দীপক বড়ুয়া
প্রাচুর্য মানুষকে অমানুষ করে। প্রতিটি মানুষের বেলায় আবার সেটা প্রযোজ্য নয়।
দেবনাথ সরকার আধুনিক যুগের। হলেইবা কি? সেই ছোটবেলা থেকে তার ছিলো দুঃখি মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। ইশকুল, কলেজে যাবার টাকা গরীবদের দান করতো। কেউ চাইলো, আমার শার্ট নেই। সহজে খুলে দিতো। তার চিন্তামননে শুধু দান করা। সে আজ অনেক বড়ো হয়েছে।
সংসারে মা- বাবা এক বোন আছে। প্রিয়াংকা ডাক্তারি পড়ছে সরকারি কলেজে। দেবনাথ সরকারি বড়ো চাকুরে। ভালো মাইনে পায়। উপরি টাকাও আসে। সংসারে অভাব কি? কেউ জানে না।
দেবনাথের টাকার পাহাড়।
অভিলাষ দেবনাথের বাবা। ঐ টাকার পাহাড় দেখে বাবার ভয় হয়। দেবনাথ টাকা ব্যাংকে রাখে না। সম্পত্তি কেনে না। পোস্ট অফিসে সঞ্চয়পত্রও কেনে না। রাখে ঘরে। এখানে, ওখানে। ঘরে ডাকাতি হতে পারে, সেই ভয়ও করে না।
মা- বাবা এত বলার পরে দেবনাথ বিয়ে করে না। তার একটি কথা, বিয়ে করা মানে একজনের শাসনে আবদ্ধ হওয়া। সেটা আমি পারবো না। মা- বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে। ঐ বিয়ে বিষয় বিষয় ছাড়া বাবার সব কথা শোনে।
প্রিয়াংকা তার আরেকটি জীবন। প্রিয়াংকা বড্ডো ভালো মিষ্টি মেয়ে। লেখাপড়ায় ভালো। এসএসসি, এইচএসসিতে জি পি এ ফাইভ পেয়ে পাস করেছে। ডাক্তারিতে ভালো করছে। এবার থার্ডইয়ার পাস করেছে।
অভিলাষ বলে, প্রাচুর্য, সবটাকা ঘরে রাখিস, পোকা খাবে তো!
– ঐ আর কত টাকা। সব মানুষের জন্য। যাদের টাকা তারা আসবে। তাদের দেবো। ঐ নিয়ে ভেবোনা বাবা। সবটাকা দান করবো বাবা।
– কোথায় দান করবি?
– তোমাকে বলবো।
সেইদিন শুক্রবার।
দেবনাথের অফিস বন্ধ। প্রিয়াংকার কলেজ ছুটির দিন। অভিলাষ বাজার করে ফিরেছে। তখনই একদল লোক আসে গ্রাম থেকে। অভিলাষের পাশের বাড়ি। মুসলিম। মুসলিম হলেও বাড়ির সব অনুষ্ঠানে একে অপরকে নিমন্ত্রণ করে। মুসলিম হিন্দুদের পার্থক্য নেই। যেন এক সমাজ। এইগ্রামের সব বাড়ি হিন্দু, বৌদ্ধ,মুসলিম পাশাপাশি। পাশাপাশি মসজিদ, মন্দির।
এদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ওদের নিয়মিত যাওয়া- আসা। একটি সম্প্রীতিময় গ্রাম। মানুষ মানুষের জন্য ওরা। এখানে ধর্মটা বড়ো নয়। মানুষ সবার আগে।
ইছাক অভিলাষের ছেলেবেলার বন্ধু। গ্রামের দুইদু’বার চেয়ারম্যান। গ্রামের সবার প্রিয় সে। অভিলাষকে দেখে বড়ো গলায় বলে, ছেলে খবর পাঠালো, চলে এলাম।
সবাই ড্রইংরুমে বসে। ওরা চারপাঁচজন। সালেহ, করিম, আব্বাস, দিদার। কেউ অভিলাষের বড়ো নয়, ছোট। ইছাক অভিলাষের বন্ধু।
ইছাক জিগ্যেস করে, দেবনাথ কই?
– ঘুম থেকে উঠলো। আজ ছুটির দিন, দেরিতে উঠেছে।
কথার শব্দ পেয়ে ভেতরের ঘর থেকে ছুটে আসে দেবনাথ।
সবাইকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। জিগ্যেস করে, কাকা আপনারা কেমন আছেন?
– ভালো। ইছাক সহ সবাই বলেন।
অভিলাষ ইছাকের পাশে বসে। অভিলাষ প্রশ্ন করে, – দেবনাথ তোদের কাকাদের খবর দিয়েছিস কেন? ওরাতো ব্যস্ত মানুষ।
ইছাক চেয়ারম্যান বলে,
-রাস্তার পাশে তোদের একটি পঁচিশ গ-ার জমি আছে। আমাদের মসজিদের জন্য প্রয়োজন। আগের মসজিদ একটু ছোট। শুক্রবারের জুমার নামাজে সংকুলান হয়না। ছেলেকে বলেছি। আসতে বললো। আসলাম।
ইছাক সাহেবের কথা শোনে অভিলাষ হাসে। হেসে বলে,
– সে আর অমন কি? ছেলের কথা আমার কথা। মসজিদের প্রয়োজনতো, দিলাম।
– কাকা, আমি আপনাকে ফোনে বলেছিলাম, বাবা আপত্তি করবেনা।
দেবনাথ বলে।
– এমনে রেজিস্টারি দিলেতো হবেনা। প্রতি গ-ায় কত টাকা দিতে হবে, তাই বল অভিলাষ।
– কাকা, কোন টাকা লাগবে না। একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সবার। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি দান ক’জনের ভাগ্য হয়। আপনি টাকার কথা নয়, রেজিস্টারি কখন নেবেন তাই বলেন।
– শোনো ছেলের কথা।
দেবনাথের মা এসে বলে, ইছাকদাদা, ভাতের আয়োজন করেছি, খেয়ে যাবেন।
– এই আপনাদের জন্য পারি না বৌদি। এলেই খেতেই হবে।
দুপুরের খাওয়া শেষে দেবনাথ একটি টাকার বান্ডিল দিয়ে ইছাক সাহেবকে বলে-
– কাকা, এখানে পাঁচ লাখ টাকা আছে। মসজিদ নির্মাণের জন্য দিলাম। তাড়াতাড়ি শেষ করেন। লাগলে পরে আবার দেবো।
ইছাক সাহেব রেগে বলেন, তোর মাথা খারাপ হলো, জমিন দিলি, মসজিদ নির্মাণের টাকা দিচ্ছিস কেন?
– কাকা, প্রতিটি মানুষের দান করা উচিৎ। এটা আমার স্বভাব। দান করলে মানুষের লোভ ক্ষয় হয়। মনে হিংসার জন্ম হয়না। রাগ কমে।
আপনি না করবেন না।
ওরা চলে যায়।
তখন দুপুর দু’টা।
অভিলাষ বলে,
– দেবনাথ, সত্যিই তুই অনেক বড়ো মনের। তো তুই যেভাবে দান করছিস, নিজেদের জন্য রাখছিসতো?
– বাবা, একটি পরিবারের জন্য মাসে কত টাকার প্রয়োজন হয়? ঐ চলে যাবে। তুমি ভাববে না।
সন্ধ্যার আগে দেবনাথের মামা আসে। সঙ্গে মেয়ে। অভিলাষ বসার ঘরে বিকেলের চা খাচ্ছিলো। সরুপমকে দেখে কি খুশি অভিলাষ!
মুখে একরাশ হাসি মেখে বলে,
– কি খবর, অনেকদিন পরে আসা।
সরুপম, তার মেয়ে প্রণাম করে। অভিলাষ বলে বসো। এটা তোমার মেয়ে? মেয়ের কি নাম ?
– জামাইবাবু, একসঙ্গে এত প্রশ্ন? কোনটার উত্তর আগে দিই বলুনতো! দিদি, দেবনাথ কোথায়?
– আরে ভায়া, তুমিও তো আমার মতো শুধু প্রশ্ন করছো! কোনটার উত্তর দিই, বলোতো! সবাই আছে। তোমার দিদি সন্ধ্যাপুজোয়। দেবনাথ ওর ঘরে টিভি দেখছে। এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
– এটা আমার মেয়ে রংধনু। মাস্টার্স করেছে।
রংধনুর মুখটা শুকনো। সুস্থ মনে হলোনা অভিলাষের। তবু বলে,
– রংধনু? ভারি মিষ্টি ঐতিহ্য নাম। খুব ভালো, তো কোন বিষয়ে?
-ইংরেজিতে।
– চমৎকার।
তখনই বসার ঘরে ঢুকে দেবনাথ। পরনে হাফপ্যান্ট। গায়ে সাদা হাফগেঞ্জি। মামাকে প্রণাম করলো। রংধনুকে দেখে লজ্জা পায়। হাফপ্যান্ট পরেছে তাই। মামা বলে, তোর দেবনাথদা, প্রণাম কর।
রংধনু প্রণাম করে।
দেবনাথ জিগ্যেস করে, মামা, ও কে?
– রংধনু, আমার একমাত্র সন্তান।
– সেই কবে দেখেছিলাম, এক্কেবারে পিচ্চি ছিলো। অনেক বড়ো হয়েছে।
– বাবা, ইংরেজিতে মাস্টার্স করলো এবার। অতটা ছোট নয়।
প্রিয়াংকা আসে মায়ের সাথে। ভাই, ভাইজিকে দেখে আনন্দ ধরে না হৈমন্তীর। রংধনুকে বুকে জড়িয়ে ধরে। বলে, তোর মা কেমন আছে?
– ভালো পিসিমনি।
পরপর প্রিয়াংকা, রংধনুর জড়াজড়ি।
রংধনু সুন্দরী, লাজুক। রোগা। তবে স্মার্টনেস লাজুকতাকে হার মানায়। লম্বা চুল, ফর্সা। দারুণ মিষ্টি।
রংধনুর তুলনায় প্রিয়াংকা কম সুন্দর। শ্যামলা, হালকা পাতলা গড়ন। তা’ ছাড়া ডাক্তার পড়ুয়া মেয়েরা পড়ায় ব্যস্ত থাকে। রূপচর্চায় সময় দেয়না।
রংধনুকে প্রথম দেখে দেবনাথ হারিয়ে যায়। মনে মনে ভাবে রংধনুকে নিয়ে। স্বপ্ন দেখে। যেই ছেলে বিয়ের কথা শুনলে রাগতো! রঙধনুকে দেখে সে আজ শান্ত শীতল, স্তদ্ধ।
রাতের খাওয়া শেষে অভিলাষ, সরুপম ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছে।
সরুপম বলছে, জামাইবাবু,একটি বিশেষ কারণে এসেছি।
– কি বিশেষ কারণ। অভিলাষের প্রশ্ন।
কথা বের হচ্ছে না সরুপমের। মুখটা ভার। ঠিক তখন দেবনাথ তার রুম থেকে বেরিয়েছে। বাবা,মামার কথা কানে বাজে। দাঁড়ায় দেবনাথ। সরুপমের কথায় আবেগ ভরা।
বলছে-
-জামাইবাবু রংধনুর একটি কিডনি শেষ, আরেকটি শেষের পথে। আমার আর্থিক এতটা ভালো নয়। প্রতিদিন অনেক টাকার অষুধ লাগে। রংধনুকে বাঁচাতে কিডনির প্রয়োজন। কিডনি পাবো কোথায়? টাকাওতো নেই।
অভিলাষ বলে,- কি বলছো? এতটা খারাপ কখন হলো?
– জানি না, জামাইবাবু।
দেবনাথ ঐসব শুনে নিজের রুমে ছুটে যায়। রঙধনুর জন্য কি করবে ভাবে। হঠাৎ দেখে রঙধনুকে ভালো লেগেছে। কিন্তু ওতো বেশিদিন বাঁচবে না। তবে হ্যাঁ, একটি উপায় আছে। কিডনি সংযোজন। নতুন একটি কিডনি দিলেই অনেকদিন বাঁচবে।
সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছে দেবনাথ। শেষরাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয় দেবনাথ। নিজের একটি কিডনি রঙধনুকে দেবে। রংধনু বাঁচবে। সুন্দর জীবন পাবে।
পাখি ডাকছে। ভোরের আলোয় সূর্য উঠে। আজ শনিবার। দেবনাথের অফিস ছুটি। তারপরও তাড়াতড়ি ঘুম থেকে উঠে দেবনাথ। সবাইকে ডাকে। মা,বাবা, মামা, রংধনু, প্রিয়াংকাকে।
সবাই অবাক। হলোটা কি? বন্ধের দিনে ভোরে দেবনাথ সবাইকে ডাকছে।
মা জিগ্যেস করে,
– কি হলো বাবা, ছুটির দিনে সবাইকে ডাকলি কেন?
– কথা আছে মা। তোমরা সবাই জানো? রংধনুর একটি কিডনি শেষ। অন্যটিও খারাপের দিকে। ওকে বাঁচাতে হবে।
– কে বললো? মা জিগ্যেস করে।
– মামা গত রাতে বাবাকে বলছিলেন।
– সেতো অনেক টাকার প্রয়োজন। বাবা বলে।
– সেই জন্যইতো সবাইকে ডাকা।
– কিডনি কে দেবে? খুঁজতে হবে না? আবারও বলে।
– খুঁজতে দেরি হবে। তাই ঠিক করেছি কিডনি আমি দেবো। অন্ততঃ রংধনু বাঁচবে। স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে।
– কি বলছিস দেবনাথ? কিডনির জন্য বিজ্ঞাপন দে। পাবিতো!
মা কান্না কন্ঠে বলে।
– মা, এইটাও একটি দান। জীবনদান। অন্যজনের কিডনি চেয়ে আমার কিডনিটা রংধনুর জন্য বেশি নিরাপদ হবে। তোমরা কেউ কিচ্ছু বলো না।
সবাই স্তব্ধ। নির্বাক। কেউ কথা বাড়ায়না।
মা, বাবা, মামা, প্রিয়াংকা সবাই চলে যায়।
ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে থাকে রঙধনু, দেবনাথ।
রংধনু দেবনাথের মুখোমুখি দাঁড়ায়। বলে,
– দেবনাথদা, এটা কি কঠিন সিদ্ধান্ত নিলে তুমি? তোমার জীবনের ঝুঁকি নেয়াটা কি ঠিক হলো? আমার জন্য তোমার জীবনটা পঙ্গু হয়ে যাবে!
দেবনাথ কথা বলে না। রঙধনুর চোখের উপর চোখ রাখে। একটু পর দেবনাথের চোখে জল বেরোয়।
তাই দেখে রংধনুর চোখেও জল।
অস্পষ্ট গলায় দেবনাথ বলে,
– রংধনু, তোমার চোখে জল। তুমিও কাঁদছো? সত্যি আমি তোমাকে ভালোবাসি। বাঁচলে দু’জন বাঁচবো। মরলে!—–
তখনি রংধনুর হাত দেবনাথের মুখে।
রংধনু উঁচু গলায় বলে,
– দেবনাথদা, ঐ অশুভ কথাটি মুখে বলো না। তুমি দান করো শুনেছি, কিন্তু জীবনদান করো এই প্রথম জানলাম। তুমি কত বড়ো মনের মানুষ, কাছাকাছি না আসলে জানতামনা।
দেবনাথ রংধনুকে বুকে টেনে নেয়।
রংধনু না করে না।
দীপক বড়ুয়া, গল্পকার




