এখন সময়:রাত ১:০৬- আজ: শনিবার-৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:রাত ১:০৬- আজ: শনিবার
৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২৩শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

বাঁশি: চিরন্তন বাংলার গৌরব ও ঐতিহ্যের নিজস্ব সুর-পঞ্চম পর্ব

নাজমুল টিটো :

 

রবীন্দ্রনাথের বাঁশি

 

(১৭১)     “কহিলাম, ‘ওগো রানী,

সাগরপারের নিকুঞ্জ হতে এনেছি বাঁশরিখানি।

উতারো ঘোমটা তব,

বারেক তোমার কালো নয়নের

আলোখানি দেখে লব।’

[ইটালিয়া, পূরবী]

 

# লেখন (১৯২৭) রবীন্দ্রনাথের কণিকা’র মতই আরেকটি অনু কাব্য। কণিকা’র কবিতায় শিরোনাম থাকলেও ‘লেখন’এ গ্রন্থভুক্ত ১৮৯টি অনু কবিতা শিরোনামহীন। তন্মধ্যে ১টি কবিতা ১২ চরণে,১টি কবিতা ০৮ চরণে,৩টি কবিতা ০৬ চরণে,৪টি কবিতা ০৫ চরণে বাকি সবগুলি ০২ ও ০৪ চরণে রচিত। তবে প্রতিটি স্তবকের সংখ্যা নির্ণায়ক আছে। এই ক্ষুদ্রাকৃতি কবিতাগুলোর অন্তর্নিহিত ভাব এতই গভীর যে এগুলোকে অনেকে প্রবাদ বাক্যের মত ব্যবহার করেন। ৭০ সংখ্যক কবিতায় মাত্র দুই চরণে কবি বাঁশি নিয়ে অসাধারণ এক পদ সৃজন করেছেন। যা সত্যিই তাত্ত্বিক ও নান্দনিক।

 

(১৭২) “গুণীর লাগিয়া বাঁশি চাহে পথপানে,

বাঁশির লাগিয়া গুণী ফিরিছে সন্ধানে।।”

[লেখন-৭০]

 

# মহুয়া (১৯২৯) কবির পরিণত বয়সে লেখা অসাধারণ এক প্রেমের কাব্য। তবে এটিযে কোন আকস্মিক রচনা নয় কবি নিজেই সাবধান করে দিয়েছেন। পূরবীতে যে প্রেমানুভূতির উদ্বোধন হয়েছে তারই পূর্ণবিকাশ আমরা লক্ষ্য করি মহুয়াতে। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ মনে করেন “জীবনের শেষ বসন্তে চেতনার আকাশে যে স্বর্ণ আলোর মধু ছডেিয় দিয়েছে, কবিচিত্তে যে অনাসক্ত প্রেমের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছে তারই সার্থক প্রকাশ মহুয়ার প্রেম বিষয়ক কবিতাগুলিতে।” আর এমনই প্রেম-সর্বস্ব কবিতা ও সঙ্গীত সৃজনে কবি বাঁশিতে তুলেছেন নিত্যনতুন প্রেমময় সুর।

 

 

(১৭৩) “পথপাশে মল্লিকা দাঁড়ালো আসি,

বাতাসে সুগন্ধের বাজালো বাঁশি।

ধরার স্বয়ম্বরে

উদার আড়ম্বরে

আসে বর অম্বরে ছড়ায়ে হাসি।”

[বরযাত্রা মহুয়া]

 

(১৭৪) “নীরব হাসির সোনার বাঁশির ধ্বনি

করবে ঘোষণ প্রেমের উদ্বোধনী,

প্রাণদেবতার মন্দিরদ্বার

যাক রে খুলে,

অঙ্গ আমার অর্ঘ্যের থাল

অরূপ ফুলে।”

[অর্ঘ্য, মহুয়া]

 

 

(১৭৫) “তব কুঞ্জের পথ দিয়ে যেতে যেতে

বাতাসে বাতাসে ব্যথা দিই মোর পেতে,

বাঁশি কী আশায় ভাষা দেয় আকাশেতে

সে কি কেহ নাহি বোঝে।”

[সন্ধান, মহুয়া]

(১৭৬)

“সন্ধ্যাতারা উঠিল যবে গিরিশিখর-‘পরে

একেলা ছিলে ঘরে।

কটিতে ছিল নীল দুকূল, মালতীমালা মাথে,

কাঁকন দুটি ছিল দুখানি হাতে।

চলিতে পথে বাজায়ে দিনু বাঁশি,

‘অতিথি আমি’, কহিনু দ্বারে আসি।”

[সাগরিকা, মহুয়া]

(১৭৭)

“মধ্যাহ্নের স্থলপদ্ম অমলিন রাগে

প্রফুল্ল সে সূর্যের সোহাগে,

সায়াহ্নের জুঁই সে-যে,

গন্ধে যার প্রদোষের শূন্যতায় বাঁশি ওঠে বেজে

মৈত্রীসুধাময় চোখে

মাধুরী মিশায়ে দেয় সন্ধ্যাদীপালোকে।”

[নাম্নী- মালিনী, মহুয়া]

 

(১৭৮) “উৎসবের বাঁশিখানি কেন-যে কে জানে

ভরেছে দিনান্তবেলা ম্লান মুলতানে,

তোমারে পরালো সাজ মিলি সখীদল

গোপনে মুছিয়া চক্ষুজল।”

[নববধূ, মহুয়া]

(১৭৯)

“ছেড়েছে সকল কাজ, রঙিন বসনে ওরা সেজে চলেছে প্রান্তর বেয়ে, পথে পথে বাঁশি চলে বেজে, পুরানো সংসার হতে জীর্ণতার সব চিহ্ন মেজে

রচিল নবীন আচ্ছাদন।

Í————————————————–

বাজা তোরা বাজা বাঁশি, মৃদঙ্গ উঠুক তালে মেতে

দুরন্ত নাচের নেশা পাওয়া।

 

নদীপ্রান্তে তরুগুলি ওই দেখ আছে কান পেতে,

ওই সূর্য চাহে শেষ চাওয়া।”

[মিলন, মহুয়া]

(১৮০)

“দূরে গিয়েছিলে চলি, বসন্তের আনন্দভা-ার তখনো হয় নি নিঃস্ব; আমার বরণপুষ্পহার

তখনো অম্লান ছিল ললাটে তোমার। হে অধীর,

কোন্ অলিখিত লিপি দক্ষিণের উদ্ভ্রান্ত সমীর

এনেছিল চিত্তে তব। তুমি গেলে বাঁশি লয়ে হাতে, ফিরে দেখ নাই চেয়ে আমি বসে আপন বীণাতে বাঁধিতেছিলাম সুর গুঞ্জরিয়া বসন্তপঞ্চমে,

আমার অঙ্গনতলে আলো আর ছায়ার সংগমে

Í————————————————–

আজি বাজিবে না বাঁশি,

জ্বলিবে না প্রদীপের মালা

পরিব না রক্তাম্বর;

আজিকার উৎসব নিরালা।”

[প্রত্যাগত, মহুয়া ]

 

(১৮১)          “তুমি হাসি

মোর হাতে দিলে তব বিরহের বাঁশি।

তার পরদিন হতে

বসন্তে শরতে

আকাশে বাতাসে উঠে খেদ,

কেঁদে কেঁদে ফিরে বিশ্বে

বাঁশি আর গানের বিচ্ছেদ।”

[বিচ্ছেদ, মহুয়া]

 

(১৮২)        “যে চায় তাহারে ভোলে

তবুও নিজেরে ছলিতে ছলিতে

বাঁশি বাজে মনে চলিতে চলিতে,

‘ভুলিব না কভু’ বিভাসে ললিতে

এই কথা বুকে দোলে।”

[বিদায়সম্বল, মহুয়া]

 

(১৮৩) “শুনি যেন কাননশাখায়

বেলাশেষের বাজায় বেণু;

মাখিয়ে নে আজ পাখায় পাখায়

স্মরণভরা গন্ধরেণু।”

[শেষ মধু, মহুয়া]

 

# বনবাণী (১৯৩১) উদ্ভিদরাজ্য, নিসর্গ জগতের প্রশস্তি কাব্য। এটি রবি ঠাকুরের মানবজীবন ও প্রকৃতি প্রেমের এক অনবদ্য কাব্যগ্রন্থ।

‘যদিদং কিঞ্চ জগৎ প্রাণ এজতি নিঃসৃতম’ অর্থাৎ

‘এই যা কিছু জগত যা কিছু চলছে তা প্রাণ থেকে নিঃসৃত হয়ে প্রাণেই কম্পমান’ কবি নিজেই বলেছেন “ছেলেবেলা থেকেই তিনি এই ঋষিবাক্যের সঙ্গে পরিচিত, পরে কল্পনাবৃত্তির সাহায্যে তিনি প্রকৃতির এই প্রাণের স্পন্দন অন্তঃকর্ণে শুনেছেন, নিজের মধ্যে গভীরভাবে বিশুদ্ধভাবে বনের বাণীকে অনুভব করার আনন্দই ‘বনবাণী’ কাব্যের বিভিন্ন কবিতায় প্রকাশ করেছেন।” সেই উচ্ছ্বাস প্রকাশে কবি প্রাণের বাঁশি নিঃসৃত সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিতার পদে পদে ।

(১৮৪)

“তব প্রাণে প্রাণবান,

তব স্নেহচ্ছায়ায় শীতল, তব তেজে তেজীয়ান, সজ্জিত তোমার মাল্যে যে মানব, তারি দূত হয়ে ওগো মানবের বন্ধু, আজি এই কাব্য-অর্ঘ্য ল’য়ে শ্যামের বাঁশির তানে মুগ্ধ কবি আমি

অর্পিলাম তোমায় প্রণামী।”

[বৃক্ষবন্দনা, বনবাণী]

(১৮৫)

“আপন দানের পুণ্যে স্বর্গ তার রহিল না দূর,      সূর্যের সংগীতে মেশে মৃত্তিকার মুরলীর সুর।”

[দেবদারু, বনবাণী]

(১৮৬)

“তব পথচ্ছায়া বাহি বাঁশরিতে যে বাজালো আজি

মর্মে তব অশ্র”ত রাগিণী,

ওগো আম্রবন,

তারি স্পর্শে রহি রহি আমারও হৃদয় উঠে বাজি-

চিনি তারে কিংবা নাহি চিনি,

কে জানে কেমন!”

[আম্রবন, বনবাণী]

 

(১৮৭)     “আমি আজ কোথা আছি,

প্রবাসে অতিথিশালা-মাঝে।

তব নীললাবণ্যের বংশীধ্বনি দূর শূন্যে বাজে।”

[নীলমণি লতা, বনবাণী]

 

(১৮৮) “তোমার কুটিরের

সমুখবাটে

পল্লিরমণীরা

চলেছে হাটে।

উড়েছে রাঙা ধূলি,

উঠেছে হাসি-

উদাসী বিবাগীর

চলার বাঁশি

আঁধারে আলোকেতে

সকালে সাঁঝে

পথের বাতাসের

বুকেতে বাজে।”

[কুটিরবাসী, বনবাণী]

 

(১৮৯)“হে পবন কর নাই গৌণ,

আষাঢ়ে বেজেছে তব বংশী।

তাপিত নিকুঞ্জের মৌন

নিশ্বাসে দিলে তুমি ধ্বংসি।”

[বৃক্ষেরোপণ উৎসব- মরুৎ, বনবাণী]

 

# অতীত দুঃখের স্মৃতিচারণা, বাহ্যিক বস্তুর প্রতি আসক্তি-নিরাসক্তির দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বিষয় পরিশেষ (১৯৩২) কাব্যেও বর্তমান। কবি তখন সত্তর বৎসর পার হয়ে একাত্তরে পা দিয়েছেন। এই সময় শ্রী দিলীপকুমার রায়কে লেখা এক পত্রে কবি লিখেছেন- “বয়স সত্তর হ’লো-আমার পরিচয়ের কোঠায় অনুমানের জায়গা প্রায় বাকি নেই”-

এ কথার উপর ভিত্তি করে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ সুখেন্দুসুন্দর গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর গবেষণায় যে মতামত প্রতিষ্ঠিত  করেছেন তার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা হলো:-

“সুতরাং গানের পালা শেষ করে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কবি মনে মনে অনুভব করেছেন-‘পরিশেষ’ কাব্যগ্রন্থে। তাঁর কাব্যসৃষ্টির পালা শেষ হবে এই রকম অনুমান করে কাব্যগ্রন্থের নামকরণে তার আভাস দিয়েছেন। অবশ্য এর আগেও আমরা কবিকে বারবার তাঁর কবি জীবনের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করতে শুনেছি ‘সোনার তরী’, ‘কল্পনা’, ‘গীতালি’ প্রভৃতি অনেকগুলি কাব্যই বাণীর বরপুত্রটি বীণাপাণির কাছ থেকে বিদায় নিতে চেয়েছেন কিন্তু প্রতিবারই তাঁকে শেষের পর আবার শুরু করতে হয়েছে-জীবনদেবতার অমোঘ নির্দেশে কবিকে আবার সাহিত্যসৃষ্টির দুরূহ কর্তব্যভার কাঁধে তুলে নিতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে সাতের দশকে পা দিয়ে কবি যেন সত্য সত্যই অনুভব করেছেন তাঁর কবি জীবনের এইবার যথার্থ পরিসমাপ্তি ঘটবে- হয়তো ব্যক্তি জীবনেরও, তাই পরিশেষ-ঞযব ঊহফ বলে যে কাব্যের শুরু হল তার সূচনাতেই লিখেছেন।

 

 

নাজমুল টিটো, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাহিত্য-গবেষণার আলোকবর্তিকা

শাহেদ কায়েস   আহমদ রফিক (জন্ম: ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-মৃত্যু: ২ অক্টোবর ২০২৫) বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুবনে আহমদ রফিক একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে

অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

আন্দরকিল্লা ডেক্স \ চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের আত্মজীবনী ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

ফেরা

সৈয়দা মাসুদা বনি   নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন   রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু! মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে

চিরহরিৎ বৃক্ষের গল্প

সুজন বড়ুয়া   ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়।