নাজমুল টিটো
রবীন্দ্রনাথ রচিত অসাধারণ সব শৈল্পিক কাব্য ও গানের সাথে যেমন মিশে আছে বাঁশির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব তেমনি তাঁর গদ্যে রচিত সৃষ্টিকর্মজুড়েও বাঁশি অপূর্ণতা ও পূর্ণতার মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি, বঞ্চনা ও বেদনার ভাব প্রকাশ এবং লৌকিক-অলৌকিক অনুভূতির গভীর উপলব্ধি প্রকাশে কখনো রূপক, কখনো উপমা কখনোবা প্রতীকি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
# বাঁশির সুর প্রকৃতির প্রতি মানুষের যে এক অমোঘ আকর্ষণ সৃষ্টি করে তা ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ (১৮৮৪) নাট্যকাব্যে পুনঃপুনঃ স্পষ্ট।
দ্বিতীয় দৃশ্যে একদল রাখাল বালক সমস্বরে গায়,
“হেদে গো নন্দরানী,
আমাদের শ্যামকে ছেড়ে দাও।
হেরো গো। প্রভাত হল, সুয্যি উঠে
ফুল ফুঠেছে বনে-
আমরা। শ্যামকে নিয়ে গোষ্ঠে যাব
——————————————
তার হাতে দিয়ো মোহন বেণু,
নূপুর দিয়ো পায়।
রোদের বেলায় গাছের তলায়।
নাচব মোরা সবাই মিলে।
বাজবে নূপুর রুনুঝুনু,
বাজবে বাঁশি মধুর বোলে।
বনফুলে গাঁথব মালা,
পরিয়ে দিব শ্যামের গলে।”
চতুর্থ দৃশ্যে স্ত্রীলোকে মিলিয়া গায়-
“কথা কোস নে লো রাই, শ্যামের বড়াই বড়ো বেড়েছে। কে জানে ও কেমন করে মন কেড়েছে। শুধু ধীরে বাজায় বাঁশি, শুধু হাসে মধুর হাসি, গোপিনীদের হৃদয় নিয়ে তবে ছেড়েছে।”
সপ্তম দৃশ্যে কবি বাঁশির সুরকে প্রকৃতির আহ্বান ও আত্মার জাগরণের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। দু’জন নারী পর্বতপথে প্রমোদ বিহারে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে গিয়ে দূর হতে বাঁশির সুর তাদের চিত্তে দোলা দেয় তার অনুভব প্রকাশ পায়।
“বনে এমন ফুল ফুটেছে,
মান করে থাকা আজ কি সাজে।
মান-অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে
চলো চলো কুঞ্জমাঝে।
আজ কোকিলে গেয়েছে কুহু, মুহুরমুহু
আজ কাননে ওই বাঁশি বাজে।
মান করে থাকা আজ কি সাজে।”
সন্ধ্যেবেলায় শ্যামের বাঁশির সুর বিনোদনী রাধার মনে যে মরণ দশা সৃষ্টি করে তা শুধু তার সখিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনা আশপাশের সমাজও টের পেয়ে যায়।
“মরি লো মরি,
আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে!
ভেবেছিলেম ঘরে রব, কোথাও যাব না-
ওই যে, বাহিরে বাজিল বাঁশি বলো কী করি?
শুনেছি কোন্ কুঞ্জবনে যমুনাতীরে
সাঁঝের বেলা বাজে বাঁশি ধীর সমীরে-
ওগো তোরা জানিস যদি
আমায় পথ বলে দে।
আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে!
দেখি গে তার মুখের হাসি,
তারে ফুলের মালা পরিয়ে আসি,
তারে বলে আসি তোমার বাঁশি
আমার প্রাণে বেজেছে।
আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে!”
অষ্টম দৃশ্যে ‘গুহারদ্বারে’ বাঁশির সুর সন্ন্যাসীর হৃদয়ের গভীর সত্তাকে জাগিয়ে তোলে নির্জন জীবন থেকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসার জন্য উদ্বেলিত করে ।
“সেথা হতে কারা তোরা বাঁশিটি বাজায়ে
আজিও ডাকিস মোরে! আমি ফিরিব না।
বন্দী করে রেখেছিলি মায়ামুগ্ধ করে,
পালায়ে এসেছি আমি, হয়েছি স্বাধীন।
তীরে বসে গা তোদের মায়াগানগুলি-
অনন্তের পানে আমি চলেছি ভাসিয়া।
বাছা, তুই কাছে আয়, দেখি তোরে আমি,
মুখেতে পড়েছে তোর চাঁদের কিরণ।”
প্রত্যুত্তরে বালিকা বলছে,
“গান পড়িতেছে মনে, গাই বসে পিতা!-
সুদূরে- অতি- অতি দূরে,
বুঝি রে কোন্ সুরপুরে
তারাগুলি ঘিরে বসে বাঁশরি বাজায়।
মেঘেরা তাই হেসে হেসে
আকাশে চলে ভেসে ভেসে,
লুকিয়ে চাঁদের হাসি চুরি করে যায়।”
# নারীমুক্তি ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন নিয়ে রচিত ‘মায়ার খেলা’ (১৮৮৮) গীতিনাট্যে বাঁশির সুরকে রবিঠাকুর মোহ, আকর্ষণ বা কোনো বিশেষ অনুভূতির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
(১) “কী স্বপনে কী জাগরণে।
তুমি জান বা না জান,
মনে সদা যেন মধুর বাঁশরি বাজে
হৃদয়ে সদা আছ বলে।
আমি প্রকাশিতে পারি নে,
শুধু চাহি কাতর নয়নে।”
[কানন, পঞ্চম দৃশ্য]
(২) “পুরুষগণ। ফুলগন্ধে আকুল করে, বাজে বাঁশরি
উদাস স্বরে, নিকুঞ্জ প্লাবিত চন্দ্রকরে-
স্ত্রীগণ। তারি মাঝে মনোমোহন মিলনমাধুরী,
যুগল মুরতি।”
[কানন, সপ্তম দৃশ্য]
# রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজা ও রানী’ (১৮৮৯) নাটকে বাঁশির ব্যবহার পরোক্ষ ও প্রতীকী, যা মূলত রাজা বিক্রমদেবের স্মৃতি ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত। বসন্ত পূর্ণিমায় যে বাঁশি বাজবে বলে রাজা আশা করেছিলেন, সেই বাঁশির সুর রাজাকে মনে করিয়ে দেয় তাঁর রানীকে চেনার মুহূর্তটি এবং তাঁর হারানো স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে। বাঁশি এখানে শুধুমাত্র একটি বাদ্যযন্ত্র নয়, বরং রাজা ও রানীর মিলনের বা চেতনার সংযোগের একটি প্রতীক হিসেবে কাজ করে।
পঞ্চম দৃশ্যে সখীদের কথোপকথন ও গান শুনে অনুধাবন করা যায় বাঁশি এই নাটকে কতটা প্রভাবক।
“প্রথম সখী। আলো কোথায় দেবে ভাই।
দ্বিতীয় সখী। আলোর জন্যে ভাবি নে। আলো তো কেবল এক রাত্রি জ্বলবে। কিছু বাঁশি এখনো এল না কেন? বাঁশি না বাজলে আমোদ নেই ভাই।
তৃতীয় সখী। বাঁশি কাশ্মীর থেকে আনতে গেছে, এতক্ষণে এল বোধ হয়। কখন বাজবে ভাই।
প্রথম সখী। বাজবে লো বাজবে। তোর অদৃষ্টেও একদিন বাজবে।
তৃতীয় সখী। পোড়াকপাল আর-কি। আমি সেইজন্যেই ভেবে মরছি।
প্রথম সখীর গান
বাজিবে, সখী, বাঁশি বাজিবে-
হৃদয়রাজ হৃদে রাজিবে
বচন রাশি রাশি, কোথা যে যাবে ভাসি
অধরে লাজহাসি সাজিবে।
দ্বিতীয় সখী। তোর গান রেখে দে। এক-একবার মন কেমন হু হু করে উঠছে। মনে পড়ছে কেবল একটি রাত আলো হাসি বাঁশি আর গান। আর পরদিন থেকে সমস্ত অন্ধকার।
তৃতীয় সখী। তুই তো ভাই, চেষ্টা করতে ছাড়িস নি। তা, তুই যখন পারলি নে তখন কি আর আমি পারব? ওলো, আমাদের সখীকে যে একবার দেখেছে তার মন কি আর অমনি পথে-ঘাটে চুরি যায়? ঐ বাঁশি এসেছে। ঐ শোন্ বেজে উঠেছে।
প্রথম সখীর গান
ওই বুঝি বাঁশি বাজে-
বনমাঝে কি মনোমাঝে?
বসন্তবায় বহিছে কোথায়, কোথায় ফুটেছে ফুল!
বলো গো সজনী, এ সুখরজনী কোনখানে উদিয়াছে-
বনমাঝে কি মনোমাঝে?”
# রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘মালিনী’ (১৮৯৬) কাব্য-নাটকটি সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থাবলীর অন্তর্গত হয়ে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই নাটকে বংশী শব্দটি মাত্র একবার ব্যবহার হলেও এই নাটকের প্রধান চরিত্র মালিনীর একাকিত্ব, প্রকৃতির সাথে তার একাত্মতা এবং তার ভিতরের গভীর অনুভূতির প্রকাশ পেয়েছে এই বাঁশির সুরে।
“দেবী, ডুবায়েছি তারে।
জীবনের সব কথা বলেছি তোমারে,
শুধু, সেই কথা আছে বাকি।
যেই দিন
বিদ্বেষ উঠিল গর্জি দয়াধর্মহীন
তোমারে ঘেরিয়া চারি দিকে, একাকিনী
দাঁড়াইয়া পূর্ণ মহিমায়, কী রাগিণী
বাজাইলে। বংশীরবে যেন মন্ত্রাহত
বিদ্রোহ করিল আসি ফণা অবনত
তব পদতলে। শুধু বিপ্র ক্ষেমংকর
রহিল পাষাণচিত্ত, অটল-অন্তর।
একদা ধরিয়া কর কহিল সে মোরে-
‘বন্ধু, আমি চলিলাম দূর দেশান্তরে।”
# ‘শারদোৎসব’ (১৯০৮) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি রূপক-সাংকেতিক নাটক। এই নাটকটি মানুষের জীবন, সংস্কার ও কুপ্রথা এবং বোলপুর-ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ছাত্রদের শরৎকালের উৎসবের পটভূমিতে রচিত। নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে ঠাকুরদাদা ঝগড়া না করে বালকের দলকে গান ধরার জন্য আহ্বান জানিয়ে নিজেই গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করে।
“ওরে যাব না আজ ঘরে রে ভাই,
যাব না আজ ঘরে।
ওরে আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ
নেব রে লুঠ করে।
যেন জোয়ার-জলে ফেনার রাশি
বাতাসে আজ ছুটছে হাসি,
আজ বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি
কাটবে সকল বেলা।”
[দ্বিতীয় দৃশ্য, বেতাসিনীর তীর। বন]
এই নাটকের মূলভাবের সঙ্গে বাঁশির সুরের সম্পর্ক কতটা অন্তরঙ্গ তা কবির মুখেই শোনা যাক। “কবি স্বয়ং বিভিন্ন উপলক্ষে শারদোৎসবের মর্মব্যাখ্যা করেছিলেন। ১৩২৬ সালে শান্তিনিকেতন আশ্রমে শারদোৎসব অভিনয় উপলক্ষে কবি এ নাটকের ‘ভিতরের কথাটি’ ‘শান্তিনিকেতন পত্রে’ মুদ্রিত একটি প্রবন্ধে নিম্নরূপে লিপিবদ্ধ করেন:
শারদোৎসবের ভিতরকার কথাটাই এই- ও তো গাছতলায় বসে বসে বাঁশরি সুর শোনবার কথা নয়।” [সবুজ পত্র। আশ্বিন ও কার্তিক ১৩২৪]।
ভানুসিংহের পত্রাবলীতে প্রকাশিত এক চিঠিতে (২৪ ভাদ্র ১৩২৯) কবি শারদোৎসব সম্বন্ধে লিখেছিলেন:
“ওটা হচ্ছে ছুটির নাটক। ওর সময়ও ছুটির, ওর বিষয়ও ছুটির। রাজা ছুটি নিয়েছে রাজত্ব থেকে, ছেলেরা ছুটি নিয়েছে পাঠশালা থেকে। তাদের আর-কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই কেবল একমাত্র হচ্ছে- ‘বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি কাটবে সকল বেলা’। ওর মধ্যে একটা উপনন্দ কাজ করছে, কিন্তু সেও তার ঋণ থেকে ছুটি পাবার কাজ।”
[ভানুসিংহের পত্রাবলী। পত্রসংখ্যা ৫২]
# ‘ঘরে বাইরে’ (১৯১৬) স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমি, দেশপ্রেম, ব্যক্তিগত আদর্শের দ্বন্দ্ব সংঘাত ও ত্রিভুজ প্রেমের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণধর্মী উপন্যাস। নিখিলেশ-বিমলা-সন্দীপের আত্মকথন ও পারস্পরিক কথোপকথনের মধ্য দিয়ে স্বকীয় ভঙ্গিতে উপন্যাসের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এ উপন্যাসেও লেখক স্বভাবতই বাঁশিকে রূপক ও প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করে বিভিন্ন চরিত্রের গভীরতা এবং পটভূমির অন্তর্নিহিত সুরকে আরো নান্দনিক করে তুলতে চেয়েছেন।
(১) নিখিলেশের কথার জের ধরে সন্দীপ উত্তরে বলে তোমার বায়নার আশায় আমরা বসে নেই। আমাদের নিকড়িয়া উৎসব কড়ি দিয়ে কিনতে হবে না বলে তাঁর ভাঙা মোটা গলায় গান ধরলেন-
“আমার নিকড়িয়া রসের রসিক কানন ঘুরে ঘুরে
নিকড়িয়া বাঁশের বাঁশি বাজায় মোহন সুরে।”
একপর্যায়ে বিমলা স্বগত সংলাপে বলতে থাকে-
“দেশের সুরের সঙ্গে আমার জীবনের সুরের অদ্ভুত এই মিল। এক-একদিন অনেক রাত্রে আস্তে আস্তে আমার বিছানা থেকে উঠে খোলা ছাদের উপর দাঁড়িয়েছি। আমাদের বাগানের পাঁচিল পেরিয়ে আধপাকা ধানের খেত, তার উত্তরে গ্রামের ঘন গাছের ফাঁকের ভিতর দিয়ে নদীর জল এবং তারও পরপারে বনের রেখা, সমস্তই যেন বিরাট রাত্রির বর্তের মধ্যে কোন-এক ভারী সৃষ্টির ভ্রূণের মতো অস্ফুট আকারে ঘুমিয়ে রয়েছে। আমি সামনের দিকে চেয়ে দেখতে পেয়েছি, আমার দেশ দাঁড়িয়ে আছে আমারই মতো একটি মেয়ে। সে ছিল আপন আঙিনার কোণে, আজ তাকে হঠাৎ অজানার দিকে ডাক পড়েছে। সে কিছুই ভাববার সময় পেলে না, সে চলেছে সামনের অন্ধকারে; একটা দীপ জ্বেলে দেবারও সবুর তার সয় নি। আমি জানি, এই সুপ্তরাত্রে তার বুক কেমন করে উঠছে পড়ছে। আমি জানি, যে দূর থেকে বাঁশি ডাকছে ওর সমস্ত মন এমনি করে সেখানে ছুটে গেছে যে ওর মনে হচ্ছে যেন পেয়েছি, যেন পৌঁছেছি, যেন এখন চোখ বুজে চললেও কোনো ভয় নেই। না, এ তো মাতা নয়। সন্তানকে স্তন দিতে হবে, অন্ধকারের প্রদীপ জ্বালাতে হবে, ঘরের ধুলো ঝাঁট দিতে হবে, সে কথা তো এর খেয়ালে আসে না। এ আজ অভিসারিকা। এ আমাদের বৈষ্ণব-পদাবলীর দেশ। এ ঘর ছেড়েছে, কাজ ভুলেছে। এর আছে কেবল অন্তহীন আবেগ; সেই আবেগে সে চলেছে মাত্র, কিন্তু পথে কি কোথায় সে কথা তার মনেও নেই। আমিও সেই অন্ধকার রাত্রির অভিসারিকা। আমি ঘরও হারিয়েছি, পথও হারিয়েছি। উপায় এবং লক্ষ্য দুইই আমার কাছে একেবারে ঝাপসা হয়ে গেছে, কেবল আছে আবেগ আর চলা। ওরে নিশাচরী, রাত যখন রাঙা হয়ে পোহাবে তখন ফেরবার পথের যে চিহ্নও দেখতে পাবি নে। কিন্তু ফিরব কেন, মরব। যে কালো অন্ধকার বাঁশি বাজালো সে যদি আমার সর্বনাশ করে, কিছুই যদি সে আমার বাকি না রাখে, তবে আর আমার ভাবনা কিসের? সব যাবে; আমার কণাও থাকবে না, চিহ্নও থাকবে না, কালোর মধ্যে আমার সব কালো একেবারে মিশিয়ে যাবে; তার পরে কোথায় ভালো কোথায় মন্দ, কোথায় হাসি কোথায় কান্না!”
উক্ত টানা সংলাপে বাঁশি দু’বার ব্যবহার হয়েছে। প্রথমবার ইতিবাচক ও দ্বিতীয়বার নেতিবাচক অর্থে। বিশ্ব সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ এখানে বিমলার মনের দোলাচল বৃত্তির মতো বাঁশি নিয়েও খেলা করেছেন।
(২) আমি জানি আমার উপর আমার স্বামীর ভালোবাসা কত গভীর। সেদিন আমার বুদ্ধি যদি স্থির থাকত তা হলে আমার পোড়া মুখ নিয়ে এমন দিনে সেই ভালোবাসার উপর দাবি করতে যেতে আমার লজ্জায় মাথা কাটা যেত। কিন্ত সন্দীপকে যে দেখাতে হবে আমার শক্তি কত! তাঁর কাছে আমি যে শক্তিরূপিণী! তিনি তাঁর আশ্চর্য ব্যাখ্যার মানুষের কাছে এক-একজন বিশেষ মানুষেরই রূপে দেখা দেন: তিনি বলেন, আমরা বৈষ্ণবতত্ত্বের হ্লাদিনীশক্তিকে প্রত্যক্ষ দেখবার জন্যেই এত ব্যাকুল হয়ে বেড়াচ্ছি, যখন কোথাও দেখতে পাই তখনই স্পষ্ট বুঝতে পারি আমার অন্তরের মধ্যে যে ত্রিভঙ্গ বাঁশি বাজাচ্ছেন তাঁর বাঁশির অর্থটা কী। বলতে বলতে এক-একদিন গান ধরতেন-
“যখন দেখা দাওনি রাধা, তখন বেজেছিল বাঁশি।
এখন চোখে চোখে চেয়ে সুর যে আমার গেল ভাসি।
তখন নানা তানের ছলে
ডাক ফিরেছে জলে স্থলে,
এখন আমার সকল কাঁদা রাধার রূপে উঠল হাসি।”
[ঘরে বাইরে, বিমলার আত্মকথা]
(৩) মায়ের পূজা প্রতিষ্ঠা করবার পণ করে সন্দীপ নিরুপায় হয়ে বিমলার কাছে সসংকোচে অর্থাভাবের বিষয়টি প্রকাশ করা মাত্রই অমনি বিমলার মুখে একটি বেদনার কুঞ্চন দেখা দেয়। পরদিন সন্দীপের মুখে “এখন সেই পঞ্চাশ হাজারের বিশেষ দরকার নেই, হিসেব করে দেখছি পাঁচ হাজার, এমন-কি, তিন হাজার হলেও চলে যাবে।”এমন ভারমুক্ত কথাটি আচমকা শুনে বিমলার বেদনার্ত কালো ছায়া যেন এক পশলা আনন্দ বৃষ্টি হয়ে ঝরে যায়। বিমলা সঙ্গে সঙ্গে যেন গানের সুরে গেয়ে উঠে, “পাঁচ হাজার তোমাকে এনে দেব।” বিমলার অন্তরের উচ্ছ্বসিত সেই বাক্য রাধিকার গাওয়া সে গানের মত সন্দীপের অন্তরাত্মা ছুঁয়ে যায়,
“বঁধুর লাগি কেশে আমি পরব এমন ফুল
স্বর্গে মর্তে তিন ভুবনে নাইকো যাহার মূল।
বাঁশির ধ্বনি হাওয়ায় ভাসে,
সবার কানে বাজবে না সে-
দেখ লো চেয়ে, যমুনা ওই ছাপিয়ে গেল কূল।”
সন্দীপের কাছে “এ ঠিক সেই সুরই, আর সেই গানই, আর সেই একই কথা- ‘পাঁচ হাজার তোমাকে এনে দেব’। বঁধুর লাগি কেশে আমি পরব এমন ফুল!’ বাঁশির ভিতরকার ফাঁকটি সরু বলেই, চার দিকে তার বাধা বলেই, এমন সুর। অতিলোভের চাপে বাঁশিটি যদি ভেঙে আজ চ্যাঁপটা করে দিতুম তা হলে শোনা যেত, কেন, এত টাকায় তোমার দরকার কী? আর, আমি মেয়েমানুষ, অত টাকা পাবই বা কোথা? ইত্যাদি ইত্যাদি। রাধিকার গানের সঙ্গে তার একটি অক্ষরও মিলত না। তাই বলছি, মোহটাই হল সত্য, সেইটেই বাঁশি, আর মোহ বাদ দিয়ে সেটা হচ্ছে ভাঙা বাঁশির ভিতরকার ফাঁক- সেই অত্যন্ত নির্মল শূন্যতাটা যে কী তার আস্বাদ নিখিল আজকাল কিছু পেয়েছে, ওর মুখ দেখলেই সেটা বোঝা যায়। আমার মনেও কষ্ট লাগে। কিন্তু নিখিলের বড়াই, ও সত্যকে চায়, আমার বড়াই আমি মোহটাকে পারতপক্ষে হাত থেকে ফসকাতে দেব না। যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবদি তাদৃশী। অতএব এ নিয়ে দুঃখ করে কী হবে?”
রাধা-কৃষ্ণের আনন্দ-উচ্ছ্বাস ও বিরহ-বেদনা প্রকাশে বড়ু চন্ডীদাস কিম্বা বৈষ্ণব কবিরা যেমনি ঘুরেফিরে বাঁশির সুর ও ধ্বনিকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়েছেন কবি রবীন্দ্রনাথও তাঁর সমগ্র রচনার ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটি করেছেন।
[ঘরে-বাইরে, সন্দ্বীপের আত্মকথা]
(৪) ঘরে বাইরে উপন্যাসের ত্রয়ী কেন্দ্রীয় চরিত্রের ফাঁক দিয়ে ‘কচি মুরলী বাঁশটি’র মতো সরল ও সরস’ বালক অমূল্য চরিত্রটি গল্পের প্রাসঙ্গিকতায় অনিবার্যভাবে ঢুকে পড়ে। লেখক কী নিপুণ দক্ষতায় বিমলার জীবনের অস্থিরতা ও জটিলতার বিপরীতে অবস্থিত অমূল্যর সরলতা, নির্মলতা এবং নিষ্পাপতাকে বোঝাতে ‘কচি মুরলী বাঁশ’ উপমাটি ব্যবহার করেছেন। যা দিয়ে চারদিকে অসাধারণ সব সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে দেয়া যায়।
ভ্রাতৃতুল্য অমূল্যর অমঙ্গলের ভয়ে বিমলার বুক কাঁপতে থাকে। “যারা সাপুড়ে তারা বাঁশি বাজিয়ে সাপ নিয়ে খেলুক, মরতে যদি হয় তারা জেনেশুনে মরুক। কিন্তু, আহা, এরা যে কাঁচা, সমস্ত বিশ্বের আশীর্বাদ এদের যে নিয়ত রক্ষা করতে চায়, এরা সাপকে সাপ না জেনে হাসতে হাসতে তার সঙ্গে খেলা করতে যখন হাত বাড়ায় তখনই পষ্ট বুঝতে পারি এই সাপটা কী ভয়ংকর অভিশাপ! সন্দীপ ঠিকই বুঝেছে- আমি নিজে যার হাতে মরতে পারি, কিন্তু এই ছেলেটিকে তার হাত থেকে ভাঙিয়ে নিয়ে আমি বাঁচাব।”
(৫) উপসংহারে এসে মুখ্য জুটি বিমলা-নিখিলেশ এর মানসিক অবস্থার চূড়ান্ত উপলব্ধি প্রকাশেও লেখক প্রতীকী ও রূপক হিসেবে বাঁশিকে বেছে নিয়েছেন।
বিমালা বলছে, “এবারকার মতো আমাকে মাপ করো, হে আমার প্রভু। যা-কিছুকে তুমি আমার জীবনের ধন বলে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলে সে-সমস্তকেই আমি আমার জীবনের বোঝা করে তুলেছি। আজ তা আর বহনও করতে পারছি নে, ত্যাগ করতেও পারছি নে। আর-একদিন তুমি আমার ভোরবেলাকার রাঙা আকাশের ধারে দাঁড়িয়ে যে বাঁশি বাজিয়েছিলে সেই বাঁশিটি বাজাও, সব সমস্যা সহজ হয়ে যাক; তোমার সেই বাঁশির সুরটি ছাড়া ভাঙাকে কেউ জুড়তে পারে না, অপবিত্রকে কেউ শুভ্র করতে পারে না। সেই বাঁশির সুরে আমার সংসারকে তুমি নতুন করে সৃষ্টি করো। নইলে আমি আর কোনো উপায় দেখি নে।”
[ঘরে বাইরে, বিমলার আত্মকথা]
(৬) স্ত্রী ও সঙ্গী হিসেবে বিমলার সঙ্গে নিখিলেশের দৃশ্যমান ও মনোজাগতিক সম্পর্কের অবস্থান ও অস্তিত্বের যে টানাপোড়ন তা নিয়ে নিখিলেশের সর্বশেষ উপলব্ধি এরকম-
“আমরা সহধর্মিণীকে গড়তে গিয়ে স্ত্রীকে বিকৃত করি। আবার কি সেই গোড়ায় ফেরা যায় না? তা হলে একবার সহজের রাস্তায় চলি। আমার পথের সঙ্গিনীকে এবার কোনো আইডিয়ার শিকল দিয়ে বাঁধতে চাইব না: কেবল আমার ভালোবাসার বাঁশি বাজিয়ে বলব, তুমি আমাকে ভালবাসো, সেই ভালোবাসার আলোতে তুমি যা তারই পূর্ণ বিকাশ হোক, আমার ফর্মাশ একেবারে চাপা পড়ুক, তোমার মধ্যে বিধাতার যে ইচ্ছা আছে তারই জয় হোক- আমার ইচ্ছা লজ্জিত হয়ে ফিরে যাক।”
[ঘরে বাইরে, নিখিলেশের আত্মকথা]
# ব্যঙ্গকৌতুক
রবীন্দ্রনাথ শুধু সাহিত্যে নয় ব্যক্তিগত জীবনেও হাস্য রসবোধ সম্পন্ন বুদ্ধিদীপ্ত একজন সূক্ষ্ম ব্যঙ্গকৌতুকশিল্পী ছিলেন। তাঁর সাহিত্যের একটা বিশাল জায়গাজুড়ে রয়েছে হাস্য ও ব্যঙ্গকৌতুক। বাঁশি’র মতো একটি সুরযন্ত্র দিয়ে যে ব্যঙ্গকৌতুকসম্পন্ন নান্দনিক কনটেইন তৈরি করা যায় তিনিই দেখিয়েছেন সর্বাগ্রে।
(১) “মীমাংসা” হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গকৌতুকধর্মী রচনার তেমন একটি অংশ। “মীমাংসা”য় লেখক কল্পিত একটি বাড়ি সংলগ্ন প্রতিবেশীর (মুকুন্দ ঘোষ) বাঁশি বাজানোর শব্দের প্রতি নিজের অসহিষ্ণুতা ও তার কারণ অনুসন্ধানের একটি মজাদার কাহিনি বর্ণনা করেছেন ।
“আমাদের বাড়ির পাশেই নবীন ঘোষের বাড়ি। একেবারে সংলগ্ন বলিলেই হয়।
আমি কখনো আমাদের বাড়ির ছাদে উঠি না, জানালায়ও দাঁড়াই না। আপন মনে গৃহকার্য করিয়া যাই।
নবীন ঘোষের বড়ো ছেলে মুকুন্দ ঘোষকে কখনো চক্ষে দেখি নাই।
কিন্তু মুকুন্দ ঘোষ কেন বাঁশি বাজায়! সকালে বাজায়, মধ্যাহ্নে বাজায়, সন্ধ্যাবেলায় বাজায়। আমার ঘর হইতে স্পষ্ট শোনা যায়।
আমি কবি নই, মাসিক পত্রিকার সম্পাদক নই, মনের ভাব সম্পূর্ণ ব্যক্ত করিয়া উঠিতে পারি না। কেবল সকালে কাঁদি, মধ্যাহ্নে কাঁদি, সন্ধ্যাবেলায় কাঁদি এবং ইচ্ছা করে ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া যাই।
বুঝিতে পারি রাধিকা কেন তাঁহার সখীকে সম্বোধন করিয়া কাতর স্বরে বলিয়াছিলেন ‘বারণ কর্ লো সই, আর যেন শ্যামের বাঁশি বাজে না বাজে না’।
বুঝিতে পারি চণ্ডীদাস কেন লিখিয়াছেন-
“যে না দেশে বাঁশির ঘর সেই দেশে যাব,
ডালে মূলে উপাড়িয়া সাগরে ভাসাব।”
কিন্তু পাঠক, আমার এ হৃদয়বেদনা তুমি কি বুঝিয়াছ?
(২) বিশ্বকবি রচিত “উত্তর” শিরোনাম বিষয়ক রম্য রচনার মূল উপাদানও এই বাঁশি।
“আমি বুঝিয়াছি। যদিও আমি কুলবধূ নই। কারণ, আমি পুরুষমানুষ। কিন্তু আমার বাড়ির পাশেও একটি কন্সর্টের দল আছে। তাহার মধ্যে একটি ছোকরা নূতন বাঁশি অভ্যাস করিতে আরম্ভ করিয়াছে- প্রত্যুষ হইতে অর্ধরাত্রি পর্যন্ত সারিগম সাধিতেছে। পূর্বাপেক্ষা অনেকটা সড়গড় হইয়াছে এখন প্রত্যেক সুরে কেবলমাত্র আধসুর সিকিসুর তফাত দিয়া যাইতেছে। কিন্তু আমার চিত্ত উদাসীন হইয়া উঠিয়াছে; ঘরে আর কিছুতে মন টেকে না। বুঝিতে পারিতেছি রাধিকা কেন বলিয়াছিলেন ‘বারণ কর লো সই, আর যেন শ্যামের বাঁশি বাজে না বাজে না’। শ্যাম বোধ করি তখন নূতন সারিগম সাধিতেছিলেন। বুঝিতে পারিতেছি চণ্ডীদাস কেন লিখিয়াছিলেন-
যে না দেশে বাঁশির ঘর সেই দেশে যাব,
ডালে মূলে উপাড়িয়া সাগরে ভাসাব
বোধ হয় চণ্ডীদাসের বাসার পাশে কন্সর্টের দল ছিল। আমার বাড়ির পাশে যে ছোকরা বাঁশি অভ্যাস করে বোধ হয় তাহারই নাম মুকন্দঘোষ।”
(চলবে-)
নাজমুল টিটো, গবেষক ও প্রাবন্ধিক)




