নিলুফা ইসলাম
রাতের আকাশে ধবধবে তারকারাজি। সাথে আছে নজরকাড়া চাঁদের আলো।এমন সুন্দর রাতে উঠানে মাদুর পেতে হাসেম মিয়া একপলকে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে তার কতো কথা উঁকি দিচ্ছে। তার বয়স যখন সাতবছর তখন তার মা মারা যায়। তার বড় একটি বোন ছিলো যার বয়স তখন নয় বছর। ছোট একটি ভাই ছিলো যার বয়স ছিলো পাঁচবছর। তার বাবা ছিলো গ্রামের চৌকিদার। দাদার সহায় সম্পত্তি থাকলেও নিজের দাদি আগে মারা যাওয়ায় দাদার সম্পত্তি সৎদাদির ছেলেমেয়ের দখলেই ছিলো বেশি। মা মারা যাওয়ার কিছুদিন পরেই কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং যে মিয়াভাই বলে ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হতো সেও চলে গেলো বিধাতার ডাকে সাড়া দিয়ে। হয়তো ছোট ভাইটি আকাশের ঐ চাঁদের সাথে মিশে আছে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে হাসেম মিয়ার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ভাইটি মারা যাওয়ার পর বাজির মনটাও ভালো থাকতোনা। এর মধ্যে দেখা দিলো মহা দুর্ভিক্ষ। সেই দুর্ভিক্ষ এতোটাই ভয়ংকর ছিলো যে খাদ্যের অভাবে প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যেতে লাগলো।
আমার সৎচাচারা বাজিকে কিছু খাবার দিয়ে গাঁয়ে রটিয়ে দিলো তার সকল সম্পত্তি নাকি চাচাদের লিখে দিয়েছে। আশে পাশের মানুষ যখনই বাজিকে এর সত্যতা জানার জন্য ডাকতো। জানিনা বাজি কোন অজ্ঞাত কারণে দৌড়ে তার ভাইদের কাছে চলে যেতো। তখন কেউ আর এ ব্যাপারে বলার সাহস করতো না। আমার বড় বোনটির বয়স দশ বছর হলেই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তাই সে তার স্বামীর বাড়িতেই থাকতো। দুর্ভিক্ষ চলাকালীন সময়ে আমার বাজিকে নিয়ে ঘরে শুয়েছিলাম। সকাল হলে দেখি আমার বাজি আর কথা বলেনা।আমি তখন দৌড়ে চাচাদের ডাকতে গেলাম। সবাই আসলোওনা। দু’একজন এসে বললো,তুর বাপ মারা গেছে। এই অভাবের দিনে কাফন দাফনের টাকা পাবি কোথায়? কলাগাছের ভেলায় লাশ ভাসিয়ে দে।তখন আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। একবার বাজির মুখের দিকে তাকায় আরেকবার তাকায় ঘরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর দিকে। সত্যি সত্যি আমার পরাণের বাজিকে এই নদীতে ভাসিয়ে দিতে বেলা বাড়তে লাগলো কিন্তু কেউ এলোনা। আমি ভয়ও পেতে থাকলাম।তখন ঘরে থাকা দা এনে কলাগাছ কেটে ভেলার মতো বানিয়ে কতিপয় প্রতিবেশীদের সহায়তায় পরানের বাজিকে ভেলায় করে ভাসিয়ে দিলাম। একথা বলে হাসেম মিয়া অনেকক্ষণ কোন কথায় বলতে পারলোনা। কিছুক্ষণ পরে আবার সে একা একা বলতে শুরু করলো আমার বাজির লাশটি কোথায় কোন ঘাটে ভিড়ে ছিলো কিংবা মাছ বা কোন জন্তুতে খেয়ে ছিলো কি তাও জানিনা। সে কথাগুলি বলছে আর তার গলার কম্পন যেনো বেড়ে চলছে। হাসেম মিয়া চোখ মুছে আবার বলতে লাগলো,এরপর শুরু হলো আমার জীবনের নতুন এক অধ্যায়। বাজি চলে গেলো এখন আমি কোথায় থাকবো। তখন শিমুলপাড়া গ্রামে আমার দূর সম্পর্কের একখালার শ্বশুড় বাড়ি ছিলো। তার ছিলো শুধু চারটি মেয়ে। তার কোন পুত্র সন্তান ছিলো না বলে তাদের মনে খুব দুঃখ ছিলো। একইগ্রামে আমার ফুফুর শ্বশুর বাড়ি ছিলো। ফুপা তখন আমাকে খালার কাছে দিয়ে বলে, আজ থেকে এই তোমাদের পুত্র সন্তান। খালাতো ভীষণ খুশি। খালুও অনেক খুশি হলো। তখন আমার বয়স হবে দশ কি তার একটু বেশি। বাজিকে হারিয়ে মনে আমার অনেক কষ্ট ছিলো। তারপর খালা খালুকে মা, বাজি বলে ডাকতে লাগলাম। কয়েকমাস যাওয়ার পর সে বাড়ি,চারটি বোন, মা,বাবা সবাইকে আপন করে নিলাম। দু’চার দিন স্কুলেও গেলাম। কিন্তু বাজি বলতো,স্কুলে গেলে হাল চাষ করবো কে? গেরস্তের ছেলের এতো পড়ালেখার দরকার নেই বাপু! তখন স্কুল বাদ দিয়ে আমি হাল চাষ শিখতে লাগলাম। আমার হাল চাষ দেখে লোকে বলাবলি করতো,এই কচি হাতে কড়া পরে যাবে। আমি তখন হাসতাম আর বলতাম বাজি একা এতো কাজ কীভাবে করবে তাই আমি তাকে সাহায্য করছি।
আজ যেনো কি হয়েছে! মনের মাঝে জমে থাকা যত স্মৃতি আছে সব খৈ হয়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। এদিকে আমার ফেলে আসা বাড়িতে সৎ চাচারা নিজেদের জন্য বাড়ি তৈরি করে। তারা বলে আমার বাজি নাকি তাদের সব জমি লিখে দিয়েছিলো। এখন পর্যন্ত একথায় প্রচলিত।যদিও তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমার তখন জীবন নিয়ে কোন রকম খেয়ে না খেয়ে জগৎ সংসারে বেঁচে থাকাই প্রথম লক্ষ্য ছিলো তাই অন্য কিছুর প্রতি খেয়াল ছিলো না। দেখতে দেখতে বছর পার হতে লাগলো। নতুন সংসারের সবাই আমার খুব আপন হয়ে উঠলো। এখানে চারটি বোনের যেনো প্রাণের ভাই হয়ে উঠলাম। আমার বয়স তখন পনেরো কি ষোল। আর্মি ট্রেনিং এর জন্য বাছাই হলাম। কয়েক মাস ট্রেনিং শেষও করলাম। কিন্তু বাজি হঠাৎ একদিন সেখানে গিয়ে হাজির। বললো,এসব কর্ম আমাদের জন্য নয়, বাড়ি চলো। তারপর এখানেই এই কর্মের ইতি টানলাম। বাড়ি ফিরে সংসারের পুরো দায়িত্বভার আমার কাঁধে। খেতে কাজ করার পাশাপাশি শুরু করলাম কয়লার ব্যবসা। ঘোড়ায় করে কয়লা নিয়ে দূর দূরান্তে দিয়ে আসতাম। বাজি পরে গিয়ে মহাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসতো। বাজির সম্পদ ছিলো কিন্তু পুত্র সন্তান না থাকায় তার সবটুকু কাজে লাগাতে পারতো না। আমি আসার পর থেকে বাজি আরো সহায় সম্পদ কিনতে লাগলো। এদিকে তিন বোনের বিয়ে কার্য শেষ করে সবার ছোট বোনটির বিয়ে দিয়ে শ্বশুর বাড়ি পাঠালাম। কয়েকদিন পর বাজি ও মা বললো,বোনকে দেখে আসতে। আমি মাটির হাঁড়িতে মিষ্টি কিনে রওনা দিলাম বোনের বাড়ি। বোন আমাকে দেখে দৌড়ে এসে বললো,মিয়াভাই! আমি এ বাড়িতে থাকবো না। আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো। তখন আমি বোনকে বললাম, শান্ত হও। পরে সব শুনবো। এখন এসব কথা কাউকে বলো না। তখন বোনটি চুপ হয়ে গেলো। বোনজামাই এসে অতি আদরে অন্দরমহলে নিয়ে মেহমানদারি করতে লাগলো। আমি শুধু ভাবতে লাগলাম এত সুখ শান্তি রেখে বোন আমার কেন এখানে থাকতে চাইছে না। যাহোক এবার ঘুমানোর পালা। সবাই যখন ঘুমাতে গেলো তখন বোন এসে বলে গেলো,মিয়াভাই, সজাগ থেকো। আমি মাঝরাতে তোমায় একজায়গায় নিয়ে যাবো। আমি বিছানায় মাথা ঠেকালাম কিন্তু চোখে কিছুতেই ঘুম আসছে না। এ পাশ ও পাশ করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেলো। হঠাৎ বোন এসে চুপিচুপি মিয়াভাই বলে ডাকতেই আমি দরজার কাছে চলে গেলাম। তারপর বোন আমাকে তার পিছনে পিছনে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো। বাংলা ঘরের কাছে যেতেই সে থামল। ছোট জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভেতরে দেখার জন্য আমাকে ইশারা করলো। আমি ভেতরের দিকে তাকিয়ে যা দেখলাম তাতে আমি শিহরিত হয়ে গেলাম। আমি এটি দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। দেখলাম আমার বোনজামাই মস্ত তলোয়ার,চাকু,বড় দাসহ বিভিন্ন অস্ত্র বাড়ির পাহারাদারের সাথে বালি দিয়ে ঘষাঘষি করছে। আর বলছে, বেশ হয়েছে। মালামাল আনার সময় ঝামেলা করলে এককোপে কল্লা ফেলে দেবো। এ বলে হুহু করে হাসছে। আমি বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ না করে আমার বিছানায় চলে আসলাম। তখন বোনটি বললো,মিয়াভাই এরা ডাকাত। আমি এখানে থাকবোনা। তখন আমি বললাম, ঠিক আছে। শান্ত থাকো। সকালে নাইওর এর কথা বলে নিয়ে যাবো। তারপর বাজিকে সব বলে একটা ব্যবস্থা করবো। এখন গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কেউ যেনো বুঝতে না পারে আমরা সব জেনে গেছি। বিপরীত হলে আমাদের জীবনও যেতে পারে। বোন মাথা নেড়ে তার ঘরে চলে গেলো। আমি সারারাত সাহস সঞ্চার করলাম। সকালে সবাই যখন খেতে বসলো,আমিও বসলাম। কিন্তু কিছুতেই যেনো গলা দিয়ে খাবার নামছে না। তখন বোনজামাই বললো,মিয়াভাই, কি হয়েছে আপনার? বললাম না কিছুনা। মনটা ভালো না। মায়ের শরীর ভালো নেই। বোনকে কয়দিনের জন্য নিয়ে যেতে বলছিলো। তখন সে বললো,ঠিক আছে। নিয়ে যান, দুএকদিন পরে আমি গিয়ে নিয়ে আসবো। মনে মনে অনেক খুশি হলাম। তারপর কোনোরকম খাওয়া শেষ করে বোনকে নিয়ে রওনা হলাম। বাড়িতে এসে বাজিকে সব বললাম। বাজি সব শুনে কৌশলে বোনের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায়। তারপর কয়েকমাস পর বোনকে অন্য জায়গায় আবার শাদি দেওয়া হয়। ঐদিকে আমার মায়ের পেটের বোনটি মামার বাড়ি এসে আমাকে দেখার জন্য খবর দিলে আমি বোনকে দেখতে গেলাম। বোন আমাকে ধরে অনেক কান্নাকাটি করে। বাজির কথা, ভাইয়ের কথা বলে। আমিও বোনকে এতবছর পরে দেখে কাঁদতে থাকি। ঠিক তখনই আমার পালক পিতা সেখানে হাজির হয়ে বকাবকি করতে থাকে। বলে,এতদিন পর এসে ভাইয়ের মন নষ্ট করছিস কেন? আর কখনো আসবেনা বলে দিলাম। মামার বাড়ি থেকেই চলে যাবে। তারপর আমাকে বললো, এক্ষুনি আমার সাথে আয় দেখি। আর কখনো এদিকে আসবে না। এ কথা বলে সে হনহন করে চলতে লাগলো। এদিকে বোনটি আমার কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। সেই অবস্থায় রেখে আমি পাষাণ হৃদয়ে বাজির পিছনে পিছনে চললাম।
নিলুফা ইসলাম, গল্পকার




