ইদরিস আলী মধু
আবিদ সাহেব তার বাসার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে যখন হাত ঘড়িতে চোখ রাখছিলেন তখন রাত পৌনে তিনটে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সময়টা ভালোভাবেই দেখে নেন তিনি। এবার গোটা বাসাটার বাহির দিকটা পরখ করতে থাকেন। এভাবে এক সময় তার শয়ন কক্ষের দিকে চোখ যায়। ভেতরে আলো জ্বলছে না বলে মনে করেন। আবার মনে করেন, জ্বলছে। আবার কে বা কারা যেন মৃদু কথোপকথন করছে, সেগুলো ফিসফিসে বদ শব্দের-সেটাও মনে করেন। পুরোপুরি বুঝাতে না পারলেও প্রণয়ঘটিত অশ্রাব্য কম্পন কথনের কিছু কিছু যেন বুঝতে পারছেন। এসব সত্য-মিথ্যা নিশ্চিত না হলেও সেই মুহূর্তে ক্ষোভ ও ঘৃণায় তার শরীরের ভেতরটা রি রি করতে থাকে। মাথায় বিস্ফারিত পেট্রোল বোমার আগুন জ্বলে ওঠার মতো জ্বলতে থাকে। প্রতিবাদ-প্রতিহিংসায় ফোঁসে ওঠেন তিনি।এ মুহূর্তে খুন-খারাবি ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছেন না যেন।
তিনি শুনতে পাচ্ছেনÑ‘সত্যি বলছো?’
তার উত্তর, ‘একটুও মিথ্যে না। আপনার আগাগোড়া ম্যাচিং ফিগার, স্বছন্দ গতিময়তা, স্মার্টনেস, প্রাণখোলা হাসি, বেশভূষা শুধু আমাকে নয় যে কাউকে মুগ্ধ করবে। এই যে আমি আপনাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি-দেখুন, দেখে নিন-আপনি কতটা অপরুপা ও আকর্ষণকারিণী।’
’হয়েছে। আমি নিজেও দেখে থাকি।’ তৎক্ষণাৎ নিজেকে অধিক পরখ করে ফেরদৌসি বেগম পুনরায় বলেন, ‘তাহলে একটা গল্প বলি।’
‘আরে বলুন না। একটা কেন, অনেক বলুন।’
গত ঈদের কথা। আমি তোমার স্যার শপিং করতে যাই। একটা দোকানে একসেট থ্রি-পিস পছন্দ হলে নাড়াচাড়া করতে থাকি আর তখনি দোকানদার ব্যাটা সাবলীলভাবে আবিদকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘স্যার! এটা নতুন মডেলের। নায়িকা ঝিনুক পরে। বিনা দ্বিধায় নিতে পারেন। আপনার মেয়েকে দারুণ মানাবে।’
‘আপনাকে দেখে আমিও প্রথম সেটাই ভেবেছিলাম।’
‘তাহলে এতটা ইয়াং দেখায় আমাকে?’
‘বলছি আর কী! একদম আনমেরিড আনমেরিড।’
‘আরে আমি তো দু’সন্তানের মা।’
‘মেয়েরা বারতেও মা হয়। এমন টানটান শরীর বলেই কথা। দেখুন না আপনার নিতম্ব ও স্তনদ্বয় কতটা ভরাট, কতটা ছুরিত।’
এরূপ কথার মাঝে হঠাৎ পাশের ঘরে ঘুমন্ত বাচ্চাদের একজন ঘুমের ভেতর কীসব প্রলাপ বকে ওঠে। ফেরদৌসি বেগম ‘কী হলো বাবা-সোনা’ বলে দৌড়ে সে দিকে ছুটে যাওয়ার শব্দও কানে আসে।
আবিদ সাহেবের আরও ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়। মনটার ভেতরে কান্না জমে ওঠে। জোরে চিৎকার করে দরজায় ধাক্কা মারতে গিয়েও থেমে যান। কারণ তখন আর কোনো শব্দ শুনতে পান না। ঘরের আলোটাকেও তেমন তীব্র বা বিজলী বাতির বলে মনে হয় না। তিনি আর বলতেও পারেন না, ‘হারামযাদি তোকে দেখাচ্ছি মজা। কত বাইড় বাড়েছিস তুই।’ দরজাটা আচমকা লাথি মেরে ভেঙে ফেলতেও পারেন না। শেষতক কিছুই করতে পারেন না। আরও কিছুটা সময় পরখ করতে অকস্মাৎ কী যেন ভেবে আনমনে বিড়বিড় করতে থাকেন শুধু। তখন সমস্ত রাগ-অভিমান সাঈদের ওপর গড়িয়ে পড়ে। বলতে থাকেন, ‘ছিঃ সাঈদ ছিঃ! তুমি কতটা নিচ্। এসব করতে পারছো? তুমি না ছোট ভাইয়ের মতো। তোমার নামের নামও ছিল তার। হুবহু দেখতে না হলেও বয়স তো একই। আহ্! ভাইটা আমার ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ২৮ নভেম্বর অফিস থেকে বাসায় ফিরতে শাহাবাগের শিশু পার্কের সামনে বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাসের মধ্যে পেট্রল বোমার আগুনে পুড়ে মারা গেল। দেশে রাজনীতির নামে কীসব হরতাল, অবরোধ চলছিল তখন। চোরাগোপ্তা হামলা করে যাত্রী, পথচারী, নারী, শিশুসহ সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করছিল দুর্বৃত্ত পিকেটাররা। তার সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করার প্রতিবাদে কোথাও কোথাও প্রতিপক্ষদের কুপিয়ে কুপিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা করছিল তাদের দোসর রা। একাত্তরের মতো লুটপাট করে ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। আহ্ সাঈদ! তুমি এতটা বিশ্বাসঘাতক হবে বুঝিনি। তোমাকে পেয়ে নারীর প্রতি আমার চিরদিনের অবিশ্বাস ভুলেই গিয়েছিলাম। জুনিয়র সরল সাইয়েন্টিফিক পদে আলিফগড়ে পোস্টিং নিয়ে আসার পর তোমার জন্য কী-না করেছি। তোমার মতো স্মার্ট সহকর্মীই এই কৃষি ফার্মে চেয়েছিলাম। এখানে প্রচুর জমি অনুর্বর। আমাদের কাজই হবে এ মাটিতে কী ভাবে ফসল ফলানোর পদ্ধতি বের করা যায়। অনেক গবেষণার প্রয়োজন। জমিগুলো যদি ফসলের আওতায় আনা যায় দেশের খাদ্য উৎপাদন আরো বেড়ে যাবে। এজন্য নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে তোমাকে সামান্যতম কষ্ট পেতে দিই নি। জঙ্গল ঘেরা অনঊন্নত জায়গা হলেও থাকার জায়গা করে দিয়েছি। বাসায় নিয়ে তোমাকে যতœ করে খাওয়া-দাওয়া করিয়েছি। এখনও সে ধারাবাহিকতা চলতেই আছে। আর তুমি কী নাÑছিঃ ছিঃ!’
সেই থেকে সাঈদকে নিয়ে মনোপীড়া চলতেই আছে। কিন্তু মুখ খুলে কিছু বলতে পারেন না। কী আর বলারই বা থাকে। ছেলেটা বাসায় আসে। ফেদৌসিকে ভাবি করে ডাকে। ছেলে-মেয়ে দু’জনকে আপন ভেবে আদর করে। কোনো কোনো দিন বিকেলে ঘুরতে নিয়ে যায়। ফেরদৌসিও মাঝে মাঝে শেয়ার করে। সে এখন আর এখন সাঈদকে নিয়ে কোথাও যেতে স্বামীর পূর্বানুমতির প্রযোজনও মনে করে না। দু’এক দিন বাসায় না এলে বা অন্য কোথাও গেলে কবে আসবে না আসবে বলে খবর জানতে চায়। মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে গল্পও করে, ‘ছেলেটা খুব ন¤্র, ভদ্র, ভালো। আজকাল এমন ছেলে হয় না। আমার একটা ছোট বোন থাকলে ওকে সাড়া জীবনের জন্য বেঁধে রাখতাম।’ অফিসের কাজে-কামেও খেয়াল রাখতে বলে। এসব ভেবে ভেবে মনটা বিষিয়ে ওঠে। সন্দেহের বোঝা ভারী হয়। মুর্খ দোকানদারের কথাগুলো আজও থাপ্পড় মারে গালের ওপর। লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে, কেন যে নিজের থেকে অর্ধেকেরও বয়সী মেয়েকে বিয়ে করতে গিয়েছিলাম। আজ সবাই উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্ন করে-করতেই থাকে।
আবিদ সাহেব যুবক বয়সে অন্যদের থেকে একটু বেশি মেয়েপাগলা ছিলেন। ক’জন মেয়েকে পছন্দ করে ঘুর ঘুর করলেও তারা সাড়া দেয়নি। অবশেষে একজনের জন্য পড়ালেখা পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলেন। সে মেয়েটি ছিল চতুর স্বভাবের। আবিদ সাহেবের চেহারা ঢ্যাঙ্গা, নাক মোটা, ঢ্যাঁড়স গড়নের বলে যেখানে কোনো মেয়ে কাছ ঘেঁষতো না, সেখানে সে অর্থের বিনিময়ে চুটিয়ে প্রেমের অভিনয় করে চলে। আর সেই প্রেমে ডুবে প্রথম বার আইএসি পরীক্ষা দিতে পারেন না। লেখাপড়ার প্রস্তুতি তো ছিলই না-সাথে কলেজের বেতন, ফরম ফিলাপের টাকা পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলেছিলেন। সেই মেয়েটির বিনা বাধায় অন্য ছেলের সাথে গোপনে প্রেম করে বিয়ে করলে তিনি মেয়েদের প্রতি সাগর পরিমাণ ঘৃণা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ান। এমন শিক্ষা পেয়ে জীবনে আর কোনো মেয়েকে বিশ্বাস করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেন। প্রতিজ্ঞা মতো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে সায়েন্টিফিক অফিসার পদে যোগদান করে অর্ধশত বছরে পা রাখলে মৃতকল্প মায়ের অনুরোধ ফেলতে পারেননি বলে ফেরদৌসিকে বিয়ে করেছিলেন।।
ইতোমধ্যে আবিদ সাহেবের আপাদমস্তকে চির ধরে। হাত-পা কেঁপে ওঠে। কী করবেন না করবেন না ভেবেই কলিং বেলের বোতাম চাপ দিয়ে ধরে রাখেন। তখনও বাসার ভেতরে কোনোরকম সাড়াশব্দ ছিল না। ছিল না আগের মতো খেয়ালের চোখ-ঝলসানো আলো।
কলিংবেল বেজেই চলে। কিছুক্ষণ পর ফেরদৌসি বেগম ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। বেল বাজানোর আওয়াজেই বুঝতে পারেন কে হবে। আর দেরি না করে চাবি নিয়ে দরজা খুলতে খুলতে বলেন, ‘কী ব্যাপার! এক দিন আগে চলে এলে যে, তা কাজ হয়েছে?’ আবিদ সাহেব কিছু বলেন না। তখন তার মনে হয় বাসার পেছন দিকে কিসের যেন শব্দ হচ্ছে। অনুমান করেন অন্যকিছু। পেছন দরজা দিয়ে হয়তো বেরিয়ে গেছে। তিনি দ্রুত করে দোতালার সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকেন। সেদিকটায় যেতেই দেখেন মানুষ সমান একখ- আঁধার বাসার দেয়াল পেরিয়ে হুড়মুড় করে ঝোপঝাড়ের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। ফেরদৌসি বেগম তখনো তার পিছে পিছে। কী হয়েছে, কী দেখছো, কাকে খুঁজছো-ইত্যাদি রকম প্রশ্ন করে চলেন। তিনি তখন ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘সাঈদ সাহেব বাসায় ছিল বুঝি? আঁধারের রঙে তাকেই তো পালাতে দেখছিলাম বোধহয়।’ ফেরদৌসি বেগম তখন যেন পাহাড় থেকে ছিটকে পড়েন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বলেন, ‘তুমি কী বলো এসব? পাগল হয়ে গেছো? জান তো এরকম সন্দেহের ফল কী হবে? কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের? তুমি ঢাকা যাওয়ার পর সে তো বাসাতেই আসেনি। শুনেছি মায়ের অসুখের খবর পেয়ে দেশের বাড়িতে গেছে।’
‘কই, আমাকে তো সে কথা বলে নি। ছুটিও তো নেয় নি। ফোনও তো করতে পারতো।’
হয়তো ব্যস্ততায় ভুলে গেছে। অনেক দিন থেকেই তো মায়ের অসুখের কথা বলে আসছিল। কিন্তু তুমি এত রাতে এরকম করছো কেন? আর তাকে নিয়েই বা প্রশ্ন করছো কেন? সেতো আমাদের ¯েœহতুল্য। আমি বেশ কিছুদিন যাবত লক্ষ্য করছি তুমি তাকে জড়িয়ে আমাকে নানান রকম সন্দেহ কর। ছিঃ ছিঃ! তুমি এতটা নিচে নেমে গেছ। ভাবাই যায় যে তুমি কীসব ভাবছো? আমাকে কি বুঝতে পার? হায় কপাল! কাকে নিয়ে আমি…
আবিদ সাহেব আর কিছু বলতে পারেন না। মাথা নিচু করে বাসার দিকে ফিরে আসতে থাকেন।
বাসায় ঢুকেই ফেরদৌসি বেগম চেঁচিয়ে জানতে চান, ‘কই, আমার কথার জবাব দিলে না তো?’
আবিদ সাহেব তখন শিশুর মতো নরম হয়ে যান। লজ্জাবনত ভাবে তাকিয়ে বলেন, ‘ফেরদৌসি! কী ভাবে যে বলি, কী হয়েছে আমার। তুমি কি বলতে পারো?’
‘আমি জানি তুমি আমাকে অনেক বেশি ভালোবাস।’
‘আমার মনে হয়, এরকম ভালোবাসার পেছনে অপরাধবোধ থাকে। একটা জ্যান্ত অতীত সে অপরাধ থেকে আমাকে মুক্তি দেয় না। আমি কত দিন যে নিজেকে বুঝতে চেযেছি। সরি।’
‘ফেরদৌসি বেগম তখনও কাঁদতে ছিলেন। কাঁদতে কাঁদতেই আবিদ সাহেবকে বুকে জড়িয়ে বলেন, ‘আমি তোমার অতীত শুনেছি। মেয়েদের থেকে অর্জিত ঘৃণা বা সন্দেহ করার অধিকার তোমার থাকলেও থাকতে পারে। কিস্তু আমার ওপর কেন? আমি তো তোমার স্ত্রী, তোমার সস্তানদের মা। আমি তো তোমাকেই আমার জীবনের অহঙ্কার আর অলঙ্কার বলে মনে করি।’
এবার স্ত্রীর প্রতি দুর্বলতা বাড়ে। বুকে জড়িয়ে আদর করতে থাকেন। এতে করে ফেরদৌসি বেগম আরও বেশি আবেগতাড়িত হন। চোখের জলে বুক ভেজাতে থাকেন। এ মুহূর্তে আবিদ সাহেব নিজের ভেতরে অন্যরকম এক অনুভূতি খুঁজে পান। যা সুখ ও সত্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। তিনি অনুভব করেন কেবলমাত্র মনের মানুষেরাই নারী ও পুরুষের জীবনকে সুন্দর ও সাবলীল করতে পারে। জীবনের হোক বা মনের বিভ্রম হোক সেগুলো জঞ্জাল ছাড়া কিছু নয়। তারপর আবিদ সাহেব ঘুমন্ত ছেলে- মেয়েদুটির পাশে গিয়ে দাঁড়ান। ভাবেন, এরা আমার চরম সত্যের দুটি ফুল।
ইদরিস আলী মধু, কথাসাহিত্যিক




