এখন সময়:দুপুর ২:২৮- আজ: বৃহস্পতিবার-৬ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২১শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:দুপুর ২:২৮- আজ: বৃহস্পতিবার
৬ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২১শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

সৈয়দ মনজুর কবির-এর পাঁচটি অনুগল্প

অনড় প্রতিযোগিতা

 

এই মাত্র ভোরের সূর্য লাল আভা ছড়িয়েছে! অসংখ্য কাক উড়ছে দিক্ বিদিক। শুধু একটি কাকের যত আগ্রহ ডাস্টবিনের পাশে তাকিয়ে থাকা লোকটির দিকে। মজার খেলা- সে চরম আগ্রহে তাকিয়ে আছে বসে থাকা লোকটির উন্মোচিত চোখের দিকে। দুজন দুজনার চোখে চোখ – স্থির, অনড়। ইচ্ছে করলে কাকটি তার মাথাটি নাড়াতে পারে। তবে কেন জানি সেও বোধ হয় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ লোকটির মতো – সেও হবে অনড়। এ এক নতুন প্রতিযোগিতার খেলা। সময় বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে ক্রমেই আলোর তীব্রতা। কিছু কিছু হেঁটে চলা পথিক থমকে দাঁড়ায় পলকহীন বসে থাকা লোকটিকে দেখে। গাদাগাদি করে ঘিরে দাঁড়ায়। কাকটি বিচলিত – লোকটির অনড় চোখটি দেখা যাচ্ছে না আর। দীর্ঘ শব্দ তুলে একটা দানব গাড়ি আসে। সাদা কাপড়ে জড়িয়ে ভিড়ের ভেতর থেকে কাকে যেন তুলে নিয়ে যায়। অতঃপর উৎসাহী জনগণের ভিড়ও ভেঙে যায়। ডাস্টবিনের পাশে চেয়ে থাকা লোকটি কোথায়? কাকটি একাই নিঃশ্চুপ চেয়ে আছে বিপরীত প্রতিযোগীর শূন্যস্থানের দিকে। এক অসম্ভব মজার অনড় প্রতিযোগিতায় জয়ী কাক – হতবাক, বিহবল।

 

নীল অশ্রুধারা

 

ফুটফুটে ছোট্ট মেয়ে। বয়স হয়তো আট কি নয় বছরের হবে। ছোট ছোট সাদা ফুলে ভর্তি গোলাপি রঙের ফ্রকে দেখে যেন মনে হচ্ছে কোন রাজকন্যা। একটা আইসক্রিম ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে কিন্তুু স্থির নয়। ছোট্ট ডান পা টি বারবার উঁচিয়ে দিচ্ছে ভ্যানের চিকন পাইপটিতে। দু হাত দিয়ে আঁকরিয়ে ধরার চেষ্টা বাক্সের ওপরের কিনারা। বাবার আইসক্রিম ভ্যানটিতে ওঠার এমনই চেষ্টা তার। হঠাৎ পা টি ফসকে যেতেই খিল খিল হাসির ধ্বনি শুরু মেয়ের। অপার্থিব সেই হাসি বাবার হৃদয়কেও দিলো ভাসিয়ে। সশব্দে বাবার হাসিও থমকে থমকে উছলে উঠে। চোখের কোণ বেয়ে ধেয়ে আসে হৃদয় ভাঙা বেদনার জল। প্যাডেলের ওপর গুটিয়ে রাখা পায়ে পড়ে সেই ফোঁটা ফোঁটা জল। রাস্তার পাশে জীর্ণ কুটিরের ছেঁড়া পর্দা সরিয়ে বাহিরে তাকায় মা। মেয়ের এমন ভুবন ভুলানো তুলতুলে মুখের হাসি মায়ের বুকের গহিনে কোথায় যেন বেদনার সুর তোলে। তারও দুচোখ বেয়ে নেমে আসে আনন্দ ও আক্রোশের জল। তবুও শব্দ করে হেসে হেসে মেয়ের সাথে তাল মিলায় মা। দরিদ্র মা-বাবার চোখের এমন নীল অশ্রুধারা কখনোই দেখতে পাবে না অক্ষিকোটরহীন আদুরে মেয়েটি। সৃষ্টিকর্তার রহস্য ভরা দুনিয়ায় ছোট্ট মেয়েটির অক্ষিগোলকহীন সমান জায়গাটিই শুধু যে দৃশ্যমান!

 

 

 

 

 

তিন সত্যি

 

দিনের শুরুতেই প্রথম বাসটির যাত্রায় এ কিসের বাধা? এক মায়াবিনীর আবির্ভাব চালকের জানালা পাশে। শাড়ির আঁচলে বাঁধা আছে দুটি ডাসা পেয়ারা। অনেকটি পথ দৌড়ে এসেছে। হৃদয় বেচারা বেহাল। শ^াস প্রশ^াসের অস্থিরতা প্রাণপ্রিয়কে একবার দেখার সুখটার পরম শত্রু হয়ে দাঁড়ায় এই ক্ষনে। কিছুতো একটা বলার ছিল – হয়তো অতি জরুরী। বাসের যাত্রীরা বড়ই ধৈর্য্যহীন। দশ মিনিট দেরী! তাদের জীবনের এক সেকেন্ড সময় এর মূল্য কত? এ নি¤œ শ্রেনীর বাস চালকের চিন্তা চেতনার বাইরেই হবে। যুবক চালকের হৃৎপিন্ডে বয় ¯িœগ্ধ কম্পন। পলকহীন চোখ ব্যস্ত জানালার পাশে মায়াবিনীকে দেখতেই। মায়াবিনীর কম্পমান কয়টা আঙুল ব্যস্ত- আঁচলের গেরো খুলতে। যাত্রীদের বর্বর চাপে অনিচ্ছায় বাস চলতে থাকে। মায়াবিনীর উঁচিয়ে ধরা ঘর্মাক্ত অপার্থিব হাত ঢুকে যায় জানালা গলে। হাতে আলতো করে ধরা পেয়ারা দুটো – নাকি ভালোবাসা? গাড়ির গতির সাথে সাথে প্রায় দৌড়াতে থাকে মায়াবিনী। সত্যি, সত্যি, সত্যি – তিন সত্যি। এটাই সেই ভালোবাসা!

 

 

 

অলৌকিক!

 

কসিমুদ্দি মেম্বরের বাড়ির উঠোন লোকে লোকারণ্য। স্বনামধন্য বাটি চালানকারী ওস্তাদ দবির বাটি হাতে প্রস্তুত। উদ্দেশ্য- হাতেম মিয়ার বাড়ির টাকা চুরির অপরাধী ধরা। চিরাচরিত বাটি চালানের নিয়মে আগে থেকেই অপরাধী নির্ধারিত হয়ে থাকে, এবারের ব্যাপারো তাই। আজও ওস্তাদ দবিরের বাটি পূর্ব পাড়ার কালুর দিকেই যাবে।

গোল হয়ে বসা অন্যান্যদের সাথে কালুও বসে আছে। মেম্বরের নির্দেশে আজকের আয়োজন নিরপেক্ষ করতেই হবে। কয়েকজন শুদ্ধ পড়ুয়া,আর কয়েক জন বখাটের সাথে নিজের বখাটে ছেলে রবিকেও রাখা হলো। সবার মাঝে টানটান উত্তেজনায় দবির বাটি চালনা শুরু করে। হাতের নিখুঁত কৌশলে ঘোরাতেই বাটি সবার চোখের সামনে ঘোরাতে থাকে। কিছুক্ষণ পর দবিরের ইচ্ছাতেই দু’তালুতে বন্দি বাটি গুটি গুটি করে মাটি ছেচড়ে এগোতে থাকে কালুর দিকে।

হঠাৎ ওস্তাদ দবিরের উচ্চস্বরে বোধগম্যহীন মন্ত্রপাঠ থেমে যায়। জীবনে এই প্রথম বাটি এগোচ্ছে তার ইচ্ছার বাহিরে। চুম্বুকের মতো হাত দুটো টেনে রেখেছে বাটি – ছুটছেও নিজ থেকে। হঠাৎ কালুকে পাশে ফেলে এগিয়ে থামে কসিমুদ্দির বখাটে ছেলের সামনে। নিয়ন্ত্রণহীন দবির স্থবির এই অলক্ষুণে অলৌকিক কা-ে।

অসম্ভব বলে লাফিয়ে ওঠে মেম্বর। বলে,পুনরায় চালাও বাটি।

দবিরের সাজানো বাটি চালানে এ পর্যন্ত কখনো যে ভুল হয়নি। দরদরিয়ে ঘাম ঝরে দবিরের যখন দ্বিতীয়বারও বাটি অলৌকিক ভাবে দেখায় রবিকেই। মেম্বরের হুমকিতে বন্ধ হয় বাটি চালানো আর পেটানো হয় স্বয়ং ওস্তাদ দবিরকেই।

মুক্ত কালু হতবিহ্বল হয়ে ফিরে বাড়িতে। গভীর রাতে শাবল নিয়ে যায় ঘরের পিছনে। নির্দিষ্ট জায়গা খুঁড়েই চাপা আর্তনাদে ফেটে পড়ে কালু। নিজ হাতে হাতেমের বাড়ি থেকে সত্যিই চুরি করা টাকার পুটুলিটা গর্ত থেকে উধাও! সবই কেমন যেন অলৌকিক মনে হচ্ছে এখন কালু চোরের কাছে। ব্যাপারটা কি!

ব্যাপারটা রবির কাছেও লাগছে অলৌকিক। কেননা কাকতালীয় ভাবে এই রবিই যে কালুর চুরি করা দেখে ফেলে ছিল। পরে অনুসরণ করে গিয়েও ছিল কালুর বাড়ি পর্যন্ত। আর কালুর অজান্তে টাকার পুটলিটা বের করে নিতে তেমন অসুবিধাই হয়নি। কিন্তু সবার সামনে দবিরের চলমান বাটি ওভাবে ওর দিকে এগিয়ে আসা – সত্যিই, ব্যাপারটা রবির মনের ভীষণ দাগ কাটে।

 

 

 

 

হেলেঞ্চা শাক

 

শহরের কোলাহল ছেড়ে দূরে আরো দূরে গাঁয়ের পথে ছুটছে পাজেরো জিপটি। যাত্রী বলতে চার জনা – দুই সন্তানের সাথে সস্ত্রীক সাজেদ সাহেব। গাড়ি চালানোর সাথে সাথে আশপাশের সৌন্দর্য্য দেখছেন প্রাণভরে। নামিদামি এক গ্রামীণ রিসোর্টে গ্রামীণ ছায়ায় কিছু সময় কাটাবেন আর খাবেন দুপুরের খাবারও। খরচের ব্যাপারটা সাজেদ সাহেবের কাছে এখন খুবই তুচ্ছ। যেতে যেতেই রাস্তার ঢালু পাড়ে এক রমণীকে দেখে হঠাৎ চমকে উঠেন। মুখ ঢাকা ঘোমটা টানা, মাথা নিচু করে মাটি থেকে কিছু তুলছেন রমনীটি। কি ভেবে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েন এক অজানা ঘোরে।

উৎসুক ধনীর অযাচিত উপস্থিতিতে বিব্রত রমণীটি শাড়ির আঁচলে কিছু লুকানোতে হয়ে উঠে ব্যস্ত। বিস্মিত সাজেদ সাহেব দেখেন সতর্কতা সত্ত্বেও রমণীর শাড়ির আঁচল থেকে কিছু সবুজ পাতা যেন পড়ল মাটিতে। বুকের ভেতরে যেনো চিনচিন করে উঠে মুহূর্তেই।

অতীত স্মৃতি মনে পড়ে যায়। দরিদ্র তাঁতী পিতার দুঃসময়ে দুবেলা সাদা ভাত জুটলেও, জুটতো না প্রায়ই কোনো সাধারণ তরকারি।

ছোট্ট সাজেদ প্রশ্ন করতো মাকে- শুধু নুন দিয়ে কি ভাত খাওয়া যায় মা?

ছেলের প্রশ্নে মা হতেন লজ্জিত। এই রমণীর মতো- হা ঠিক এই রমণীর মতোই লম্বা ঘোমটা টেনে, দ্রুত বেড়িয়ে যেতেন বাড়ির বাহিরে কোনো এক অদৃশ্য টানে। যখন ফিরে আসতেন মুখে থাকতো হাসি- রাজ্য জয়ের। সযতেœ আঁচলে বাঁধা ছোট পুটলির ভেতরে থাকতো ভর্তি এই সেই সবুজ পাতায়!

মা রাঁধতেন কতো অমৃত স্বাদে আর ছোট্ট সাজেদ খেতেন, সাদা ভাত সাথে মায়ের তুলে আনা সেই সবুজ পাতার শাক ভাজি। সেই কষ্ট সময়ের স্মৃতি সাজেদ সাহেবের হৃদয়ে তোলে ঢেউ , অশ্রুর বাষ্প দৃষ্টিকে করে ঝাপসা। লুকিয়ে কৌশলে মুছে নেন অশ্রু। অযতেœ জন্মানো হেলেঞ্চা শাক – যার নাম আর কেউ জানুক আর না জানুক কিন্তু সাজেদ সাহেব জানেন, জানবেন আজীবন।

 

সৈয়দ মনজুর, গল্পকার

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাহিত্য-গবেষণার আলোকবর্তিকা

শাহেদ কায়েস   আহমদ রফিক (জন্ম: ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-মৃত্যু: ২ অক্টোবর ২০২৫) বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুবনে আহমদ রফিক একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে

অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

আন্দরকিল্লা ডেক্স \ চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের আত্মজীবনী ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

ফেরা

সৈয়দা মাসুদা বনি   নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন   রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু! মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে

চিরহরিৎ বৃক্ষের গল্প

সুজন বড়ুয়া   ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়।