি তা হলো ডাক্তার সু– উইনের কথা ধার করতে পারি।

 

সে আমার দিকে মুখ ফিরায় এবং তার দুই বাহুতে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমার শীতল শরীরের বিপরীতে তার চামড়া মসৃণ এবং উষ্ণ। ফিসফিসিয়ে বলা তার কথায় আমি মনোযোগ দিতে পারি নাই। আমার শরীরের সমস্ত চেতনা তার স্পর্শের পরশে শুধু খুশিতে নেচে ওঠে।

‘প্রিয়তম, এটা অতি গরম’, আমি গুনগুনিয়ে বলি। সে কোনো জবাব দেয় না, শুধু আমাকে আদর করতেই থাকে যতক্ষণ না আমার শরীরের ভেতর থেকে উষ্ণতা বের হওয়া অনুভব করি। আমার লম্বা চুলের বেণী খুলে যায় এবং কয়েকটি চুল আমার মেরুদণ্ডের ওপর গড়াগড়ি খায়। আমার প্রেমিকের রুমাল দিয়ে আমার চুল বাঁধার চেষ্টা করি। রুমাল থেকে তার গন্ধ পাওয়া যায়। রুমালটি ব্যবহারের আগে সেটা থেকে তার ঘ্রাণ নিই। ‘এটা নোংরা’, সে দুঃখ প্রকাশ করে বলে। জবাবে বলি, ‘আমি পরোয়া করি না।’ ‘আমি অতিমাত্রায় গরম। কয়েক মিনিট আমার কাছে আসিও না।’ সে প্রতিবাদ করে বলে, ‘আমিও গরম।’ আমরা পরস্পর চোখে চোখ রাখি এবং অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি। আমরা হাসি এবং হাসি বন্ধ করি, আনন্দ অনুভব করি, যা শব্দ তরঙ্গের মতো ভেসে আসে এবং নাগালে চলে আসে আর আমাদের থামিয়ে দেয়।

 

আমি যদি সময় স্থির করে রাখতে পারতাম। আমি যদি আঙ্গুলের নির্দেশে দিন, রাত, ঘণ্টা, সূর্য এবং চাঁদ, পৃথিবীর যাবতীয় সবকিছু নির্দেশ করে চলাচল, সমস্ত প্রগতি এবং সকল অবক্ষয় বন্ধ করতে পারতাম। আমি যদি এই মুহূর্তকে ধরে রাখার জন্য সূর্য দেবতার বাহনকে বন্ধ করতে পারতাম! আমি হতাম হনুমান, রামায়ণের বলবান বানর জেনারেল, হনুমান যিনি ইচ্ছামতো পুরো সেনাবাহিনীতে পরিণত হতে পারে এবং তার খালি হাতে সূর্যকে থামাতে পারে।

 

সে যখন আমাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য বিরতি দেয়, আমি চূর্ণবিচূর্ণ পাখাটি হাতে নিই এবং সেটাকে টেনে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনি। শূন্য আসমানের বিপরীতে অবস্থিত পাহাড় বরং ভাজ পড়ে কুঁচকে যায় এবং গাছপালা বেঁকে যায়। তবে ছোটখাট মানুষটি তার বাঁশি হাতে প্রস্তরখণ্ডে হেলান দিয়ে তখনো বসে আছে।

আমি উঠে দাঁড়াই এবং টেবিলের দিকে হেঁটে যাই। ফুলদানিতে রঙিন পেন্সিল, ব্রাশ এবং তুলি খুঁজে বেড়াই। আমি একটা লাল

 

 

কলম হাতে তুলে নিই এবং পাখাটির উপর একটি বালিকার ছবি আঁকি —শরীরে মজাদার পোশাকে একজন চৈনিক বালিকা প্রস্তরের পেছনে গাছতলায় দাঁড়ানো। আমি তাকে এটা দেখিয়ে বলি, ‘ দেখ, তার বালিকাটি এখানে।’ জবাবে তার একমাত্র মন্তব্য ছিল, ‘কেন বালিকাটি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, ওর কাছ থেকে এতো দূরে?’ তাই আমি সেই ছোটখাট মানুষটির জন্য আর একটি বালিকার ছবি আঁকি এবার তার একদম কাছে। এখন তার আছে দু’জন বালিকা। সে আমার হাত থেকে পাখাটি টেনে নেয় এবং আমাকে তার নিচে শুইয়ে দেয়। আবার দুনিয়া থমকে দাঁড়ায়, হায়! আমি দুর্বল হয়ে পড়ি।

সে আমার কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়ায় এবং গোসলখানায় ঝর্ণার পানি পড়ার শব্দ শুনতে পাই। এতে কানচানাবুরির সাই ইয়ক জলপ্রপাতের ঠাণ্ডা ঝরনাধারার পানির কথা মনে পড়ে, যেখানে হাজার হাজার পীতপালকযুক্ত হলুদ প্রজাপতি পাখাযুক্ত পুষ্পের মতো গাছের ছোট ছোট ডালে ও পাতায় ফুর ফুর করে উড়ে বেড়ায় এবং আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। আমি সেগুলো ধরার চেষ্টা করি। তবে যদি কখনো তাদের হলুদ পাখা আমার আঙ্গুলের সংস্পর্শে আসে, তারা পুনরায় উড়ে যায়, আমার আশাহীন কাজে ফেলে রেখে, অধিকন্তু কোনো রঙধনু, কবিতার চমৎকারিত্ব, অগাস্ট রদিনের প্রতিভা সন্ধানে।

পুরুষালি ওডিকোলনের সুগন্ধি আমার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে। আমি খুঁজে দেখি এই শীতল সুরভির উৎস কোথায়। আমি উত্তপ্ত ছিলাম। আমি পান্না রঙের সাগরে ভেসে বেড়ানোর ভান করি। একটা ফুলদানি থেকে আমি কয়েকটা ফুল হাতে নিই এবং একটা একটা করে ফুলের পাপড়ি স্নানাগারে ছড়িয়েছিটিয়ে দিই যেখানে ইতিমধ্যে এমনকি উত্তপ্ততর কেউ একজন শুয়ে আছে।

আমি মানুষটাকে পর্যবেক্ষণ করি আমাকে যে বুঝতে পারে এবং আমি যাকে বুঝতে পারি। মানুষটা ছিল যেন ভাস্কর্যের একটা সুন্দর টুকরো। আমি মনে মনে ভাবছিলাম একজন পুরুষ একজন নারীর চেয়ে কত অপরিমেয়ভাবে অধিকতর সুন্দর হতে পারে। আমার মানুষটা ছিল আগাগোড়াই তামাটে। তার গলা ও কাধ মজবুত, তার বাহুর মাংসপেশির সৌন্দর্য ছিল ঠিক যেন খোদাই করা কাঠের মতো। হা! তবে তাকে অনেক সতর্ক থাকতে হবে! যদি সে শরীরের প্রতি যত্ন না নেয়,তার পাকস্থলীর পেশি কোমরের চারপাশের বাড়তি চর্বির নিচে ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনগুণ গালফুলা একজন ভুঁড়িওয়ালা বুড়ো মানুষের চেয়ে অধিকতর কদাকার কোনো কিছু আমি কল্পনা করতেও পারি না, দেখতে কিছুটা বিরক্তিকর বুড়ো কামুক।

 

আমার অহমিকায় প্রায়ই আমি মনে মনে ইচ্ছা পোষণ করি তার সৌন্দর্য হারিয়ে যাক, অর্থাৎ তার চুল ঝরে যাবে, তার মাথায় টাক হবে এবং অন্য নারীর কাছে অনাকর্ষণীয় হবে যাতে করে আমি নিশ্চিত হতে পারি সে সর্বদা আমারই থাকবে। এই চিন্তা মনে করে আমার হাসি পায়।

‘তুমি এখন কি স্বপ্ন দেখছ, দিবা স্বপ্নদর্শী?’ সে নিজের বিরাট পুরুষালি হাতে আমার নাসিকার ডগা টিপে ধরে। আমি মনে মনে শ্বাসযন্ত্র খুঁজি, সাগরের গভীরে মাছের মতো যেন শ্বাস নিতে পারি।

 

তার হাতের নাগালের বাইরে নিজেকে সরিয়ে এনে জবাব দিই, ‘আমি তোমাকে গোপন অভিশাপ দিচ্ছি। আমার ইচ্ছা হয় তুমি হবে একজন মুটো, টেকো এবং থাকবে বিশাল ভূড়ি।’

 

সে পানি থেকে উঠে আসে। তার মাথার চুল ভিজা এবং জটপাকানো। আমার মনে হয় যদি একজন পুরুষ মানুষ সম্পূর্ণরূপে চুলছাড়া হয় সে হবে চিনচুকমাছের মতো কদাকার। প্রকৃতি বা আল্লাহ,  যাহোক না কেন, যে কেউ, মানুষ সৃষ্টি করেছে, সে একজন প্রতিভার কারিগর, যিনি এমন চমৎকার ধরনের বিশুদ্ধ প্রতিসাম্য তৈরি করেছেন। সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই দেখেছে শুধু মাংস এবং চুলছাড়া পুরুষ মানুষ হবে একটা হাস্যকর মানবমূর্তি। সৃষ্টিকর্তা এক মুঠো ধূলা হাতে তুলে নেয় এবং তার সৃষ্ট মানব শরীরের এখানে সেখানে লাগিয়ে দেয়, সাথে কিছুটা যাদুর বাছাই করা শব্দ। ঠিক যেন দেখতে মানুষকে তেমন একটা নগ্ন না দেখায়।

 

আমার কোমর ছুঁয়ে সে বলে, ‘আমি চাই তুমিও মোটা হও। আমি কামনা করছি তোমার কোমর প্রসারিত হয়ে তোমার পাছা সম হোক।’ তার একথা শুনে আমি থরথর করে কাঁপি।

‘আমি যখন মোটা হবে, আমার মনে হয় তুমি পালিয়ে গিয়ে কোনো একজন হালকাপাতলা তরুণীকে খুঁজে বের করে আমার স্থানে বসাবে?’

তখন আমার স্নান করার পালা। স্নানাগারের ঠাণ্ডা পানি আমার মাথার চুল ভিজিয়ে দেয়। ঝরনার পানিতে আমি চুল ধুই। পুষ্পের পাপড়ি আমার শরীরের উপর এসে পড়ে এবং বাহু ও পায়ে এঁটে যায়। সে এগুলো একটা একটা করে আমার হাত ও পা থেকে তুলে নেয় এবং আমাকে টেনে তার কাছে নিয়ে যায়। আমার কাঁধের উপর তার দুই হাত রাখে। আমি তার বাদামি রঙের মুখের দিকে তাকাই এবং সে হাসি দেয়। সে যখন হাসি দেয় তার চোখের কোণায় ভাঁজ পড়ে। আমি দৃষ্টি সরিয়ে তার মুখ পানে তাকাই। এমন ধরনের মুখ অন্য কারো ছিল না এবং

 

তার গোঁফ শরীরে স্পর্শ করলেই সুড়সুড়ি দেয়।

সে বিস্ময় ভরে বলে, ‘কেন তুমি একজন আগন্তুকের মতো আমাকে দেখছ?’ আমার নিজের চিন্তা সে উচ্চস্বরে বলছে। তবে সে ছিল একজন আগন্তুক। বাস্তবিকপক্ষে, আমি তার শরীর ও প্রেম নিবেদন সম্পর্কে যতসব জানতাম তথাপি আমি নিজেকে বোকা বানিয়েছিলাম তাকে আমি জেনেছি এই বিশ্বাস করে।

‘তোমার মাথার ভিতরের চিন্তাভাবনা আমি দেখতে চাই।’ আমার এই কথার তার একমাত্র জবাব ছিল মাথা নিচু করে থাকা এবং ঠান্ডা পানির নিচে আমার জন্য হাতছানি দেয়া। আমি তার শ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করার চেষ্টা করি। তাকে যাচাই করার আমার প্রয়াস ঠিক সেখানেই সমাপ্ত হয়।

 

কেন অতীত আমার মাথায় লাফাতে থাকে? যত চেষ্টাই করা হোক না কেন নির্বোধ মস্তিষ্ক দুর্ভাবনা দূর করতে পারে না। কারণ আমরা সময়কে নিশ্চল করতে পারি না, আমাদের আনন্দ বাষ্পীভূত করতে নিন্দিত হয়। অস্তিত্ব ছাড়া এটা ক্ষণস্থায়ী, এমনকি রাডার রশ্মির জন্যও অতিমাত্রায় অধরা।

সেই মে মাস থেকে সময় উড়ে গেছে এবং ইতিমধ্যে মে মাস আবার ফিরে এসেছে। গত মে মাসে, আমরা পুকুর পাড়ে বসে ভাসমান লাল ও সাদা রঙের বোগেনভেলিয়া ফুল দেখছিলাম। কিছু কিছু ফুল ঝকমকে পদ্মপাতার উপর পড়েছিল। আর্দ্রতার গুটির মধ্যে সেসব ফুল রত্নের মতো ঝিকঝিক করে। আমার মানুষটির হারানো সিগারেটের লাইটারটি ঘাসের মধ্যে খুঁজে দেখতে উঠে দাঁড়াই। অত্যধিক শিশিরে আমার স্যান্ডেল পুরোপুরি ভিজে যায়। অবশ্য লাইটারটির একটা চকচকে প্রতিফলন ছিল। তাই ভেবেছিলাম হয়তো এটা খুঁজে দেখা সহজ হতে পারে। তবে আমি এটা খুঁজে পাইনি। অবশেষে আমি এটা খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিই এবং তার পাশে শরীর ঘেঁষে বসি। ভিজে মাটি ও সতেজ ঘাষের গন্ধের সাথে আমি তার পুরুষালি ঘ্রাণ টের পাই। সে আমাকে তার কাছে টেনে ধরে। তার ঠোঁট নরম ও উষ্ণ, তার ঠোঁটের স্পর্শ আমার শরীরের সর্বত্র আগুন ধরিয়ে দেয়। ‘আগামীকাল তোমার জন্মদিন, তাই না?’ আমি তাকে বলি। বাতাসে আমার সাদা ব্লাউজ খুলে যায়। ধারালো ছোট ছোট ঘাস আমার পৃষ্ঠদেশে দংশন করে মনে হয় যেন একদল পিঁপড়া আমাকে কামড় দিচ্ছিল।

 

পুকুর পাড়ে সূর্য উঠেছে। আমরা পরস্পর জন্মদিনের উপহার বিনিময় করেছি।

এই মে মাসে, আমি পুনরায় পুকুর পাড়ে বসে ফুয়েঙফা ফুলের দিকে তাকিয়ে দেখি। এসবের কিছু কিছু ফুল গলিপথে ঝরে পড়েছে। বিবর্ণ জোছনায় পদ্মপাতা একদা দীপ্তি ছড়াতো, এখন তা উধাও হয়েছে। পুকুরে একটা মাছ লাফ দেয়, পানিতে মৃদু তরঙ্গের লহর বয়ে যায়। মাঝে মাঝে বেড়ার ছায়া আমাকে চমকে দিত এবং আমি সারাক্ষণ কামনা করতাম কেউ একজন আসবে এবং তার সিগারেটের লাইটারটি পুনরায় হারাবে, ঠিক যেমন আমরা সেটারই সন্ধানে সারারাত কাটাতে পারি। কেউ আসে নাই, লাইটারটিও খুঁজে নাই এবং যখন ভোর হল আমি তখনও একাই বসেছিলাম।

 

যখন সময়টা ছিল সাঁঝের বেলা, আমি একটা ফুয়েঙফা ফুল হাতে তুলে নিই। আমি সতর্কতা অবলম্বন করি ফুলের লাল পাপড়িগুলো যেন নষ্ট না হয় এবং এগুলোকে আমি পায়ের উপর পাখার মতো করে বয়ে নিয়ে যাই। ‘আজতো তোমার জন্মদিন, তাই না?’ আমি বলতে চেয়েছিলাম। তারপর আমি তাকে ফুলটি দিতে যাচ্ছিলাম।

 

তবে আমি যখন কয়েক কদম এগিয়ে তার কামরায় প্রবেশ করি আমার কথামালা কোনোমতেই আগের মতো ছিল না। আমি কফির ঘ্রাণ পাই।

‘কফি চলবে?’ সে আমাকে জিজ্ঞাসা করে। তারপর ছোট চুল্লিতে কেতলির ফুটন্ত পানির দিকে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানায়। এটা কোন ধরনের কথা? আমি মনে মনে চিন্তা করি। আমি এখানে তোমাকে সুখী জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে চাই এবং তুমি আমাকে কফির প্রস্তাব দিচ্ছ। সুতরাং আমার পেছনের দিকে আমি হাত রাখি এবং সরাসরি তার দিকে হেঁটে যাই। এক বুক আশা নিয়ে অপেক্ষা করি গত বছরের মতো এবারও সে আমাকে দুই বাহু জড়িয়ে ধরবে। তবে সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অতএব আমাকেও মুখ ফিরিয়ে নিতে হল, সেই উচ্ছসিত কান্না লুকাতে সুখীতর সময়ে আমি যেমন ভেবেছিলাম।

আমি ফুলটা ফুটন্ত পানিতে ছুঁড়ে মারি এবং দেখতে থাকি ফুলের পাপড়িগুলো ফুটন্ত পানিতে দ্রুত উঠানামা করছে। ঠিক যেন আমার ঘূর্ণায়মান চিন্তাভাবনার মতো তলিয়ে যায়। কেতলিটা তুলে আনার আগে আমি কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করি। কেতলির পানি স্থির হয় এবং বুদবুদগুলো মিলিয়ে যায়, বিদ্যমান থাকে শুধু কিছু সাদা ফেনা। আমি পানির উপর থেকে উষ্ণ লাল ফুলটি হাতে তুলে নিই। ফুলের পাপড়িগুলো এখন শুকিয়ে গেছে। আমি ফুলের পাপড়িগুলো সতর্কতার সাথে একটা একটা করে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করি এবং আঙ্গুলের চাপ দিয়ে চুরমার করি। এগুলো আমার আঙ্গুল রক্তের রঙে রঞ্জিত করে।

পরের মে মাস, তার পরের মে মাসে, আমাদের এই প্রেমের ভাগ্যে কি ঘটবে? করার কিছু নাই? রত্ন সাগরের নিচে সামুদ্রিক শৈবালের সংখ্যাবৃদ্ধির মতোই ঠিক বিকাশমান ও প্রসারণশীল আমাদের মধ্যকার এই উদাসীনতা বন্ধ করার কি কোনো পথ নাই?

 

সাদাত উল্লাহ খান, সম্পাদক, প্রতি বুদ্ধিজীবী

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাহিত্য-গবেষণার আলোকবর্তিকা

শাহেদ কায়েস   আহমদ রফিক (জন্ম: ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-মৃত্যু: ২ অক্টোবর ২০২৫) বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুবনে আহমদ রফিক একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে

অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

আন্দরকিল্লা ডেক্স \ চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের আত্মজীবনী ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

ফেরা

সৈয়দা মাসুদা বনি   নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন   রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু! মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে

চিরহরিৎ বৃক্ষের গল্প

সুজন বড়ুয়া   ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়।