সংগীত মানবজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। গান মানুষের আনন্দ, বেদনা, ভালোবাসা ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে সংগীতের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের মধ্যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই গানের ধারাকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে অনেক গুণী শিল্পী কাজ করেছেন। তেমনই একজন বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত সংগীতশিল্পী হলেন শহীদ ফারুকী, যিনি চট্টগ্রামের গানের ঐতিহ্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
শহীদ ফারুকীর জন্ম ১৯৭৫ সালের ১৫ জুন, চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক পটিয়া উপজেলার কচুয়াই, ফারুকী পাড়ায়। তার পরিবার সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য চর্চায় সম্পৃক্ত। তার পিতা মিয়া আবু মোহাম্মদ ফারুকী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, লেখক ও গবেষক, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর। তার মা রোকেয়া বেগম ছিলেন একজন রত্নগর্ভা নারী। তার বড় ভাই শোয়েব ফারুকী একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্র শিল্পী। পারিবারিক পরিবেশই তাকে সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট করে। শিক্ষাজীবনে তিনি পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি, পটিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচ.এস.সি. এবং স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সংগীত ছিল তার হৃদয়ের মূল আকর্ষণ, এবং ছোটবেলা থেকেই তিনি এই পথচলা শুরু করেন।
শহীদ ফারুকীর সংগীতজীবন শুরু হয় খুব অল্প বয়সে। তিনি শিশুশিল্পী হিসেবে বাংলাদেশ বেতারে গান গাওয়ার সুযোগ পান। তার কণ্ঠের মাধুর্য এবং প্রতিভার জন্য দ্রুতই তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি শুধু আঞ্চলিক গানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং পল্লীগীতি, আধুনিক ও মাইজভান্ডারি গানেও দক্ষতা অর্জন করেছেন। তাঁর গায়কী অনেকটা বৈঠকী ঘরনার মতই, এটাই তার অনবদ্য পারক্ষমতা।
চট্টগ্রামের বিখ্যাত শিল্পী শ্যামসুন্দর বৈঞ্চব ও শেফালী ঘোষের রেখে যাওয়া গানগুলোকে নতুন করে উপস্থাপনের পাশাপাশি তিনি নিজস্ব মৌলিক গান পরিবেশন করেন। তার গাওয়া আঞ্চলিক গানগুলো চট্টগ্রামের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে এবং বিশ্বব্যাপী চাটগাঁইয়া ভাষার গানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছে।
প্রকাশিত অ্যালবাম ও জনপ্রিয় গান- চট্টগ্রামের অন্যতম জনপ্রিয় অডিও প্রতিষ্ঠান আমিন স্টোর থেকে শহীদ ফারুকীর প্রথম মিউজিক ভিডিও অ্যালবাম প্রকাশিত হয়, যেখানে ১০টি গান ছিল। এই গানগুলোর সুর ও কথা দিয়েছেন, এম এন আলম, উত্তম কুমার আচার্য্য এবং এস এম ফরিদুল হক।
তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে,
রফিক আশিকীর লেখা ও সুরে-
হত হইলাম রাঙামাটি লই যাইয়ুম ফাল্গুনে
পাহাড়ি বাঙালির হোয়ারে লই বেড়াইয়ুম সাম্পানে,
সন্জিত আচার্য্যরে লেখা ও সুরে-
দাওয়াত দিলাম তোঁয়ারে চাটগাঁ বেড়াইতা আইয়,
চলো যাই রাঙামাটি আঁরা দোনজন।
উত্তম কুমার আচার্য্যরে লেখা ও সুরে-
ভোরের শিউলী হয়ে ফুটলে তুমি যখন।
এস এম ফরিদুল হকের লেখা ও সুরে-
ঘুম ভাঙলেই পাখির গান, চোখ খুললেই সোনার ধান,
রংধনুতে রাঙা নীল আকাশ, হরেক পাখি শীতল বাতাস।
এছাড়াও তার নিজের লেখা গান “কোন রূপসী হেটে যায় নাম ঠিকানা জানা নাই” শ্রোতাদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
শহীদ ফারুকী একক গানের পাশাপাশি বহু তারকা শিল্পীর সঙ্গে জুটি বেঁধে গান করেছেন। তার সহশিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন গীতা আচার্য্য, কোহেলী দাশগুপ্তা, নাজনীন মোস্তারী, অনামিকা মনি, জুলি, সুপ্রিয়া লাকী, শারমিন হোসেন, মুন্নী আকতার মারিয়া, তমালিকা বিশ্বাস ও শারমিন চৌধুরী।
বাংলাদেশ টেলিভিশন, এটিএন বাংলা, মোহনা টিভি বৈশাখী টিভি, আরটিভি, বাংলা টিভিসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তার গান প্রচারিত হয়, যা চট্টগ্রামের সংগীতকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করছে।
শুধু সংগীতশিল্পী হিসেবেই নয়, শহীদ ফারুকী একজন সফল অনুষ্ঠান পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রগ্রাহক ও অভিনেতা হিসেবেও পরিচিত। তিনি প্রখ্যাত পরিচালক নুরুল ইসলাম নুরুর “মন চোরা মাঝি” টেলিফিল্মে অভিনয় করেছেন, যা তার বহুমুখী প্রতিভার প্রমাণ বহন করে। এক অর্থে তিনি বহুমাত্রিক প্রতিভাবানসম্পন্ন।
সংগঠন ও সামাজিক কার্যক্রম- শহীদ ফারুকী, সাংগঠনিক কাজেও সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। তিনি চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
সংগীতের পাশাপাশি শহীদ ফারুকী কর্মজীবনে আন্তর্জাতিক মানের “পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতাল” চট্টগ্রাম এর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। শহীদ ফারুকী তার প্রতিভা ও পরিশ্রম দিয়ে চট্টগ্রামের সংগীতকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তার কণ্ঠে চট্টলার গান নতুন মাত্রা পেয়েছে এবং এই ধারাকে তিনি আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট। সংগীত, সাংগঠনিক কাজ ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তিনি চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। তার মতো নিবেদিত প্রাণ শিল্পীদের মাধ্যমেই চট্টগ্রামের সংগীত ও সংষ্কৃতি আরও সমৃদ্ধ হবে।
শহীদ ফারুকীর পথচলা অব্যাহত থাকুক, তার কণ্ঠে আরও নতুন গান প্রাণ ছুঁয়ে যাক। চট্টগ্রামের গানের ঐতিহ্যকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে তিনি আরও এগিয়ে যান এই প্রত্যাশা রইলো। নিরহঙ্কার ও নিভৃতচারী এই শিল্পীর নিজস্ব গায়কী ঢঙ কর্ণফুলির জলতরঙ্গের মতই অবশ্যই বহমান থাকবে— এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আন্দরকিল্লা ডেক্স




