কামরুল হাসান বাদল
অশীতিপর কারো মৃত্যু হলে তাকে অকাল মৃত্যু বলা যাবে না তা মানি কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যুর পরও অনন্ত বাসনা জাগে ‘আরও কিছুদিন বাঁচলে কী হতো!’
সুনীতিভূষণ কানুনগোর মৃত্যুর পর আমরা কি অবলীলায় সে আক্ষেপ করতে পারি? যাঁকে আমরা একপ্রকার উপেক্ষাই করেছিলাম, অনেকটা অপাংক্তেয় করে রেখেছিলাম আজ তাঁর মৃত্যুতে শোক জানাতে একটু কুণ্ঠিতই হই বৈকি!
গত ৪ অক্টোবর শনিবার বিকেলে মৃত্যুবরণ করেন উপমহাদেশের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. সুনীতিভূষণ কানুনগো। তিনি নিজে ছিলেন কিছুটা নিভৃতমুখী। কাজেই নগরের সভা-সেমিনারে তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল না বলে এ প্রজন্মের অনেকের কাছে তিনি অনেকটা অপরিচিতই রয়ে গেছেন। অনুচ্চ থাকা তাঁর চরিত্রেরই বৈশিষ্ট্য।
১৯৬০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ইতিহাসে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করে ১৯৬১ সালে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। পর্যায়ক্রমে স্যার আশুতোষ কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘকাল শিক্ষকতা শেষে ১৯৯৯ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ। ১৯৭২ সালে তিনি পিএইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পিএইচ.ডি. গবেষক ছাত্র এবং তাঁর গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ঐতিহাসিক ড. আবদুল করিম। তাঁর অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল ‘A History of Chittagong under Muslim rule’।
তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন এবং ১৯৯৯ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো মূলত চট্টগ্রাম এবং বাংলার ইতিহাসের ওপর গভীর গবেষণা ও লেখালেখির জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো, ‘চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস’ (তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলির মধ্যে অন্যতম) ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি’, ‘বাংলার ইতিহাস: প্রাচীন যুগ’, ‘A History of Chittagong Vol-I’ (তাঁর পিএইচ.ডি. থিসিসের ভিত্তিতে রচিত), ‘The Chittagong Revolt, 1930-34’, ‘Chakma Resistance to British Domination’, ‘বাংলার শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস’, ‘বাংলায় বৈষ্ণব আন্দোলন’, ‘চট্টগ্রাম চরিতাভিধান’, ‘ইংল্যান্ডের ইতিহাস’ তাঁর লেখা বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে, যা তাঁর গবেষণার গুরুত্ব প্রমাণ করে।
তাঁর জন্ম চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় ২৫ অক্টোবর ১৯৩৬ সালে। তাঁর পিতা প্রধান শিক্ষক পুলিন বিহারী কানুনগো আর মা সুচারুপ্রভা কানুনগো। বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়া গ্রামেই কাটে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশে কলকাতা যেতে হয় তাঁকে। তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেই নিজ গ্রামে ফিরে আসেন এবং স্যার আশুতোষ কলেজে অধ্যাপনায় যোগদানের মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন।
তাঁর জ্যেষ্ঠ পিতৃব্য উপমহাদেশের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক কালিকা রঞ্জন কানুনগোর উৎসাহে তিনি গবেষণা কাজে মনোযোগী হয়ে ওঠেন।
ড. সুনীতির ‘A History of Chittagong. Vol-I’- গ্রন্থটি তাঁর গবেষণা কর্মের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এটি তাঁর পিএইচ.ডি. অভিসন্দর্ভের (Thesis) ভিত্তিতে রচিত, যা চট্টগ্রাম ও বাংলার ইতিহাস গবেষণায় একটি অনন্য মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। গবেষণা অভিসন্দর্ভ গ্রন্থটি মূলত তাঁর পিএইচ.ডি. অভিসন্দর্ভের সম্পাদিত ও বিস্তারিত রূপ। তাঁর গবেষণার মূল শিরোনাম ছিল ‘A History of Chittagong under Muslim rule’ (মুসলিম শাসনাধীনে চট্টগ্রামের ইতিহাস)। এটি প্রণিধানযোগ্য যে, ড. কানুনগো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে ডক্টরেট করা প্রথম গবেষক ছাত্র। ফলে তাঁর এই কাজটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাধারার সূচনাও করেছিল। গ্রন্থটি ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়। চট্টগ্রামের মুসলিম শাসন আমলের ইতিহাস এবং এর সামগ্রিক পটভূমির ওপর আলোকপাত করে বইটি। এতে প্রাচীন হরিকেল জনপদ, আরাকানের সঙ্গে চট্টগ্রামের সম্পর্ক, ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পকলার চর্চার মতো বিষয়গুলো বিশ্লেষণাত্মক উপায়ে আলোচিত হয়েছে। এই গবেষণামূলক বইটি আন্তর্জাতিক মহলেও স্বীকৃত। অনেকে জানেন, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পাওলা টিনটি (Paola Tinti) এই বইটি পড়ার পর এর দ্বিতীয় খণ্ডের (Vol-II) খোঁজে ড. কানুনগোর সঙ্গে দেখা করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বইটি সংরক্ষিত আছে এবং এটি ইতিহাসের আকর গ্রন্থ (Source Book) হিসেবে ঐতিহাসিকদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান ।
‘চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস’ গ্রন্থটি সুনীতি ভূষণ কানুনগোর একটি মৌলিক কাজ, যা বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রাচীন পর্বের ইতিহাসকে সাধারণ পাঠকের কাছে সহজভাবে তুলে ধরেছে।
গবেষক সুনীতি ভূষণ কানুনগো চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে পূর্বে তাঁর আকরগ্রন্থ ‘A History of Chittagong’ রচনা করলেও, এই বইটি তিনি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র পরিসরে এবং সাধারণ পাঠকদের উপযোগী করে লিখেছেন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে সাধারণ পাঠকদের কৌতূহল ও জ্ঞানের চাহিদা পূরণ করা। প্রাচীন চট্টগ্রামের ইতিহাস নির্মাণ করা একটি দুরূহ কাজ, কারণ এখানে পাথুরে ও ধাতব প্রমাণের অভাব রয়েছে। লেখক এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বহু প্রাচীন গ্রন্থ, পর্যটকদের বিবরণ, তাম্রলিপি এবং মুদ্রা থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছেন। প্রাচীন চট্টগ্রামের সীমারেখা, নামকরণ এবং এর জনবিন্যাস সম্পর্কে বিভিন্ন পণ্ডিতের মতামতের ভিত্তিতে একটি স্বচ্ছ রূপরেখা তুলে ধরেছেন তিনি। প্রাচীন চট্টগ্রামে আর্য সংস্কৃতির বিস্তার, ধর্মীয় অবস্থা এবং শিল্পকলার চর্চা— এইসব সাংস্কৃতিক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে এ গ্রন্থে। প্রাচীন এই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি, চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাসে আরাকানের ভূমিকা ও পারস্পরিক সম্পর্ককে তুলে ধরেছেন তিনি গুরুত্বের সঙ্গে। বইটি তথ্যের সমাহারে ও বিশ্লেষণে অনবদ্য এবং এটি চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাসচর্চায় একটি নির্ভরযোগ্য আকরগ্রন্থরূপে সমাদৃত।
পার্বত্য চট্টগ্রাম: ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি
গ্রন্থটির মাধ্যমে ড. কানুনগো পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জটিল ইতিহাস, স্বতন্ত্র সমাজ ব্যবস্থা এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি তার নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য, ভূপ্রকৃতি এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর কারণে সর্বদা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর এই বইয়ে পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জীবনযাত্রা, ঐতিহাসিক বিবর্তন, এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে এর আগেও গবেষণা করেছেন। তাঁর ‘চাকমা রেজিস্টেন্স টু ব্রিটিশ ডমিনেশন (১৭৭২-১৭৯৮)’ শীর্ষক মূল্যবান গ্রন্থে চাকমাদের ব্রিটিশ-বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রামের কারণ ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আলোচ্য ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থটি এই অঞ্চলের ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, সমাজ ও সংস্কৃতির সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিসত্বা যেমন: চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ইত্যাদি সমাজ ব্যবস্থা, ধর্ম (যেমন: চাকমাদের বৌদ্ধধর্ম), ভাষা এবং ঐতিহ্যবাহী উৎসব ও সংস্কৃতি (যেমন: জুম নৃত্য, বৈসাবী) ইত্যাদি বিষয়ে তথ্যবহুল আলোচনা স্থান পেয়েছে। এ অঞ্চলের ওপর কোম্পানি শাসন (১৭৬০ সালের পর) ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভাবের সূচনা, প্রশাসনিক ক্রমবিকাশ এবং জাতিগোষ্ঠীগুলোর প্রতিরোধ, বিশেষত চাকমা বিদ্রোহের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো নিয়ে লেখক ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন।
গ্রন্থটি পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক দিকগুলি নিয়ে আগ্রহীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র। এটি পার্বত্য অঞ্চলের জটিল সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং তাদের ঐতিহ্যকে জাতীয় ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে বোঝার জন্য সহায়ক।
এই দুটি বই একত্রে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইতিহাসকে সুপ্রাচীন কাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত একটি বৃহত্তর পরিসরে উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে নিঃসন্দেহে।
ইতিহাসের ছাত্র হওয়া আর ইতিহাসবিদের দায়িত্ব পালন করা এক নয়। আমরা জানি ইতিহাস কখনও পরিপূর্ণভাবে নিরপেক্ষ নয়। ফলে ইতিহাসবিদও কখনও কখনও নিরপেক্ষ না-ও থাকতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ইতিহাসবিদের সততা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আড়ালে থাকা অনন্য প্রভা ড. সুনীতির ইতিহাস বিষয়ক বইপত্র পড়ে আমাদের প্রতীতি জন্মেছে যে তিনি সততার সঙ্গে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তথ্যগুলো থেকে সত্যকে ছেঁকে তুলে এনে পাঠকের সামনে উপস্থিত করেছেন। তিনি এতদ্বাঞ্চলের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। অভিসন্দিগ্ধ মনের খোরাক যুগিয়েছেন। কিন্তু সমাজ তাঁর প্রয়োজনের খোরাক যুগিয়ে দেয়নি। তাঁর অভিমানের কথা, কষ্টের কথা, বেদনা ও নিঃসঙ্গতার কথা শুনতে চায়নি। আমাদের দায় ছিল। তা রয়ে গেল।
কামরুল হাাসান বাদল, কবি ও সাংবাদিক




