এখন সময়:রাত ১:৪৭- আজ: শনিবার-৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:রাত ১:৪৭- আজ: শনিবার
৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

তারা

আজিজুল হক

 

সতেরো দিন ধরে নিউইয়র্কের রচেস্টার জেনারেল হাসপাতালে শুয়ে আছি। ডাক্তার বলেছে সময় বেশি নেই।

আমারও তেমনটাই মনে হচ্ছিল। তবু আমি আরো স্পেসিফিক করে জানতে চাইলাম, কতদিন হতে পারে?

“এই ধরো মাস দুয়েক। যদি ‘মিরাকল’ কিছু না ঘটে” ডাক্তার বললো বাম হাতের কব্জিতে তার লম্বা তিন আঙুলে ভেইন খুঁজতে খুঁজতে। এমনভাবে যেন মিরাকল কিছু সে নিজেও খুঁজছে। তারপর আমার মুখের দিকে বিষন্ন চোখে চেয়ে আরো যোগ করলো, “অনেক সময় বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা মৃত্যু কে বিলম্বিত করে। যদি তোমার ভেতরেও তেমন কিছু থাকে সেক্ষেত্রে ব্যপারটা ভিন্ন রকমও হতে পারে।”

ডাক্তার চলে যাবার পরপর গভীর কুয়শার অন্ধকার ও নীরবতা একসাথে হয়ে একটা কবর যেন আমার ঘরে ঢুকে গেলো। আমি মাথার উপর জ্বলা উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকিয়ে সেই অন্ধকারকে দেখলাম অনেকক্ষণ ধরে। আর ভাবছিলাম ডাক্তারের বলে যাওয়া ‘মিরাকল’ এবং ‘বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছার’ কথা দুটো নিয়ে।

 

মিরাকল আমার এ যাবৎকালের যাপিত জীবনে কখনো ঘটতে দেখিনি। তাই এ নিয়ে আশা করার মতো কিছু অবশিষ্ট নেই।

আর বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা?

তাও তো মরে গেছে বহু আগে। যা আমি ভেতরে ভেতরে অনুভব করছিলাম বহুদিন থেকে। মানুষ তার মৃত্যু দেখতে না পেলেও মরে যাওয়াটা অনুভব করতে পারে।

হতাশা নিয়েই আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম। এমন কেউ বা কিছু কে, যার জন্য বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা আবার প্রবলভাবে জেগে উঠতে পারে। ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, কুইন্স এর বিশাল বাড়ি আরও ভাববার মতো  যা যা বিষয় ছিলো তার সবকিছু। গভীরভাবে। তন্নতন্ন করে।

না, কোথাও তেমন কিছু পেলাম না। যা বেঁচে থাকার জন্য আমার প্রবল প্রেরণা হয়ে কাজ করতে পারে। একটা দীর্ঘশ্বাস উদ্দেশ্যহীনভাবেই বুক খালি করে বের হয়ে সর্বত্র ঘোলাটে করে দিলো।

পেছনের সবকিছু দূরের তারার যেন। বহুদিনের পুরোনো আলো কতোটাই বা আর উত্তাপ দিতে পারে! সবই বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন।

মনে পড়লো সেই ছোটবেলা। সেই খোয়াইছড়ি গ্রাম। তিরতির ঝর্নার রিনিঝিনি জল। সাদা বকের গলার মতো বাঁকানো নারকেল গাছ। যার নীচে মার্বেল গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা হতো প্রতিদিন। সেই সুবল, হাসান, রমিজ, সেতারা আর রেনু বালার কথা। কেউ আর ওখানে নেই। কোথায় আছে তাও জানা নেই। কেবল স্মৃতি আছে। বুকের ভেতর আর ওইসব স্থানে। লাল ইটের নীচে।

বুকটা কেমন যেনো মোচড়ে উঠলো।

আহা, একবার যদি যাওয়া যেতো!

 

দেখতে দেখতে পার হয়ে গেছে আরো এক মাস। ছেলেমেয়েরা এসে একবার দেখা করে গেছে। আবার দেখা হবে বলে মনে হয় না। শরীরের অবস্থার অবনতি হচ্ছে দ্রুত। যেভাবে হবার কথা ছিল তার চেয়ে বেশিই দ্রুততার সাথে। ডাক্তার কে কাছে পেয়ে আবার জিগ্যেস করলাম, আর কতদিন?

ডাক্তার চুপ করে আছে। সম্ভবত তার বলার মতো এমন কিছু ছিলো না যা আমাকে আশ্বস্ত করতে পারে।

আমি বেশিক্ষণ জবাবের অপেক্ষা অপেক্ষা করে জিগ্যেস করলাম, ডেড বডি নিয়ে তোমার কাছে কী কোন নির্দেশনা আছে?

এবার সে মুখ খুললো। আমার চোখের দিকে স্পষ্টভাবে তাকিয়ে থেকে বললো, হ্যাঁ। ওটা তোমার দেশে পাঠানোর জন্য বলা আছে। প্রয়োজনীয় অর্থও দেয়া আছে। অবশ্য যদি তুমি ভিন্ন কিছু চাও সেটাও করা যাবে।

কথাগুলো আত্মস্থ করতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে অনুরোধের সুরে বললাম, তুমি কী দয়া করে আমাকে আগে আগেই পাঠিয়ে দিতে পারবে?

আমার কথা শুনে ডাক্তার অবাক হয়েছে বলে মনে হলো। তবুও দৃঢ় কন্ঠে বললো, তোমার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। এ অবস্থায় মুভ করা অসম্ভব।

“তাহলে বাক্সে ভরে পাঠাও। অন্তত শেষ নিঃশ্বাসটুকু যেনো নিজের মাটিতে ফেলতে পারি” আমি বললাম, তার মাছের মতো মৃত চোখের দিকে তাকিয়ে।

ডাক্তার চোখ কপালে তুললো। তারপর আবার নামাল ধীরে ধীরে। মুখে শুষ্ক হাসি আনার বৃথা চেষ্টা করে বললো, যে নিঃশ্বাস তুমি ফেলছ প্রতিমুহূর্ত, প্রকৃত অর্থে সেটাই তোমার শেষ নিশ্বাস। আমারও। চাইলেই তুমি একই নিঃশ্বাস দ্বিতীয়বার ফেলতে পারবে না।

আমি হতাশ হলাম। জিগ্যেস করলাম, আমার ছেলেমেয়েরা কী আবার আমাকে দেখতে আসবে বলে তোমার মনে হয়, মানে আমি বেঁচে থাকতে থাকতে?

এবারও ডাক্তার উত্তর দিল না। বললো, তুমি চাইলে আমি তোমার ইচ্ছার কথা ওদের জানতে পারি।

“ধন্যবাদ, তার আর দরকার আছে বলে মনে হয় না। তুমি বরং আমাকে একটা অষুধ দাও যাতে আমার চিন্তাশক্তিটা আমার আগে আগে চলে যায়। আমি যেনো একটু শান্তিতে যেতে পারি” আমি বললাম।

 

ডাক্তার মনিটরে চোখ স্থির রেখে বললো, তুমি বরং দূরের একটা তারার কথা ভাবতে পার। মনে মনে। যে তারাটা উজ্জ্বল। আকাশে তাকিয়ে তুমি তাকে দেখছো। সে—ও তোমাকে দেখছে। একে অন্যের সাথে কথা বলছো। তুমি ভালো বোধ করবে।

ডাক্তারের কথামতো আমি চোখ বন্ধ করলাম। রাতের আকাশে দূরের এক তারার কথা ভাবতে চেষ্টা করলাম। তার আগে ডাক্তারকে বললাম, উজ্জ্বল আলোয় রাতের তারার কথা ভাবা যায় না। তুমি বরং রুমের সবগুলো বাতি নিভিয়ে দিয়ে দাও।

ডাক্তার বাতি নিভিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর ধীর পায়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

আমি মনে মনে একটি উজ্জ্বল তারাকে খুঁজে নিলাম। আমরা দুজন দুজনকে মিটিমিটি চোখে দেখছি। আমি তাকে দুচোখ দিয়ে দেখছি সে এক চোখে। দুঃখবোধ হলে মানুষের মতো তারার দুই চোখ নেই বলে। একটা সূক্ষ্মকোণী ত্রিভুজ হয়ে আমরা একে অন্যের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। খুব কাছাকাছি থেকে। ভোরের আলো ফোটার আগ পর্যন্ত।

 

আজিজুল হক

পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (অব.)

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাহিত্য-গবেষণার আলোকবর্তিকা

শাহেদ কায়েস   আহমদ রফিক (জন্ম: ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-মৃত্যু: ২ অক্টোবর ২০২৫) বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুবনে আহমদ রফিক একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে

অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

আন্দরকিল্লা ডেক্স \ চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের আত্মজীবনী ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

ফেরা

সৈয়দা মাসুদা বনি   নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন   রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু! মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে

চিরহরিৎ বৃক্ষের গল্প

সুজন বড়ুয়া   ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়।