সৈয়দা মাসুদা বনি
নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে পারছে, সে নিজেকে হাত দিয়ে স্পর্শ করবার চেষ্টা করে কিন্তু কোন অনুভূতি কাজ করে না।তার প্রচণ্ড অস্বস্তি হয়। চোখটাও কী খুলতে পারব না? মনে এই প্রশ্ন আসতেই রিশান প্রাণপণে তার চোখ দুটি খোলবার চেষ্টা করতে থাকে। সিসার মতো ভারী কথাটি কতই না পরিচিত। আজ সে কথাটির মর্ম হাড়ে হাড়ে টের পায় রিশান। তার মনে হয় চোখের পাতার চেয়ে ভারী ওজনের আর কিছুই বোধ করি হতে পারবে না। তবুও সে হাল ছাড়ে না, চেষ্টা করতে করতে একসময় তার মনে হয় অন্ধকার কি একটু কমে এল!! সে চোখ খুলতে সমর্থ হয়। কেমন জানি বিষণ্ন ধূসর কুয়াশাচ্ছন্ন চারিদিক। সীমাহীন!!
কোথায় সে? কোন জায়গা এটি? কীভাবে জানবে, কাকে জিজ্ঞেস করবে? অস্থির রিশান ছটফট করে ওঠে। ভয় হয় তার। প্রচণ্ড ভয়। হঠাৎই মনে হয় ধূসর কুয়াশা একটু করে হলেও পরিষ্কার হচ্ছে। ধীরে ধীরে সেই কুয়াশা যেন কমে আসতে থাকে। এটা কি কোন ঘর? তাহলে কোনো সীমা কেন নেই? ঘরের তো দেয়াল থাকে। এরকমই আরও বিভিন্ন চিন্তার জাল ছিন্ন হয়ে যায় মাথার পেছনে হওয়া মৃদু নড়াচড়ার শব্দে। রিশান চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখবার চেষ্টা করে। তাহলে সে এই জায়গায় একা নয়, আরও কেউ আছে। সেই কেউ একজন সামনে এসে তার মুখের ওপর ঝুঁকে পরে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, কিরে জাগা পাইলি তাইলে।
যে একখান মড়ার ঘুম দিছিস, এইটারে যদি ঘুম বলা যায় আরকি!!!
রিশান অবাক চোখে তাকিয়ে রয়। কি নিষ্পাপ একটি মুখ, মায়াবী গভীর কালো দু চোখ আর মাথা ভর্তি ঝাকরা চুলের ছেলেটি তার চেয়ে কম করে হলেও তিন চার বছরের বড়ই হবে। হুড়মুড় করে তার মনে এতক্ষণ ধরে চলতে থাকা প্রশ্নগুলো চলে আসে। তবে ছেলেটির পরবর্তী প্রশ্ন রিশানকে থামিয়ে দেয় একেবারে।
-কিরে চ্যাম্প বয়স তো মনে হয় ষোলো সতেরোর বেশি হবে না। তা এই গেন্দা কালেই এই শখ হইল ক্যান তোর? কি করছিলি লটকে গেছিস? নাকি গিলছিস কিছু-মিছু?
বেশ কিছুক্ষণ লাগে রিশানের বুঝতে যে ছেলেটি কি জানতে চাইছে। সাথে সাথে সে খুবই অবাকও হয় যে এই ছেলেটি জানলো কীভাবে?
রিশান খুবই অপরাধীর মতো মাথা নীচু করে জবাব দেয় লটকে যাওয়ার সাহস নাই, গিলেছিলাম।
-ধুস্স কি বলতেছিস রে ব্যাটা, ঘটনা ঘটায়া ফেলছিস আর কইতাছস সাহস নাই হাহ্।
তা নিজেরে খুন করণের ইচ্ছা হইল ক্যান ক দেখি। আচ্ছা থাম থাম তোর নামই তো জানা হইল না এখনও। নাম কি?
-রিশান।
-সুন্দর নাম। আমি আরিফ। মানে কোনো এককালে বাপ মায়ে নাম দিছিল আরকি।এখন ঝটপট কয়া ফেলা দেখি কেস কি? ছ্যাকামাইসিন, বুলিং নাকি সারা দুনিয়ার উপরে অভিমান?
বুঝলি চ্যাম্প এই শেষেরটার ভেতরে হাজারটা কারণ থাকতে পারে। তুই এক থেকে চল্লিশ গুনতে গুনতে কোনো একজন টপকে যাবে। মানে প্রতি চল্লিশ সেকেন্ডে একজন নিজেরে খুন করে। এই হিসাবটা প্রতি বছরে আট লাখেরও বেশি। আবার চেষ্টা চালায়া ফেল মারে পনেরো থেকে বিশ গুণ মানুষ। আমাদের দেশও পিছায়া নাই। এই মনে কর আমার তোর মতন প্রায় চৌষট্টি হাজার বলদ নিজেরে খুন করে প্রতি বছর। জনসংখ্যা বেশি হয়া গেছে তো তাই কমানোর জন্য একটু হেল্প করতেছে আরকি।
রিশান প্রতিটি কথা খুবই অবাক হয়ে শোনে,তার এতকিছু জানা ছিল না। সে খুবই মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে, আরিফ ভাই আপনি এত কিছু জানার পরেও আত্মহত্যা করেছিলেন!!!
-আত্মহত্যা! হাহ্!কি একখান গালভরা নাম দিয়া রাখছে দেখছস। অথচ এর চাইতে জঘন্যতম বোকামি পৃথিবীতে আর কিছুই হইতে পারে না।
আরে আগে জানলে কি আর এই কাম করি! এই খানে বইসা বইসা জানার চেষ্টা করি। সবকিছু উন্মুক্ত যা ইচ্ছা জানতে চাইলেই জানা যায়। নে এত কথায় কাম নাই, তোর কাহিনী ক দেখি।
রিশান খুবই অপরাধী এবং বিষণ্ন কন্ঠে জবাব দেয়, প্রথম দুটো। ওরা স্কুলের প্রথম দিন থেকে কলেজ পর্যন্ত আমার পিছনে লেগে আছে।
– আরিব্বাস তোর তো দেখি ম্যালা ফ্যান!!
আরিফ শিস দিয়ে বলে ওঠে।তাইলে এর মইধ্যে মাইয়া আইল কেমনে?
-কলেজে নতুন ভর্তি হয়েছিল, মেয়েটিকে আমি পছন্দ করি জানা মাত্রই জারিফদের গ্রুপ আমাকে খুবই নোংরা ভাবে মেয়েটির কাছে উপস্থাপন করে। আরও অনেক কিছুই করে।আমি এর কিছুই জানতাম না। তাই যখন একবুক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে আমি ঐশীর সাথে কথা বলতে যাই তখন নতুন করে আরেক ধরনের বুলিংএর স্বীকার হই। ঐশীর কাছ থকে।আমার আর মেনে নেয়ার বা সহ্য করে নেয়ার ক্ষমতা ছিল না,কাউকে বলতে পারিনি। শুনতে খুবই সহজ শোনালেও ছয়টা মাস কী বিভীষিকাময় জীবন পার করেছি সেটা শুধু আমিই জানি। তবে এখন মনে হচ্ছে সেটা আসলে কিছুই ছিল না।
-হুম বুঝলাম।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরকমই হয়।মানসিক দুর্বলতা।
-হ্যাঁ আরিফ ভাই অনেক বেশি দুর্বলতা। বাবা মা যদি আমাকে আরও একটু শক্ত করে গড়ে তুলত!! তারা শুধুই বলেছে তোমার যখন যা চাই পাবে, কিন্তু পড়াশোনা ঠিক থাকতে হবে। আমি শুধুই র্ফাস্টের পিছনে ছুটেছি মনের মাঝে সীমাহীন ভয় নিয়ে।আমার বাবা মা আমাকে পারফেক্ট হিসেবে দেখতে চেয়েছে।
-পুরো সমাজেরই এই একই চিত্র। তোর বাপ মাকে আর দোষ দিয়ে কি হবে।
-আচ্ছা আরিফ ভাই তুমি কেন এই কাজ করেছিলে?
রিশানের এই প্রশ্নের উত্তরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরিফ বলে, জানিস আমি একজন লুজার, কাপুরুষের মতো জীবন থেকে পালাইছি। ক্যান্সারে আম্মু চলে গেল আমার এস,এস,সির সময়। তখন থেকেই পুরাডা দুনিয়ার উপ্রে আমার কঠিন অভিমান। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন ছিল, হয় নাই। হইল জগন্নাথে। মাইনষের কথাগুলান সহ্য হইত না। বাপটাও মা চলে যাওয়ার শোক সামলাতে পারে নাই।স্ট্রোকের পর বিছানাগত হয়া যায়। ছোট বোনটারে সাথে কইরা সবকিছু কোনরকমে টানতেছিলাম। কিন্তু টানতে পারতেছিলাম না স্কুলবেলার প্রেমটা। মেয়েটা ধীরে ধীরে আমার থেকে সরতে শুরু করে,যেইটা আমি বুঝতে পারলেও কোনভাবেই মানতে পারতেছিলাম না। আসলে আমার কাছে তার আর কিছু পাওয়ার ছিল না। অথচ আমি চাইতাম সে আমার পাশে থাকুক,সাহস দিক।জীবনের সব চাওয়াই যদি পূরণ হইত রে!!
আরিফের মুখের দিকে তাকিয়ে রিশানের বুকের মাঝে খুব কষ্ট হতে থাকে। তাকেও ঠিক এমনই কষ্টের মাঝ দিয়ে যেতে হয়েছে। সে আবার জিজ্ঞেস করে তারপর কি হল আরিফ ভাই?
-কি আর, অগুনতি নির্ঘুম রাত, অনাহার, হাহাকার, অন্তরজ্বালা সব একদিন অসহ্য মনে হইল। মনে হইল আর পারি না। দেই সব শেষ কইরা। মাথায় আর অন্য কিছুই থাকল না। তারপরে আমিও সেই নয়শ চুরাশি জনের একজন হইয়া গেলাম, যে স্টুডেন্টরা ২০২৩-২০২৪ সালে আত্মহনন করছিল। আমিও তো স্টুডেন্টই আছিলাম। ঐ যে শোনা যায় না ভার্সিটির ছাদ থেকে লাফ দিছে,বিষ খাইছে,লটকে গেছে গাছের সাথে। আমিও শেষেরটা ট্রাই করছিলাম। আহারে শেষ সময়ে মাথাটা পরিষ্কার হয়া গেছিল,হায় আমি কি করতেছি, আমি বাঁচতে চাই, দড়ি খোলার কত চেষ্টা!! জানিস পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান হইল মানুষের জীবন, বেঁচে থাকা, ভাল থাকার চেষ্টা করা। নিজের যত্ন নেয়া। তাইলেই অন্যের জন্য কাজ করা যায়। তবে এইটা এখন বুইঝা আর লাভ নাই।
হঠাৎ রিশান ভয়ংকর ভাবে কেশে ওঠে। সেই কাশি থামতেই চায় না যেন। আরিফ চমকে উঠে রিশানের কাছে আসে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে,তার মাথায় ঝড়ের গতিতে চিন্তা চলতে থাকে, এটা এমন একটা জায়গা যেখানে মানুষের জৈবিক কোনো ব্যপারই কাজ করে না। তাহলে রিশান কাশে কীভাবে?? রিশানের পিঠের দিকে সে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে। কারণ বুকের যেখানে হার্ট থাকে ঠিক তার পেছন দিকে পিঠের মাঝ থেকে একটা চিকন ফিতা দেখা যায়, যেটার কোন শেষ দেখা যায় না। আরিফের যেটা সাদা। রিশানের সেই ফিতাটাই ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠছে।এর মানে কী? আরিফ চিৎকার করে ওঠে
-ওই তুই কি খাইছিলি? সেইটাতে নিশ্চিত ভেজাল ছিল। তুই মনে হয় মরস নাই। তোরে ফিরতে হইব।
হতভম্ব রিশান প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে না, তারপরই চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলে কি বলছ আরিফ ভাই, আমি বেঁচে যাব! আমি পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারব! আমি মা বাবার মুখ দেখতে পারব আবার!!!
-হ্যাঁ রিশান হ্যাঁ। এইটা মিরাকল ছাড়া আর কিছুই হইতে পারে না। তুই দ্বিতীয়বার সুযোগ পাচ্ছিস রে চ্যাম্প। আরিফ খুবই উত্তেজিতভাবে বলে।
কিন্তু এই জায়গা থেকে একা যাওয়া তোর পক্ষে অসম্ভব। আমি নিয়া যাব তোরে।তুই ভয় পাইস না ভাই।তুই চোখ খুলবি না একবারও যত যা-ই হয়া যাক। এরপর আরিফ রিশানকে খুব শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নেয় এবং বলে, যাই হয়া যাক না কেন তুই আমারে কোনভাবেই ছাড়বি না।
এরপরই রিশান দেখতে পায় সেই ঘরটির যেন একটি দরজা রয়েছে যেটি খুলবার সাথে সাথে একটি পুতি দুর্গন্ধময় দমকা হাওয়া এসে ধাক্কা দেয় তাদেরকে, তার মাঝেই আরিফ রিশানকে নিয়ে ঘর থেকে বেরোয় এবং চিৎকার করে বলে রিশান চোখ বন্ধ। কোন মানুষ বোধহয় জীবনে কোনদিন শোনে নাই, এমনই সব ভয়ংকর জান্তব চিৎকার শুনে ভয়ে রিশানের জ্ঞান ধরে রাখা কঠিন হয়ে পরে,দুই একবার তাকে ছুটিয়ে নেয়ার চেষ্টাও হয়। সীমাহীন ভয়ে সে আরও বেশি শক্ত করে আরিফকে আঁকড়ে ধরে।
ঠিক কতক্ষণ এভাবে পার হয় রিশান বলতে পারে না কারণ তার ধারণা তার ঠিকমত জ্ঞান ছিল না হয়ত। একসময় সে বুঝতে পারে সেই সব শব্দ আর নেই। সে খুবই সাবধানে জিজ্ঞেস করে আরিফ ভাই, আমরা কি পৌঁছে গেছি,আমি কি এখন চোখ খুলতে পারি?
হ্যাঁ রে ভাই চোখ খুলে দেখ তোর মা কাঁদতেছেন তোর জন্য। জায়নামাজে বসে দোয়া চাইতেছেন তোর জন্য। আমি এইবার বুঝছি তুই ক্যান ফিরা আইলি, তোর মায়ের দোয়া তোরে ফিরায়া আনছে। আহারে আমার মা টাও যদি আমার জন্য দোয়া করার জন্য থাকত!! আরিফের গভীর কালো চোখ দুটো পানিতে টলমল করে। সে বলে রিশান যা ভাই ঐ দেখ হাসপাতালের বেডে তোর শরীর, যা ফিরা যা। আমি আর থাকতে পারতেছি না। খালি একটা কথা তুই একদিন আমার বাড়িতে যাবি ভাই, আমার বাপ বোনের কাছে মাফ চাইছ আমার হয়া….আরিফের শরীরটা রিশানের চোখে ঝাপসা হতে শুরু করে শেষের কথাগুলো যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ চিৎকারের মতন শোনায় রিশানের কানে। তার চোখ থেকে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পরে।
একমাস পরের কথা রিশান আর তার বাবা মা কলাবাগানের ঘিঞ্জি এলাকার একটা শ্রীহীন একতলা বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রিশানের বাবা সদর দরজায় কড়া নাড়েন। তিন চার বারেও কোন সারা পাওয়া যায় না। তারা অপেক্ষা করেন।
আরিফের শেষের কথাগুলো রিশান খুব যত্ন করে মনে রেখেছে, আরিফ আসলে তার ঠিকানাটা বলেছিল চিৎকার করে। এই এক মাস রিশান ঠিকমত ঘুমাতে পারত না, ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে জেগে উঠত। সে একটা ট্রমার মাঝে ছিল। শুধু কাঁদত আর বাবা মার কাছে ক্ষমা চাইত। তার বাবা মাও তার কাছে ক্ষমা চেয়েছে, কারণ তাদের মনে হয়েছে তারা ছেলেকে সঠিকভাবে বড় করতে পারেন নাই, সময় দিতে পারেন নাই, কখনোই তার কথাগুলো শুনতে চান নাই বা বোঝেন নাই। শুধুই চাপিয়ে দিয়েছেন। তার মা প্রায়ই কেঁদে কেঁদে আক্ষেপ করে বলেন আমি আমার বাবুটার ভরসার জায়গা হতে পারি নাই, আমি কিসের মাঝে তাকে ঠেলে দিয়েছি!!
অনেক চিকিৎসা, কাউন্সেলিংএর পর রিশান মোটামুটি একটু স্বাভাবিক হতে পেরেছে। দুইদিন হয় সে বাবা মাকে বিশ্বাস করে আরিফের কথা সব খুলে বলেছে। বিশ্বাসযোগ্য না হলেও তার বাবা মা তার কথা মেনে নিয়েছেন। কারণ এই পৃথিবীতে ব্যাখ্যার অতীত কত ঘটনা ঘটে তার কি আর হিসাব আছে! মৃত ছেলে চোখের সামনে জীবিত হয়ে গেল!! এরচেয়ে বড় অবিশ্বাস্য ব্যাপার আর কি হতে পারে!!
বাসাটার ভেতর থেকে কেউ একজন সাড়া দেয়, কে?
রিশানের বাবা জবাব দেন। দরজাটা খুলে যায়। একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে, রিশানেরই বয়সী হবে। রিশান অবাক হয়ে দেখে আরিফ ভাইয়ের সাথে চেহারায় অনেক মিল। বুঝতে পারে এটিই আরিফ ভাইয়ের বোন। রিশান মেয়েটিকে বলে আরিফ ভাই আমার পরিচিত। মেয়েটির বিষণ্ন চেহারাটি আরও বিষণ্ন হয়ে যায়। সে বলে, কিন্তু ভাইয়া তো-
রিশান তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, আমি জানি। আমি আসলে অন্য একটা ব্যাপারে আপনাদের সাথে দেখা করতে এসেছি। তারা সবাই ভেতরে যায়।বসার ঘরে আরিফের বাঁধাই করা একটা ফোটো দেখে রিশান ছুটে যায়। সে খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। মাকে বলে,মা আরিফ ভাই। রিশানের মা এগিয়ে গিয়ে ছেলেকে সান্ত্বনা দেন।
আরিফের মৃত্যুর পর তার বাবা আর বোন খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছে। মানুষ দুটি কোনো রকমে টিকে রয়েছে। আরিফের বাবার সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই, স্ত্রীর চিকিৎসাতেই সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। এখন মেয়েটার টিউশনির টাকায় কোনো রকমে খাওয়াই চলে না ঔষুধ পত্র তো অনেক দূরের ব্যাপার।
রিশানের বাবা বলেন ভাই সাহেব আসলে আপনার ছেলে আরিফ কোন এক সময় আমার ছেলেকে বিরাট সাহায্য করেছিল, রিশানের জীবন বাঁচিয়েছিল,তার ঋণ আমরা কোনোদিন শোধ করতে পারব না। সে আজ নাই তাই আমরা চাই আপনাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক রাখতে।
এরপর পেরিয়ে গেছে বছর খানেক। অনেক বড় উৎসবের প্রস্তুতি চলছে, চারদিকে সাজ সাজ রব। পঞ্চাশ জন বিশেষ অতিথি আমন্ত্রিত। এরা তারাই যাদেরকে রিশান এবং তার প্রতিষ্ঠান ফিরে আসতে সাহায্য করেছিল মৃত্যুর মুখ থেকে। রিশানের সাথে তার বাবা মা, আরিফের বাবা, বোন এবং আরও অনেকজন নিবেদিতপ্রাণ মানুষ কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। রিশানের প্রতিষ্ঠান ‘ফেরা’ কাজ করছে বিভিন্নভাবে। রয়েছে একটি এফ এম রেডিও চ্যানেল, অনলাইন কাউন্সেলিং সেবা, সরাসরি এসেও তারা সেবা নিতে পারেন।মানুষের কথা বলার একটা জায়গা নেই,সেই জায়গাটাই তারা তৈরী করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সবচেয়ে কঠিন কাজ হল এই অসহায় মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে তাদের কাছে সেবাটি পৌঁছে দেয়া। এজন্য তারা চালু করেছে ‘জন থেকে জনা সার্ভিস’। তারা দশজন প্রত্যেকে আরও দশজনকে এ ব্যাপারে জানিয়েছে, ভুক্তভোগী কারও খোঁজ জানলে জানাতে বলা হয়েছে। এভাবে এই একশ জন আবার প্রত্যেকে আরও দশজন করে জানিয়েছে এভাবে হাজার মানুষ এই কাজে সংযুক্ত হয়ে গিয়েছে। মূল ব্যাপারটা হল আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করা। রিশান স্বপ্ন দেখে একদিন আত্মহত্যার সংখ্যা হয়ত শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসা যাবে। অতিথিরা আসতে শুরু করেছেন। যে দু’জন এইমাত্র এলেন তাদেরকে আরিফ ভাইয়ের বাবা ফিরতে সাহায্য করেছিলেন। রিশান হাসিমুখে এগিয়ে যায় তাদের দিকে।
সৈয়দা মাসুদা বনি, গল্পকার




