সরকার হুমায়ুন
সৌরজগতের এক কোণে বিশাল একশীতল সাম্রাজ্য। এটির নাম শনি গ্রহ। ২৭৪ টি চন্দ্ররাজ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে শনির এই সাম্রাজ্য। শনি তার রাজত্বের নীরব সম্রাট । তার সাম্রাজ্যের সীমানা বহুদিন ধরেই বিখ্যাত বলয় দিয়ে ঘেরা। আলো আর বরফের রিংয়ে আবৃত এক অসাধারণ সৌন্দর্য্য। এই বলয়ের আবরণে কি ঢাকা পড়েছিল এতগুলো চাঁদ?
কানাডা-ফ্রান্স-হাওয়াই টেলিস্কোপ আর “শিফট অ্যান্ড স্ট্যাক” নামে এক জাদুকরী কৌশলে, জ্যোতির্বিদরা শনির কোল থেকে আবিষ্কার করলেন এক, দুই তেইশ সাতচল্লিশ একশো আটাশ চাঁদ! শনি যে এতগুলো নতুন চাঁদ লুকিয়ে রেখেছিল, তা যেন এক রাজার গোপন অস্ত্রভাণ্ডার। ১২৮টি নতুন চাঁদ আকারে ক্ষুদ্র, অনিয়মিত যেন হারিয়ে যাওয়া গল্পের মতো।
এই চাঁদগুলো যেন জন্মের পর থেকেই আক্রমণকারী কোন দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল; যারা সংঘর্ষ আর সময়ের আঘাতে খণ্ডবিখণ্ড হয়েছে, কিন্তু শনির মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবার তাদের জড়ো করে এক নীরব সভায় বসিয়েছে।
তারা আকারে সাকারে ততো বড় নয় মাত্র কয়েক কিলোমিটারের। কেউ কাউকে জানে না, তবুও এক অদ্ভুত আকর্ষণে একে অপরের পাশে ঘোরে, যেন পুরোনো যুদ্ধের কণিকারা আবার জেগে উঠেছে।
তাদের গুচ্ছের বিন্যাস বলছে কোনো এক সময় ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়েছিল। একটি বিশাল চাঁদ হয়তো চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে ভেঙ্গে ছিটকে পড়েছিল শনির অভ্যন্তরে। এখন, সেই টুকরোগুলোর মধ্যে জীবন নেই, কিন্তু ইতিহাস আছে – আকার আছে।
এই চাঁদগুলো শুধু পাথর নয়। এরা স্মৃতি। এদের গতি আছে। গতি পথ আছে। প্রতিটির নিজস্ব কক্ষপথ আছে । ঘুরছে একটি অপটিকে ঘিরে। এদের প্রতিফলিত আলো ঠিকরে পড়ে রাতের শনিতে।
এখন, শনি শুধুই বলয়ের সাম্রাজ্য নয়। সে হারানো সন্তানদের এক মহান সম্রাট।
চাঁদের হিড়িকে শনি ভরপুর। মোট চাঁদের সংখ্যা ২৭৪-এ পৌঁছেছে; যা আমাদের সৌরজগতের সব গ্রহ মিলে মোট উপগ্রহের চেয়ে অনেক বেশি। এই অসংখ্য চাঁদগুলো আকারে বৈচিত্র্যময়। মাত্র দশ মিটার চওড়া ক্ষুদ্র চাঁদ থেকে শুরু করে বিশাল টাইটান পর্যন্ত ; যেটি বুধ গ্রহের চেয়েও আকারে বড় ।
২০১৯ সালে শনি ২০ টি চাঁদ বেশি নিয়ে বৃহশপতি থেকে এগিয়ে ছিল; তখন শনিতে চন্দ্রসংখ্যা ৮২-এ পৌঁছেছিল। এরপর ২০২৩ সালে বৃহস্পতি ৯২-এ এগিয়ে যায; কিন্তু সেই বছরের শেষের দিকে, শনি ১৪৬-তে পৌঁছে। ৯৫টি চাঁদ নিয়ে বৃহস্পতিকে সম্মানজনক দ্বিতীয় স্থানে রেখে যায়।
শনি এ বছরের মার্চ মাসে বৃহস্পতির সম্মানজনক অবস্থানকে একলাফে সত্যিই ধূলিসাৎ করে দিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা শনিতে আরও ১২৮টি নতুন চাঁদ আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন; যার ফলে, শনির মোট চাঁদের সংখ্যা ২৭৪-এ পৌঁছেছে।
আপাতদৃষ্টিতে যদিও শনিতে রেকর্ড সংখ্যক চাঁদের এই ঘোষণাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয়; কারণ এই ১২৮টি নতুন চাঁদ শনির নিয়মিত উপগ্রহ নয়।
এই স্তূপীকৃত মহাকাশ বস্তুগুলো, প্রতিটির অবস্থান মাত্র কয়েক মাইল জুড়ে; যেগুলো অনিয়মিত চাঁদ হিসেবে পরিচিত। কারণ এগুলো “এই বন্য কক্ষপথে যাযাবরের মতো অবস্থান নিয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন, “এই চাঁদগুলো দৈত্যাকৃতি শনি গ্রহের চারপাশে খাড়া কোণে প্রায়শই শনির নিজস্ব ঘূর্ণনের বিপরীত দিকে ঘোরাফেরা করে। কয়েক বিলিয়ন বছর আগে, পাথর এবং বরফ দিয়ে তৈরি এই ভ্রমণকারীরা শনির মাধ্যাকর্ষণ দ্বারা বন্দী হয়েছিল; এই প্রক্রিয়ায় চাঁদে পরিণত হয়েছিল। অবশেষে, তাদের মধ্যে কিছু একে অপরের সাথে ধাক্কা খেয়েছিল; যার ফলে চাঁদ-চাঁদের সংঘর্ষের এক ঝলক শুরু হয়েছিল; যা শত শত ক্ষুদ্র, তরুণ চাঁদ তৈরি করেছিল – প্রতিটি তাদের বিলুপ্ত পূর্বপুরুষের একটি টুকরো – যা এখন থেকে একশ’ মিলিয়ন বছর আগে ঘটেছিল।”
চাঁদ আবিষ্কারক দলের প্রধান গাডম্যান বলেন’ শনির ‘হাস্যকর’ সংখ্যক চাঁদ আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। গত কয়েক দশক ধরে, প্রচুর ছোট অনিয়মিত চাঁদ সনাক্ত করা হয়েছে, প্রায়শই হাওয়াইয়ের সুপ্ত মাউনা কেয়া আগ্নেয়গিরির উপরে কানাডা-ফ্রান্স-হাওয়াই টেলিস্কোপ ব্যবহার করে।
শনি গ্রহ পৃথিবী থেকে এক বিলিয়ন কিলোমিটারেরও বেশি দূরে অবস্থিত, তাই এটি আশ্চর্যজনক যে তাদের এমনকি সনাক্ত করাও সম্ভব,” যাই হোক না কেন, এই ১২৮টি বস্তুকে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে চাঁদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমরা এখন কিছুটা অস্বাভাবিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি— কারণ তাদের প্রত্যেকটির নামকরণ করতে হচ্ছে, যা প্রচলিত রীতি অনুসারে, গ্যালিক, ইনুইট বা নর্স পুরাণের কোনও ব্যক্তির নামে নামকরণ করতে হবে।
শনির বিপরীতে, বৃহস্পতির একটি তরুণ-সুদর্শন চাঁদের গুচ্ছ নেই। এর অর্থ হল বৃহস্পতির সাম্প্রতিক চাঁদ-চাঁদের সংঘর্ষ হয়নি, যা নতুন, ক্ষুদ্র উপগ্রহ তৈরি করতে পারে।
এটাও মনে হচ্ছে না যে বৃহস্পতির বৃহত্তর উপগ্রহগুলোর কোনওটি অদূর ভবিষ্যতে একে অপরের সাথে ধাক্কা খাবে, যার ফলে শনি গ্রহ দীর্ঘ সময়ের জন্য চাঁদ সংগ্রহকারী চ্যাম্পিয়ন থাকবে। “আমি মনে করি না বৃহস্পতি কখনও এটি ধরতে পারবে।”
সরকার হুমায়ুন, কল্পবিজ্ঞান লেখক




