নাজমুল টিটো
# বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক ড. সুখেন্দু সুন্দর গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে “ ‘পরিশেষ’ কাব্যগ্রন্থে পূর্ববর্তী কাব্যধারার পরিসমাপ্তি ঘোষণা করে কবি ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২) দিয়ে আবার যে কাব্যরচনার পালাটি শুরু করলেন তা শেষ পর্ব হলেও সামান্য পর্ব নয়। রচনার প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্যে, ভাবের গভীরতায় ও প্রকাশের উৎকর্ষে আধুনিক কাব্যপাঠককে বিস্মিত ও হতবুদ্ধি করে দেওয়ার মত উপকরণ এই পর্বে আছে। এই পর্বের প্রথম কাব্যখানি (পুনশ্চ) সম্পর্কে কবি যা কিছু বলেছেন পরবর্তী গদ্যরীতিতে লেখা কয়েকখানি কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে তাই খাটে। শেষ জীবনের কাব্য কার্যতঃ কবির আত্মবিশ্লেষণের, আত্মবিচারের কাব্য। রবীন্দ্র-কাব্যগ্রন্থাবলীর প্রায় দুই-পঞ্চমাংশ কবিজীবনের শেষ দশ বছরের ফসল হলেও এই সব কাব্য সম্পর্কে কবিকৃত আলোচনার পরিমাণ খুব কম বলেই সমস্ত কাব্যকেই একটি পর্বের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”
কবি পুনশ্চ কাব্যের কবিতায়ও বাঁশিকে বারবার অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
(২০৭)
“তার ফাঁকের ভিতর দিয়েই
নতুন বসন্তের হাওয়া আসে
রজনীগন্ধার গন্ধে বিষণ্ণ হয়ে;
তারি ফাঁকের মধ্যে দিয়ে
কাঁঠালতলার ঘন ছায়া
তপ্ত মাঠের ধারে
দূরের বাঁশি বাজায়
অশ্রুতে মূলতানে।”
[ফাঁক, পুনশ্চ]
(২০৮)
“নদীর ওপারে রাস্তা,
রাস্তা ছাড়িয়ে ঘন বন-
সে দিক থেকে শোনা যায় সাঁওতালের বাঁশি
আর শীতকালে সেখানে বেদেরা করে বাসা
ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে।”
[বাসা, পুনশ্চ]
(২০৯)
“সেও তো নেই স্থির হয়ে যে পরিপূর্ণ,
সে যে বাজায় বাঁশি,প্রতীক্ষার বাঁশি-
সুর তার এগিয়ে চলে অন্ধকার পথে।”
[বিচ্ছেদ, পুনশ্চ]
(২১০)
“তোকে দেব আমার ঘষা ঝিনুক
কাঁচা আম ছাড়াবি মজা ক’রে-
তার আর দেব আমের কষির বাঁশি।
————————————————-
সেই প্রতিবেশীদের ভাগ্নে ছিল সাত বছরের,
তার মাথার উপর চাপিয়ে দিয়ে এল
এক ভাঙা হাঁড়ি।
হাঁড়ি-চাপা তার কান্না শোনালো
যেন ঘানিকলের বাঁশি।”
[ছেলেটা, সপুনশ্চ]
# ‘পুনশ্চ’ কাব্যে গদ্য ছন্দে রচিত ৫০-টি কবিতা রয়েছে। তন্মধ্যে গল্প ও কবিতার সমানুপাতিক মিশ্রণে রচিত ‘বাঁশি’ শিরোনামের কবিতাটিই পাঠকের কাছে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও আদৃত। ইতোপূর্বেও ‘কড়ি ও কোমল’ এবং ‘খেয়া’ কাব্যে বাঁশি শিরোনামে বিশ্বকবির আরো ২টি পূর্ণাঙ্গ কবিতা আমরা পেয়েছি। সেই দুটি কবিতা তাঁর রচিত অজস্র গতানুগতিক কবিতার মত ছিল বলে পাঠক তেমন মনে রাখেনি। কিন্তু ‘পুনশ্চ’ কাব্যের বাঁশি কবিতাটি পড়েননি কিংবা এই কবিতার সাথে পরিচিত নন বাংলা ভাষাভাষী এমন কাব্যপাঠক বোধহয় খুব বেশি পাওয়া যাবে না। মাত্র পাঁচ স্তবকে রচিত এই কবিতায় একজন ছাপোষা কেরানির দিনযাপনের গল্পের সাথে তার অন্তরলোকের কল্পনা ও স্বপ্নের যে নিখুঁত ছবি আঁকা হয়েছে তা শুধু হরিপদ কেরানির জীবনালেখ্যয় সীমাবদ্ধ থাকেনি বেদনার্ত বাঁশির করুন সুরের চিরন্তন আবেদনের মতো সকল ব্যক্তি-আত্মার যন্ত্রণার কাহিনীর সাথে মিলেমিশে এক অনন্য উচ্চতায় আসন লাভ করেছে।
(২১১) “বেতন পঁচিশ টাকা,
সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি।
খেতে পাই দত্তদের বাড়ি
ছেলেকে পড়িয়ে।
শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই,
সন্ধেটা কাটিয়ে আসি,
আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।
এঞ্জিনের ধস্ ধস্,
বাঁশির আওয়াজ,
যাত্রীর ব্যস্ততা,
কুলি-হাঁকাহাঁকি।
সাড়ে দশ বেজে যায়,
তার পরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার।
ধলেশ্বরীনদীতীরে পিসিদের গ্রাম।
তাঁর দেওরের মেয়ে,
অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক।
লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল-
সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে।
মেয়েটা তো রক্ষে পেলে,
আমি তথৈবচ।
ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসাযাওয়া-
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।
————————–
হঠাৎ খবর পাই মনে
আকবর বাদশার সঙ্গে
হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।
বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে
ছেঁড়াছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে
এক বৈকুণ্ঠের দিকে।
এ গান যেখানে সত্য
অনন্ত গোধূলিলগ্নে
সেইখানে
বহি চলে ধলেশ্বরী;
তীরে তমালের ঘন ছায়া ;
আঙিনাতে
যে আছে অপেক্ষা ক’রে, তার
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।”
[বাঁশি, পুনশ্চ]
(২১২)
‘চিররূপের বাণী’ কবিতায় কবি মাটির তৈরি মানব দেহকে বাঁশি ও প্রাণকে সুরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মনকে বানিয়েছেন প্রাণের মিতা। বাঁশিরূপী সেই জড় বস্তুর মাটির দেহের সাথে যদি মন, প্রাণ, রূপ ও বাণীর সুন্দর সম্মিলন না ঘটতো তাহলে এই মর্তলোকে মাটির দেহের বাঁশির অনুতে অনুতে নৃত্য, নাড়ীতে নাড়ীতে সুর ও তালের অপরূপ বাণীর ঝংকার কী করে উঠতো?
“কম্পমান কণ্ঠে প্রাণ বললে, হে মাটি, হে নিষ্ঠুর, কী চাও তুমি?
দূত বললে, আমি চাই দেহ।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে প্রাণ; বললে;
এতকাল আমার লীলা এই দেহে,
এর অণুতে অণুতে আমার নৃত্য,
নাড়ীতে নাড়ীতে ঝংকার,
মুহূর্তেই কি উৎসব দেবে ভেঙে
দীর্ণ হয়ে যাবে বাঁশি,
চূর্ণ হয়ে যাবে মৃদঙ্গ,
ডুবে যাবে এর দিনগুলি
অতল রাত্রির অন্ধকারে?
দূত বললে, ঋণে বোঝাই তোমার এই দেহ, শোধ করবার দিন এল-
মাটির ভা-ারে ফিরবে তোমার দেহের মাটি।
——————————————-
রূপ এল ফিরে দেহহীন ছবিতে,
উঠল শঙ্খধ্বনি।
ছুটে এল চারি দিক থেকে রূপের প্রেমিক। আবার দিন যায়, বৎসর যায়।
প্রাণের কান্না থামে না।
আরো কী চাই।
প্রাণ জোড়হাত করে বলে;
মাটির দূত আসে,
নির্মম হাতে কণ্ঠযন্ত্রে কুলুপ লাগায়-
বলে ‘কণ্ঠনালী আমার’।
শুনে আমি বলি,
মাটির বাঁশিখানি তোমার বটে,
কিন্তু বাণী তো তোমার নয়।
—————————————-
মাটির দানব মাটির রথে যাকে
হরণ করে চলেছিল
মনের রথ সেই নিরুদ্দেশ বাণীকে
আনলে ফিরিয়ে কণ্ঠহীন গানে।
জয়ধ্বনি উঠল মর্তলোকে।
দেহমুক্ত রূপের সঙ্গে যুগলমিলন হল
দেহমুক্ত বাণীর
প্রাণতরঙ্গিণীর তীরে,দেহনিকেতনের প্রাঙ্গণে।”
[চিররূপের বাণী, পুনশ্চ]
(২১৩)
“রাত্রি প্রভাত হল।
শুকতারা অরুণ-আলোয় উদাসী।
তোরণদ্বারে বাজল বাঁশি বিভাসে ললিতে।
অভিষেকের স্নান হবে,
পুরোহিত এল তীর্থবারি নিয়ে।”
[মুক্তি, পুনশ্চ]
(২১৪)
“কার্তিক পূর্ণিমা, পূজার উৎসব।
মঞ্চের উপরে বাজছে বাঁশি মৃদঙ্গ করতাল,
মাঠ জুড়ে কানাতের পর কানাত,
মাঝে মাঝে উঠেছে ধ্বজা।
পথের দুই ধারে ব্যাপারীদের পসরা-
তামার পাত্র, রুপোর অলংকার,
দেবমূর্তির পট, রেশমের কাপড়;
ছেলেদের খেলার জন্যে কাঠের ডমরু,
মাটির পুতুল, পাতার বাঁশি;
অর্ঘ্যের উপকরণ, ফল মালা ধূপ বাতি,
ঘড়া ঘড়া তীর্থবারি।”
[প্রথম পূজা, পুনশ্চ]
(২১৫)
“কেউ বা এসে প্রহর-খানেক বসে তলায়,
পা ছড়িয়ে কেউ বা বাজায় বাঁশি,
যনববধূর পাল্কিখানা নামিয়ে রাখে
ক্লান্ত দুই পহরে;”
[ছুটি, পুনশ্চ]
# ‘বিচিত্রিতা’ (১৯৩৪) কাব্যটি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও ছবির এক মিলিত ভাবনার প্রকাশ। এ কাব্যের কবিতাগুলোর মধ্য দিয়ে কবি নিজের ও অন্যান্য শিল্পীদের চিত্রকর্মের ভাবনাকে কাব্যের ভাষায় ধ্বনিময় করে তুলেছেন। সেই ধ্বনিকে কাব্য ব্যঞ্জনায় ভরিয়ে দিতে কবি তাঁর প্রিয় সুরযন্ত্র বাঁশির ব্যবহার করেছেন অতি সযতেœ।
(২১৬)
“এনেছে তব জন্মডালা অজর ফুলরাজি, রূপের-লীলালিখন-ভরা পারিজাতের সাজি।
অপ্সরীর নৃত্যগুলি
তুলির মুখে এনেছ তুলি,
রেখার বাঁশি লেখায় তব উঠিল সুরে বাজি।”
[আশীর্বাদ, বিচিত্রিতা]
(২১৭)
“এ-পারে চলে বর, বধূ সে পরপারে,
সেতুটি বাঁধা তার মাঝে।
তাহারি ‘পরে দান আসিছে ভারে ভারে,
তাহারি ‘পরে বাঁশি বাজে।
——————————————–
নদীটি বহি চলে মাঝে,
বধূরে দেখা যায়
মাঠের কিনারায়,
সেতুর ‘পরে বাঁশি বাজে।”
[বরবধূ, বিচিত্রিতা]
(২১৮)
“প্রাণোচ্ছ্বাস নাহি পায় সীমা
তোমার আপনা-মাঝে,
সে-প্রাণেরই ছন্দ বাজে
দূর নীল বনান্তের বিহঙ্গসংগীতে,
দিগন্তে নির্জনলীন রাখালের করুণ বংশীতে।”
[ছায়াসঙ্গিনী,বিচিত্রিতা]
# ‘শেষ সপ্তক’ (১৯৩৫) কাব্যগ্রন্থে কবি তাঁর শৈশব-যৌবনের স্মৃতি ও শেষ জীবনের বিষাদের সুর, ফুটিয়ে তুলেছেন বাঁশি-বাজিয়ে।
(২১৯)
“যে বাঁশি বাজিয়েছি
ভোরের আলোয়, নিশীথের অন্ধকারে,
তার শেষ সুরটি বেজে থামবে
রাতের শেষ প্রহরে।”
————————————————
আর বেশি কিছু নয়।
আমি আলোর প্রেমিক ;
প্রাণরঙ্গভূমিতে ছিলুম বাঁশি-বাজিয়ে।
পিছনে ফেলে যাব না একটা নীরব ছায়া
দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে।”
[ছয়, শেষ সপ্তক]
(২২০)
‘বিশ্বকবি তাঁর অসীম ছড়াটা থেকে
একটা পদ ছিঁড়ে নিলেন কোন্ কৌতুকে,
ভাসিয়ে দিলেন
পৃথিবীর হাওয়ার স্রোতে,
যেখানে ভেসে বেড়ায়
ফুলের থেকে গন্ধ,
বাঁশির থেকে ধ্বনি।”
[ত্রিশ, শেষ সপ্তক]
(চলবে-)
নাজমুল টিটো, গবেষক ও প্রাবন্ধিক




