সাজ্জাদ হোসেন জামি ও আ.ম.ম.মামুন
শিল্পসাহিত্য ও সমাজভাবনামূলক কাগজ ‘মাসিক আন্দরকিল্লা’র জুলাই-২০২৩ সংখ্যা। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত স্নিগ্ধ ব্যতিক্রম একটি ছবি দেখে চোখ আটকে গেলো। রঙের এমন ঝকমকে ব্যবহারে হঠাৎ চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কিন্তু ক্ষণকাল পর দৃষ্টি স্থিত হলে দেখি, বহুমুখী ভাবনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। ছবির ধরন দেখে কোনো চেনাজানা শিল্পীর কাজ বলে মনে হোলো না। ‘আন্দরকিল্লা’ সম্পাদক, বন্ধু নুরুল আবসার সূত্রে জানতে পারি,শিল্পী দেশি নন, বিদেশি- আজারবাইজানি। নাম- রামিনা সাদাতখান। সুদূর আজারবাইজান তাঁর জন্মদেশ।
‘আন্দরকিল্লা’ কর্তৃপক্ষ জুলাই-২০২৩ সংখ্যা ছাড়াও অক্টোবর-২০২৩সহ ২০২৪ সালের জুন, জুলাই, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর সংখ্যায়ও রামিনা সাদাতখানের শিল্পকর্ম ব্যবহার করে।পরপর বেশ কয়েকটি সংখ্যায় এই বিদেশ বিভাষী শিল্পীর কাজ দেখে তাঁর শিল্পকর্মের লোভে পড়ে যাই। এইসব চিত্রকর্ম দেখতে দেখতে এক ধরনের অন্তর্গত টান অনুভব করি। প্রকৃত পক্ষে শিল্পী ও শিল্পের কোনো বর্ডার নেই, হয় না। এদুটো পাখির মতো। গোটা আকাশটাই তার। ইচ্ছে করলেই পাখি সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বেড়িয়ে যেতে পারে, কোনো পাসপোর্ট ভিসা লাগে না। শিল্পী ও শিল্প কখনো ভাষা ও ভূগোলের সীমিত সীমায় সীমাবদ্ধ থাকে না। তাঁরা সব দেশের।সব ভাষার।

রামিনার চিত্রকর্মগুলো খুব সহজেই আমাদের চোখমন জুড়িয়ে দেয় আবার সংক্ষুব্ধ করে তোলে অস্থির সময়ের স্মারকচিহ্ন হয়ে। তাঁর ছবিগুলো অনেকটা কবিতার মতো। পুরোপুরি ঠিক বুঝে ওঠা যায় না। আবার খুব গভীর, মধুর একটা অন্তর্গত টান অনুভূত হয় বলে সরিয়ে রাখাও দুরূহ। রামিনার ছবির জগতে প্রবেশ করতে গেলে আপাতদৃষ্টিতে একটা ধাঁধাঁয় পড়তে হয়।জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো চেতন অবচেতনের মায়াজালে আটকেপড়া যেনো।তাঁর ছবিতে রঙের বহুমাত্রিক ব্যবহার এবং বিষয়ের এমন তীব্রতা আমাদের অভিনিবেশ দাবি করে। বিশেষ করে গাঢ় রঙ ব্যবহারের কুশলতা দেখে আমাদের জগৎখ্যাত শিল্পী ভ্যানগগের কথা মনে পড়ে, ‘যিনি আকাশ থেকে নীল আর শস্য থেকে সোনালি তুলে’ আনতেন।
‘আন্দরকিল্লার প্রচ্ছদে ব্যবহৃত কয়েকটি ছবি আমাদের মনে এমন অনভূতির জন্ম দেয়। আমরা শিল্লীর আরও ছবি খুঁজতে থাকি। এবং পেয়েও যাই। শিল্পী রামিনার কল্যাণে তাঁর আরও দু’ডজন ছবি দেখে ওঠার সুযোগ হয় আমাদের।ক্রমাগত আড্ডা, আলাপচারিতা এবং শিল্পীর পোর্টফলিও অবলম্বনে আমরা রামিনার শিল্পজগৎ নিয়ে এই নাতিদীর্ঘ লেখাটা লিখে উঠি।
রামিনা সাদাতখানের চিত্রকর্ম দর্শনে আমাদের মনে বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঞ্চার হতে পারে। একদিকে তাঁর ছবি রঙের লাগামহীন শক্তির প্রতীক। অন্যদিকে তাঁর ক্যানভাস জুড়ে থাকে এক অপার্থিব ছন্দ। তাঁর ছবির অদ্ভুত সব আকার এই চোখে পড়েতো,এই হারিয়ে যায়। ছবিগুলো একদিকে শব্দময়,অপরদিকে গভীরভাবে নীরব।
সাধারণ অর্থে, কিছু ব্যতিক্রমী রূপক উপাদান থাকা সত্ত্বেও, এই ক্যানভাসকে বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। কিন্তু, সত্যি বলতে কি, তাঁর ছবিকে কোন নির্দিষ্ট ঘরানায় আটকে ফেলা কঠিন।

স্পষ্টতই এই শিল্পীর চিত্রকর্মের মূল বিষয় আধ্যাত্মিক জগত। । তাঁর শিল্পকর্মে রেখা এবং রঙের চরম প্রকাশ অপরিণত দর্শকদের হঠাৎ চমকে দিতে পারে। তবে শিল্পবোদ্ধাদের ওপরও এগুলো জাদুকরি প্রভাব ফেলতে পারে। কোনো শিল্প আনুরাগী প্রথমে হয়তো তাঁর নিছক রঙের উৎসবে সম্মোহিত হবে। কিন্তু ক্রমে সে অনুরাগীকে তাঁর ছবিগুলো শিল্পের এমন এক উঁচু স্তরে উন্নীত করবে, যেখানে অসীমতা বিরাজ করে। এক অবিনাশী আধ্যাত্মিক স্তরে, যা ভাষায় প্রকাশ প্রায় অসম্ভব। অন্যভাবে বলা যায়, রামিনা তাঁর ক্যানভাসে এক অনুপম উদ্বেগময় রঙ, রেখা এবং ঝিকমিকে রূপের উৎসব সৃষ্টি করেন, যা আমাদের দৃষ্টি আপাতদৃষ্টিতে নিয়ে যায় মূর্ত ও বিমূর্তের মাঝামাঝি জগতে। তারপর ধীরে ধীরে আমাদের দৃষ্টি নিপতিত করে এক বর্ণনাতীত ও অদ্ভুত সত্তার ওপর, যা প্রায়শ মানব চক্ষুর অগোচরে থাকে।
রামিনার ক্যানভাস আমাদের সামনে এক প্রাচীন,মানব-পূর্ব জগত তুলে ধরে, যেখানে মহাজগতের আদিরূপ ও উপাদানগুলো নাটকীয়ভাবে আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠে।
তাঁর ক্যানভাসকে তুলনা করা যেতে পারে স্বর্গের উদ্যানের সাথে। তবে এর দারুণ অনিশ্চয়তা একটু অস্বস্তিকর বৈকি। স্বর্গ উদ্যানের চিত্রগুলি তাদের অতিপ্রাকৃত উজ্জ্বলতা ও অভিব্যক্তিতে আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে। পার্থিব জগতের নিয়মসমুহ এই অকৃত্রিম ও আদি পরিবেশে অসহায়। প্রাণহীন সভ্যতার জাঁতাকলে যখন আমরা আমাদের শৈশবের অবশিষ্ট স্মৃতিটুকু হারিয়ে ফেলেছি, সে থেকে এই প্রাণবন্ত কল্পনা ও লাবণ্যময় স্বপ্নের জগত আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
প্রাপ্তবয়স্কদের জগতের একঘেয়ে প্রত্যাহিকতার সাথে জোরপূর্বক তাল মেলাতে গিয়ে, বেঁচে থাকার সংগ্রামে, তাঁর চিত্রকর্ম ছলনাময়ী শব্দের এক সূক্ষ্ম জাল সৃষ্টি করে আমাদের চেতনাকে আবিষ্ট করে রাখে।
এই দুঃখজনক পরিস্থিতি সত্ত্বেও, আমাদের সত্তার গভীরে, হৃদয়ের অন্ধকার রহস্যময়তার মধ্যে কিছু একটা রয়েছে, যা অবচেতনে এই ঐন্দ্রজালিক জগতটাকে চিনতে পারে; এটি আমাদের বিশ্বাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, একটি দীর্ঘ বিস্মৃত প্রজ্ঞাবান শিশুর স্বপ্নের মতো। কিছু একটা কোমলভাবে আমাদের ক্লান্ত স্নায়ুগুলোকে সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে; আমাদের জন্য নিয়ে আসছে এক অব্যক্ত আনন্দের অনুভূতি; সে সাথে অনির্বচনীয় রহস্যময়তার অস্বস্তিদায়ক সংবেদনা। .
এখানে মানবতা তার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাই অনেক সময় এটি নিজেকে ভীতিজনক মানবসদৃশ রূপে প্রকাশ করে, যার সাথে উন্নতধারার ধর্মীয় আচারিক মুখোশের সাদৃশ্য রয়েছে, যেসব মুখোশ অজানা কারণে প্রাচীন শিল্পীরা তৈরি করেছিলেন।
এক নজরে রামিনা সাদাতখান
জন্ম: ১৯৭৭,বাকু,আজারবাইজান
কর্ম ও বসবাস দুটোই বাকুতে।
শিক্ষা:
১৯৯৫-২০০০
এ.আজিজজাদেহ আর্ট কলেজ,বাকু,আজারবাইজান
২০০০-২০০৫
অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস,বাকু,আজারবাইজান
২০০২ থেকে সদস্য: আজারবাইজান শিল্পী ইউনিয়ন
২০০৬ থেকে সদস্য: আজারবাইজান ফটোগ্রাফার্স ইউনিয়ন
একক প্রদর্শনী
২০২২-ডান্সিং জ্যাজ,কিউ গ্যালারি,বাকু,আজারবাইজান
২০২১-এনার্জি অব ক্যাওস,
আধুনিক শিল্প জাদুঘর,বাকু,আজারবাইজান
২০১৯- ফ্রেম সিম্পোজিয়াম
সলো আর্ট ক্যাফে,বাকু,আজারবাইজান
২০১২-আনবিগিনিং লাইফ,নির্বাচিত ফটোগ্রাফি
আন সেন্টার, বাকু,আজারবাইজান
১৯৯৭- সেন্টার অব কনটেম্পরারি আর্ট,বাকু,আজারবাইজান
১৯৯৪- প্রথম একক প্রদর্শনী
চিলড্রেন আর্ট গ্যালারি,বাকু, আজারবাইজান
গ্রুপ প্রদর্শনী
২০২৩- সাপ্রেসড মেমোরিজ,(বিলুপ্ত স্মৃতি)গ্রুপ প্রদর্শনী,গাজেলি,আর্ট হসউস, বাকু
২০২২- ডেঞ্জারাস বিউটি,(বিপজ্জনক সৌন্দর্য) আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী, বুরগাস, বুলগেরিয়ার
সমসাময়িক ইস্তাম্বুল,আর্ট এজেন্সি
সোফিয়া বুথ,ইস্তাম্বুল,তুরস্ক
২০১৯-আন্তর্জাতিক আর্ট সিম্পোজিয়াম
উত্তর সাইপ্রাস,নিকোডিয়া
২০১৪-হ্যানরিউ!কোরিয়া আর্ট ফেস্টিভাল
সিউল,দক্ষিণ কোরিয়া
২০১৭-আন্তর্জাতিক শিল্প মেলা, ক্যারোসেল ডু ল্যুভর,
প্যারিস, ফ্রান্স
২০০৮-দ্য ওয়ার্ল্ড অব আর্টিস্ট (শিল্পীদের বিশ্ব), সেন্ট্রাল হাউস অব আর্টিস্ট, মস্কো, রাশিয়া
পুরস্কার
২০১৯-সিলভার কি,
ইস্ট ইউনিভার্সিটি, নর্দার্ন সাইপ্রাস,নিকোসিয়া
২০১২- সিলভার আর্গাস,বাকু,আজারবাইজান।




