মুন্সী আবু বকর
নাজিয়া আহমেদ—পঁচিশের এক স্বপ্নতরুণী— বসে আছে ল্যাপটপের সামনে। স্ক্রিনের সাদা পটভূমিতে মিটমিট করে কাঁপতে থাকা কার্সর যেন তার চিন্তার শূন্যতায় হারিয়ে যাওয়া এক নিঃসঙ্গ পথিক। এই নিঃশব্দ প্রান্তরে সে খুঁজে চলেছে একটি নাম — রায়ান মালিক। তার প্রথম উপন্যাস “অন্তর্দৃষ্টির প্রতিধ্বনি”-র কেন্দ্রীয় চরিত্র। কিন্তু রায়ান যেন ধরা দেয় না, তার অবয়ব, তার আত্মা যেন কুয়াশার আবরণে ঢাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী নাজিয়া ছোটবেলা থেকেই শব্দে ঘর বেঁধেছে। বইয়ের পাতায় লুকানো ভাবনারা তার আত্মার আত্মীয়। বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঘরে বইয়ের গন্ধ, মায়ের রন্ধন আর ভাইয়ের হাসি মিলিয়ে এক নির্ঝঞ্ঝাট, উষ্ণ পরিবেশ। তবু রায়ানের চরিত্রে ডুবে গিয়ে সে এক অচেনা একাকীত্ব অনুভব করে যেখানে কেউ নেই, শুধু নিঃশ্বাস আর শব্দের একটানা খেলা।
তার ইচ্ছে শব্দে গড়া চরিত্ররা যেন পাঠকের হৃদয়ে জেগে ওঠে। তারা যেন কাঁদে, হাসে, ভালোবাসে, ভুল করে। কিন্তু‘ কল্পনার ঝরাপাতা দিয়ে সাজানো সেই চরিত্র যখন মনোজগতের দরজায় কড়া নাড়ে না, তখন নাজিয়ার মনে হয় সে বুঝি শব্দের কাছে পরাজিত।
রমজান মাস চলছে। সারাদিন রোজা রেখে ক্লান্ত শরীর আর ফ্যাকাশে মন নিয়ে সে প্রতিদিন সন্ধ্যায় লেখার টেবিলে বসে। চারপাশ নীরব, কেবল কি-বোর্ডের টিকটিক শব্দে ভেঙে পড়ে সে নীরবতা। কিন্তু মন যেন বিদ্রোহী পানে উড়ে যেতে চায় কোনো অজানা, মেঘলা দিগন্তে।
রায়ান একজন স্থপতি নতুন শহরের, কংক্রিটের জগতে দাঁড়িয়ে থাকা এক একাকী প্রাণ। অথচ সে খুঁজে ফেরে পুরনো দিনের স্থাপত্য, প্রকৃতির ছায়া, নিস্তব্ধতার ভেতর লুকিয়ে থাকা প্রাণের সুর। নাজিয়া বোঝে না, এই দ্বন্দ্বের উৎস কোথায়? কিসের জন্য সে অস্থির, বিষণ্ন?
হতাশা যখন চুপিচুপি ঢুকে পড়ে তার মনের বারান্দায়, তখন ফেসবুকে অন্যদের লেখা আর প্রশংসা দেখে তার মনে হয় সে কি হারিয়ে যাচ্ছে? তার শব্দ কি নিঃসার হয়ে গেছে?
এক সন্ধ্যায় ইফতারের পর সে এসে বসে দাদী আমেনা বেগমের পাশে। দাদীর গল্প যেন পুরনো দিনের গন্ধমাখা চিঠি। গ্রামের সবুজ ধানক্ষেত, নদীর কলকল শব্দ, আর শহরে এসে হারিয়ে ফেলা শিকড়ের প্রতি তীব্র টান এই কথাগুলো নাজিয়ার মনে এক অদ্ভুত আলো জ্বালায়।
হঠাৎ করে রায়ান যেন রূপ পায়। তার অস্থিরতা আধুনিক জীবনের কৃত্রিমতার বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ। কংক্রিটের দেয়ালের ফাঁকে সে খুঁজে ফেরে তার হারিয়ে যাওয়া সবুজের গান, নিঃসর্গের নিরবতা। সে যেন তার শিকড়ে ফিরে যেতে চায়।
নাজিয়া নতুন উদ্যমে লেখে রায়ানের শৈশবের গ্রাম, নদীর পাশে গড়া স্মৃতির বুনন, শহর থেকে তার পালিয়ে যাওয়ার গল্প। রায়ানের সেই নীরব যাত্রা নিজেকে খুঁজে পাওয়ার, আত্মার সঙ্গে পুনরায় সংযোগের গল্প।
তবুও, প্রতিটি শব্দ বুনন এক যুদ্ধ। কখনো সে ভাবে, রায়ান তার সৃষ্ট চরিত্র, আবার মনে হয় রায়ান নিজের মতো করে বেঁচে আছে, লেখিকাকে ছাড়িয়ে। তার মুখের অভিব্যক্তি, তার নীরব কান্না, তার অন্তর্জগতের টানাপোড়েন সবই এক অজানা নদীর মতো প্রবাহিত।
ভাষা নিয়েও লড়াই চলে। কীভাবে রায়ানের ভাবনাগুলো এমনভাবে বলবে, যাতে পাঠক কেবল শুনে না, অনুভব করে? তাই সে পড়ে চলে নানান লেখকের লেখা, শব্দের খেলা, উপমার পর উপমা। সে শেখে, অনুধাবন করে, বেছে নেয়।
অবশেষে, একদিন গভীর রাতে, উপন্যাসটি শেষ হয়। “অন্তর্দৃষ্টির প্রতিধ্বনি”। নাজিয়া তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনের দিকে যেন তার নিজের আত্মা সেখানে ঝলমল করছে। এই বই শুধুই গল্প নয়, এই বই তার আত্মার ভাষা, তার নীরব সংগ্রামের ফল।
বই প্রকাশের পর প্রতিক্রিয়া মিশ্র। কেউ বলে রায়ান হৃদয়ের দরজা খুলে দিয়েছে। কেউ ভাবে, সে বড় ধীর, বড় অন্তর্মুখী। নাজিয়া সব শুনে, সব গ্রহণ করে কারণ সে জানে, পাঠকের প্রতিটি অনুভবই লেখকের জন্য নতুন আলো।
এক রাতে আসে একটি ই-মেইল একজন তরুণ পাঠকের কাছ থেকে। নাম আরমান। সে একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কোডের ভেতরেও যার মনে বেঁচে আছে প্রকৃতির টান। সে লেখে, রায়ান তাকে নিজের সঙ্গে কথা বলতে শিখিয়েছে, শেখায়নি অনুভব করিয়েছে। নাজিয়ার চোখ ভিজে ওঠে। তার দীর্ঘ যাত্রা, তার নীরব কান্না কোনো এক হৃদয়ে সত্যি হয়ে পৌঁছেছে।
এরপর থেকে আরমান আর নাজিয়ার মধ্যে নিয়মিত কথোপকথন শুরু হয়। শুরুটা সাহিত্য দিয়ে, শেষটা… হয়তো শব্দের সেতু পেরিয়ে হৃদয়ের ঠিকানায় পৌঁছে যাবে।
মুন্সী আবু বকর, কবি ও প্রাবন্ধিক




