এখন সময়:রাত ৯:৫৪- আজ: শুক্রবার-৭ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২২শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:রাত ৯:৫৪- আজ: শুক্রবার
৭ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২২শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

বর্ষণ

সৈয়দা মাসুদা বনি

 

আকাশের কাছাকাছি একটা বাড়িতে থাকে মেঘা। বাড়ি না ঠিক, সেটা তো আর আকাশের কাছাকাছি হতে পারবে না। ফ্ল্যাটবাড়ি, বারোতলার ওপরে।তাতে অসুবিধে কিছু নেই, লিফট রয়েছে। বরং সুবিধা আছে। এই যেমন এখন বারান্দায় বসে থেকে মেঘার মনে হচ্ছে সে যেন মেঘেদের সাথে ভেসে চলে যেতে পারবে তাদের দেশে। এবাড়ির এ-দেওয়াল ও-দেওয়াল জুড়ে জানালা। খুলে দিলে ঘরটাও বারান্দা হয়ে যায় যেন। দিনের বেলা রোদভরা আকাশ, রাতে আকাশভরা জ্যোৎস্না বা অন্ধকার, নক্ষত্ররাশি, হাওয়া সব কেমন হু হু করে ঢুকে পড়ে ঘরের মধ্যে! ঘরটা যেন বাহির হয়ে যায়! একা থাকে মেঘা। ওপরের ফ্ল্যাটে বা পাশের ফ্ল্যাটে কোন শব্দই হয় না। তার স্বামী রাতুল একটা মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে চাকরি করে। সেই সকালে বেড়িয়ে যায়, ফিরতে ফিরতে রাত।বিয়ে হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। এইতো টেনেটুনে তিনচার মাস হবে হয়ত।

 

আকাশে মেঘ করতে থাকে এবং হঠাৎ করেই সেটা জমাট বেঁধে কালো হয়ে যেতে থাকে।মেঘা সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থাকে সেদিকে, তার মনের ভেতর ওলট পালট হয়ে যেতে থাকে; মনে হয় বৃষ্টি  শুরু  হলেই একটা ভয়ংকর কিছু ঘটবে।বৃষ্টি  এলেই তার ইদানিং এমন হয়। আচ্ছা এমন কি তার আগেও হত? সে কিছু মনে করতে পারে না। তার বুকের ভেতর ভয়ংকর কষ্ট হতে থাকে, যেন খুব কষ্টের, খুব জরুরি কিছু একটা তার মনে পড়া উচিত কিন্তুু‘ মনে পড়ছে না। চাপা অস্বস্তি-, ভয় এবং আতংক নিয়ে মেঘা ভাবে একছুটে ঘরে গিয়ে সমস্ত- জানালা দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকে। কিন্তুু‘ সে বারান্দা থেকে একচুল নড়তে পারে না, তার পা দুটোতে যেন শেকড় গজিয়ে গিয়েছে। এরই মাঝে শুরু হয় বৃষ্টি । সমস্ত- বিশ্ব চরাচর ভাসিয়ে নেয়া বৃষ্টি।

খুব মনোযোগ দিয়ে কর্তব্যনিষ্ঠ বৃষ্টি পড়ছে। গাছপালা, মানুষজন, চাষ-আবাদ সবই দেখতে হয় বৃষ্টিকেই। শেষ বর্ষায় তাই সে বকেয়া কাজ মিটিয়ে নিচ্ছে। রাতুল খুবই বিরক্তি নিয়ে বসে আছে গাড়িতে। ঢাকা শহরে এমনিতেই জ্যাম, তার ওপর বৃষ্টি হলে সোনায় সোহাগা। কখন বাড়ি পৌঁছুতে পারবে ভেবে তার চিন্তা হতে থাকে। এমনিতে চিন্তার কিছু নেই কিন্তুু‘ কিছুদিন থেকে তার স্ত্রী মেঘার শরীরটা ভালো না। কিছুদিন মানে এই বর্ষা শুর হওয়ার পর থেকে। প্রথম যেদিন বৃষ্টি  হয় রাতের বেলা মেয়েটা ভয় পেয়ে জেগে গিয়ে সারারাত তার হাত আঁকড়ে ধরে বসে ছিল। এর আগে ভালই ছিল।মনোযোগ দিয়ে সংসার করছিল, তাদের দুজনের মাঝে বোঝাপড়াটাও খুবই ভালো। তবে মেঘা মাঝেমাঝেই কেমন আনমনা হয়ে যায়, খুবই বিষন্ন হয়ে থাকে, কোন কারণ ছাড়াই। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে কিছু বলতে পারে না। রাতুল এটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। একেক জন মানুষ একেক রকম; কি দরকার সবকিছু নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার! এদিকে আবার তার শ্বশুড়বাড়ি থেকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে মেঘাকে পাঠাবার জন্য, মাসখানিক থেকে আসবে।তা রাতুল সময়ই করতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত- তার শ্বশুড় নিজে এসে নিয়ে যেতে চাইছেন। এত কিসের তাড়া রাতুল সেটা বুঝে উঠতে পারছে না।

কারেন্ট নেই, হাতে একটা মোম নিয়ে দরজা খোলে মেঘা।তুমি ঠিক আছ তো? জিজ্ঞেস করে মেঘার দিকে তাকিয়ে চমকে যায় রাতুল।তার চোখদুটো যেন জ্বলছে অদ্ভুতভাবে। চাপা একটা আনন্দ ছড়িয়ে রয়েছে সমস্ত- মুখে। কিন্তুু সে কোন কথার উত্তর না দিয়েই ভেতরে চলে যায়।এমন অস্বাভাবিক কেন মেয়েটা মনে মনে ভাবে রাতুল। কিছুক্ষণ পর একটু রেস্ট নেবার জন্য বিছানায় বসতে গিয়ে আরেকবার চমকে ওঠে রাতুল। বিছানার সামনের দিকে অনেকটা অংশ ভেজা।

-মেঘা…..মেঘা…

রাতুলের ডাকাডাকিতে মেঘা এলে সে জানতে চায় বিছানা কেমন করে ভিজেছে, পানি পড়ে গিয়েছিল নাকি?

-নাহ্ পানি কেন পড়বে? ওখানেই তো বর্ষণ বসেছিল, ওতো বৃষ্টি তে একদম কাকভেজা হয়ে গিয়েছিল। ওহ্ বিছানাটা ভিজে গিয়েছে আমি একদম খেয়াল করিনি। আমি এখনই চাদর বদলে দিচ্ছি।

-কোন গেস্ট এসেছিল? কে? তোমার কোন আত্মীয়? কই আগে বলনি তো এখানে তোমার আত্মীয় আছে।

-এত প্রশ্ন কেন করছ, তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করছ?

মেঘার এমন রাগী, হিংস্র চেহারা দেখে রাতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শুধু। কোন কথা খুঁজে পায় না। স্ত্রীর এমন রূপ সে আগে কখনো দেখেনি। চিন্তার ঝড় বয়ে চলে তার মাথার মাঝে। খটকা লাগে। কিছু একটা ব্যপার তো নিশ্চয় আছে। পরদিন অফিসের জন্য যাবার সময় কি মনে করে সে কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করে কাল বৃষ্টির সময় আমার বাসায় কি কোনো গেস্ট এসেছিল?

-না তো স্যার। কারও কি আসার কথা ছিল? গত সাতদিনে তো আপনার বাসায় কেউ আসে নাই।

-না না ঠিক আছে।

রাতুলের চিন্তাটা এবার আরও বেড়ে যায়।

দুদিন পর আবারও ঝুম বৃষ্টি । তবে বিকেলের আগেই বৃষ্টিটা ধরে যাওয়াতে রাতুলের বাড়ি ফিরতে খুব একটা দেড়ি হয়না।

নীল শাড়ি পরলে সব মেয়েকেই কি নীল পরির মতো লাগে? মেঘাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে ভাবতে থাকে রাতুল। আচ্ছা আজ কি কোনো বিশেষ দিন? সে মনে করতে পারে না। মেঘাকে সে কি কখনো নীল শাড়ি কিনে দিয়েছিল? নাহ্ দেয়নি। আগে থেকেই ছিল হয়তো তার।হাত ভর্তি নীল চুড়ি, সবচেয়ে অবাক ব্যপার তার চুলে গোঁজা একটি নীল শাপলা, যেটি তার সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে হাজার গুণ। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করবে না ঠিক করে রেখেও রাতুল পারে না। মেঘার আনন্দটা নষ্ট করতে মন চাইছিল না, কারণ প্রশ্ন করলে হয়তো সে আগের দিনের মতো রেগে যেতে পারে।ফুলটা দেখে রাতুল তার কৌতুহল দমন করতে পারে না

-মেঘা তোমাকে নীল শাড়িতে খুব মানিয়েছে। আর নীল শাপলা কোথায় পেলে? এই ফুল তো খুব একটা দেখতেই পাওয়া যায় না।

-ওমা দেখতে পাওয়া যাবে না কেন? এই দেখো কত নীল শাপলা, ড্রেসিং টেবিলের ওপর ফুলদানিতে রাখা একগুচ্ছ নীল শাপলা দেখিয়ে বলে সে। জানো এগুলো সব বর্ষণ এনেছে। ফুল,শাড়ি, চুড়ি সব। নীল ওর প্রিয় রঙ আর নীল শাপলা ওর প্রিয় ফুল।আমরা দুজন গ্রামের বাড়িতে গেলে কত নীল শাপলা তুলেছি। ও তুমি তো জানোই না, সেখানে বড় পুকুরটাতে দাদাজান কোথা থেকে নীল শাপলা এনে লাগিয়েছিলেন।

-ও আচ্ছা তাই নাকি খুব ভালো। আমি একটু আসছি বলে চিন্তিত রাতুল ইন্টারকমে কেয়ারটেকার এর কাছে জানতে চায় তার বাসায় আজ কেউ এসেছিল নাকি? আসেনি শুনে সে যতটা না অবাক হয় তার চেয়ে বেশি চিন্তিত হয় কারণ শুধু যে তার বাসায় কেউ আসেনি তাই নয়, বাসা থেকে কেউ বেরও হয়নি।তাহলে এখন কথা হলো শাড়ি, চুড়ি এগুলো নাহয় আগে থেকেই ছিল কিন্তুু  ফুল কোথায় পেল মেয়েটি? এটা ঢাকার বদলে কলম্বো হলে কোনো চিন্তা ছিল না, কারণ শ্রীলংকার জাতীয় ফুল নীল শাপলা।

ছোটবেলায় বিটিভির এক নাটকে এমন কাহিনি দেখেছিল রাতুল।যেখানে মেয়েটির কাছে এমন একজনের ফোন আসে এবং উপহারও পাঠায় যার সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল,কিন্তুু  ছেলেটি মারা যায়। মেয়েটির স্বামী মিসির আলীর কাছে যায় সমাধানের আশায়। রাতুল ভাবতে থাকে তার সাথে বিগত কয়েক দিনে যেসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে সেগুলোও কি এমন কিছু। হলেই বা সে কি করতে পারে এখন সে মিসির আলীকে কোথায় পাবে? এটাতো টিভি নাটক বা উপন্যাস নয়,তার নিজের জীবন।

পরের দুদিন রাতুল খুবই ব্যস্ত- সময় পার করে। মেঘার সাথে একটা কথাও বলার সময় হয় না। তিনদিনের দিন আবারও বৃষ্টি  হয়, এদিন মেঘা তাকে একটি আংটি দেখিয়ে বলে বর্ষণ এসেছিল এবং এটা তাকে দিয়েছে। নীল পাথর খচিত আংটি। রাতুল শুধু বলে অনেক সুন্দর আংটি। বর্ষণের সাথে আমাকে দেখা করিয়ে দেবে না? খুশি হয়ে মেঘা বলে হ্যাঁ কেন নয়? অবশ্যই দেব। তুমিতো বাসাতেই থাক না… এরপর মেঘা আরও অনেক কথা বলে কিন্তুু কোনটাই রাতুলের কানে যায় না, সে খুবই অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। শেষে মেঘাকে থামিয়ে দিয়ে বলে কাল ফিরতে আমার অনেক রাত হতে পারে তুমি সাবধানে থেকো।

লিফট থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দরজা পর্যন্ত- যেতে রাতুলের মনে হয় অনন্তকাল কেটে গিয়েছে। একদিনেই মনে হয় তার বয়স অনেক বছর বেড়ে গিয়েছে।তার নির্ঝঞ্ঝাট, নিশ্চিত- আনন্দের জীবনে যেন পাহাড় সমান চিন্তার বোঝা জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসেছে। সে কি করবে, তার জীবন কোনদিকে যাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। মেঘার সমস্যাগুলো নিয়েই গত দুদিন এবং আজ ব্যস্ত- ছিল রাতুল।কি করবে যখন বুঝে উঠতে পারছিল না তখনই তার মনে পড়ে প্রিয় বন্ধু সায়েমের মা সাইকিয়াট্রিস্ট রাহেলা আনজুমের কথা। সে যোগাযোগ করে তাঁর সাথে। তিনি ধারণা দেন যে, মনোজগতের কোনো সমস্যা বিশেষ করে অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া কোন ভয়াবহ ঘটনার কারণে হয়তো মেঘা কিছু জটিল সমস্যার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে। রাতুলের উচিত হবে সরাসরি তার শ্বশুড়বাড়ির সাথে যোগাযোগ করে সত্যটা জানার চেষ্টা করা,যদি তাঁরা জানান আরকি।কারণ আমাদের সমাজে কোনো দুর্ঘটনা বা সমস্যার কথা মেয়েদের বিয়ের সময় গোপন রাখা হয়। সমাজ ব্যবস্থা এবং পারিপারর্শ্বিকতা এর জন্য দায়ী। রাতুল তাই দেরি না করে এবং ফোনে কোনরকম যোগাযোগ না করেই শ্বশুড়বাড়ি ময়মনসিংহে রওনা দিয়ে দেয় খুব ভোরে। স্বাভাবিকভাবেই সে বাড়ির মানুষেরা রাতুলকে দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ে।

রাতুলের শাশুড়ি মিনা আর মামী শাশুড়ি হেনার বন্ধুত্বের গল্প সবার মুখে মুখে ছিল সে সময়ে। বাড়িতে ভালো কিছু রান্না হলেও দুই বান্ধবী একজন আরেকজনকে না দিয়ে খেয়েছেন কখনো এমনটা হয়নি। সকলেই তাদের মানিকজোড় বলত। স্কুল পেরিয়ে তারা একসময় কলেজে ভর্তি হন। বাড়ির বড় মেয়ে হবার সুবাদে স্বাভাবিক ভাবেই হেনার বিয়ের সম্বন্ধ আসতে শুরু করে। আসন্ন বিচ্ছেদের চিন্তায় দুই বান্ধবী  খুবই চিন্তিত হয়ে পরে। কিন্তুু  কোন কিছুই তাদের মাথায় আসে না। এমনই এক সময় হঠাৎ মিনাদের বাড়িতে ঘটে যায় এক আনন্দের উপলক্ষ। মিনার বড় ভাইয়ের জন্য বিয়ের পাত্রী খোঁজার ধুম পরে যায় সবার মাঝে, যে কিনা কোনদিন বিয়ে করবে না বলে বেঁকে বসে ছিল। সকলেই এ ব্যপারে তাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিল এক প্রকার। তাই তার এই হঠাৎ মত পরিবর্তনে সকলের আনন্দের সীমা নেই। সাথে সাথেই বাড়িতে চলে আসে কয়েকজন ঘটক। জানানো শুরু  হয় আত্মীয় বন্ধুদের, পাত্রী খোঁজার জন্য। এমনই একটা হুল্লোড়ের মাঝে মিনার মাথায় অসাধারণ বুদ্ধিটি চলে আসে। সে সাহস সঞ্চয় করে দুরু“দুরু“ বুকে মায়ের কাছে কথাটা বলেই ফেলে। কিভাবে কিভাবে জানি কোনো ঝামেলা ছাড়াই চৌধুরী বাড়ির বড় ছেলের সাথে হেনার বিয়ে হয়ে যায়। দুই বান্ধবীর আনন্দের সীমা থাকে না। বছর ঘুরতেই ঝুম বর্ষার দিনে হেনার কোল জুড়ে আসে এক পুত্র সন্তান। সেদিন প্রচুর বৃষ্টি  ছিল বলে ছেলের নাম রাখা হয় বর্ষণ।

এরপর বিয়ে হয়ে মিনা শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। পরবর্তীতে মেয়ে মেঘাকে নিয়ে যখনই বাবার বাড়িতে এসেছে বর্ষণ যেন ছায়ার মতনই তার পাশে পাশে থাকত। শৈশব থেকেই তাদের দুজনের এই আত্মার মিল দেখে দুই পরিবারের মনেই একটা ভবিষ্যৎ শুভ পরিণয়ের ভাবনা যে ছিল না তা নয়। ছেলেমেয়ে দুটোও এ বিষয়টা জেনেই বড় হয়। মেঘার এইচ এস সি পরীক্ষার পর তার পরিবার গ্রামে বেড়াতে যাচ্ছে শুনে বর্ষণ একদিনও দেরি করে না, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বাদ দিয়েই ছুটে চলে যায় বাড়িতে।হাসি, আনন্দ আর সুখের বন্যায় যেন ভেসে যায় পুরো বাড়ি। মেঘা আর বর্ষণের আনন্দ ছিল দেখবার মতন। হাত ধরাধরি করে তারা দুটিতে ঘুরে বেড়াত সারাদিনমান এখানে ওখানে। তাদের এই আনন্দ চিরস্থায়ী করার জন্য এবং যেহেতু তারা দুজনেই যথেষ্ট বড় হয়েছে তাই তাদের পরিবার ভাবে যে এখন পাকাপাকি ভাবে কিছু একটা করার সময় এসে গেছে। পানচিনি অথবা একেবারে বিয়ে রেজিস্ট্রি যেটাই হোক একটা কিছু করে রাখতে হবে। সেই মতন সেদিন সেই বিভীষিকাময় দিনে দুপুরের খাবারের পর বড়রা সবাই বেরোয় অনান্য আত্মীয়দের সাথে আলাপ করার উদ্দেশ্যে। মেঘা আর বর্ষণকে বাড়িতে রেখে যাওয়া হয়, যেহেতু তাদেরই বিয়ের আলাপ তাই।

তখনকার বর্ষাকালগুলো এখনকার মতো বৃষ্টি হীন ছিল না,যখন তখন আকাশ কালো মেঘে ঢেকে বৃষ্টি  শুরু হত। বৃষ্টি  পাগল ছেলেমেয়ে দুটোও বৃষ্টি তে ভিজবে বলে খুশিতে ছুটে চলে যায় ছাদে। এর পরের ঘটনা খুবই মর্মান্তিক, সঠিক কি হয়েছিল কেউ বলতে পারে না। পরবর্তীতে মেঘার এলোমেলো কথা আর প্রতিবেশীদের কথা থেকে জানা যায় পুরনো বাড়ির নোনাধরা শেওলা ঢাকা ছাদের কিনারা থেকে কোনোভাবে পা পিছলে নিচে পড়ে যায় বর্ষণ। একতলা বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে সাথে সাথে তার মৃত্যু হয়ে যাবে এটা ভাবতেই পারেনি কেউ। তবে বর্ষণ বেকায়দায় পড়ে গিয়ে মাথার সেই জায়গাটায় আঘাত পেয়েছিল যেখানে আঘাত পেলে মানুষ চোখের পলক ফেলার আগেই মারা যায়।রক্তে ভেসে যাওয়া বর্ষণকে উপর থেকে দেখে পাগলের মতো চিৎকার করছিল মেঘা, পাশের এক বাড়ি থেকে কেউ এই দৃশ্য দেখে ছুটে আসে তাদের উদ্ধার করতে। নয়ত মেঘাও একটা কিছু করে বসত। কারণ সে সময়ে তার কোন হুঁশই ছিল না, তার নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না, শুধু হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছিল একগুচ্ছ নীল শাপলা যেন এটিই তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। হয়ত ছেলেটি জীবনের শেষ দিনটিতেই প্রিয় মানুষকে হৃদয়ের কথা বলেছিল। সেটা আর কোনোদিন জানতে পারা যাবে না।ছেলে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান চৌধুরী পরিবার মেঘার সুস্থতার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পরে।অতিরিক্ত মানসিক শক থেকে মেঘা প্রায় কোমায় চলে যায়। দীর্ঘদিন পর চোখ মেলে তাকালেও পড়ে থাকে জীবন্মৃতের মতো, কোনো কিছুই মনে করতে পারে না। ডাক্তারের পরামর্শে মেঘার বাবা মা গ্রামের বাড়ির সাথে সমস্ত- যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। বর্ষণকে মেঘার জীবন থেকে, স্মৃতি থেকে চিরতরে মুছে দিতে কি প্রাণান্তকর চেষ্টাই না করতে হয় তাদের! দীর্ঘ দুই বছরের চেষ্টায়, চিকিৎসায় খুব ধীরে হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে থাকে মেঘা।এ যেন এক নতুন মেঘা, এক নতুন জীবন যেখানে বর্ষণের ছিল না কোনো স্থান। নতুন করে শুরু  হয় পড়াশোনাও। সেই সময়টাতেই রাতুলের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে বিয়ের সম্মন্ধ আসে এবং কিভাবে কিভাবে জানি খুব দ্রুত বিয়ে হয়েও যায়। খুব সংগত কারণেই মেঘার বাবা মা আগের বিষয়টি পুরোপুরি গোপন করে যান।তাদেরকে অবশ্য দোষ দেয়া যায় না, সন্তানের ভালো কোন বাবা মা না চায়।

শাশুড়ি মায়ের বুক চিড়ে বেরোনো দীর্ঘশ্বাস চিন্তামগ্ন রাতুলকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। এতক্ষণ তার মনে হচ্ছিল যেন কোনো গল্প শুনছে, কারও জীবনের সত্যি ঘটনা নয়। অবশ্য গল্প, উপন্যাস মানুষের বাস্তব জীবনের কথা নিয়েই লেখা হয়। হঠাৎ রাতুলের মাথায় একটা চিন্তা আসে, সে বর্ষণের কোনো ছবি আছে কিনা জানতে চায়। কেন জানি তার মনে হয় এই ছেলেটির সাথে তার কোনদিন দেখা হলেও হতে পারে।মৃত মানুষের সাথে দেখা হওয়া অসম্ভব তবুও তার বারবার এই কথাটিই মনে হতে থাকে।মিনা তখন বলেন-বর্ষণের কোন চিহ্নই আর নেই আমাদের কাছে।মেঘার সু¯’তার স্বার্থে সবকিছুই আমরা সরিয়ে ফেলেছিলাম।তবে জোগাড় করার চেষ্টা করা যেতে পারে।বান্ধবী হেনাকে ফোন করে মিনা খুলে বলেন সবকিছু যা কিছু রাতুল জানিয়েছে তাকে।স্মার্টফোনের যুগে কি আর একটা সামান্য ছবি পাঠানো কোন কঠিন বিষয়!! রাতুল খুবই আগ্রহ নিয়ে দেখে বর্ষণকে,ঝাঁকড়া চুলের অসম্ভব আকর্ষণীয় চেহারার ছেলেটির টানা টানা মায়াবী চোখ দুটোর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যেন তাকিয়ে রয়েছে তারই দিকে। হঠাৎ চমকে উঠে রাতুল ফোনটা ফিরিয়ে দেয় মিনার হাতে।বুকের মাঝে এক অদ্ভুত শূন্যতা এসে ভর করে, এক অজানা অভিমান। মনে হয় সে বোধহয় বর্ষণের জায়গা দখল করে রয়েছে। মনটা খুবই খারাপ হয়। দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত- শশুর শাশুড়িকে আশ্বস্ত- করে সে অনেক কষ্টে ঢাকার পথ ধরে। শাশুড়ি মা তো তখনই তার সাথে মেয়ের কাছে যাবার জন্য তৈরি ছিলেন।মেয়ের জন্য উদ্বিগ্ন হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। রাতুল অনেক বোঝানোর পর উনি বুঝেছেন।এখন হঠাৎ মাকে দেখে বা রাতুল কেন  না জানিয়ে  তাদের বাড়ি গিয়েছে এসব অনেক প্রশ্ন সামনে চলে আসতে পারে,যেটা মেঘার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নাও হতে পারে।আর রাহেলা আনজুমের সাথে কথা না বলে রাতুল আপাতত কোনো কিছু করতে চায় না।

রাতুল আসলে এ যুগের আর দশটা সাধারণ ছেলের মতন নয়।তার সহপাঠীদের সময়ের সিংহভাগ কাটত যেখানে প্রেম, ব্রেকআপ, আবার কাউকে ভালো লাগে নাকি এসব ধান্দায়,  সেখানে রাতুল তার মনের সমস্ত- ভালোবাসা সঞ্চিত করে রেখেছিল কখনও না দেখা ভবিষ্যত জীবন সংগীর জন্য। ধীর, স্থির, শান্ত- স্বভাবের রাতুল তার বয়েসী অন্য যে কোনো ছেলের তুলনায় ছিল অনেক পরিণত আর বাস্তববাদী। তাই নিজের জীবনের হঠাৎ আসা ঝড় মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিতীয় বার ভাবতে হয় না তার। রাহেলা আনজুমের কাছে গিয়েছিল সে এবং মেঘার পরিবারের কাছ থেকে যা যা জেনেছিল সব খুলে বলেছিল। সব শুনে তিনি বলেছিলেন-

-দেখো রাতুল এই পৃথিবীতে সবচাইতে জটিল এবং বিচিত্র জিনিস হচ্ছে মানুষের মন, মস্তিস্ক। শরীরের অসুখ হয়ত তবুও বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষায়, ওষুধে অপারেশানে ভাল করার চেষ্টা করা হয় কিন্তুু  মনের অসুখের ক্ষেত্রে এসব সুযোগ একেবারে নেই বললেই চলে।

হ্যাঁ কিছু ওষুধ এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই দেয়া যায় তবে সবচেয়ে যেটা বেশি দরকার সেটা হল কাছের মানুষের ধৈর্য্য, যতœ, মায়া আর ভালোবাসা।বেশির ভাগই দেখা যায় এই সাপোর্টগুলো দীর্ঘদিন কেউ দিতে পারে না। তুমি ইয়াং ছেলে জীবনটা সামনে পড়ে রয়েছে তুমিই বা কেন এসব ঝামেলা ঘাড়ে নিতে যাবে। খুব সহজেই তুমি ডিভোর্স দিয়ে আরেকটা বিয়ে করে সুখে সংসার করতে পার।মেঘার ব্যপারটা ওর বাবা মা বুঝবে।

এতক্ষণ একটানা কথাগুলো বলে রাহেলা আনজুম থামলেন, তাকিয়ে রইলেন রাতুলের মুখের দিকে ও কি বলে সেটা জানার জন্য।কারণ সেটার উপরই নির্ভর করছে এই রোগীর চিকিৎসার পরবর্তী ব্যবস্থাপত্র তিনি কি দেবেন বা আদৌ কিছু দেবার সুযোগ পাবেন কিনা।

রাতুল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে খুবই হালকা অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলতে শুরু করে- দায়িত্ব নিয়ে সেটা এড়িয়ে যাওয়াটা মানুষের কাজ নয়। আর আমি নিজেকে সত্যিকার মানুষ ভাবতে ভালবাসি।

রাহেলা আনজুমের মুখে একটা স্মিত হাসি ফুটে ওঠে। ছেলের বন্ধু হিসেবে তিনি রাতুলকে যথেষ্ট কাছ থেকে চেনেন।তিনি এমনটাই আশা করছিলেন।

রাতুল মেঝের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু  করে -আন্টি যে মেয়েটি পরম নির্ভরতায় আমার হাত ধরে তার সবকিছু ছেড়ে এসেছে তার সেই হাত আমি কিভাবে ছেড়ে দেব!! আর ডিভোর্সের তো প্রশ্নই আসে না।মেঘা আমার দায়িত্ব। তার ভালো মন্দ সবকিছুরই দায়িত্ব আমার।স্ত্রী মানে তো অর্ধঙ্গীনী, মানে সে আমার জীবনের অর্ধেক। কিন্তুু  আমার জীবনে মেঘা পুরোটাই।

রাতুল চোখ তুলে তাকায়,বিষণœ সে চোখ দুটি জলে ভরা কিন্তুু  দৃঢ় প্রত্যয় আর ভালোবাসায় দীপ্তিময়। রাহেলা আনজুম মুগ্ধ হয়ে দেখেন। বহুদিন এমন ভালোবাসা দেখেন না, তাঁর বড় আনন্দ হয়, মন থেকে এই ছেলেমেয়ে দুটির সুখী জীবনের প্রার্থণা করেন।এখন তিনি জানেন যে কোনো উপায়েই হোক রাতুল মেঘাকে সুস্থ্য করে তুলবে।

সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত- ব্যক্তিদের মধ্যে বাস্তব চিন্তা একদম কমে যায়, বিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন হয়,  যা ঘটেনি বা যা নেই এমন জিনিসে বিশ্বাস করে এবং দেখে। এটি মূলত সাইকোটিক ডিজঅর্ডার। মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারে মাত্রাতিরিক্ত বিপর্যয়ের কারণে এসব সমস্যাগুলো দেখা দেয়। তবে সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় হলে এবং ১-২ মাস নিয়মিত মেডিকেশানে নিউরোট্রান্সমিটারের ইমব্যালান্স ঠিক হয়ে আসে।এটাই ছিল মেঘার রোগ সম্পর্কে  রাহেলা আনজুমের দেয়া মোটামুটি একটা বিবরণ। মেঘার মেডিকেশান কিভাবে শুরু  করা যায় সেটা একটা বড় চিন্তার বিষয় ছিল। সহজ সমাধান দিয়েছিলেন মেঘার মা।তার কথা হলো মেঘা যেহেতু দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিল তাই তার আবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে চেক আপের জন্য, এটা বোঝানো খুব একটা কঠিন হবে না। মিনা এসেছিলেন মেয়ের কাছে। সাথে করে নিজে নিয়ে গিয়েছিলেন ডাক্তারের কাছে। তারপর যতœ করে ওষুধ খাওয়ানো থেকে শুরু  করে সবকিছুই দেখেশুনে রাখছিলেন। রাতুল খুবই আশান্বিত হয়েছিল, ভরসা করেছিল এইবারে মেঘা সুস্ত হয়ে উঠবে নিশ্চিত। হঠাৎই মেঘার বাবা অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় তার মাকে ফিরে যেতে হয় মাসখানেক না পেরোতেই।

রাতুল মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে মেঘার মায়াবী মুখের দিকে। ঘুমিয়ে আছে মেয়েটি। রাতুলের একটি হাত ধরে আছে পরম নির্ভরতায়।সে যে সব সময় ইনসিকিউরিটিতে ভোগে তারই বহিঃ প্রকাশ যেন এটি। রাতুল মেঘার ঘুমন্ত- মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে কতই না নিষ্পাপ একটি মুখ অথচ মনোজগতে কত কষ্ট!! মেঘা ঘুম ভেঙে চোখ মেলে তাকায়, রাতুলকে তার দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে দেখে একটুখানি হেসে বলে – তুমি এভাবে বসে আছ কেন আমার পাশে? আমি কি কোন ছোট বাচ্চা যে ঘুমের মধ্যে ভয় পাব বলেই সে রিনিঝিনি শব্দে হাসতে থাকে। হঠাৎই হাসি থামিয়ে রাতুলকে জিজ্ঞেস করে

-এই আজ কি বৃষ্টি  হবে?

রাতুল চমকে যায়। বলে – জানিনাতো। কেন বৃষ্টি  হলে কি হবে? ভিজবে তুমি আমার সাথে?

– না। আসলে অনেক দিন বৃষ্টি  হয় না তো তাই। বৃষ্টি  না হলে আমার খুব মন খারাপ হয় জানো, অন্যমনস্ক হয়ে কথাগুলো বলতে বলতে থেমে যায় মেঘা, আর রাতুলের মাথায় চিন্তার ঝড় বয়ে যায়। সে ঠিকই জানে বৃষ্টি  হতে পারে, ওয়েদার ফোরকাস্ট দেখেছে সে। যেদিন থেকে মেঘার সমস্যার শুরু  সেদিনের পর থেকে টানা এক মাস প্রায় বৃষ্টি  নেই। রাতুল তাই আজ সকাল থেকেই চিন্তায় আছে। বেলা গড়িয়ে বিকেলের দিকে যাচ্ছে এখনও পর্যন্ত উত্তাপসহ ঝকঝকে রোদ  ছিল হঠাৎ কেমন জানি রোদটা কমে চারিদিকে আলো কমে আসে। জানালা দিয়ে এক ঝলক হঠাৎ হাওয়া এসে মেঘার গাল ছুঁয়ে এলোমেলো করে দেয় তার চুল। জানালার পর্দাগুলো উড়তে থাকে উত্তাল নদীর পালের মতন। দূর থেকে মেঘের গর্জন ভেসে আসে। মেঘা চঞ্চল পায়ে ছুটে যায় জানালার ধারে।অস্বাভাবিক রকম উত্তেজনা নিয়ে বলে -দেখো রাতুল বৃষ্টি  আসছে, আমার মন বলছিল।

রাতুল বিষণœ চোখে তাকিয়ে থাকে মেঘার খুশি ঝলমলে মুখের দিকে। তাকে দেখে বোঝাই যায় কতটা তৃষিত সে প্রিয় কারও অপেক্ষায়। রাতুলের মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়,  ভিতর থেকে খুবই দুর্বল লাগে। মনে হয় চারপাশের এই সবই যেন এক যুদ্ধ আয়োজন। অদৃশ্য এক প্রতিপক্ষের কাছে হেরে যাবার জন্যই কি তার এত চেষ্টা!! হঠাৎ রাতুলের মন ছেয়ে যায় এক অসম্ভব ক্রোধে। এটা তার জীবন,কেন সে এমন কারো কাছে হার স্বীকার করে তা নষ্ট করবে যার কোন অস্তিত্বই নেই। না এটা সে কোন ভাবেই হতে দেবে না।

-রাতুল, এই শোন না, চলো আমরা বারান্দায় যাই। বৃষ্টি এসে গিয়েছে।

মেঘার কথায় চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসে রাতুল। গভীর দৃষ্টিতে তাকায় সে মেঘার দিকে, চঞ্চল পায়ে বারান্দার দিকে অগ্রসরমান নিজের স্ত্রীকে ডাকে সে। রাতুলের গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যা মেঘাকে বাধ্য করে ফিরতে। রাতুল এগিয়ে গিয়ে মেঘার দুবাহু স্পর্শ করে নিজের দিকে কিছুটা আকর্ষণ করে বলে-

মেঘা তুমি আজ আমার সাথে বৃষ্টি তে ভিজবে। আমার হাত ধরে।জানো মেঘা আজ প্রায় দুই যুগ হয় আমি বৃষ্টি তে ভিজি না।

-কেনো রাতুল প্রতি বছরই তো বৃষ্টি  হয়। অনেক অনেক বার। তাহলে তুমি কেন ভেজো না অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে মেঘা।

মেঘার কাঁধের পেছন দিয়ে ওয়াল টু ওয়াল ফ্রস্টেড গ্যাস ডোরের পিছন দিয়ে রাতুল পরিস্কার দেখে তুমুল বৃষ্টি তে ভেসে যাওয়া তাদের যতেœ গড়া বাগানের কামিনী গাছের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেউ চির অপেক্ষা নিয়ে। যার ঝাঁকড়া চুল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ছে পানি।রাতুল জানে এ দৃশ্য বাস্তবের কোন দৃশ্য নয় হয়ত তার মস্তিষ্কের কল্পনা তারপরও তার বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে ভয়ে। মেঘাকে হারানোর ভয়। রাতুল তাই তার শেষ চেষ্টাটি করবার জন্য প্রস্তুত হয়।

– তুমি জানতে চাও? মেঘার জিজ্ঞাসার জবাবে বলে রাতুল।

-ছোটবেলায় আমি প্রায় সবসময় অসুস্থ থাকতাম। নিউমোনিয়া হয়েছিল একাধিক বার। তাই সবসময় জ্বরটা লেগেই থাকত। আমার মা অনেক কষ্ট করেছেন আমাকে নিয়ে।

– তারপর কবে তুমি ভালো হয়ে গেলে? তোমার তো এখন আর এমন কোন সমস্যা নেই । তুমি এখন সুস্থ।

-হ্যাঁ মেঘা আমি সুস্থ হয়েছিলাম।আমার কাছে সেই দিনটিকে এখনও মনে হয় যেন এইতো গতকালের ঘটনা। এমনি ঝুম বর্ষার এক ভোরে আমার মা হঠাৎ কাঁথার নিচ থেকে জ্বরতপ্ত আমাকে টেনে বের করতে করতে বলেন এই বাবু সোনা চল আমার সাথে। আমরা একটা মজার কাজ করি। পাঁচ বছরের ছোট্ট সেই আমার হাত ধরে একটি অদ্ভুত কাজ করেন আমার মা, উঠোনের ঝুম বৃষ্টি র মাঝে নেমে যান তিনি। বৃষ্টি র ঠান্ডা পানিতে ভিজে কাঁপতে থাকি আমি আর মা তার মুখ উর্ধ্বাকাশের দিকে করে বিরবির করে বলতে থাকেন কিছু আর বুকে জড়িয়ে রাখেন আমাকে যতক্ষণ না আমার বাবা ঘুম ভেঙে আমাদের খুঁজতে খুঁজতে এসে আমাদের সেখান থেকে না সরান।

– তারপর? তারপর কি হয়েছিল রাতুল?

-তারপর আমি সুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম আশ্চর্যজনকভাবে।জীবনে এখনও পর্যন্ত আর কোনোদিন আমার একটুও জ্বর হয়নি। তবে….

-তবে কি?

-তবে এই ঘটনার পর আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রচ- জ্বর শুরু  হয় তার। নিউমোনিয়া হয়ে গিয়েছিল তার। চিকিৎসকরা অবাক হয়ে বলেন উনার লাংস পানিতে এমনভাবে পরিপূর্ণ যেন পানি ঢেলে ভরে দেয়া হয়েছে। চিকিৎসা শুরু র দুই সপ্তাহের মাঝে আমার মা আমাদের ছেড়ে চলে যান চিরতরে।

মেঘার মায়াবী চোখদুটো উপচে নামে অশ্রু ধারা।হাত বাড়িয়ে রাতুলে গাল স্পর্শ করে সে বলে আমি খুবই দুঃখিত রাতুল।আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে তোমার জন্য। আমি জানতাম না তোমার ভেতরে এত কষ্ট লুকানো আছে।

খোলা আকাশের নিচে হাত ধরাধরি করে ভিজছে দুজন মানব মানবী। পবিত্র জলধারা যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জগতের সকল দুঃখ কষ্ট। মেঘা শক্ত করে ধরে আছে রাতুলের হাত। আর রাতুল তাকিয়ে আছে উর্ধ্বাকাশে , ঠিক তার মায়ের মতো। মেঘাকে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে নেয় সে আর কায়মনোবাক্যে প্রার্থণা করতে থাকে সৃষ্টিকর্তার কাছে।

সৃষ্টিকর্তা কারও পবিত্র ডাক উপেক্ষা করতে পারেন না। খালি হাতে ফেরান না কাউকেই।

 

 

সৈয়দা মাসুদা বনি, গল্পকার

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাহিত্য-গবেষণার আলোকবর্তিকা

শাহেদ কায়েস   আহমদ রফিক (জন্ম: ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-মৃত্যু: ২ অক্টোবর ২০২৫) বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুবনে আহমদ রফিক একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে

অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

আন্দরকিল্লা ডেক্স \ চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের আত্মজীবনী ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

ফেরা

সৈয়দা মাসুদা বনি   নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন   রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু! মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে

চিরহরিৎ বৃক্ষের গল্প

সুজন বড়ুয়া   ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়।