এখন সময়:সন্ধ্যা ৬:৩৫- আজ: রবিবার-২১শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৬ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-শীতকাল

এখন সময়:সন্ধ্যা ৬:৩৫- আজ: রবিবার
২১শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৬ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-শীতকাল

স্বপ্নে গড়া অবয়ব

সৈয়দ মনজুর কবির

 

মনটা যখনই কেমন অজনা বিষণ্নতায় ছেয়ে যায় তখনই কেয়া জানালার ধারে এই চেয়ারটাতে এসে বসে। আজ অবশ্য অন্য একটা কারণ আছে যা ওর কিশোরী মনকে গত দুদিন ধরে বেশি করে চঞ্চল করে তুলেছে। অভ্যাসবশত আকাশে রূপোর চাঁদকে খুঁজছে না। ওর অনুসন্ধিৎসু চোখের চাহনী এখন পাশের বাড়ির নীচ তলার আধা পর্দাটানা জানালার উপর স্থির হয়ে আছে। অদ্ভুত সেই সুর। সেই সুর মনকে কেবলি ছুঁয়ে যাচ্ছে। মন তাই মরিয়া হয়ে আছে এ আবেশী সুর সৃষ্টিকারীকে দেখবার জন্য। সুর সৃষ্টিকারীর দরদী হৃদয়কে খুব কাছে থেকে অনুভব করার প্রবল ইচ্ছা আচ্ছন্ন করে রেখেছে চঞ্চল মনকে। কিন্তু মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয় না, জানালার পর্দা মনকে হার মানিয়েছে। পর্দাটা ঠিক সম্পূর্ণ খোলা নয়, বিশেষ কায়দায় পর্দাটা ঝুলছে মনের আকর্ষণকে নিত্য বাড়িয়ে তোলার বলিষ্ঠ প্রয়াসে। হালকা গিয়ে রঙের জানালার গ্রীলের ওপাশে পর্দাটা ঝুলছে। শুধুমাত্র গাঢ় খায়রী রঙের স্প্যানিশ গিটার ও একজোড়া সচল হাত পর্দার আড়াল উপেক্ষা করে কেয়ার অপলক দৃষ্টিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও এর চেয়ে বেশি কিছু দেখতে

 

পায়না কেয়া। অসাধারণ সুর স্রষ্টা আড়ালেই থেকে যায়। খোঁজ নিয়েছে কেয়া নিজের তাগিদে নির্লজ্জভাবে। নিজের এ অভাবনীয় পরিবর্তনে নীরবে হেসেছে ও কতবার।

মারুফ ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র ছেলে। পাশের বাড়িতে ভাড়া এসেছে আজ নিয়ে চারদিন। আসা থেকে অবধি মারুফের মা-বাবার ভীষণ বিমর্ষ ঘোর দুশ্চিন্তার ছায়া চোখে মুখে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। মারুফের বাবা আরিফুর রহমানকে কয়েকবার দেখেছে কেয়া রাস্তায়। মারুফের মা মিসেস রহমানকে চারদিনে গুনে গুনে ছয়বার দেখেছে। কিন্তু মনকে অশান্ত করা সেই সুরের জাদুকর মারুফ দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে যায়। দৃষ্টির অগোচরে থেকেও কেয়ার কাছে মারুফ এক সুন্দর যুবক। মনের মাধুরীতে ও নিজের মনমতো গড়ে তুলেছে যুবককে। মনের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে দাগ কেটে কেটে রূপ দিয়েছে সেই স্বপ্নের অবয়বকে। সেই অবয়ব বড়ই শান্ত, মায়াবী। মনের সকল অতৃপ্ত কামনাকে তৃপ্ত করে কল্পনার সেই অবয়ব।

গত দু’দিন কেয়া কলেজে যায় নি। দুপুরে বান্ধবী টেলিফোন করে সব পড়া জানিয়ে দিয়েছে। অনেকটা অনীহায় পড়া লিখে নিয়েছে খাতায়। টেলিফোন শেষে ছুড়ে ফেলে খাতা কলম টেবিলের কোণায়, ছুটে চলে এসেছে জানালার ধারে। চোখ শুধু একটি জায়গায় নিবন্ধ। জানালার পর্দা সেই একইভাবে টেনে দিয়েছেন মিসেস রহমান। কেয়া অবশ্য সালাম দিয়ে মৃদু হেসেছিলো। কিন্তু মিসেস রহমান শুধু বিষণ্ন মনে সালামের উত্তর দিয়ে ভেতরে চলে গেছেন। অন্য সময় হলে কেয়া ঠিকই এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করত। কিন্তু আজ কেয়া ব্যস্ত অন্য কিছু নিয়ে। তাই মিসেস রহমানের কান্নায় ফুলে ওঠা রক্তিমবর্ণ চোখ, নাসিকা এ কোনো বিষয়ই ওর কোন আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে নি। মন যখন অধীর কোনো চিন্তায় অন্য সকল কিছু তখন অতি সাধারণ বলেই গন্য হয়। কেয়ার চোখের চাহনী নেচে ওঠে যখনই বাতাসে সামান্য ফাঁক হওয়া পর্দার ফাঁকে একজোড়া হাত ও খয়েরী গিটার ভেসে ওঠে।

পাশের বাড়িতে তীক্ষ্ম কান্নায় ভেঙে পড়েছে কেউ, হয়তো মিসেস রহমান। একটা পুরুষ কণ্ঠও যোগ দিল, মি. রহমানের ভাঙা ভাঙা কান্না মিশ্রিত মাতম। একটু আগে কেয়া যখন সুরের মূর্ছনায় মোহিত মগ্ন তখন হঠাৎ করেই মনে হলো সুরে ছন্দ পতন হচ্ছে। গিটারে চঞ্চল হাত দুটি ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে এলো। হঠাৎ করেই হাতের ফাঁক দিয়ে গিটারটি মেঝেতে পড়ে যায়। থেমে যায় মোহময় সুরছন্দ। বাম হাতটা ঝুলে পড়ল। সাথে সাথে শুরু হলো ভয়ার্ত তীক্ষ্ম কান্নার ধ্বনি হঠাৎই তখনই হৃৎপিন্ডের কাঁপন হঠাৎ করেই দাপাদাপি শুরু করে কেয়ার। মনে হয় বুক চিরে হৃৎপিণ্ড বেরিয়ে যেতে পারলে শান্ত হবে। বুক ফেটে কান্নায় ভেঙে পড়তে চাইছে মন। সামনের জানালা ঝাপসা অন্ধকার হয়ে আসে কেয়ার। মাথা ঢলে পড়ে সেগুন কাঠের তৈরী বার্নিশ করা মসৃণ হাতলটার উপর। মুহূর্তেই স্বপ্নের রাজত্বে গড়ে ওঠা মারুফের অবয়ব চোখের সামনে ভেসে উঠে আবার মিলিয়ে যায় নিঃশব্দে।

চোখে আলোর ঝলক পড়তেই আবার চিন্তাশক্তির জগতে ফিরে এসেছে কেয়া। মৃদু কান্নার ধ্বনি ভেসে আসছে খুব কাছে থেকে। তাকিয়ে দেখতেই ডাক্তারের টর্চের আলো এসে চোখ ধাঁধিয়ে দেয় কেয়ার। কিছুটা সহ্য হতেই হাসি হাসি ডাক্তার চাচার মুখ দেখতে পায়। পাশে তাকাতেই মাকে দেখল আঁচলে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। বাবা কিছু দূরে বিছানার কিনারায় ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে সন্দেহ, মেয়ে কেমন আছে?

দুই ঘণ্টা আটচল্লিশ মিনিট কেয়া অজ্ঞান ছিল। মাথা তুলবার চেষ্টা করল ও। মুখ দিয়ে তিনটি অস্ফুট শব্দে বেরিয়ে এলো, মারুফ কেমন আছে?

ডাক্তার চাচা বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল, হু ইজ মারুফ ভাবি?

বাবাও একই প্রশ্ন করল মাকে। যেন ঐ নামটির সাথে কেয়ার মা বিশেষভাবে পরিচিত। এ ধরনের অদ্ভুত প্রশ্নে মায়ের কান্না থেমে যায়। মাথা ঘুরিয়ে ডাক্তার ও স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো, পাশের বাড়ির নতুন ভাড়াটে মিঃ রহমানের ছেলে ছেলেটা ক্যান্সারে ভুগছিল সাড়ে তিন মাস ধরে। মারা গেল সন্ধ্যায়।

বিদ্যুৎ বেগে লাফিয়ে উঠে বসে কেয়া। মায়ের কথা ওর কানে গেছে স্পষ্ট। হাত পা আবার ঠান্ডা হয়ে আসছে কেয়ার। ডাক্তারের আঙুল ওর কব্জি চেপে ধরেছে, অনুভব করে। আবার সবকিছুই ঝাúসা হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার চাচার হাতের উপর ঢলে পড়েছে মাথা। জ্ঞান হারিয়েছে কেয়া আবার?

বুকে প্রচণ্ড ব্যথা করছে। কেয়াকে ঘিরে থাকা আত্মীয় স্বজনদের চিন্তিত মুখ দেখতে থাকল এক এক করে। ঢাকায় যত আত্মীয় থাকেন তারা তো এসেছেনই আবার পাড়া প্রতিবেশীও কম আসেন নি। কেয়া উঠে বসতে চেষ্টা করল। পাশে বসে থাকা মা সাহায্য করল। মাকে মনের ইচ্ছেটা বলল কেয়া। মা একবার বিস্মিত বিস্ফোরিত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে কেয়াকে বিছানা থেকে নামতে সাহায্য করল। বড় খালাও কেয়ার ইচ্ছেটা শুনেছেন তাই তিনি হাতের শালটা ওর গায়ে জড়িয়ে দিলেন ভালোভাবে। মায়ের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে কেয়া। শরীর মানছে না, তবুও যে তাকে যেতেই হবে।

সাদা কাপড়ে সজ্জিত কেয়ার স্বপ্নের সুরের জাদুকর। আগরবাতির ধোঁয়া বের হচ্ছে আবার বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বাতাসে মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে দিচ্ছে অনবরত। খাটিয়ার নিচ থেকে বরফের গায়ে এসে লেগেছে জমে যাওয়া জলীয় বাস্প। অনেক কষ্টে কেয়া এ বাড়িতে এসেছে। মারুফের মৃত্যুর পর জ্ঞান হারানো, হঠাৎ জ্ঞান ফিরে মারুফের নাম উচ্চারণ, এসবের একটা বাস্তবনিষ্ঠ সারমর্ম পাড়া-প্রতিবেশীরা বুঝে ফেলেছে ইতিমধ্যে। কেয়াকে গেটে দেখামাত্র সকলেই আবার আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ল। জায়গা করে দিল মারুফের লাশের কাছে পৌঁছাতে। বুকের ভেতরের কম্পন আবার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে কেয়ার। যার অবয়ব কদিন ধরে বারবার লুকিয়ে দেখার চেষ্টা করেছে অথচ আজ  কতো সহজেই এ সুযোগ পেয়ে গেলো কেয়া। স্নেহভরা চোখে মিসেস রহমান এসে জড়িয়ে ধরে কেয়াকে, আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কেয়ার বুকের ভেতরের অসহ্য যন্ত্রণা ক্রমশ বেড়ে চলেছে।

মিসেস রহমান কেয়ার হাত ধরে বললেন, আয় আয় মা দেখবি তোর স্বপ্নের রাজকুমারকে, আয়। তিনি একটানে মারুফের মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেন।

এক সেকেন্ড দু সেকেন্ড তিন সেকেন্ড। মনে হলো প্রায় একযুগ ধরে বন্ধ হয়ে গেছে কেয়ার হৃদকম্পন। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এখন। হঠাৎ করে সারা ঘর গিটারের সুরের মূর্ছনার ছেয়ে যায়। মাঝে দাঁড়িয়ে আছে কেয়ার স্বপ্নের অবয়ব মারুফ। ধীরে ধীরে এক হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকল মারুফের সাথে। এ কি! এ যে কেয়ার মনের মাধুরীতে গড়া স্বপ্নের রাজত্বের সেই মারুফ। সেই হাসি হাসি মায়াবী অবয়ব। ক্রমশ ঘরের ভেতরে গিটারের শব্দ আরো বাড়তে থাকে। সামনে শায়িত মারুফ ক্রমশ অস্পষ্ট হতে লাগল। দুলে উঠল কেয়ার দুর্বল শরীর। ধীরে ধীরে পড়তে লাগল মেঝের ওপর।

 

সৈয়দ মনজুর কবির, গল্পকার

আন্দরকিল্লা প্রকাশনার ২৮ বছর আগামীর পথ ধরে অনাদিকাল

রূপক বরন বড়ুয়া আমি মাসিক ‘আন্দরকিল্লা’ কাগজের নিয়মিত পাঠক। প্রতিবারের মতো হাতে নিলাম এবারের দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে ঢাকা জুলাই ২০২৫ সংখ্যা, হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখতেই

জলে জঙ্গলে (পর্ব-২)

মাসুদ আনোয়ার   ৬ ডিসেম্বর রাজশাহী বোর্ডের রেজাল্ট আউট হলো। আমি কুমিল্লা বোর্ডের পরীক্ষার্থী। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলাম। যে কোনোদিন কুমিল্লা বোর্ডও ফল প্রকাশ

স্বপ্নে গড়া অবয়ব

সৈয়দ মনজুর কবির   মনটা যখনই কেমন অজনা বিষণ্নতায় ছেয়ে যায় তখনই কেয়া জানালার ধারে এই চেয়ারটাতে এসে বসে। আজ অবশ্য অন্য একটা কারণ আছে

অন্তহীন সুড়ঙ্গ

সুজন বড়ুয়া   কবর থেকে বেরিয়ে মহিম অশরীরী রূপ নিল। সঙ্গে সঙ্গে গত কয়দিনের সব ঘটনা একে একে মনে পড়ে গেল তার। ফার্স্ট সেমিস্টারের পর

রাত যখন খান খান হয়ে যায়…

মনি হায়দার   চোখ মেলে তাকায় সোাহেল হাসান। প্রথম দৃষ্টিতে সবকিছু অচেনা লাগে। কোথায় এলাম আমি? উঠে বসতেই মনে পড়ে গতরাতে অনেক ঝক্কি আর ঝামেলার