ভাষান্তর : জ্যোতির্ময় নন্দী
[প্রখ্যাত জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামি (জন্ম: ১২ জানুয়ারি, ১৯৪৯)’র পরিচয় বিশ্ব সাহিত্যের পাঠকদের নতুন করে দেয়ার কিছু নেই । তাঁর উপন্যাস, প্রবন্ধ, এবং ছোট গল্প জাপানে এবং আন্তর্জাতিকভাবে বহুবার বেস্ট সেলার হয়েছে, তাঁর কাজ পঞ্চাশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং জাপানের বাইরে লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে। বহুপ্রজ লেখক মুরাকামির অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বা বহুলপঠিত ও পরিচিত কয়েকটির মূল জাপানি নাম প্রকাশনার কালানুক্রমে নিচে দেয়া হলো (পাঠকের বোধগম্যতার স্বার্থে বইগুলোর ইংরেজি অনুবাদের নামগুলোও এখানে দেয়া হলো, যদিও সেগুলোর প্রকাশকাল মূল বইগুলোর সমসাময়িক নয়):
‘কাজে নো উতা ও কিকে’ (হিয়ার দা উইন্ড সিং, ১৯৭৯), ‘১৯৭৩-নেন নো পিনবরু’ (‘পিনবল-১৯৭৩, ১৯৮০), ‘হিৎসুজি ও মেগুরু বকেন’ (এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ, ১৯৮২), ‘সেকাই নো অওয়ারি তো হাদো-বইরুদো ওয়ান্ডারালান্ডো’ (হার্ড বয়েল্ড ওয়ান্ডারল্যান্ড অ্যান্ড দা এন্ড অব দা ওয়ার্ল্ড, ১৯৮৫), ‘নরউওয়েই নো মোরি’ (নরওয়েজিয়ান উড, ১৯৮৭), ‘দান্সু দান্সু দান্সু’ (ড্যান্স ড্যন্স ড্যান্স, ১৯৮৮), ‘নেজিমাকি-দোরি কুরোনিকুরু’ (দা ওয়াইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিকল, ১৯৯৪-৯৫), ‘উমিবে নো কাফুকা’ (কাফকা অন দা শোর, ২০০২), ‘ইচি-কিয়ু-হাচি-ইয়ন’ (ওয়ানকিউএইট্টিফোর, ২০০৯-১০), ‘শিকিসাই ও মোতানাই তাজাকি ৎসুকুরু তো, কারে নো জুনরেই নো তোশি’ (কালারলেস ৎসুকুরু তাজাকি অ্যান্ড হিজ ইয়ার্স অব পিলগ্রিমেজ, ২০১৩) প্রভৃতি। চিন্তাধারা ও রচনাশৈলীর দিকে দিয়ে মুরাকামি যাঁদের প্রভাব স্বীকার করেছেন, তাঁরা হলেন: নাৎসুমে সোসেকি, কেনজাবুরু ওয়ে, ইমানুয়েল কান্ট, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, কার্ল ইয়ুং, লুডভিগ ভিডগেনস্টেইন প্রমুখ। মুরাকামি কেন এখনও পর্যৗল্প সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান নি, সেটা অনেক সাহিত্যামোদির ও সমালোচকের বিস্ময়মিশ্রিত প্রশ্ন বটে। তবে নিজের সাহিত্যকর্মের জন্য অন্যান্য অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে গুনজো পুরস্কার (১৯৭৯), নর্মা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২), তানিজাকি পুরস্কার (১৯৮৫), ইয়োমিউরি পুরস্কার (১৯৯৫), কুওয়াবারা তাকিও পুরস্কার (১৯৯৯), ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি পুরস্কার (২০০৬), ফ্রান্জ্ কাফকা পুরস্কার (২০০৬), ফ্রাঙ্ক ও’কনর আন্তর্জাতিক ছোটগল্প পুরস্কার (২০০৬), হ্যান্স খ্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন সাহিত্য পুরস্কার (২০১৬), আমেরিকা সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮), জেরুজালেম পুরস্কার ইত্যাদি। এখানে ধারাবাহিকভাবে দেয়া হচ্ছে তাঁর লেখা ‘শেহেরাজাদে’ নামের বিখ্যাত গল্পটি। “আলিফ লায়লা’ বা ‘হাজার এক রজনী’র গল্পকথক কেন্দ্রীয় চরিত্র শেহেরাজাদের নামানুসারে এ গল্পের নাম রাখা হয়েছে, যেহেতু এ বইয়ের অন্যতম প্রধান চরিত্র মেয়েটিও উপকথার শেহেরাজাদের মতো গল্প বলে। আলিফ লায়লার শেহেরাজাদে যেমন প্রতি রাতের শেষে একটা গল্প অসমাপ্ত রেখে দিতো পরের রাতে বলার জন্যে, এ গল্পের শেহেরাজাদেও তেমনটাই করেছে। গল্পের কোথাও লেখক মেয়েটার আসল নাম লেখেন নি, সবসময় তাকে শেহেরাজাদে নামেই উল্লেখ করা হয়েছে। গল্পটার বাংলা ভাষান্তর করা হয়েছে মূল জাপানি থেকে টেড গাসেনের করা ইংরেজি অনুবাদ অনুসরণে।]
প্রতিবার যৌনমিলনের পর মহিলাটা হাবারাকে একটা অদ্ভুত আর মন কাড়া গল্প বলতো। রানি শেহেরজাদের ‘হাজার এক রজনী’র মতো। অবশ্য ‘আলিফ লায়লা’র বাদশার মতো পরদিন ভোরে তার মাথা কেটে নেয়ার কোনো পরিকল্পনা হাবারার ছিলো না (যদিও সে কখনো তার সঙ্গে সকাল পর্যন্ত থাকেও নি)। সে তাকে গল্প বলতো, বলতে চাইতো বলেই। কারণ, হাবারার মনে হত, যৌনমিলনের পরেরকার সেই মন্থর, ঘনিষ্ট মুহূর্তগুলোতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে পাশের মানুষটার সঙ্গে গল্প করতে সে ভালোবাসতো। আর তা ছাড়া সারাদিন ঘরের ভেতরে আবদ্ধ থাকা হাবারাকে হয়তো সে একটু শান্তি দিতে চাইতো।
এ কারণে হাবারা মহিলাটার নাম দিয়েছিলো শেহেরাজাদে। সে কখনো সামনাসামনি এ নামে তাকে ডাকেনি, কিন্তু সে ছোট যে-ডায়েরিটা রাখতো, তাতে তাকে ও-নামেই সে উল্লেখ করে থাকে। “ আজকে শেহেরাজাদে এসেছিলো,” তার বলপয়েন্ট কলমটা দিয়ে সে ঘটনাগুলো টুকে রাখতো এভাবেই। তারপর সে সেদিনের গল্পটাকে সাদামাটা, সাঙ্কেতিক ভাষায় লিপিবদ্ধ করতো, যা পরে কেউ পড়লে বিভ্রান্ত হতে বাধ্য।
তার গল্পগুলো সত্য, নাকি বানানো, নাকি অর্ধেক সত্য আর অর্ধেক বানানো, সেটা হাবারা জানতো না। তার জানার কোনো উপায় ছিলো না। মহিলাটির বর্ণনায় বাস্তবতা আর অনুমান, পর্যবেক্ষণ আর বিশুদ্ধ কল্পনা যেন একসাথে মিলেমিশে থাকতো। একটা শিশু যেমন অত বেশি প্রশ্ন না করে একটা গল্প শুনতে পারে, হাবারাও সেভাবে তার কাহিনিগুলো শুনতো। ওগুলো মিথ্যে বা সত্যি, অথবা সত্য-মিথ্যার জটিল জোড়াতালি, যেটাই হোক না কেন, তাতে তার কী এসে যেতো?
ঘটনা যা-ই হোক, শেহেরাজাদের কিন্তু গল্প বলার একটা বিধিদত্ত ক্ষমতা ছিলো, যেটা মনকে ছুঁয়ে যেতো। গল্প যে-ধরনেরই হোক না কেন, সে ওটাকে বিশিষ্ট করে তুলতো। তার গলার স্বর, তার সময় নির্ধারণ, তার বলার গতি — সবই ছিলো ত্রুটিহীন। সে তার শ্রোতার মনোযোগ দখল করে নিতো, তাকে আশা-নিরাশার দোলায় দোলাতো, তাকে বিচার-বিবেচনা করে দেখার দিকে ঠেলে দিতো, আর তারপর, পরিশেষে ঠিক সেটাই দিতো, যেটা শ্রোতা চাইছে। মন্ত্রমুগ্ধ হাবারা তার চারপাশের বাস্তবতা ভুলে যেতে পারতো, অন্তত মুহূর্তের জন্যে হলেও। ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মোছা একখানা ব্ল্যাকবোর্ডের মতো তার সমস্ত উদ্বেগ, সব নিরানন্দ স্মৃতি মুছে যেতো। এর চেয়ে বেশি আর কী চাওয়ার ছিলো? জীবনের সেই পর্বটাতে এ ধরনের বিস্মরণই ছিলো হাবারার সবচেয়ে কাক্সিক্ষত।
শেহেরাজাদের বয়স ছিলো পঁয়ত্রিশ, হাবারার চেয়ে চার বছরের বড়। সে ছিলো প্রাইমারি স্কুলে পড়া দুটো বাচ্চার মা এবং একজন সার্বক্ষণিক গৃহবধূ (যদিও সে একজন নিবন্ধীকৃত নার্সও ছিলো এবং স্পষ্টতই এ কাজেও সে মাঝে মাঝে ডাক পেতো)। কোনো প্রতিষ্ঠানের চাকুরে বলতে যা বোঝায়, তার স্বামী ছিলো ঠিক তাই। তাদের বাড়ি ছিলো হাবারার বাসস্থল থেকে গাড়িতে কুড়ি মিনিটের পথ। সে স্বেচ্ছায় নিজের সম্পর্কে কেবল (বা মোটের ওপর) এ তথ্যগুলোই জানিয়েছিলো। এগুলোর কোনোটার সত্যতা যাচাই করার কোনো উপায় হাবারার ছিলো না, তবে তাকে সন্দেহ করার কোনো বিশেষ কারণও সে দেখতে পেতো না। সে কখনো তার নাম বলেনি। “জানার তো কোনো দরকার নেই, তাই না?” শেহেরাজাদে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো। হাবারাকেও সে কখনো নাম ধরে ডাকেনি, যদিও নামটা সে জানতো। নামের ব্যাপারটা সে বিচক্ষণতার সঙ্গে এড়িয়ে গিয়েছে, যেন মুখ দিয়ে সেটা বেরিয়ে গেলে কোনোভাবে অপয়া বা অসঙ্গত কিছু একটা হয়ে যাবে।
অন্ততপক্ষে বাইরের দিক থেকে ‘আলিফ লায়লা’র সেই সুন্দরী রানির সঙ্গে এ শেহেরাজাদের কোনো মিল ছিলো না। ওই সময়ে সে এগিয়ে যাচ্ছিলো মাঝবয়েসের দিকে আর এর মধ্যেই তার শরীরে মেদ জমতে শুরু করেছিলো, গালের হনু বেরিয়ে পড়েছিলো আর চোখের কোণে ফুটে উঠেছিলো মাকড়সার জালের মতো সরু সরু রেখা। তার চুলের স্টাইল, প্রসাধন, পোশাক আশাকে ঠিক অযতœ-অবহেলার ছাপ ছিলো বলা যাবে না, তবে সেগুলো কোনো প্রশংসা পাওয়ার মতো ছিলো বলেও মনে হতো না। সে অনাকর্ষণীয় ছিলো না, কিন্তু তার চেহারা নজর টানতো না, যার ফলে সে মনে যে-ছাপটা ফেলতো তা যেন ছিলো খানিটা ঝাপসামতো। ফলত, যারা রাস্তায় তার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতো বা তার সঙ্গে একই লিফটে উঠতো, তারা সম্ভবত তাকে তেমন লক্ষ্যই করতো না। দশ বছর আগে সে হয়তো একজন প্রাণবন্ত, আকর্ষণীয় তরুণীই ছিলো, হয়তো কয়েকজনের মাথাও সে ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। এক পর্যায়ে অবশ্য তার জীবনের সে-অধ্যায়টায় পর্দা নেমে এসেছিলো এবং মনে হচ্ছিলো সেটা আর কখনো উঠবে বলে মনে হচ্ছিলো না।
শেহেরাজাদে হাবারার সঙ্গে দেখা করতে আসতো সপ্তাহে দুবার। তার আসার দিনগুলো নির্ধারিত ছিলো না, তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সে কখনো আসতো না। সে এসময়টা যেতার পরিবারের সঙ্গে কাটাতো তাতে কোনোসন্দেহ নেই। এসে পৌাঁছার ঘণ্টাখানেক আগে সে সবসময়েই ফোন করতো। স্থানীয় সুপারমার্কেট থেকে সে নিত্যেপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে আনতো তার ছোট নীল রঙের মাজদা গাড়িটায় করে। অপেক্ষাকৃত পুরোনো একটা মডেল, যার পেছনের বাম্পারে টোল পড়ে গেছে আর চাকাগুলো ধুলোময়লায় কালো হয়ে গেছে। বাড়িটার বাসিন্দাদের জন্যে সংরক্ষিত জায়গায় গাড়িটা পার্ক করে, থলেগুলো হাতে ঝুলিয়ে সে সামনের দরজায় এসে দরজার ঘণ্টি বাজাতো। পিপহোল দিয়ে দেখে নিশ্চিত হয়ে তারপর হাবারা দরজার তালা আর ছিটকিনি খুলে তাকে ভেতরে ঢোকাতো। মুদিখানার জিনিসগুলো গুছিয়ে রান্নাঘরের ফ্রিজে তুলে রাখতো শেহেরাজাদে। তারপর সে পরের সপ্তাহে আসার সময় কী কী কিনে আনতে হবে তার একটা তালিকা তৈরি করতো। এসব কাজ সে করতো খুব নিপুণভাবে, একটুও বাড়তি নড়াচড়া না করে এবং পুরোটা সময় জুড়ে যথাসম্ভব কম কথা বলে।
হাতের কাজগুলো শেষ হওয়ার পর তারা দুজন চুপচাপ এগিয়ে যেতো শোবার ঘরের দিকে, যেন কোনো অদৃশ্য গ্রোত তাদেরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। শেহেরাজাদে দ্রুত তার কাপড়চোপড় খুলে ফেলতো, এবং তখনও একটা শব্দও উচ্চারণ না করে, বিছানায় হাবারার পাশে শুয়ে পড়তো। তার মাসিকের সময়গুলোতে সে হাত ব্যবহার করে হাবারাকে আনন্দ দিতো। তার দক্ষ, অনেকটা ব্যবসায়িক ধরনের আচরণ হাবারাকে মনে করিয়ে দিতো যে, সে একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত নার্স।
যৌনমিলনের পর তারা শুয়ে শুয়ে কথা বলতো। কিংবা আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে, শেহেরাজাদে কথা বলতো আর হাবারা মনোযোগ দিয়ে শুনতো, এখানে ওখানে দু-একটা লাগসই শব্দ যুগিয়ে দিয়ে, কখনো সখনো এক-আধটা প্রশ্ন করে। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে চারটার ঘরে পৌঁছলেই শেহেরাজাদে তার গল্প বলায় দাঁড়ি টানতো (হাবারার কেন জানি মনে হতো, কাহিনিটা সবেমাত্র যখন একটা ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছেছে তখনই সেটা শেষ করে দেয়া হচ্ছে)। বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে নিজের কাপড়চোপড় কুড়িয়ে নিয়ে সে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হতো। বলতো, রাতের খাবার তৈরি করার জন্যে তাকে এবার বাড়ি ফিরতে হবে।
হাবারা তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতো, তালা আর ছিটিকিনিটা আবার লাগিয়ে দিতো, আর জানালার পর্দা ফাঁক করে দেখতো ধুলোবালি মাখা ছোট্ট নীল গাড়িটা পার্কিং স্পেস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাতের আহারের জন্যে সে সন্ধ্যে ছয়টা নাগাদ সাদাসিধে কিছু রান্না করে একা একাই খেয়ে নিতো। একসময় সে বাবুর্চি হিসেবে কাজ করেছে, তাই কিছু রান্না করে নেয়াটা তার কাছে তেমন কঠিন কিছু ছিলো না। ডিনারের সাথে সে পান করতো পেরিয়ার মিনারেল ওয়াটার বা জ্যুস (সে কখনো মদ স্পর্শ করতো না), এবং আহারশেষে একটা ডিভিডি দেখতে দেখতে বা একটা বই পড়তে পড়তে সে এককাপ কফিতেও চুমুক দিতো। বড় বড় বই পড়তে সে ভালোবাসতো, বিশেষ করে যেগুলো বোঝার জন্যে একাধিকবার পড়তে হয়। এ ছাড়া তার করার মতো আর বেশিকিছু ছিলো না। এমন কেউ ছিলো না যার সঙ্গে কথা বলা যায়। কাউকে ফোন করারও ছিলো না। কম্প্যুটার না থাকায় ইন্টারনেটে ঢোকারও উপায় ছিলো না। তার বাসায় কোনো খবরের কাগজও আসতো না, এবং সে কখনো টেলিভিশনও দেখতো না (এর পেছনে অবশ্য একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিলো)। না বললেও চলে যে, তার বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় ছিলো না। কোনো কারণে শেহেরাজাদের আসা যদি বন্ধ হয়ে যেতো, তাকে পুরোপুরি একা একাই পড়ে থাকতে হতো।
এ সম্ভাবনা নিয়ে হাবারা খুব একটা মাথা ঘামাতো না। সে ভাবতো, এমনটা ঘটলে একটু কষ্ট হবে, তবে আমি কোনো না কোনোভাবে ঠিকই সামলে নিতে পারবো। আমি তো আর কোনো জনশূন্য দ্বীপে পড়ে নেই। তারপর আবার ভাবতো, না, আমি নিজেই জনশূন্য দ্বীপ। একা নিজের মনে থাকতে তার কখনোই খারাপ লাগতো না। তার খারাপ লাগতো বিছানায় সে শেহেরাজাদের সঙ্গে কথা বলতে পারবে না, সেটা ভেবে। অথবা আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে, তার গল্পের পরের কিস্তিটা সে শুনতে পাবে না ভেবে।
একদিন তারা যখন বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে ছিলো, শেহেরাজাদে বললো, “আগের জন্মে আমি ছিলাম একটা ল্যাম্প্রে বান মাছ।” এটা ছিলো এক সরল, সোজাসাপ্টা মন্তব্য — এমন তাৎক্ষণিক, যেন সে ঘোষণা করছে দূর উত্তরেই উত্তর মেরুর অবস্থান। ল্যাম্প্রে বানগুলো ঠিক কোন্ ধরনের জীব সেসম্পর্কে হাবারার কোনো ধারণাই ছিলো না, ওগুলো দেখতে কিরকম সেটা জানা তো দূরের কথা। তাই এ ব্যাপারে তার কোনো বিশেষ মতামত ছিলো না।
“ল্যাম্প্রে বান মাছগুলো কিভাবে রুইমাছ ধরে খায় তুমি জানো?” শেহেরাজাদে জিজ্ঞেস করেছিলো।
হাবারা জানতো না। সত্যি বলতে কি, এই প্রথম সে জেনেছিলো যেল্যাম্প্রেরা রুইমাছ ধরে খায়।”
“ল্যাম্প্রেদের কোনো চোয়াল নেই। এখানেই অন্যান্য ধরনের বানমাছগুলো থেকে তাদের পার্থক্য।”
“তাই? অন্য বানমাছদের চোয়াল আছে?”
“তুমি কি কখনো ওগুলোর দিকে ভালো করে তাকিয়েও দেখো নি?” শেহেরাজাদে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
“আমি মাঝে মাঝে বানমাছ খাই, কিন্তু ওদের চোয়াল আছে কি নেই সেটা দেখার সুযোগ কখনো পাই নি।”
হাবারা একটা ঘ্রদের তলদেশে শ্যাওলার মতো দুলতে থাকা একঝাঁক ল্যাম্প্রের কথা কল্পনা করলো। দৃশ্যটাকে তার মনে হলো সম্পূর্ণ বাস্তবতা বর্জিত, যদিও সে জানে, বাস্তবতা মাঝে মাঝে ভীষণ রকমের অবাস্তব হতে পারে।
“ঠিক আছে, তোমার কখনো এটা নিজের চোখে যাচাই করে দেখা উচিত। অ্যকোয়ারিয়ামে বা সেরকম কোথাও গিয়ে। সাধারণ বানমাছদের দাঁতসহ চোয়াল থাকে। কিন্তু ল্যাম্প্রে বানদের থাকে শুধু চোষক অঙ্গ, যা দিয়ে তারা নদী বা হ্রদের তলায় পাথরের গায়ে নিজেদের আটকে রাখে। তারপর তারা সেখানে একধরনের ভাসমান অবস্থায় থাকে, জলজ শৈবালের মতো গা দোলাতে দোলাতে।”
“ল্যাম্প্রেরা এভাবেই বেঁচে থাকে, শ্যাওলার ভেতরে গা ঢাকা দিয়ে। অপেক্ষারত অবস্থায়। তারপর যখন মাথার ওপর দিয়ে কোনো রুইমাছ ভেসে যায়, তখন তারা তিরবেগে তাদের চোষক দিয়ে ওটার গায়ে আটকে যায়। তাদের চোষকগুলোর ভেতরে থাকে সেই দাঁতওয়ালা জিভের মতো জিনিসটা, যেটা তারা রুইমাছটার পেটের আগুপিছু ঘষতে ঘষতে ফুটো করে ফেলে সেখান দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে কুরে কুরে তার মাংস খেতে থাকে, একটু একটু করে।
“আমি এরকম কোনো রুইমাছ হতে চাইতাম না,” হাবারা বললো।
“সেই পুরোনো রোমান আমলে পুকুরে ল্যাম্পে প্রচুর চাষ করা হতো। গোঁয়ার ক্রীতদাসদের গায়ে ল্যাম্প্রে লাগিয়ে দিয়ে জ্যান্ত অবস্থায় তাদের মাংস বানমাছগুলোকে খাইয়ে দেয়া হতো।”
হাবারা ভাবল, রোমান ক্রীতদাস হওয়াটাও তার উপভোগ্য মনে হতো না।
“আমি প্রথম ল্যাম্প্রে মাছ দেখি প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রী থাকার সময়, স্কুল থেকে ভ্রমণে গিয়ে একটা অ্যাকোরিয়ামে,” শেহেরাজাদে বললো। যে-মুহূর্তে আমি তাদের জীবনধারণের বর্ণনাটা পড়লাম, আমি বুঝে গেলাম পূর্বজন্মে আমি এগুলোর একটা ছিলাম। মানে, আসলে আমার এটা মনে পড়ে গেলো — কিভাবে আমি একটা পাথরের গায়ে আটকে থাকতাম, শ্যাওলার ভেতরে অদৃশ্য অবস্থায় দুলতে দুলতে, আমার ওপর দিয়ে ভেসে যাওয়া মোটাসোটা রুইমাছগুলোর দিকে নজর রেখে।”
“তোমার ওগুলোকে খাওয়ার কথা মনে পড়ে?”
“না, পড়ে না।”
“জেনে স্বস্তি পেলাম,” হাবারা বললো। “কিন্তু তুমি তোমার ল্যাম্প্রে জীবন সম্পর্কে কি কেবল এটুকুই মনে করতে পারো যে, কোনো নদীর তলায় শ্যাওলার মতো মাথা নেড়ে নেড়ে দুলছো?” ( ক্রমশ)
জ্যোতির্ময় নন্দী, কবি, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক




