জ্যোতির্ময় নন্দী
“মোলোয়াসের রক্ত!” এ হুঙ্কারটাই ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো সেদিন, ১৯৮৫’র ১৮ অক্টোবর, দক্ষিণ আফ্রিকায় জোহানেসবার্গের রাস্তায় রাস্তায়। এ হুঙ্কারের সঙ্গে মাঝে মাঝে মিশে যাচ্ছিলো সোয়াহিলি রণহুঙ্কার, ‘মায়িহ্রোম’ অথবা ‘অস্ত্র হাতে তুলে নেয়া’র, দেশের বর্ণবিদ্বেষী নিপীড়ক শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক। সেদিন ভোর সাতটা নাগাদ প্রিটোরিয়া কেন্দ্রীয় কারাগারে কবি, মুক্তিযোদ্ধা, দু সন্তানের পিতা বেনজামিন মোলোয়াসকে ফাঁসি দেয়া হয়।
বেঁচে থাকলে চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর ৬৯ বছরে পা দিতেন তিনি। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক বর্ণবাদী সরকার ১৯৮৫’র ১৮ অক্টোবর তাঁকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মাত্র তিরিশ বছরের ভরা যৌবনেই তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছিলো। আমি মালেসেলা বেনজামিন মোলোয়াসের কথা বলছি, যাঁর ফাঁসির ঐতিহাসিক ঘটনাটি তাঁকে শহিদ কবি বেনজামিন মোলোয়াস (১৯৫৫-১৯৮৫) নামে পরিচিতি করে তুলেছিলো বিশ্বব্যাপী।
বস্তুত, গত শতকের শেষদিকে মোলোয়াসের ফাঁসি ছিলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলোর একটি। একজন কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশ ওয়ারেন্ট অফিসার ফিলিপুস সেলেপেকে হত্যার দায়ে মোলোয়াসকে ১৯৮২-তে গ্রেফতার করা হয়।
দীর্ঘ দু বছরেরও বেশি সময় ধরে এক প্রশ্নবিদ্ধ অনিয়মতান্ত্রিক বিচার বা বিচারের নামে প্রহসনেন পর মোলোয়াসের ফাঁসির রায় দেয়া হয়, তাঁর অপরাধ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও এই বিচার ও রায় দক্ষিণ আফ্রিকাসহ সারা বিশ্বে প্রবল আলোড়ন তোলে। মোলোয়াসের মৃত্যুদণ্ড রদ করার জন্যে দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রপতি পি. ডব্লিউ. বোথার কাছে আবেদন জানায় জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, যুক্তরাষ্ট্র সরকার। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারকে এ মৃত্যুদণ্ড রহিত করার পরামর্শ দিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটা প্রস্তাবও পাস করা হয়। মার্কিন সরকারের স্টেট ডিপার্টমেন্ট (পররাষ্ট্র বিভাগ)-এর একজন মুখপাত্র বলেন, “আমরা সুস্পষ্ট ভাষায় আমাদের মতামত জানিয়ে বলেছি, এ মামলাটার ক্ষেত্রে সাধারণ ক্ষমাই ন্যায়সঙ্গত হবে।”
দক্ষিণ আফ্রিকা, আফ্রিকা মহাদেশসহ সারা বিশ্বের প্রবল প্রতিবাদ আর অনুরোধ-উপরোধ সত্ত্বেও বোথা সরকার শেষপর্যন্ত এই তরুণ কবিকে ফাঁসিতে ঝোলায়। বিচারকরা রায় দেয়ার আগে মোলোয়াসের আইনজীবীরা তাঁদের মক্কেলের নিরাপরাধতার সপক্ষে নতুন নতুন সাক্ষ্যপ্রমাণ পেতে থাকায় আবেদন জানিয়েছিলেন মামলাটার পুনঃশুনানির জন্যে। কিন্তু আদালত ও বোথা সরকার সে-আবেদন প্রত্যাখ্যান করে।
জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব পেরেজ দ্য কুইয়ার মোলোয়াসের ফাঁসিকে মানবেতিহাসের শোচনীয়তম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর একটা বলে বর্ণনা করেছিলেন। আফ্রিকান ঐক্য সংস্থা এটাকে “এক বর্বর কর্ম” আখ্যা দিয়েছিলো। বিশ্বের প্রায় সব দেশ, জাতি, বিশিষ্ট নেতা, ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনের পক্ষ থেকে এ মৃত্যুদণ্ডের তীব্র নিন্দা করা হয়েছিলো।
বস্তুত বেনজামিন মোলোয়াসের হত্যাকাণ্ডই বর্ণবাদী বোথা সরকারের পতন ত্বরান্বিত করে। মোলোয়াসের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক অবস্থানের দ্রুত অধঃপতন ঘটে। দেশটির বর্ণবাদী সরকারের ওপর দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রোধের এক প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যায়। আফ্রিকা মহাদেশের অন্যান্য দেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর কঠোর অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। দেশটির মুদ্রা ‘রান্ড্’-এর মান তলানিতে গিয়ে ঠেকে।
শেষপর্যন্ত বর্ণবেষম্যবাদী সরকার নতি স্বীকারে বাধ্য হয়। আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেস (এএনসি) দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয় এবং দীর্ঘকাল ধরে কারাবন্দী শীর্ষস্থানীয় এএনসি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেয়া হয়। তাঁর মুক্তি দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা অন্দোলনে নতুন ভাবাবেগের সঞ্চার করে। বোথা সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়, এবং ম্যান্ডেলাকে রাষ্ট্রপ্রধান করে দক্ষিণ আফ্রিকা পরিণত হয় অতীতের দমনমূলক বর্ণবাদী নীতি থেকে মুক্ত একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার চলমান বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামে মোলোয়াসের আগেই প্রায় আটশ কালো মানুষ শহিদ হয়েছিলো, কিন্তু মোলোয়াসের ফাঁসিই ছিলো এ অন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট। এর পর ঘরে-বাইরে তীব্র রোষের বন্যা বর্ণবাদীরা আর ঠেকাতে পারে নি।
মোলোয়াস ছিলেন পেশাগতভাবে মূলত একজন আপহোলস্টার, মানে বিছানার তোশক-বালিশ, সোফার গদি ইত্যাদির নির্মাতা। তৎকালীন নিষিদ্ধ ঘোষিত এএনসি’র একজন গোপন সমর্থক ছিলেন তিনি। পেশাগত কাজের পাশাপাশি তিনি হযতো কিছু লেখালেখিও করতেন, কিন্তু পুলিশ হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে দু বছরেরও বেশি সময় কারাবন্দী থাকাকালে তিনি বেশ কিছু কবিতা রচনা করেন। ফাঁসির ঠিক আগেই লেখা একটা কবিতায় তিনি বলেছেন:
“আমি যা হয়েছি তাতে আমি গর্বিত…
অত্যাচারের ঝড়ের পর আসবে
আমার রক্তের বৃষ্টি
আমি গর্বিত দিতে পেরে আমার জীবন
আমার এই একাকি একটি জীবন”
বেনজামিন মোলোয়াসের ফাঁসি সারা বিশ্বে একজন তরুণ কৃষ্ণাঙ্গ বিপ্লবী কবির হত্যাকাণ্ড হিসেবেই প্রচারণা পায়। এর প্রতিবাদে সমকালীন বিশ্বের আরো অনেক কবি সমবেদনা ও প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। শোকার্ত কবিরা মোলোয়াসের বর্ণবাদ বিরোধী অবস্থান ও সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।
এখানে এমন কয়েকটি কবিতার বাংলা অনুবাদ করে দেয়া হলো। এগুলোর মধ্যে ‘বেনজামিন মোলোয়াসের জন্যে’ শিরোনামের প্রথম কবিতাটির রচয়িতা ডেসমন্ড এগান (১৯৩৬) একজন বিখ্যাত আইরিশ কবি, অনুবাদক ও সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। ‘আমিই সেই মুখ’ শীর্ষক দ্বিতীয় কবিতাটির কবি ভার্নি ফেব্রুয়ারি ওরফে ভার্নন আলেকজান্ডার ফেব্রুয়ারি (১৯৩৮-২০০২) একজন স্বনামধন্য দক্ষিণ আফ্রিকান শিক্ষাবিদ ও কবি। তৃতীয় কবিতাটি চীনের বেইদাইহে শহরে কোনো অজানা কবির লেখা।
১
বেনজামিন মোলোয়াসের জন্যে
(যাঁকে ১৯৮৫’র ১৮ অক্টোবর শুক্রবার প্রিটোরিয়ায় ফাঁসিতে ঝোলানো হয়)
ডেসমন্ড এগান
“জীবন উঠে আসে মৃত্যু থেকে, এবং দেশপ্রেমিক নারী-পুরুষদের কবর থেকে উঠে আসে জীবন্ত জাতিগুলো.”– প্যাড্রেইক পিয়ার্স
মোলোয়াস, সারা বিশ্ব দাঁড়িয়ে
নীরবতা পালন করছে তোমার জন্যে
তোমার জনগণের জন্যে
আমরা একসাথে আমাদের মাথা নোয়াচ্ছি
নিগ্রহের ওই ময়দান ঘিরে
তোমার মৃত্যু এখন আমাদের প্রিয়জন বিয়োগের শোক
তোমার সাহস আমাদের ঘৃণা প্রতিটি দমনকারীর প্রতি
তাদের প্রতি যারা স্বাধীনতাকে লুকোতে চায়
টিয়ারগ্যাসের মেঘের আড়ালে
ন্যায়কে হাঁটু গেড়ে বসাতে চায় স্যাম্বক১ দিয়ে চাবকিয়ে
কালো আফ্রিকাকে ঝোলাতে চায় সাদা ফাঁস থেকে
কলিচুনে পুঁতে দিতে চায় যৌবনের কবিতাকে
এবং বিশ্বের নীরবতা প্রবাহিত হয় রক্তের মতো
এটা তাদের বিষণ্ন সুইমিং পুলগুলো ভর্তি করে ফেলে
চুঁইয়ে ঢুকে পড়ে তাদের বারান্দায় আর ইটের ভেতরে
এটা ঝুলে থাকে তাদের বেড়ার তারে
হামাগুড়ি দেয় তাদের সোনার সিন্দুকে
এবং গভীরতর হয়ে
এটা পরিণত হয় আর্তনাদে
এটা ঢুকে পড়ে আমাদের বিবেকের ভেতরেও
তোমার কফিনের কাঠ তোমার জীবনের
লঘুভার নিয়ে বেনজামিন
যখন আমরা কাঁধবদল করছি তোমার দেহাবশেষ বয়ে নিয়ে যেতে যেতে
শোক করছি ঠিকই কিন্তু অনুপ্রাণিতও হচ্ছি, সেইসাথে চেতনা
নিজের কাছে সত্য হয়ে উঠছে দেখতে পেয়ে একটা আদর্শ
দাগিয়ে দিচ্ছে একটা জ্বলন্ত বর্শার মতো
যার ফলে তোমাকে ওরা যখন ফাঁসিতে ঝোলালো আমরা সবাই পরিণত হলাম কালো মানুষে
জল্লাদ ভুরু কুঁচকে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকায় তার তালিকার দিকে
আমরা আইরিশরা তাকে হুঁশিয়ারি দিতে পারতাম যে
তোমাকে ধারণ করার মতো গভীর কোনো কবর হতে পারবে না
পিয়ার্সকে২ যতটুকু ধারণ করতে পেরেছে তার বেশি না
যেকোনো দেশপ্রেমীকে যতটুকু ধারণ করতে পারে তার বেশি না
এবং যদিও ওরা তোমার থেকে মুক্তি চেয়েছে
শেষরাতে সারা জগৎ যখন ঘুমিয়ে
ওই গর্দভগুলো
কবর খুঁড়তে খুঁড়তে দেখতেই পায় নি
তোমার আত্মা ছড়িয়ে পড়ছে আফ্রিকায়, সারা পৃথিবীতে
যুগের সন্তান বেনজামিন
১স্যাম্বক হলো দক্ষিণ আফ্রিকায় একধরনের লম্বা, শক্ত চাবুক, যেটা সাধারণত তৈরি করা হয় গণ্ডারের চামড়া দিয়ে।
২প্যাড্রেইক (প্যাট্রিক) পিয়ার্স (১৮৭৯-১৯১৬) ছিলেন আইরিশ জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী কবি, লেখক, শিক্ষক, আইনজীবী, যাঁকে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো।
২
আমিই সেই মুখ…
ভার্নি ফেব্রুয়ারি
আমি সলোমন মাহলাঙ্গু১
তোমরা আমাকে চিনবে না
কেএলএম বিমান থেকে বেরিয়ে
সিঁড়ি বেয়ে যখন তোমরা নিচে নেমে আসো
জান স্মাটসের২ টারম্যাকে
স্বপ্ন দেখছো — হয়তো তোমাদের সাফারি ছুটি কাটানোর
যার কথা অমন দারুণভাবে বলা হয়েছে
আমস্টারডামে তোমাদের দেখা ব্রোশিউরগুলোতে।
তোমরা আমাকে দেখতে পাবে না
সূর্যালোকিত দক্ষিণ আফ্রিকায়
তোমাদের ‘জীবনের স্মরণীয় ভ্রমণে’ যাওয়ার জন্যে
সাফারি স্যুট পরে তৈরি হতে হতে।
তবুও আমি হলঘরে তোমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া
সেই নীল ওভারঅল পরা ছেলেটা,
আমি কুড়োতে থাকবো মেঝেতে তোমাদের মতোদের
ছড়িয়ে ফেলা সিগারেটের পোড়া টুকরোগুলো,
আর যখন তোমরা টয়লেট ব্যবহার করবে
জানবে, যে-হাত দুটো সেটাকে পরিষ্কার করেছে সেগুলো আমার।
আমি সেই কালো মানুষটা
তোমরা যাকে চিনতে পারবে না
যখন তোমরা হুশ করে বেরিয়ে যাবে
ই-গাউটিনিতে তোমাদের ছুটি কাটানোর সরাইখানার দিকে।
আমি যে সলোমন মাহলাঙ্গু
সেটা তোমরা জানো না।
আমিই সেই বেনজামিন মোলোয়াজ
ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই যে ঝুলেছিলো
ওদের রশির প্রান্ত থেকে।
এখন ইনিয়ানিয়াদের৩ সাথে নিরাপদে থাকা তোমরা
আমাকে চিনতে পারবে না
যখন কেএলএম বিমান থেকে নেমে আসবে
বুশভেল্ডে৪ তোমাদের ছুটি কাটানোর জন্যে তৈরি হয়ে।
আমিই সেই লোক যে তোমাদের পত্রিকার পাতাগুলো ভর্তি করে রাখতো
এই তো মাত্র কয়েকমাস আগেও,
যখন তোমরা রৌদ্রালোকে ছুটি কাটানোর ব্যাপারে প্রথম খোঁজখবর নিচ্ছিলে।
আমিই সেই বেনজামিন মোলোয়াজ
তোমরা চিনতে পারছো না।
আমিই আহমেদ টিমল৫ নামের সেই লোক
যে ঝাঁপ দিয়েছিলো জন ভরস্টার স্কোয়ার থেকে।
আমার কালো ভাইদের ঘামে
গড়ে ওঠা এই স্বর্ণনগরীতে
কিউরিও শপগুলোতে কেনাকাটা করতে করতে
আমাকে তোমাদের চোখেই পড়বে না।
আমিই সেই লোক যার রক্ত ঝরেছিলো ঠিক ওই জায়গাটাতেই
যেখানে এখন তোমাদের বউ ছবি তোলার পোজ দিচ্ছে
এই মৃত্যুপুরীতে।
আমিই সেই আহমেদ টিমল
যার ছায়া তোমরা কোনোদিন অনুভব করবে না।
আমিই সেই হেক্টর পিটারসন৬
একটা বুলেট যার জীবনবাতি নিবিয়ে দিয়েছিলো
মাত্র এগারো বছরের বালক বয়সে।
রৌদ্রকরোজ্জ্বল দক্ষিণ আফ্রিকার অংশ হিসেবে ‘আদিম আফ্রিকা’ দেখাতে
তোমাদের মতো ভ্রমণবিলাসীদের জন্যে বিশেষভাবে আয়োজিত
জুলু আর গামবুট নাচ দেখায় মগ্ন তোমরা
আমার শিশুকণ্ঠস্বর শুনতে পাবে না।
আমরা সেসব ভূত
যারা তোমাকে সঙ্গ দেবে
রাজকীয় ড্র্র্যাকেন্সবার্গে
সুদৃশ্য গার্ডেন রুটে
ক্রুগার জাতীয় উদ্যানে
তোমাদের ভ্রমণ জুড়ে।
আমিই সেই লোক
যে তখন কেপ-এ ছিলো
যখন তোমরা এসে পৌঁছেছিলে
‘দে রাইহার’, ‘দে দ্রোমেদারিস’, আর ‘ ‘দে হুডে হোয়েপ’৭
এ তিনটে জাহাজে করে।
আমিই সেই মৃতদেহ
সেই বিকৃত ক্ষতবিক্ষত লাশ
সেই ইম্বোঙ্গি৮
সেই ইজিনিয়ানিয়া৯
সেই উত্তাল ক্রুদ্ধ জনতা
সেই মুক্তিযোদ্ধা
যাদের মুখ তোমরা কখনো দেখবে না
তোমাকে প্রলুব্ধ করা
রৌদ্রকরোজ্জ্বল দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রোশিউরগুলোতে।
১সলোমন কালুশি মাহলাঙ্গু (১৯৫৬-১৯৭৯) ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার একজন কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তিযোদ্ধা, আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেসের যোদ্ধা শাখার সদস্য। দেশটির বর্ণবাদী সরকার মাত্র তেইশ বছরের তরুণ মাহলাঙ্গুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে।
২জান স্মাটস এয়ারপোর্ট হলো দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী প্রিটোরিয়ায় সাবেক বর্ণবাদী সরকারের আমলে সেদেশের কূটনীতিবিদ, সামরিক অধিনায়ক, দার্শনিক ইয়ান খ্রিশ্চিয়ান স্মাটস (১৮৭০-১৯৫০)-এর নামাঙ্কিত বিমানবন্দর। শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী সরকারের পতনের পর এটার নাম পাল্টে আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেস (এএনসি)-এর প্রাক্তন সভাপতি, বর্ণবাদ বিরোধী রাজনৈতিক নেতা অলিভার রেজিনাল্ড কাইজানা টাম্বো (১৯১৭-১৯৯৩)’র নামে ও. আর. টাম্বো এয়ারপোর্ট রাখা হয়েছে।
৩আফ্রিকার জুলু ভাষায় ‘ইনিয়ানিয়া’ মানে হলো ‘পূর্বপুরুষ’।
৪বুশভেল্ড হলো আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যময় প্রাণীসম্পদে ভরপুর কিছু অঞ্চল।
৫আহমেদ টিমল (১৯৪১-১৯৭১) ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় নিষিদ্ধ ও গোপনে সক্রিয় কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য, বর্ণবাদ বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী। ২৯ বছরের তরুণ টিমলকে গ্রেফতার করে জোহান্সবার্গের একটা থানায় নিয়ে গিয়ে সে-ভবনের সর্বোচ্চ তলা থেকে তাঁকে ঠেলা মেরে নিচে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো।
৬জোলি হেক্টর পিটারসন (১৯৬৩-১৯৭৬) ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকার এক কৃষ্ণাঙ্গ স্কুলছাত্র। ১৯৭৬-এ সোয়েতো অভ্যুত্থানের সময় পুলিসের গুলিতে সে নিহত হয়েছিলো।
৭দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ অব গুড হোপ বা উত্তমাশা অন্তরীপে প্রথম পৌঁছা তিনটে ইউরোপীয় (ওলন্দাজ) জাহাজ, যেগুলোর ইংরেজি নামান্তর হলো যথাক্রমে ‘দা হেরন’, দা ‘ড্রোমেডারিস’, এবং ‘দা গুড হোপ’।
৮দক্ষিণ আফ্রিকার জোসা ভাষায় ‘ইম্বোঙ্গি’ মানে হলো ‘চারণ কবি’।
৯জুলু ভাষায় ‘ইজিনিয়ানিয়া’ হলো ‘ইনিয়ানিয়া’ (পূর্বপুরুষ) শব্দের বহুবচন।
৩
দক্ষিণ অফ্রিকায় বেনজামিন মোলোয়াসের ফাঁসির খবর শুনে
(কবিনাম অজ্ঞাত)
এখানে বোহাইয়ের বেলাভূমিতে
ঢেউগুলো পাকিয়ে ওঠে তাদের সবুজ শব্দের ভেতরে।
বেনজামিন মোলোয়াসকে
আজ ফাঁসি দেয়া হয়েছে প্রিটোরিয়ায়।
যেখানে সূর্য জলকে পোড়ায়
চীনা জেলেরা জাল ছোঁড়ে।
তাদের নৌকাগুলো দোল খায় শোলার ছিপির মতো।
নৌকাগুলো আর জালগুলো ছাড়িয়ে ভাসে আমার দেশ,
অনেক দূরে নীলের একটা স্বপ্ন।
বেনজামিন মোলোয়াসকে আজ ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে।
নীল জ্যাকেট পরা স্থানীয় একদল লোক এসে
একটা ঘাটে এসে তাকিয়ে আছে
শর্ট আর বিকিনি পরা অদ্ভুতদর্শন আমেরিকানদের দিকে
যারা লাফিয়ে পড়ছে ঢেউয়ের ফেনায় আবার বেরিয়ে আসছে।
কুঞ্চিত ত্বকের এক বুড়ি, যে কখনও
সোনালি চুলের ছেলে দেখে নি, কখনও শোনে নি
কোনো আমেরিকান ছেলেকে চেঁচিয়ে উঠে ঝপাং করে
ঝাঁপিয়ে পড়তে আমাদের ভালোবাসার ঠান্ডা সাগরটাতে।
বেনজামিন মোলোয়াসের পদচারণা আর কখনও
দেখা যাবে না এই সোনালি সৈকতে। মানুষদেরকে
আর তাদের জালগুলোকে ছাড়িয়ে একটা দ্বীপ ভাসে
যেখানে কাউকে কোনোদিন ফাঁসি দেয়া হয় নি।
সৈকতে দূরের প্রান্তে
এক তরুণী বসে আছে তার ইজেলের পাশে।
সে আঁকছে অ্যাস্পেন গাছ, সমুদ্রের ঢেউ, হাওয়া,
শোলার ছিপির মতো দুলতে থাকা নৌকা,
সুদূর এক নীলের স্বপ্ন।
প্রিটোরিয়ায় আজকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে
কবি বেনজামিন মোলোয়াসকে।
জ্যোতির্ময় নন্দী, কবি ও অনুবাদক




