এখন সময়:বিকাল ৩:২৫- আজ: বৃহস্পতিবার-৬ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২১শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:বিকাল ৩:২৫- আজ: বৃহস্পতিবার
৬ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২১শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

বাঁশি: চিরন্তন বাংলার গৌরব ও ঐতিহ্যের নিজস্ব সুর-দশম পর্ব

নাজমুল টিটো

জন্মদিনে (১৯৪১) কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ। এটি রবীন্দ্রনাথের কাব্য রচনার “অন্ত্যপর্ব”-এর অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। কবি তাঁর জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখকে স্মরণীয় করে রাখতে গিয়ে প্রত্যেক বার নবরত্ন সৃজনের মধ্য দিয়ে সাহিত্য শিল্পকলার বিচিত্র শাখাকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং তার রস আস্বাদনের মাধ্যমে জন্মদিন উদযাপন করেছেন। সেইসব উৎসবের ছবি, চিত্রকল্প ও বাঁশির সুরের বর্ণিল উপস্থিতি কবির অজস্র কবিতা ও গানে প্রস্ফুটিত।

 

(২৫৫)

“নির্মম আনন্দ এই উৎসবের

বাজাইবে বাঁশি

বিচ্ছেদের বেদনারে

পথপার্শ্বে ঠেলিয়া ফেলিয়া।”

[৪, জন্মদিনে]

(২৫৬)

“আমি পৃথিবীর কবি,যেথা তার যত উঠে ধ্বনি

আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি, এই স্বরসাধনায় পৌঁছিল না বহুতর ডাক-

রয়ে গেছে ফাঁক।”

[১০,জন্মদিনে]

 

 

(২৫৭)

“বয়স-অতীত সেই বালকের মন

নিখিল প্রাণের পেত নাড়া,

আকাশের অনিমেষ দৃষ্টির ডাকে দিত সাড়া, তাকায়ে রহিত দূরে।

রাখালের বাঁশির করুণ সুরে

অস্তিত্বের যে বেদনা প্রচ্ছন্ন রয়েছে,

নাড়ীতে উঠিত নেচে।”

[১৯,জন্মদিনে]

 

শেষ লেখা (১৯৪১) কাব্যের কবিতাগুলো কবির অন্তিমজীবনে লেখা। এ গ্রন্থের নামকরণ কবি করে যেতে পারেননি। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ কাব্যের ভূমিকায় লিখেছিলেন,‘’শেষ লেখার কয়েকটি কবিতা তাঁহার স্বহস্তলিখিত; অনেকগুলি শয্যাশায়ী অবস্থায় মুখে মুখে রচিত, নিকটে যাঁহারা থাকিতেন তাঁহারা সেগুলি লিখিয়া লইতেন, পরে তিনি সেগুলি সংশোধন করিয়া মুদ্রণের অনুমতি দিতেন।’’ কবির শেষ জীবনের উপলব্ধি সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারনা পাওয়া যায় এ গ্রন্থে। অন্তিম শয্যায়ও তিনি বাঁশিকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেন নি। কাব্যগ্রন্থে মাত্র ১৫টি কবিতা সংকলিত হয়। তন্মধ্যে ৫ ও ৮ সংখ্যক কবিতায় তাঁর ফেলে আসা সুমধুর স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বাঁশিকেও স্মরণীয় করে গেছেন।

(২৫৮)

“সুখস্মৃতি ডেকে ডেকে এনে

জাগরণ করিবে মধুর,

যে বাঁশি নীরব হয়ে গেছে

ফিরায়ে আনিবে তার সুর।”

[৫, শেষ লেখা]

(২৫৯)

“বিবাহের প্রথম বৎসরে

দিকে দিগন্তরে

শাহানায় বেজেছিল বাঁশি,

উঠেছিল কল্লোলিত হাসি-

আজ স্মিতহাস্য ফুটে প্রভাতের মুখে

নিঃশব্দ কৌতুকে।

বাঁশি বাজে কানাড়ায় সুগম্ভীর তানে

সপ্তর্ষির ধ্যানের আহ্বানে।”

[৮, শেষ লেখা]

 

স্ফুলিঙ্গ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয়। এর প্রকাশক ছিলেন শ্রীপুলিনবিহারী সেন। উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথের “লেখন” ও “স্ফুলিঙ্গ” কাব্যের কবিতাগুলো একই রূপের হওয়ায় একসাথে ‘স্ফুলিঙ্গ’ নামক কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হবার কথা ছিল। কিন্তু পরে দুটিই আলাদা গ্রন্থরূপে প্রকাশ পায়।

নানা সময়ে, নানা প্রয়োজনে, লিখিত ও ইতস্তত-বিক্ষিপ্তভাবে লেখা কবির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কবিতাগুলো তাঁর মৃত্যুর পর ‘স্ফুলিঙ্গ’ নামক গ্রন্থে সংগৃহীত হয়। পূর্বের লেখা ‘ক্ষণিকা’ ও ‘কণিকা’ কাব্যের কবিতাগুলোও প্রায় সম-শ্রেনীর। কবি এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কবিতাগুলোর নাম দিয়েছেন ‘কবিতিকা’।

প্রখ্যাত রবীন্দ্র গবেষক উপেন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, “ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে একটা ভাব, তত্ত্ব বা অনুভূতিকে উপযুক্ত উপমা বা তুলনার সাহায্যে রূপায়িত করিয়া সুন্দর ব্যঞ্জনামূখর করাই এই প্রকার রচনা সার্থকতা। এই জাতীয় রচনায় রবীন্দ্রনাথ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বর গুপ্ত, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, রজনীকান্ত সেন প্রভৃতি এই জাতীয় কবিতা কিছু কিছু লিখিয়াছেন, কিন্তু সেগুলি অনেক ক্ষেত্রে হইয়াছে নীতি বা তত্ত্বের পদ্যরূপ মাত্র। রবীন্দ্রনাথের কবিতা-সৌন্দর্য ও রসসৃষ্টি তাহাতে নাই। ‘কণিকা’র মধ্যে কিছু কিছু তত্বের অংশ থাকিলেও ‘লেখন’ বা ‘স্ফূলিঙ্গ’ গ্রন্থে তত্বের অংশ খুব কম। কবির পরিণত হাতে অনেকগুলির মধ্যে কাব্য-সৌন্দর্যের অপরূপ প্রকাশ হইয়াছে। এক একটি ভাব, অনুভূতি বা তত্ত্ব, ক্ষুদ্র আয়তনের মধ্যে সহজ ও সরলভাবে রূপায়িত হইয়া ব্যঞ্জনা, সৌন্দর্য ও রসে মণিখন্ডের মতো ঝলমল করিতেছে।”

‘স্ফুলিঙ্গ’ কাব্যের ১৬, ৮৯ ও ১৩১ সংখ্যক কবিতিকায় কবি জানা-অজানার বাঁশি বাজিয়ে কতই না সহজে সার্বজনীন অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

 

(২৬০)

“আকাশে ছড়ায়ে বাণী

অজানার বাঁশি বাজে বুঝি।

শুনিতে না পায় জন্তু,

মানুষ চলেছে সুর খুঁজি।”

[১৬, স্ফুলিঙ্গ]

(২৬১)

“জানার বাঁশি হাতে নিয়ে

না জানা

বাজান তাঁহার নানা সুরের

বাজানা।”

[৮৯, স্ফুলিঙ্গ]

(২৬২)

“সেথাকার বাঁশিরবে

অনামা ফুলের মৃদুগন্ধে

জানা না-জানার মাঝে

বাণী ফিরে ছায়াময় ছন্দে।”

[১৩১,স্ফুলিঙ্গ]

 

সংযোজন (১৯৪৫)

বাংলা সাহিত্যের বটবৃক্ষ রবীন্দ্রনাথের সব লেখার রচনাকাল ও প্রকাশকাল নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব। সব লেখা যেমন রচনাকালের সিকোয়েন্স ঠিক রেখে গ্রন্থভুক্ত হয়নি আবার অনেক লেখা কখনোই গ্রন্থভুক্ত হয়নি। আবার কিছু লেখা প্রথম সংস্করণে প্রকাশিত হয়ে পরবর্তী সংস্করণে বাদ পড়েছে। এমন কিছু কবিতা, গান, নাটক, প্রহসন, গল্প, উপন্যাস,প্রবন্ধ, সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা, গ্রন্থ সমালোচনাসহ বিবিধ বিষয় নিয়ে লেখা সংকলিত হয় ঐতিহ্য প্রকাশনীর ষোড়শ ও সপ্তদশ সংখ্যায় “সংযোজন” অংশে। এই লেখাগুলো ঘেঁটে লক্ষ্য করা যায় বিশ্বকবির চিরচেনা বাঁশির সুর ও স্বরের নান্দনিক প্রয়োগ এখানেও স্পষ্ট। ফিরিস্তি নিম্নরূপ:-

 

(২৬৩)

“পথিক বাজায়ে গেল পথে-চলা বাঁশি,

ঘরে সে কি উঠেছে উচ্ছ্বাসি ?

কোণে কোণে ফিরিছে কোথায়

দূরের বেদনখানি ঘরের ব্যথায়!”

[প্রত্যুত্তর, বীথিকা]

(২৬৪)

“অরূপ-কমল-বনে সেথায়

স্তব্ধবাণীর বীণাপাণি-

এত দিনের প্রাণের বাঁশি

চরণে তাঁর দাও রে আনি।”

[দিনান্ত, বীথিকা]

(২৬৫)

“সেদিন গগন মুখর বাঁশির গানে,

ধরণীর হিয়া ধায় উদাসিয়া

অভিসার-পথ-পানে।”

[যুগল পাখি, বীথিকা]

(২৬৬)

“দূর বাঁশিতে যে সুর বাজে

তাহার সাথে

মিলিয়ে নিয়ে বাজাস বাঁশি

বিদায়-রীতে।”

[যাত্রা শেষে, বীথিকা]

(২৬৭)

“আমার বাঁশি করিবে সারা যা ছিল গান তার,

সে নীরবতা পূর্ণ হবে কিসে ?

তারার মতো সুদূরে-যাওয়া দৃষ্টিখানি কার

মিলিবে মোর নয়ন-অনিমিষে?”

[আবেদন, বীথিকা]

(২৬৮)

“মুখ ফিরিয়ে পশ্চিমেতে

বারেক যদি দাঁড়াও আসি

আঁধার গোষ্ঠে এই রাখালের

শুনতে পাবে সন্ধ্যাকালের

চরম বাঁশি।”

 

সেই বাঁশিতে উঠবে বেজে

দূর সাগরের হাওয়ার ভাষা,

সেই বাঁশিতে দেবে আনি

বৃত্তমোচন ফলের বাণী

বাঁধন-নাশা।”

 

সেই বাঁশিতে শুনতে পাবে

জীবন-পথের জয়ধ্বনি-

শুনতে পাবে পথিক রাতের

যাত্রামুখে নূতন প্রাতের

আগমনী।”

[জন্মদিনে, বীথিকা]

 

“বাঁশরি আনে আকাশ-বাণী-

ধরণী আনমনে

কিছু বা ভোলে কিছু বা আধো

শোনে।

নামিবে রবি অস্তপথে,

গানের হবে শেষ-

তখন ফিরে ঘিরিবে তারে

সুরের কিছু রেশ।”

[রেশ, বীথিকা]

(২৭০)

“বধূ, তোমার দেহলীতে

বর আসিছে দেখিছ কি?

আজি তাহার বাঁশরিতে

হিয়া মিলায়ে দিয়ো সখী।”

[১৮, স্ফুলিঙ্গ]

 

…চলবে

 

নাজমুল টিটো, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাহিত্য-গবেষণার আলোকবর্তিকা

শাহেদ কায়েস   আহমদ রফিক (জন্ম: ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-মৃত্যু: ২ অক্টোবর ২০২৫) বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুবনে আহমদ রফিক একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে

অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

আন্দরকিল্লা ডেক্স \ চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের আত্মজীবনী ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

ফেরা

সৈয়দা মাসুদা বনি   নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন   রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু! মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে

চিরহরিৎ বৃক্ষের গল্প

সুজন বড়ুয়া   ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়।