আলম খোরশেদ
এমন প্রশ্নের উত্তরে অবহিতজনদের কেউ বলবেন, ‘ওই মহামানব আসে; দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে’; আবার কেউবা বলবেন, ‘হে নূতন দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’। মজার বিষয় হচ্ছে, দুটো উত্তরই ঠিক। আর সেটা নির্ভর করছে আমরা কোন অর্থে নিবন্ধের শিরোনামে ‘শেষ’ অভিধাটি ব্যবহার করছি, তার ওপর। যদি সেটি হয়ে থাকে ‘রচিত’ অর্থে, তাহলে অবশ্যই ‘ওই মহামানবের’ মুকুটেই জুটবে অমন অভিধার সুবর্ণ পালকখানি। আর যদি আমাদের প্রশ্নের অভিমুখটি থাকে ‘সুরারোপ’-এর দিকে, তাহলে ‘জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’ই যে জয়ী হবে, তাতে আর সন্দেহ কী!
গল্পটা তাহলে খোলাসা করেই বলি। ইংরেজি ১৯৪১ সাল, বাংলা ১৩৪৭, চৈত্র মাসের শেষদিন। রাত পোহালেই বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন, পয়লা বৈশাখ। শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতীর উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে শুভ উদ্বোধন হবে রবীন্দ্রনাথের আশি বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত জন্মোৎসবের। অসুস্থ শরীর নিয়েও রবীন্দ্রনাথ সেই অনুষ্ঠানে পড়ার জন্য তাঁর অভিভাষণটি রচনা করছেন, যেটি তাঁর জীবনের শেষ ভাষণ এবং সর্বশেষ গদ্যরচনাও বটে, ‘সভ্যতার সঙ্কট’ নামেই যা
আজ অমর হয়ে আছে। বিশ্বজুড়ে তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পৈশাচিকতা, নির্বিচার ধ্বংসকাণ্ড ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের হাহাকার। এসব দেখেশুনে পশ্চিমা সভ্যতা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি-সমাজনীতির ওপর থেকে রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস পুরোপুরি উঠে যাবার উপক্রম হয়েছে। তিনি তখন এক নতুন সভ্যতা ও নতুন সূর্যোদয়ের স্বপ্ন দেখছেন, যার উত্থান হবে এশিয়ার পূর্বদিগন্ত থেকেই। এমন উপলব্ধি ও প্রত্যয়ের কথাই তিনি লিখছিলেন তাঁর সেই অনন্য অভিভাষণটিতে।
এমন সময় শান্তিদেব ঘোষ এসে তাঁর কাছে আব্দার জুড়লেন পরদিন পয়লা বৈশাখের ভোরের বৈতালিকের জন্য একটি গান লিখে দিতে। শান্তিদেবের প্রস্তাবের সঙ্গে সায় দিয়ে তাঁর বন্ধু, ঠাকুরবাড়িরই সন্তান, বিখ্যাত সমাজতন্ত্রী এবং বিপ্লবী রাশিয়া, ত্রয়ী, যাত্রী ইত্যাদি গ্রন্থের রচয়িতা সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠাগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে) তাঁকে আরও অনুরোধ করলেন, তাঁর সেই গানে যেন বিশ্বমানবের জয়গানই ধ্বনিত হয়। তাঁদের এই সনির্বন্ধ অনুরোধটুকু কবি ফেলতে পারলেন না; কাগজ কলম নিয়ে তৎক্ষণাৎ লিখে দিলেন এই গান, ‘ওই মহামানব আসে’, যার মূল ভাবনাটি তখন ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধটি লেখার সূত্রে এমনিতেই তাঁর মনে গুঞ্জরিত হয়ে চলেছিল। শুধু লেখা নয়, অসুস্থ, অপটু শরীরে ভৈরবী রাগ আর কাহারবা তালে তাতে সুরও বসিয়ে দিলেন। ততক্ষণে নিশ্চয়ই চৈত্র শেষ হয়ে বৈশাখ এসে কড়া নাড়ছিল তাঁর তৎকালীন বাসস্থান ‘উদয়ন’ এর দ্বারে, তাই গানের নিচে তিনি লিখলেন পয়লা বৈশাখ, ১৩৪৮, উদয়ন, শান্তিনিকেতন। শান্তিদেব ঘোষ স্বয়ং ঝটপট তার স্বরলিপি করে, পরদিন ভোরের বৈতালিকে মহামানবের এই আগমনগীতিটি গাইয়ে দিয়েছিলেন একঝাঁক তরুণ আশ্রমিককে দিয়ে। এরপর তো রবীন্দ্রনাথ বেঁচেছিলেন আর মাত্র তিনটি মাস। এই তিনমাসে নতুন করে আর কোনো গান লেখার সুযোগ কিংবা সামর্থ্য হয়নি তাঁর। সেই হিসেবে এটিই তাঁর জীবদ্দশায় রচিত সর্বশেষ গান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই গানটিকে উদ্ধৃত করেই তিনি তাঁর ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধের উপসংহার টেনেছিলেন।
তবে যদি সুরারোপের কথা বলা হয়, তাহলে কিন্তু এর ‘ওই মহামানব আসে’ গানটি রচনার পরে তিনি আরও একটি গানের সুর করেছিলেন। এবং সেটি খুব বেশিদিন পরেও নয়। উল্লিখিত গানটি রচনার ঠিক চব্বিশ দিন পর পঞ্জিকার পাতায় দেখা দেয় পঁচিশে বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথের একাশিতম জন্মতিথির দিনটি। তখন তাঁর কাছে আবারও দাবি উঠেছিল এই বিশেষ দিনটির উদযাপন উপলক্ষ্যে আরও একটি গান রচনার। কিন্তু তখন তাঁর আর সেই সামর্থ্য ছিল না, অথচ প্রিয়জনদের আব্দার উপেক্ষা করতেও মন সায় দিচ্ছিল না তাঁর। তাই তিনি অনেক ভেবেচিন্তে প্রায় কুড়ি বছর আগে, ১৩২৯ সালে রচিত তাঁর ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত আশি চরণের দীর্ঘ কবিতা ‘পঁচিশে বৈশাখ’ এর সাকুল্যে দশটি পঙ্ক্তিকে সামান্য অদলবদল করে নিয়ে সুরে বসিয়ে দিলেন। আবারও সেই ভৈরবী রাগে ও কাহারবা তালে এবং আবারও সেই শান্তিদেব ঘোষের হাতেই তৈরি হল তার তাৎক্ষণিক স্বরলিপিখানি। এই গানটি ভূমিষ্ঠ হবার সেই ঐতিহাসিক তারিখটি ছিল বাংলা ২৩শে বৈশাখ, ১৩৪৮ আর ইংরেজি ৬ই মে ১৯৪১। এই হল সংক্ষেপে রবীন্দ্রনাথের শেষ গানের দাবিদার হিসেবে স্বীকৃত দুটি গানের রচনা ও সুরারোপের ইতিহাস, যে গান দুটির অন্তর্নিহিত মূল সুরটি কাকতালীয়ভাবে অনেকটা একইরকম: জগতের উদয়শিখর কিংবা উদয়দিগন্তে অচিরেই নতুন এক সূর্যোদয়ের স্বপ্ন-সম্ভাবনা এবং সেইসঙ্গে এক অভূতপূর্ব নবজীবনের আশ্বাস ও অভয়বাণীর উচ্চারণ।
পুনশ্চ: আগ্রহী পাঠকদের জন্য দুটো গানেরই পুরো বাণীরূপ এখানে উদ্ধৃত হল।
ওই মহামানব আসে
ওই মহামানব আসে;
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে।
সুরলোকে বেজে উঠে শঙ্খ,
নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক
এল মহাজন্মের লগ্ন।
আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত
ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।
উদয়শিখরে জাগে মাভৈঃ মাভৈঃ রব
নব জীবনের আশ্বাসে।
জয় জয় জয় রে মানব-অভ্যুদয়,
মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে।
(সর্বশেষ রচিত গান)
হে নূতন
হে নূতন,
দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।।
তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন
সূর্যের মতন।
রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।
ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,
ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।
উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্তমাঝে
চিরনূতনেরে দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ।।
(সর্বশেষ সুরারোপিত গান)
আলম খোরশেদ, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও অনুবাদক




