হানিফ ওয়াহিদ
দক্ষিণ এশিয়ার কোনো একটা দেশের (ভারত নয়) স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কয়েকদিন যাবৎ বুক ব্যথা করছে।
তিনি ঠিক মতো অফিস করতে পারছেন না। অফিসে বসেই তিনি কোঁৎ কোঁৎ শব্দ করেন! বুক ব্যথায় যে কেউ কোঁৎ কোঁৎ শব্দ করতে পারে, এটা কারও জানা ছিল না। তবে শব্দটা সব সময় হয় না, মাঝে মাঝে হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার ব্যাক্তিগত ডাক্তারকে ডেকে পাঠালেন। ডাক্তার এসে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করা শুরু করলেন, একবস্তা ফাইল বানালেন, কোন রোগ বের করতে পারলেন না।
মন্ত্রী বলে কথা!
দেশের সমস্ত বড়ো বড়ো ডাক্তারদের সমন্বয়ে বোর্ড মিটিং বসেছে। কী করে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কোঁৎ কোঁৎ শব্দ বন্ধ করা যায়!
বোর্ড প্রধান স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বললেন, স্যার, আপনার উচিত ইমিডিয়েট বিদেশে চলে যাওয়া। আপনার হার্ট বোধহয় নষ্ট হয়ে গেছে!
স্বাস্থ্যমন্ত্রী রেগে গিয়ে বললেন, কী বলছেন এইসব? আমি এখনো আমার বউকে ভালোবাসি। হার্ট নষ্ট হলে বউকে ভালোবাসতে পারতাম? ভালোবাসা যে হার্টে থাকে এইটা আপনারা জানেন না? কোন চুলের ডাক্তার হইছেন? তাছাড়া আমাদের দেশের চিকিৎসা সেবা তো আন্তর্জাতিক মানের। পিরোজপুর থেকেও আমাদের চিকিৎসাসেবা উন্নত। আমি এই দেশের একজন মহান নেতা। আমি কেন বিদেশে যাবো?
স্বাস্থ্যসচিব মন্ত্রীর কানে কানে বললেন, স্যার, ওটা পিরোজপুর হবে না, সিঙ্গাপুর হবে। পিরোজপুর তো স্যার বাংলাদেশের একটা জেলার নাম!
স্বাস্থ্যমন্ত্রী চিৎকার করে বললেন, পিরোজপুর হউক আর সিঙ্গাপুর হউক, আমি বিদেশে চিকিৎসা করাবো না। আমি দেশপ্রেমিক নেতা। মরলে দেশের মাটিতেই মরবো। কী করতে হবে বলেন!
স্বাস্থ্যসচিব বললেন, স্যার, বুকের এক্স রে করা লাগবে। কিন্তু আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলোর বেশির ভাগ এক্স রে মেশিন তো নষ্ট!
এক্স রে মেশিন খালি নষ্ট হয় কেন? কী করেন আপনারা?
সরকারি হাসপাতালের এক্স রে মেশিন নষ্ট হলেই ডাক্তারদের লাভ। তারা তখন বাইরে রোগী পাঠিয়ে ভালো টু-পাইস কামাতে পারে। এটা তো আর মন্ত্রীকে বলা যায় না, তাই তিনি বললেন, স্যার, আমরা আসলে মেইড ইন চায়না নামের যে মেশিনগুলো কিনি, ওগুলো মেইড ইন জিন্জিরা। আসমানে এবং জমিনে এমন কোন জিনিস পয়দা হয় নাই, যার নকল বাংলাদেশের জিন্জিরায় পাওয়া যায় না। ব্যাটারা উপরে চায়না লিখে ভিতরে জিন্জিরার রদ্দি মাল গছিযে দেয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ধমকের সুরে বললেন, যেভাবে হউক, এক্স রে মেশিন ঠিক করেন। আমি সরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসা করাবো। প্রয়োজন হলে বাংলাদেশের ধোলাই খাল হতে পার্টস নিয়ে আসেন। শুনেছি ওখানে পুরাতন ভালো ভালো পার্টস পাওয়া যায়। ইমিডিয়েট এক্স রে করানোর ব্যবস্থা করেন। যদি ধোলাই খাল না পান,তবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ‘জবাই দেন’ এর সাথে যোগাযোগ করেন। শুনছি এবারের নির্বাচনে উনি জয়লাভ করেছেন!
স্যার, ঠিকই শুনেছেন,তবে উনার নাম জবাই দেন নয়, জো বাইডেন!
ঐ হলো আর কি! তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করেন। ও মাই গড! এতো আধুনিক দেশ আমাদের,আমাদের দেশ ‘সিঙ্গারাপুর ‘ থেকেও উন্নত, অথচ এক্স রে মেশিন নাই! এইটা একটা কথা! আজই সবার চাকরি নট করবো-
সব ডাক্তার মন্ত্রীর এক্স রে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো। দেশের সব চিকিৎসা সেবা এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ রইল। মন্ত্রীর চিকিৎসা বলে কথা!
এক সপ্তাহ পর আবার বোর্ড মিটিং বসেছে। স্বাস্হ্যমন্ত্রী বললেন, খবর কী? এক্স রে মেশিন কি ঠিক হয়েছে?
স্বাস্থ্যসচিব বললেন, আমরা এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিক নির্দেশনা চেয়েছি। ফাইল চালাচালি হচ্ছে স্যার।মাস খানেকের মধ্যে সমাধান এসে যাবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোঁৎ করে শব্দ করে বললেন, এক মাসের মধ্যে মেশিনের সমাধান আসবে? ততদিন কি আমি বাঁচবো বলে মনে হয়?
বোর্ড মিটিং প্রধান বললেন, আমাদের কিছুই করার নাই, স্যার। এটাই এই দেশের সিস্টেম। আমরা দোয়া দুরুদ পড়ছি স্যার, আপনিও পড়ুন। আপনার পরিচিত কোন পীর ফকির থাকলে পানি পড়া এনেও খেতে পারেন। কোন মাদ্রাসায় গিয়ে কোরান মজিদ খতম করাতেও পারেন।
অনেক দেন দরবার করে এক্স রে মেশিন ঠিক করা হয়েছে। মন্ত্রীর বুক এক্স-রে করা হয়েছে।
আবার বোর্ড মিটিং বসেছে। বোর্ড প্রধান বললেন, একটা সমস্যা ধরা পড়েছে, স্যার।
মন্ত্রী অবাক হয়ে বললেন, কেন? কী হয়েছে?
তেমন কিছু না, স্যার। আপনার এক্স রে রিপোর্টে তেলাপোকা পাওয়া গেছে। আপনার বুকে তেলাপোকা দৌড়াদৌড়ি করছে,এজন্যই আপনার মুখ দিয়ে কোঁৎ কোঁৎ শব্দ হয়।
অসম্ভব! মন্ত্রী চিৎকার করে বললেন। আমার বুকে তেলাপোকা থাকতে পারে না। তেলাপোকা দেখলেই আমার বউ অজ্ঞান হয়ে যায়। আমার বুকে তেলাপোকা থাকলে বউ অজ্ঞান হয় না কেন?
সত্যি বলছি স্যার। আপনার বুকে তেলাপোকা দৌড়াদৌড়ি করছে। টিকটিক টিকটিক আওয়াজ করে।
মন্ত্রী অসহায় গলায় বললেন, ওরে আল্লাহ রে! তেলাপোকা টিকটিক আওয়াজ করে? ব্যাটা গাধার গাধা!
সচিব বললেন, স্যার অন্য দেশের তেলাপোকা টিকটিক আওয়াজ করে না, আপনার বুকে কেন করছে বুঝতে পারছি না। এই নিয়ে গবেষণা চালাতে হবে। তবে এই গবেষণার ফল পেতে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে। এই তেলাপোকা আপনার হার্ট খেয়ে ফেলছে। তেলাপোকা মেরে ফেললেই আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। সমস্যা হচ্ছে, এই তেলাপোকা কীভাবে মারতে হয়, আমরা জানি না। আমরা মনে করছি, কোন পীর ফকিরের পানি পড়া খেলেই কাজ হয়ে যাবে। আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই রোগের চিকিৎসার কথা জানা নাই স্যার। রোগটা একেবারে নতুন! এমন জটিল রোগের কথা পৃথিবীর মানুষ আগে কখনো শুনে নাই।
তেলাপোকার কথা শুনে মন্ত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চোখেমুখে পানি দেওয়ার পর তার জ্ঞান ফিরলো। তিনি আকুল গলায় বললেন, আমার কী বাঁচার কোন আশা নাই?
স্বাস্থ্য সচিব কাঁচুমাচু মুখে বললেন, এই তেলাপোকা রোগের চিকিৎসা এখনো বের হয় নাই স্যার। তবে চিন্তা করবেন না, বিজ্ঞানীরা একদিন ঠিকই এর চিকিৎসা বের করে ফেলবে,তবে ততদিন আপনি বেঁচে থাকবেন কিনা তা বুঝতে পারছি না!
স্বাস্থ্যমন্ত্রী অসহায় ভঙ্গিতে চিৎকার করে বললেন, আমাদের চিকিৎসা সেবা আন্তর্জাতিক মানের। যেভাবেই হউক একটা বুদ্ধি বের করেন। নইলে সবার চাকরি নট!
মন্ত্রীর ব্যাক্তিগত ডাক্তার মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন, একটা চিকিৎসা আছে স্যার, এটা প্রয়োগ করলে নিশ্চিত তেলাপোকা মারা পড়বে!
মন্ত্রী চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বললেন, এতক্ষণ বলেন নাই কেন? কোন ঘোড়ার আন্ডা ভাজছিলেন? এক্ষুনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। এই চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে একটা ফিচার লিখে আন্তর্জাতিক জার্নালে পাঠিয়ে দেন। বিশ্ববাসীর উপকার হউক। পদ্ধতিটা কী?
কিছু না স্যার,আপনাকে বিষ খেতে হবে। বিষ খেলে আমি নিশ্চিত তেলাপোকা মারা পড়বে, তবে আপনি বেঁচে থাকবেন কিনা তা বুঝতে পারছি না!
মন্ত্রী আবার ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ কোঁৎ কোঁৎ শব্দ করলেন। কোঁৎ কোঁৎ করতে করতেই বললেন, আমাদের চিকিৎসা সেবা আন্তর্জাতিক মানের হলেও আমাদের দেশের বিষ আন্তর্জাতিক মানের না। বাজারের বেশির ভাগ বিষ নকল। আমি নাও মরতে পারি। ছাত্র জীবনে একবার আমার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমি বিষ খেয়েছিলাম। মরি নাই। বিষ খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
স্বাস্থ্যের ডিজি বললেন,সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি লাগবে, স্যার। যেহেতু আপনি মন্ত্রী পরিষদে আছেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া আপনার বিষ খাওয়া উচিত হবে না।
মন্ত্রী বললেন, আপনাদের কারও বিষ খাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে? আমি সারাজীবন করে এসেছি আলু পটলের ব্যবসা, বিষ খাওয়ার ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা কম। তারপরও একবার খেয়ে দেখেছি। আপনারা খেয়েছেন? আছে কারও অভিজ্ঞতা?
লজ্জিত মুখে সবাই স্বীকার করলো, এর আগে বিষ খাওয়ার অভিজ্ঞতা কারও নাই। তবে অভিজ্ঞতার দরকার ছিল!
এক সপ্তাহ পর মন্ত্রী পরিষদের মিটিং বসেছে। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর বিষয়টা জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই উপমহাদেশের সেরা হার্ট বিশেষজ্ঞ হচ্ছেন ভারতের দেবী শেঠি। তার সাথে যোগাযোগ করা উচিত।
প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে একশো এক সদস্য বিশিষ্ট কমিটির দল ভারত গেল দেবীশেঠির পরামর্শ নিতে!
সব শুনে দেবীশেঠি বললেন, আমি নিজ চোখে রোগী দেখতে চাই।
বিশেষ বিমানে করে সেই দেশে দেবী শেঠিকে উড়িয়ে নেওয়া হলো।
দেবীশেঠি এসে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাগজপত্র সব দেখলেন, এক্স রে রিপোর্ট দেখে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তারপর স্বাস্থ্য মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মাননীয় মন্ত্রী, আপনার দেশ কাগজে কলমে সিঙ্গাপুর থেকে উন্নত হলেও বাস্তবে বাঙ্গিপুর থেকেও পিছিয়ে আছে।
দেবি শেঠির কথা শুনে মন্ত্রী মুখ কালো করে ফেললেন। তার কথাটা পছন্দ হয় নাই। কিন্তু কী আর করা! ব্যাটা তার তেলাপোকার চিকিৎসা করতে এসেছে বলে কিছু বলা গেল না। নইলে তিনি দেখিয়ে দিতেন, তারা দেশকে কোথায নিয়ে গেছেন।
দেবি শেঠি মন্ত্রীর মনোভাব বুঝেও পাত্তা না দিয়ে বললেন, আসলে আপনার কিছু হয় নাই। আপনার বুকের ব্যথাটা হচ্ছে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা। কয়েকদিন গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। আর, আপনার বুকে তেলাপোকা দৌড়াদৌড়ি করছে না, এক্স রে করার সময় ওটা এক্স রে মেশিনের উপর দৌড়াদৌড়ি করেছিল!
স্বাস্থ্য মন্ত্রী তার দেশের ডাক্তারদের ডেকে বললেন, আমি না হয় আলু পটলের ব্যবসায়ী। আপনারা? আপনাদের সবার চাকরি নট করা হলো।
ডাক্তার সাহেবরা মন্ত্রীর কথায় গ্রাহ্য করে না। মুখ টিপে হাসে। তারা জানে, তারা নট হলে তার আগে মন্ত্রী নিজেই নট হয়ে যাবে।
সচিব সাহেব মাথা চুলকায় আর ভাবে, দেবি শেঠি এইটা কী বলল? শালার এই বাঙ্গিপুরটা কই?
বাংলাদেশের বরিশাল নয় তো? ওখানে তো শুনেছি ভালো বাঙ্গী ভালো চাষ হয়।
হানিফ ওয়াহিদ, রম্য লেখক




