মোহীত উল আলম
কবিদের জীবন অভিমানে ভরা।
কবি নয় যারা, তাদের জীবনও অভিমানে ভরা। তবে এ লেখায় আমি কবিদের অভিমানের কথা বলব, বলব বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের একটি গান এবং নজরুলের একটি গান নিয়ে, যে দু’টি গান আমার বিবেচনায় খুবই অভিমানক্লিষ্ট, এবং যে দু’টি গানের মধ্যে বিষয়ের আঁচ এবং বেদনা প্রায় একই রকমের।
রবীন্দ্রনাথের গানটি তাঁর প্রেম পর্বের, প্রথম চরণটি হচ্ছে: “বিদায় করেছ যারে নয়ন জলে।” ১৮৮৬ সালে লেখা, যখন কবির বয়স মাত্র ২৫, যখন তিনি দার্জিলিং ভ্রমণ করছিলেন। নজরুলের গানটি সম্ভবত নার্গীসের প্রতি অভিমানবশত লেখা, যার প্রথম চরণটি হচ্ছে, Õযারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই, কেন ডাকো আজি তারে।” এই গানটির রচনাকাল ১৯৩৯ সাল, কবির কবিজীবন শেষ হবার বছর দুয়েক আগে। কবির নিজের সুর, সন্তোষ সেনগুপ্তের কণ্ঠে প্রথম রেকর্ডিং এইচ এম ভি, জুলাই ১৯৩৯।
রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের প্রেম ও বিরহের গানগুলির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের গান প্রাণ হরণ করলেও তাদের মধ্যে এমন একটা ধ্রুপদী নৈর্ব্যক্তিকতা আছে যেটি ঠিক শ্রোতার বুকের মাঝারে যে জায়গাটিতে বিরহ নিয়ে রক্ত ঝরে সেখানে একটা মধুর প্রলেপ দিয়ে দেয়। আর একই ধরনের গানে নজরুলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে শ্রোতার হৃদয় থেকে রক্ত ঝরবেই, এতটাই ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে যায় তাঁর গানের শুল। আর রবীন্দ্রনাথের প্রেম-বিরহ পর্বের গানগুলির মধ্যে একটি চলমান ধাঁধা থাকে। ধাঁধাটা হচ্ছে এরকম যে যেমন বাইশ তেইশ বছর যখন আমার বয়স ছিল, যখন আমি একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে দূর থেকে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম, যখন আমি ঐ বাসার মেয়েটির ছোট দু’ভাইকে প্রাইভেট পড়াতাম, তখন প্রত্যেক সন্ধ্যায় ঐ বাসায় হেঁটে যাওয়া আর হেঁটে আসার সময় আমার নিত্য সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথের ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে রচিত “চরণ ধরিতে দিয়ে গো আমারে নিয়ো না নিয়ো না সরায়ে” গানটি। এ গানটি তিনি লিখেছিলেন ১৭ মে, ১৯১৪ সালে রামগড়, হিমালয় অঞ্চলে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ধারণা করছেন যে ১৪ মে ১৯১৪ সাল ছিল কবির পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৯৭তম জন্মবার্ষিকী, এবং সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতির প্রতি নিবেদন করে এই গানটি রচনা করেছিলেন। যা হোক, এই সন্ত উৎস আর আমার প্রেমিক মনে কাজ করেনি, আমি বরঞ্চ সে সময়ে আমার সবচয়ে প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী পঙ্কজ মল্লিকের মতো ‘নাকি’ গলায় গানটি অনুচ্চ স্বরে গাইতে গাইতে যেতাম, আবার গাইতে গাইতে আসতাম। যেন এই গানটির মধ্য দিয়ে আমার প্রেমিকার প্রতি আমার প্রেম আমি সঁপে দিতাম। কিন্তু এখন যখন আমি বয়স ৭১ পার করছি, তখন এ গানটি শুনলে মনে হয় যেন সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিবেদিত একটি সংগীত। ঠিক একই কথা বলা চলে রবীন্দ্রনাথের গান ঋতু গুহের গাওয়া “ও গো কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ, আরো কী তোমার চাই” গানটি। ঐ গানের অন্তরাতে আছে, “আমি আমার ভুবন শূন্য করেছি, তোমার পুরাতে আশ”–যেটা আমার প্রচন্ড প্রেমাসক্ত বয়সে আমি শুধু প্রেমিকাকে উদ্দেশ করে গেয়ে গেছি। গেয়ে গেছি মানে পরিবেশনের অর্থে নয়, নিজের কাছে নিজে গাওয়ার অর্থে। কিন্তু এই গানটিও আমার এখনকার বয়সের পরিপ্রেক্ষিতে নিতান্তই সৃষ্টিকর্তার কাছে বান্দার আকুল আবেদন বলে মনে হয়; যেন বলছি, হে সৃষ্টিকর্তা, তোমার জন্যইতো আমার জীবনের সোনার তরীটি ভারা ভারা ধান কেটে ভরিয়ে দিচ্ছি।
তাই মনে হয় এ কথা বলা সঙ্গত যে রবীন্দ্রনাথের প্রেমের আর বিরহের গান বহুমাত্রিক, কিন্তু নজরুলের একই ধারার গান একান্তই বিরহের পুঁজি নিয়ে গভীর সুরের নাড়াচাড়া। তাই, আমার বিষয় যেহেতু অভিমান, এবং অভিমান কী করে গানের মধ্যে ব্যাকুল সংশ্লেষ তৈরি করে তার ওপর আমার ধারণা দেওয়া, আমি তাই বলতে চাই, রবীন্দ্রনাথের অভিমান রোম্যান্টিক, কিন্তু ধ্রূপদী অর্থে রোম্যান্টিক। “তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা”–প্রেমিকা এবং প্রকৃতি এক হয়ে গেল না! প্রেম এবং প্রকৃতি এক হয়ে সমন্বিত হবার ফলে, এবং রবীন্দ্রনাথের সুরের বাঁধনে ধ্রুপদী লয়ের অপূর্ব সঞ্চরণ থাকাতে, এই গানটি সবারই ভালো লাগবে, কিন্তু কোন প্রেমিক এই গানটি গেয়ে তার প্রেমিকাকে স্মরণ করতে উদ্বেলিত হবে বলে মনে হয় না। কবি শেলী যে অর্থে রক্তপাতের কথা বলেছেন, “আই ফল আপন দ্য থর্নস অব লাইফ, আই ব্লিড,” সে অর্থে রবীন্দ্রনাথের গানের শ্রুতিতে রক্তপাতের কোন ব্যাপার থাকবে না। কিন্তু নজরুলের প্রতিটি প্রেমের গান, যেমন “আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে” ঠিক সে জাতের গান যেটি আমার মতো ব্যর্থ প্রেমিকেরা সবসময় তার না-পাওয়া প্রেমিকাকে নিয়ে ভজতে থাকবে। তাঁর বিরহের গানগুলি শুনলে মনে হয় যেন হৃদয় থেকে রক্ত চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ে।
এতদসত্ত্বেও এখন রবীন্দ্রনাথের যে গানটির উল্লেখ করে আমি আলোচনা শুরু করেছি, সে গানটিতে দেখা যায় পুরোটাই অভিমানের অভিব্যক্তি। এবং এটি রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রথম পর্যায়ের গান বলেই হয়তো, গানটি থিকথিকে অভিমানে ভরা। কবি বলছেন, যাকে নয়নজলে ভাসিয়ে বিদায় করেছো, তাকে আবার কী উছিলায় ফেরাবে! এর ঠিক ৫৩ বছর পরে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে ৩৮ বছরের ছোট কবি নজরুল অনুযোগ করছেন, “যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই / কেন মনে রাখো তারে।” যদিও নার্গীসকে নিয়ে নজরুল জীবনের আখ্যান যতটুকু উৎসাহী গবেষকদের জানা, তাতে এই কথাটাই বারবার আসে যে নজরুলই নার্গীসকে ত্যাগ করে চলে এসেছিলেন বিয়ের রাতে। কিন্তু সেই স্মৃতিটি কালের কপোলতলে বদলে যাবার ফলে অভিমানী কবি নজরুল এই গানে নিজেকেই প্রত্যাখ্যাত বলে দাঁড় করিয়েছেন। অর্থাৎ, এই বিবেচনায় আমাদের পৌঁছানোর সময় নজরুলকে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তাঁর গান বা সাহিত্যকে ব্যাখ্যা করার নব্যইতিহাসবাদী প্রবণতা আমরা এখানে পরিহার করলাম। এই গানে প্রেমিকই প্রেমিকা দ্বারা প্রত্যাখাত, তাই এত ফুঁসে ওঠা অভিমান!
প্রকৃতির সংশ্লেষ রবীন্দ্রনাথে প্রচন্ড। ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় যেমন প্রকৃতিই কবি-মনকে বারবার উসকে দিয়েছে, “মাই হার্ট লিপস আপ / ওয়েন আই বিহোল্ড আ রেইনবো ইন দ্য স্কাই” তেমনি রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “তারে কি পড়েছে মনে বকুলতলে”? অর্থাৎ, বকুলতলায় না গেলে প্রেমিকের প্রেমিকার কথা মনে পড়ত না। আর নজরুলের গানে এই মনে পড়াটাই হচ্ছে বিরাট বিঘ্ন । তিনি প্রায় অনন্যোপায় হয়ে বলছেন, “ভুলে যাও, মোরে ভুলে যাও একেবারে,” কিংবা তিনি যখন নীরবে কান্নার মধ্য দিয়ে তাঁর বেদনাকে সমাহিত করতে চান, তখন কেন প্রেমিকা এসে দাঁড়ায় সম্মুখে, এবং কবি প্রেমিকাকে নিষ্ঠুর কথিত করে ডুকরে কেঁদে উঠছেন বা ক্ষোভে ফুঁসে উঠছেন, “দয়া করো / দয়া করো, আর আমারে লইয়া খেলো না নিঠুর খেলা।” রবীন্দ্রনাথের গানে এই ব্যথাকাতর ওজরটা অনেকটা স্মিত, অনেকটা প্রশমিত, অনেকটা স্নিগ্ধ: “দুটি সোহাগের বাণী / যদি হত কানাকানি / যদি ঐ মালাখানি পরাতে গলে।” চমৎকার প্রকৃতি এবং প্রেমের যুগলবন্দী। শর্ত প্রয়োগ করা হলো এই যে ‘যদি’ সে সময়ে ঠিকমতো “কুসুমদলে” গাঁথা মালাখানি প্রেমিক প্রেমিকার গলায় পরিয়ে দিতো, তাহলে আজকে প্রেমিকাকে ফিরে পাওয়ার এই আকুল যন্ত্রণায় ভুগতে হতো না। রবীন্দ্রনাথের গানে মালাটা দেওয়া হয় নি বলে বিচ্ছেদ, আর নজরুলেও ঠিক তাই, যাকে মালা পরাতে পারো নি, তাকে আবার আজকে ডাকছো কেন? তারপরও রবীন্দ্রনাথের গানের শেষ পর্যায়ে একটি দার্শনিক তত্ত্ব বেরিয়ে আসছে। প্রকৃতি আসলেই নিরপেক্ষ একটি উপাদান। মানুষের জীবনের সঙ্গে এর কোন ঐ অর্থে লেনদেন নেই। যে কোন মানব জীবনের প্রথম দিনেও সূর্য উঠেছিল, তার শেষ দিনেও সূর্য উঠেছিল বা উঠবে, কিন্তু ঘটনাতো আর ফিরে আসে না: “মধুনিশি পূর্ণিমা ফিরে আসে বারবার, / সে জন ফেরে না আর যে গেছে চলে।” এই শাশ্বত দর্শনের বিপরীতে কিন্তু নজরুল অনেকটা ব্যক্তিগত, প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকার সরাসরি ব্যক্তিগত দেওয়া-নেওয়ার ব্যর্থতা থেকে সৃষ্ট একটি জ্বালা, যেটি কবির প্রেমচিত্তে না-পাওয়ার বেদনাকে রূপান্তর করেছে ক্ষোভে, এবং প্রেমিকের মনে বাসা বেঁধেছে প্রেমের জন্য শহীদ বা মার্টার অব লাভ হবার তীব্র মনোবাসনা। আমি যা করি, তাতে তোমার কেন কিছু যায় আসবে? আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু নজরুল জীবনী পাঠ করার সময় আমি কোথায় যেন পড়েছিলাম যে নার্গিস বহু বছর পরে নজরুলকে লন্ডন থেকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, যেটির উত্তর নজরুল কোনদিন দেন নি। এই গানটা শেষ হচ্ছে, প্রেমিকের সেই আপসহীন অবস্থান দিয়ে: “আমি কি ভুলেও কোন দিনও / এসে দাঁড়ায়েছি তব দ্বারে”?
যেখানে নজরুলের গানে অভিমান যেন একটি সামরিক কায়দায় কারণ-এবং-ফলাফলের মধ্যে তীব্র বিযুক্তির কথা সদম্ভে ঘোষণা করছে, সেখানে রবীন্দ্রনাথের গানে যেন একটি ‘যদি’ নিয়ে শর্তাধীন আপসের ইঙ্গিত। একটু “নিমেষের ভুল”-এর জন্য বিচ্ছেদ ঘটলো, এখন প্রেমিক সে বিচ্ছেদের ঘটনার অপনোদন চেয়ে একটি সুযোগ যেন খুঁজছে, একটি “ছল” যেটি দিয়ে কবি বা প্রেমিক তার প্রেমিকাকে হয়তো ফিরে পেতে পারে। শর্তটা হলো, “ছল” পেলে হয়তো ফিরে পাওয়া যাবে, মিলন হয়তো হবে, হবে, “আমি তোমারো সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ” ধরনের কিছু, কিন্তু কবি নজরুলের চেতনায় একবার বিচ্ছেদ হয়ে গেলে আর পুনর্মিলনকে বাস্তবে রূপান্তরিত করা অসম্ভব: “শত কাঁদিলেও ফিরিবে না সেই / শুভ লগনের বেলা।”
এই দুটি গান পারস্পরিক তুলনা করে আমি হয়তো এই কথা বলতে চেয়েছি যে রবীন্দ্রনাথ কাব্য এবং সংগীতচেতনায় ছিলেন মিলনাত্মক, আর নজরুল ছিলেন একান্তই বিয়োগান্তুক।
মোহীত উল আলম, সাবেক উপাচার্য, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়




