ইমদাদুল হক সূফী
বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পচর্চার ইতিহাসে যে নামটি সর্বজনস্বীকৃতভাবে পথপ্রদর্শকের মর্যাদা পেয়েছে, তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-১৯৭৬)। তাঁর জন্মদিন ২৯ ডিসেম্বর কেবল একটি স্মরণদিন নয়, এটি বাঙালি শিল্প-সংস্কৃতির আত্মপরিচয়কে নতুন করে অনুধাবনের উপলক্ষ। তিনি শুধু একজন চিত্রশিল্পীই ছিলেন না; ছিলেন শিক্ষক, সংগঠক, সংগ্রাহক, সাংস্কৃতিক নীতি-নির্ধারক এবং এক অর্থে জাতির রুচি-গঠনের অগ্রদূত।
জয়নুল আবেদিনের জীবনী ও শিল্পকর্মকে ঘিরে যে কোনো আলোচনা তাই অবধারিতভাবে বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাস, রাষ্ট্র-পরিচয় নির্মাণ, শিক্ষাব্যবস্থা, লোকঐতিহ্য রক্ষা, এবং মানবিকতার নান্দনিক ভাষা নির্মাণের ধারার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।
জয়নুল আবেদিন জন্মগ্রহণ করেন ২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের কিশোরগঞ্জে, ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার নৈসর্গিক পরিমণ্ডলে।
শৈশবের এই প্রকৃতিত্মনদীর চর, মৌসুমি বন্যা, কাশবন, নৌকার সারি, কৃষিজীবনের ঘনিষ্ঠতাতার শিল্পচেতনার প্রথম পাঠ। তাঁর শিল্পভাষায় নদী শুধু দৃশ্য নয়, সময় ও জীবনপ্রবাহের রূপক; চর এলাকার শ্রমজীবী মানুষ শুধু বিষয় নয়, তাঁর শিল্পকর্মের নায়ক।
তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্ট (বর্তমান আর্ট কলেজ) থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে সেখানে শিক্ষকতাও করেন।
কলকাতার শিল্পশিক্ষা তাঁকে পাশ্চাত্য ড্রইং-পেইন্টিংয়ের কৌশল, কম্পোজিশন ও আঙ্গিকের সঙ্গে পরিচিত করায়; কিন্তু তাঁর মনোযোগ ছিল দেশজ বাস্তবতার দিকে। এখানেই তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে। তিনি একদিকে আধুনিকতার রীতি আয়ত্ত করেন, অন্যদিকে বিষয় ও দৃষ্টিভঙ্গিতে থাকেন সম্পূর্ণ বাংলার মাটির কাছাকাছি।
আবুল মনসুরের প্রবন্ধের ভাষায়, “জয়নুল ‘আপাদমস্তক বাঙালি ছিলেন, তাঁর চলনে-বলনে, গ্রামীণ সারল্য ও শক্তির সোঁদা গন্ধ মিশে ছিল।'” এই বাঙালিত্বই তাঁর শিল্পের মৌলিক শক্তি; কারণ তিনি শিল্পকে কখনোই স্বদেশ-ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত বিলাস বানাননি।
জয়নুল আবেদিন অঙ্কনের ক্ষেত্রে বাস্তবতার মর্মস্পর্শী প্রকাশকে প্রধান করে তুলেছিলেন। তাঁর চিত্রভাষার কেন্দ্রে ছিল ব্রহ্মপুত্র ও তার তীরের প্রকৃতি, নদীঘাটের শ্রমিক, কৃষক-জেলে, গরু, নৌকা, হাট, বৃষ্টিভেজা মাঠ ইত্যাদি। এসব মিলিয়ে বাংলার জীবনযাপন।
এখানে নাটকীয়তা বা কৃত্রিম রোমান্টিকতা নেই; আছে গভীর মানবিকতা। রৈখিক দক্ষতা তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি। রেখা তাঁর কাছে কেবল গঠনরীতি নয় মানুষের ভেতরের ক্লান্তি, শ্রম, দারিদ্র্য, আশা, প্রতিবাদের ভাষা।
বাংলাদেশের শিল্প-সমালোচনায় জয়নুলের “রেখার নৈতিকতা” কথাটি এসেছে বার বার। তিনি তাঁর রেখার মাধ্যমে সততা ও সরলতা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। প্রাচ্যের লোকজ শিল্প ও পাশ্চাত্য বাস্তববাদ মিলিয়ে তিনি যে ধারা গড়েন, তা পরবর্তীতে বাংলাদেশের ‘সামাজিক বাস্তববাদী’ শিল্পচর্চার অন্যতম ধারা হয়ে ওঠে।
জয়নুল আবেদিনের আন্তর্জাতিক খ্যাতির মূল ভিত্তি ১৯৪৩ সালের বাংলার মন্বন্তর নিয়ে আঁকা দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা। তিনি রাস্তায় পড়ে থাকা ক্ষুধার্ত, অস্থিসার মানুষ, মৃতদেহ ঘিরে কাক-কুকুর, মায়ের কোলে নিথর শিশু; এসব দৃশ্য দেখেছিলেন প্রতিদিনের যাতায়াতে।
এই সিরিজ তিনি এঁকেছিলেন কালি-কলম ও চারকোল মাধ্যমে , অনেক সময় নিজেরই প্রস্তুত করা কালিতে এবং সস্তা প্যাকিং কাগজে। দুর্ভিক্ষের বাস্তবতার সঙ্গে উপকরণের কাকতালীয় এক নৈতিক মিল হয়ে যায়।
এই দুর্ভিক্ষের স্কেচগুলো কেবল শিল্প নয়, সমাজ-ইতিহাসের দলিল হয়ে রয়েছে। মানবসভ্যতার একটি নির্মম অধ্যায়ের যেন ভিজ্যুয়াল আর্কাইভ। আধুনিক শিল্প-তাত্ত্বিকরা একে “ধৎঃ ধং রিঃহবংং” বা সাক্ষ্যশিল্প হিসেবে দেখেন। যেখানে শিল্পী নান্দনিকতার পাশাপাশি নৈতিক সাক্ষ্যভঙ্গি গ্রহণ করেন।
জয়নুলের দুর্ভিক্ষ সিরিজ তাই আমাদের শেখায়, সংকটকালে শিল্পীর দায় কী; এবং রেখা কীভাবে প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে।
দেশভাগের পর তিনি কলকাতার নিশ্চিত শিল্পী-জীবন ছেড়ে পূর্ববাংলায় ফিরে আসেন। এই প্রত্যাবর্তন নিছক ভৌগোলিক স্থানান্তর নয়; এটি ছিল একটি সাংস্কৃতিক প্রতিজ্ঞা।
১৯৪৮ সালে তিনি সহকর্মীদের নিয়ে ঢাকায় “ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস” (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) প্রতিষ্ঠা করেন।
তখনকার পূর্ববাংলায় শিল্পচর্চা ছিল বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত। প্রতিষ্ঠান নির্মাণের মাধ্যমে তিনি দেশের শিল্পচর্চাকে প্রথমবারের মতো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে আনেন।
শিল্পশিক্ষা সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল গভীরভাবে গণতান্ত্রিক। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিল্প উচ্চবিত্তের বিনোদন নয়; এটি মানুষের নান্দনিক বোধ ও মানবিকতা গঠনের উপকরণ। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান থেকেই পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পী কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী, রশিদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীরসহ অগণিত শিল্পীর বিকাশ ঘটেছে- যা চিত্রকলা সমালোচক নজরুল ইসলামের স্মৃতিচারণে উজ্জ্বলভাবে উঠে এসেছে।
জয়নুল আবেদিন উপলব্ধি করেছিলেন- বাংলার সংস্কৃতির আত্মা গ্রামীণ লোকঐতিহ্যের ভেতরে নিহিত। আধুনিকতার চাপে যদি এই শিকড় কেটে যায়, তবে শিল্পচর্চা হবে আত্মাহীন অনুকরণ।
এই বোধ থেকেই তিনি বাংলার লোকশিল্প সংগ্রহ ও সংরক্ষণে উদ্যোগ নেন এবং ময়মনসিংহে জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা/লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন; পরে সোনারগাঁওয়ে লোকশিল্প সংগ্রহশালার প্রক্রিয়াতেও তিনি প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে ভূমিকা রাখেন।
লোকজ ঐতিহ্যকে তিনি শুধু “সংরক্ষণযোগ্য অতীত” মনে করেননি; বরং আধুনিক শিল্পের জন্য এক বিশাল অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখেছেন। ফলে তাঁর নিজের শিল্পেও লোকমোটিফ, গড়ন, সরলীকরণ, রঙের বুনট ও জীবনঘনিষ্ঠতা বারবার ফিরে আসে।
জয়নুল আবেদিন ছিলেন প্রকৃত অর্থেই সাংস্কৃতিক সংগঠক। তিনি প্রদর্শনী আয়োজন, শিল্পীদের নেটওয়ার্ক তৈরি, শিক্ষার্থীদের দিয়ে কর্মশালা, গ্রামাঞ্চলে শিল্প-সচেতনতা ও কুটিরশিল্পের সহায়তায় নেতৃত্ব দেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শরণার্থীদের সহায়তা ও স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে তিনি “সোনার বাংলা” সহ বিভিন্ন পোস্টার/চিত্রসিরিজ করেন। যার মাধ্যমে শিল্প রাজনৈতিক ও মানবিক সংগ্রামের অংশ হয়ে ওঠে।
এখানে একটি বড় তাত্ত্বিক দিক আছে: তিনি শিল্পকে কেবল গ্যালারির সীমার ভেতর রাখেননি। বরং জনজীবনের সঙ্গে যুক্ত “চঁনষরপ ধৎঃ ংঢ়যবৎব” তৈরি করেছিলেন। আবুল মনসুর যে কথাটি বলেছেন, “সমসাময়িক অনেক শিল্পী স্বাচ্ছন্দ্য ও বোহেমিয়ান অনুকরণে নিজেদের ঘিরে ফেলেছেন; তার বিপরীতে জয়নুল ছিলেন সমাজের ভেতরে দাঁড়ানো শিল্পী।”
জয়নুল আবেদিনের শিল্পজীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তাঁর সরলতা। তিনি বিমূর্ততা চর্চা খারিজ করেননি। তবে, বিমূর্ততা তাঁকে টানেনি, কারণ তিনি মানুষের কথা বলতে চেয়েছেন, “সবার কথা, সংগ্রামের কথা”।
আবুল মনসুর যথার্থই বলেছেন- তিনি তথাকথিত আধুনিক ধারায় কিছু পরীক্ষা করলেও শেষ পর্যন্ত নিজের রীতি ও মেজাজেই ফিরে আসেন- কারণ তাঁর শিল্পতৃষ্ণা ব্যক্তিগত ছিল না, সমষ্টিগত জীবনের ভাষা খুঁজছিল।
অধ্যাপক নজরুল ইসলামের স্মৃতিচারণে জয়নুলের ব্যক্তিত্বে এই দর্শনেরই মানবিক রূপ দেখা যায়: ছাত্রের খোঁজ নিতে বাড়ি পর্যন্ত আসা, ছাত্রকে বিদেশে পাঠানোর প্রস্তুতি, তরুণদের প্রণোদনা; এসব তাঁর শিক্ষক জীবনের নৈতিকতার সাক্ষ্য।
আজকের বাংলাদেশে শিল্পচর্চা যখন দ্রুত বাণিজ্যিকতা, কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতা ও বাজারদরের দিকে ঝুঁকছে, তখন জয়নুল আবেদিন স্মরণ করিয়ে দেন: ‘শিল্পের প্রথম কাজ মানবিকতা জাগিয়ে তোলা।’
দুর্ভিক্ষের স্কেচ থেকে শুরু করে নদীপারের শ্রমিক-জীবন, সবখানেই তিনি মানুষের মর্যাদা ও অস্তিত্বের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
সমসাময়িক বিশ্বে পরিবেশসংকট, উদ্বাস্তু সমস্যা, যুদ্ধ-সহিংসতা, সামাজিক বৈষম্য- এসব প্রশ্ন আবার শিল্পকে নৈতিকতা সম্মুখীন করছে। জয়নুলের কাজ আমাদের দেখায় কীভাবে শিল্প নান্দনিক হলেও সামাজিক দায়িত্ব এড়ায় না; কীভাবে লোকঐতিহ্যকে আধুনিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন না করে বরং আধুনিকতার ভেতর শেকড়ের শক্তি জাগিয়ে তোলা যায়।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন শুধু বাংলাদেশের শিল্পকে বদলে দেননি; তিনি বদলে দিয়েছেন একটি জাতির রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি ও শিল্পচেতনা।
তাঁর জীবনের তিনটি বড় শিক্ষা আজও আলোকবর্তিকা হয়ে আছে-
১। “শিল্প মানুষের জন্য”। মানুষের জীবনকে না বুঝলে শিল্পের অর্থ অনুধাবন করা যায় না।
২। “শেকড় ও আধুনিকতার সেতুবন্ধন”। লোকঐতিহ্য ছাড়া আধুনিকতা আত্মাহীন।
৩। “শিল্পীর নৈতিক ভূমিকা”। সমাজের বিপর্যয়ে শিল্পী কেবল দর্শক নয়, সাক্ষী ও সহযোদ্ধা।
২৯ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করা মানে আমাদের সাংস্কৃতিক নিজস্বতাকে নতুন করে চেনা, এবং ভবিষ্যৎ শিল্পভাবনার জন্য একটি মানবিক মানদণ্ড পুননির্মাণ করা। জয়নুল আবেদিন আমাদের শেখান, শিল্প একদিকে সৌন্দর্য; অন্যদিকে দায়িত্ব। আর এই দুইয়ের সম্মিলনেই একটি জাতির সাংস্কৃতিক স্বরূপ গড়ে ওঠে।
তথ্যসূত্র :
ক) গ্রন্থ
১। মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন (হাতেখড়ি প্রকাশনী)
২। জাহাঙ্গীর হোসেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন: জীবন ও কর্ম (মাওলা ব্রাদার্স)।
৩। Abul Mansur/Bengal Foundation, Zainul Abedin (Great MaAbul Mansur/Bengal Foundation, Zainul Abedin (Great Masters of Bangladesh Series, Skira/Bengal Foundationsters of Bangladesh Series, Skira/Bengal Foundation)।
খ) প্রবন্ধসমূহ
১। আবুল মনসুর, “অসামান্য জয়নুল আবেদিন”। ‘দেশপ্রসঙ্গ’ শিল্পসাহিত্য বিষয়ক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ৩য় সংখ্যা। নভেম্বর ২০১৪।
২। নজরুল ইসলাম, “জয়নুল আবেদিন: ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ ও শতবর্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন”। ‘দেশপ্রসঙ্গ’ শিল্পসাহিত্য বিষয়ক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ৩য় সংখ্যা। নভেম্বর ২০১৪।
৩। মতলুব আলী, “ক্রমবিকশিত বাংলাদেশ শিল্পাঙ্গনের ধারাবারিক চেতনার উৎস আবেদিন”। ‘দেশপ্রসঙ্গ’ শিল্পসাহিত্য বিষয়ক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ৩য় সংখ্যা। নভেম্বর ২০১৪।
ইমদাদুল হক সূফী, সম্পাদক, দেশপ্রসঙ্গ




