কামরুল হাসান বাদল
ঘুমের মধ্যেই সঙ্গীতের একটি ব্যঞ্জনা শুনতে পাচ্ছিলাম। তাতে ঘুমটা হালকা হতে থাকল। আর ঘুম ভাঙতে ভাঙতে বুঝতে পারলাম সেটি ছিল মোবাইলের রিং টোন। কল সবেমাত্র শেষ হওয়ায় স্ক্রিনের আলোটা নেভেনি তখনো। তাতে দেখলাম পাঁচটা বাজার আরও দু মিনিট বাকি। এ সময় মৃত্যুসংবাদ দেওয়া ছাড়া অন্যকোনো কারণে ফোন করে না কেউ। একটি দুঃসংবাদ শোনার জন্য যখন মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন আবারও বেজে উঠল ফোন। স্ক্রিনে ভেসে উঠল লীলা। কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে ভেবে ভয়ে ভয়ে ফোনটা ধরলাম।
অপর প্রান্ত থেকে কোনো ভূমিকা ছাড়া লীলা বলল, ‘আজ সকালেই আমাকে বিয়ে করতে পারবি?’
তখনো ধাতস্থ হইনি। বললাম ‘মানে?’
‘মানে হল আজ সকালেই কাজির অফিসে গিয়ে আমরা বিয়ে করব। তোর পক্ষে সম্ভব কিনা বল?’
আমার এক সেকেন্ড লাগল ভাবতে। খুব স্মার্টলি বললাম, ‘ইম্পোসিবল!’
‘হারামির বাচ্চা’-
বলে ফোনটা কেটে দিল । আমি কতক্ষণ হ্যালো হ্যালো করলাম। তারপর কলব্যাক করলাম। কল যাচ্ছে না। বিজি দেখাচ্ছে। মেসেজ পাঠালাম; গেল না। ওয়াটসঅ্যাপস দেখলাম; ব্লক। মেসেঞ্জারে দেখলাম; ব্লক। ফেসবুকেও আমাকে ব্লক করে দিয়েছে। প্রায় পনেরো মিনিট চেষ্টা করলাম অনবরত। কোনো লাভ হলো না। এখন নিজের চুল নিজেকেই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কেন যে এভাবে বলতে গেলাম।
আমি ভেবেছিলাম, ইম্পোসিবল বলার পর লীলা বিস্মিত হয়ে বলবে, ‘কী বললি, ইম্পোসিবল?’
আমি বলব, ‘হ্যাঁ। তোর আরেকটা মোবাইলের নোটে ইংরেজিতে লেখ ওসঢ়ড়ংংরনষব. লিখেছিস? এবার আই-এর পর একটা ঊর্ধ্বকমা দে।’
লীলা বলবে, ‘ঊর্ধ্বকমা কী?’
আমি বলব, ‘বোকা! ঊর্ধ্বকমা বুঝিস না।’
সে সময় লীলা বলবে, ‘ও বুঝেছি বুঝেছি, দিলাম।’
আমি বলব, ‘এবার এম ও পি-এর মাঝখানে স্পেস দে।’
ও বলবে, ‘দিলাম।’
কিছু একটা জয় করার মতো করে বলব, ‘এখন কী দাঁড়াল?’
তখন ও বলবে, ‘আই অ্যাম পসিবল।’
আমি তখন এপ্রান্ত থেকে বলব, ‘উম-ম-ম হা, হা, হা। এখনই বের হচ্ছি। একটু দাঁতটা ব্রাশ করে নিই?’
ওসব কিছুই হলো না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কেন যে নাটকীয়তা করতে গেলাম! এই মেয়ের মাথা যে কখন ঠাণ্ডা হবে!
খুব অসহায় লাগছে। কী করব ভাবতে ভাবতে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। বাইরে চোখ ফেলতেই খুব অবাক হলাম। অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ। আহা! কতদিন এমন ভোর দেখিনি। কী অসাধারণ শান্ত, সৌম্য পরিবেশ। আমার ব্যালকনিটি যে পাশে সেদিকে কাছাকাছি কোনো বহুতল বাড়ি নেই। লাগোয়া একটা সেমিপাকা বাড়ি আছে। তার চারপাশে কাঁঠাল, পেয়ারা, নারিকেল, কামরাঙাসহ বেশকিছু গাছ আছে। সেসব ঘিরে নানা জাতের পাখি কিচিমিচির করছে। এই ব্যস্ততম ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এখনও এত ধরনের পাখি আছে দেখে অবাকই হলাম। কতদিন হলো এই বাসায় উঠেছি কিন্তু এ দৃশ্য চোখে পড়েনি।
পূর্বে জেনারেল হাসপাতালের ফাঁক দিয়ে সূর্যের লাল আভা উঁকি দিতে শুরু করেছে। অপূর্ব দৃশ্য। মোবাইল দিয়ে কয়েকটি ছবি তুললাম।
এতক্ষণের বিমর্ষতা কাটতে শুরু করেছে। মনের মধ্যে জেগে উঠছেন কবিগুরু। এই ভদ্রলোককে নিয়ে বড় ঝামেলায় আছি। আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ কোনোটাতেই তাঁকে ভুলে থাকতে পারি না। যে কোনো অনুভূতি জানাতে তাঁর শরণাপন্ন হতেই হয়! এই যেমন এখন মনে পড়ল, ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার / আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হলো কার।’
ভাবছি আজ দিনটা কেমন যাবে? লীলা হঠাৎ বিয়ের কথা বললো কেন? তবে ও বলেছিল, ওর বাবা কোন এক আত্মীয়ের সঙ্গে ওর বিয়ের কথা ভাবছেন।
লীলা এখন বিয়েতে রাজি নয় তা না কি জানিয়ে দিয়েছে। তাহলে কী এমন জরুরি অবস্থা হলো ভোররাতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বিয়ের? আসলে এই মেয়েকে হ্যান্ডল করা মুশকিল।
বাসায় কেউ জাগেনি এখনও। ব্রেকফাস্ট দিতে দিতে নয়টা বাজবে। সময় দেখলাম প্রায় সাতটা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই রেস্টুরেন্ট খোলার কথা। আমাদের গলির মুখেই দস্তগীর হোটেল। সে হোটেলের নেহারি অর্থাৎ গরুর নলা খুব বিখ্যাত। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে নারীপুরুষ এখানে নলা খেতে আসে। এমন কি ডিসি হিলে প্রাতঃভ্রমণে আসা বয়স্ক লোকেরা ব্যায়াম শেষে এখানে নলা খেতে বসে যায়। নলা আমার পছন্দ না। মানুষ যখন নলা মুখে নিয়ে তাতে লেগে থাকা মাংস নিয়ে টানাটানি করে সে দৃশ্য আমার কাছে খুব কুৎসিত মনে হয়। সেই আমি আজ রাগে-দুঃখে-অপমানে দস্তগীরে নলা খেতে বের হচ্ছি।
সড়ক পেরিয়ে দস্তগীরে ঢুকতে যাব মুখে দেখা হয়ে গেল লীলার মায়ের সঙ্গে। সেলোয়ার কামিজের সঙ্গে এখন নারীরা কেডস পরে। তিনিও পরেছেন। বুঝলাম তিনিও প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন। সঙ্গে তাঁর সমবয়েসী কয়েকজন আছেন। খুব বিনয়ের সঙ্গে সালাম দিলাম। সালামের উত্তরে মৃদু হাসলেন। সম্ভবত তাঁর সঙ্গীদের কেউ পার্সেল নিয়ে যাচ্ছেন। চলে গেলেন তাঁরা।
আজকের দিনটি কেমন যাবে আবার ভাবতে ভাবতে টেবিলে বসে নলা ও নানরুটির অর্ডার দিলাম।
খাওয়ার মাঝখানে দেখলাম টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে দোকানে ঢুকল আদনান। একই বিল্ডিংয়ে থাকি। আমাকে খুব পছন্দ করে। ক্লাস নাইন কি টেনে পড়ে। বাসার জন্য নলা ও নানরুটি নিতে এসেছে। কাছে ডেকে বললাম, ‘ভাইয়ার একটা কাজ করে দিবি? তোকে বার্গার খাওয়াবো বিকেলে।’ বার্গারের কথা শুনে রাজি হয়ে গেল সে।
টেবিল থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে আদনানকে বললাম, ‘ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে কলম নিয়ে আয়।’
টিস্যু পেপারেই লিখলাম, ‘তোমাকে ছাড়া বাঁচার প্রশ্নই আসে না। তখন বলতে পারিনি। আজকেই বিয়ে করবো।’
আদনানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘এই কাগজটা লীলা আপুকে দিয়ে আসবি।’
একই পাড়ায় সবাই সবার পরিচিত। কাছাকাছি বিল্ডিং। সে কী বুঝল জানি না। বলল, ‘শুধু বার্গার খাওয়ালে হবে না। একটা পিজার টাকাও দিতে হবে।’
তখন আমি অনন্যোপায়। বললাম, ‘সব পাবি। যা ভাই তাড়াতাড়ি।’
সম্ভবত দশ মিনিটেই ফিরে এলো সে। আমি প্রায় লাফ দিয়ে গেলাম ওর কাছে। বললাম, ‘দিয়েছিস?’
ও মাথা ঝাঁকালো। বলল, ‘ভাইয়া আমার নাস্তা নিতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। মা বকা দেবে।’
লীলার সঙ্গে পরিচয়টা দীর্ঘদিনের হলেও সম্পর্কটা বেশিদিনের নয়। বছর দুয়েক হবে হয়ত। আপনি থেকে তুমি, তুমি থেকে তুইতে নামতে দু মাসও লাগেনি। আমি পড়া শেষ করে কোথাও জয়েন করিনি। বেকার সময় কাটাচ্ছি। আর লীলা ফাইনাল দেবে আগামীবার। ওর বাবা ব্যবসায়ী। অর্থবিত্ত যথেষ্ট আছে। আলীশান একটি ফ্লাটে থাকেন। তাঁদের একমাত্র মেয়ে লীলাবতী। বেশি আদরযত্নে জেদি হয়ে ওঠা একটা ভালো মেয়ে।
পাড়ায় এক সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। ছোট বলে আমিই তাকে তুই বলে সম্বোধন করতাম। বয়সের ব্যবধান ঘুরিয়ে একদিন তা বন্ধুত্বে রূপ নিল। আপনি-তুই সম্বোধন একদিন শুধু তুই-তে নেমে এলো।
লীলার বাইরে পড়ার সুযোগ ছিল। বাড়ি থেকে চাপও ছিল কিন্তু সে গেল না। সে নাকি কখনো বাংলাদেশ ছেড়ে যাবে না। ওর থিম সং নাকি ‘ ও আমার দেশের মাটি তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা।’
গ্রামার স্কুলের ছাত্রী হলেও নাক উঁচা ভাব নেই। পারত পক্ষে ইংরেজি বলে না। জিনস-টিশার্ট পরলেও কপালে মস্ত একটা টিপ লাগাবে। অসম্ভব মিষ্টি কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে। লীলার প্রেমে পড়ার ১০১টি কারণ আছে।
নলা খেয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। চা খেতে খেতে হাই উঠল কয়েকবার। সোজা বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়লাম।
আবার ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো। ফোন রিসিভ করতে করতে ঘড়িতে দেখলাম দুপুর একটা। অপরপ্রান্তে লীলার খুব চড়া গলা, ‘হারামজাদা আমাকে না করে দিয়ে আমার মাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিস? আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।’
আমি চতুর্থ আসমান থেকে পড়লাম যেন, বললাম, ‘কী বলছিস এসব? তোর মাথা ঠিক আছে? আমি খালাম্মাকে এমন কথা লিখতে পারি?’
‘তোর কথা থামা, আমার কথা শোন’, আমাকে থামিয়ে দিল লীলা। বলল, ‘ভোরে মা’র সঙ্গে তোর দেখা হয়েছিল?’
‘হ্যাঁ।’
মাকে দেখে মাথা চুলকাতে চুলকাতে ‘হেসেছিলি?’
আমি মনে করার চেষ্টা করছি।
‘তার কিছুক্ষণ পর আদনানকে দিয়ে মায়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিস, তোমাকে ছাড়া বাঁচার প্রশ্নই আসে না। তখন বলতে পারিনি।’
‘মায়ের মাথায় পানি ঢালতে হচ্ছে সকাল থেকে। তোর মতো বেয়াদব ছেলে নাকি মা জীবনেও দেখেনি। বাবা অফিস থেকে এলে তোর বাবার কাছে বিচার নিয়ে যাবে।’
লাইন কেটে দিল লীলা।
চিৎকার করে উঠেছিলাম বোধহয়। মা রুমে ঢুকে বলল, ‘দুঃস্বপ্ন দেখেছিস? চিৎকার দিলি কেন? ওঠ। আমি চা দিতে বলি।’
আমার সবচেয়ে অপছন্দের শিল্পীর গাওয়া শীর্ষ অপছন্দের গানের কলিটি মনে আসল- ‘আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার।’
সন্ধ্যায় বসেছিলাম টং দোকানে। ছিলাম চার-পাঁচজন। কারো সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ভোর থেকে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনা শেয়ারও করলাম না কারো সঙ্গে। পরপর তিনকাপ চা খেয়েছি। এখন মুখটা তেতো তেতো লাগছে। সিগ্রেটও ভালো লাগছে না। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ডিসি হিলে। নির্জন একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে বসলাম। এরমধ্যে অন্তত ২০টা ফোন এসেছে একটাও রিসিভ করিনি। সাড়ে সাতটার দিকে লীলার ফোন এলো।
‘মাকে ম্যানেজ করেছি। চিঠিটা তোর না এবং তুই এমন কাজ কোনোদিন করতে পারিস না সেটা মাকে বিশ্বাস করিয়েছি। রাতে ফোন দেব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে’- বলেই ফোনটা কেটে দিল।
ডিসি হিলে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা নেই। চারদিকে আবর্জনার স্তুপ। এরই মধ্যে প্রচুর মানুষ আছে। কেউ বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ কেউ হাঁটছে। কিছু শিশু-কিশোর মঞ্চের সামনে সমান জায়গাটিতে ফুটবল খেলছে। সে বল অনেক সময় মানুষের গায়ে এসে পড়ছে তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই ওদের।
এরমধ্যে ইউনিফর্ম পরা এক লোক হ্যান্ডমাইক নিয়ে ঘোষণা দিল, আটটা বেজে গেছে, আপনারা সবাই বেরিয়ে যান। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হুইসেলও দিচ্ছে সে। বেশিরভাগ লোক বের হয়ে যেতে লাগল। তবে একদল মহিলা গেটের পাশে সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে তর্ক করছে আরও আধঘণ্টা থাকার আবদার নিয়ে।
ভাবছি এক সময় ডিসি হিল ছিল সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মূলকেন্দ্র। এখন সেখানে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এমন পাবলিক প্রপার্টিগুলো পাবলিক সার্ভেন্টরা দখল করে রেখেছে তা নিয়ে বলবার কেউ নেই।
বেরিয়ে এলাম ডিসি হিল থেকে। ভালো লাগছে না কোথাও। রাতে লীলা কী বলতে পারে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। ফোন করলাম, যাচ্ছে না।
ঠিক রাত ১২টায় ফোন করে লীলা বলল, ‘বের হ। আমি গলির মুখে দাঁড়িয়ে আছি।’
বললাম, ‘এত রাতে কই যাবি?’
‘এত কথার দরকার নাই। জিন্সের প্যান্টের সঙ্গে একটা পাঞ্জাবি পড়বি। পকেটে টুপিটা রাখবি। কুইক কুইক।’
বের হয়ে দেখলাম সে সত্যি সত্যি গলির মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
কাছে গিয়ে বললাম, ‘টুপি আনতে বলেছিস কেন?’
‘আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি তাই। আমি ব্যাগের মধ্যে ওড়না নিয়ে এসেছি।’
‘এই রাতে বিয়ে কীভাবে করবি? কাজী পাবি কোথায়?’
‘বিয়ে করব কাল। বাদে ফজর। আমি দেখেছি অনেকের আকদ হয় যোহর, আছর মাগরিব ও এশার নামাজের পরপর। আমরাই প্রথম ফজরের নামাজের পর বিয়ে করতে যাচ্ছি। আমরা একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছি। আমি ভীষণ এক্সাইটেড। এক কাপ চা খাওয়া লাগবে চল।’
শহরে কিছু কিছু টং দোকান আছে যেগুলো সারারাত খোলা থাকে। এমন একটাতে গিয়ে বসলাম। চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললাম, ‘এত রাতে বিয়ে হবে কীভাবে? বুঝলাম না।’
ব্লু জিন্সের সঙ্গে একটি সাদা টিশার্ট পরা। বুকের ওপর নীল রঙে লেখা ‘গধৎৎু সব’. পায়ের ওপর পা তুলে এবং দোলাতে দোলাতে জবাব দিল, ‘আজ রাতে বিয়ে হচ্ছে আমাদের সে কথা কে বলল তোকে। গাধা কোথাকার। এত রাতে কাজি পাবি কই?’
এই মেয়েটা জীবনেও সিরিয়াস না। বিয়ের মতো এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ওর হেঁয়ালিপনা দেখে খুব রাগ লাগছে। তবে তা প্রকাশ করতে পারছি না। বিশ্বাস নেই এই মেয়ে যেকোনো কিছুই করে ফেলতে পারে।
চা শেষ করে সিগারেট জ্বালালো সে।
বললাম, ‘একটু লুকোছাপা করে টান। পাড়ার কেউ দেখে ফেলবে তো।’
শুনে গভীর একটা টান দিয়ে বলল,
‘কার বাপের পয়সা দিয়ে খাই নাকি? লোকে কী বলবে তা নিয়ে ভাবি না। তুইও খা, খাচ্ছস না ক্যান?’
‘একটু সিরিয়াস হ লীলা। জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি আমরা-‘
কথা শেষ করার আগেই চুটকি বাজিয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘রাইট, কাম টু দ্য পয়েন্ট। এটার জন্যই তো মধ্যরাতে তোকে ঘর থেকে বের করে আনলাম। শোন, মনোযোগ দিয়ে শোন।’
বলতে বলতে দাঁড়িয়ে গেল সে। সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিল। আমরা দুজন ছাড়া আরও তিন-চারজন দোকান ঘিরে বসা। দেখে বোঝা যাচ্ছে এরা রিকশাচালক বা শ্রমিক টাইপের লোক হবে হয়ত। ওরা ভীষণ বিস্ময়ের সঙ্গে লীলাকে দেখছে। সেদিকে খেয়াল নেই লীলার। তবে ইশারায় আমাকে কাছে ডেকে প্রায় কানে কানে বলল,
‘বিয়ে তো করব কাল। তবে আজ সারারাত আমরা দুজন শহরে ঘুরতে ঘুরতে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। হঠাৎ আচমকা তো বিয়ে করা যায় না।’
খালি বেঞ্চটা দেখিয়ে বলল, ‘বয়, বসে মাথা ঠাণ্ডা কর। বিয়ের কিছু শর্ত আছে না? বিয়ের পর কার কী করণীয়, কার কেমন কাজ, পরষ্পরের ব্যবহার, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ইত্যাদির মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে, সমঝোতা হবে। যদি সব মিলে যায় তাহলে ফজরের নামাজের পরপর আমাদের বিয়ে হবে।’
‘ফজরের নামাজের পরপর মানে?’ আমি প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠলাম। ও ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বলল, ‘আস্তে। এভাবে চিৎকার করে কথা বলছিস ক্যান?’
‘ফজরের নামাজের পরপর কারো আকদ হয়? হয়েছে কারো শুনেছিস? তারপর সাক্ষী লাগবে না। এত ভোরে সাক্ষী দিতে কে আসবে?’
‘শোন, বাদে জোহর, বাদে আসর, বাদে মাগরিব, এমন কি বাদে এশা হতে পারলে বাদে ফজর হবে না কেন? সাক্ষী দুজন আমি ঠিক করে রাখছি। ফোন দিলেই ওরা যথাস্থানে হাজির হয়ে যাবে। কাজি, মৌলানাসব ম্যানেজ করা আছে। এইটা একটা অভূতপূর্ব বিয়ে হবে। আকদের পরে খোরমার বদলে আলুবোখরা দেওয়া হবে। আলুবোখরা বলার মধ্যেও শালার আলাদা একটা জোশ আছে। বিয়ের পরপর সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের একটা যৌথ বিবৃতি যাবে। নো দেনমোহর, নট সোনাদানা। ভেরি সিম্পল মাই বেবি।’
আমি অদৃষ্টবাদী না। কিন্তু এই মুহূর্তে অদৃষ্টকে দোষ দেওয়া ছাড়া আর কোনো অবলম্বন নেই আমার। এই সময়ে আমার ছোট বোনের একটি কথা বারবার মনে পড়ছে। ও প্রায় বলে, ‘ভাইয়া তোর লাভারের তার ছিঁড়া।’
এরকম একটা তারছিঁড়া মেয়ের সঙ্গে বাদবাকী জীবনটা কাটাতে হবে ভাবতেই শিউরে উঠছি। মায়ের মুখটা মনে পড়ছে কেন বারবার? মাকে কখন কীভাবে কষ্ট দিয়েছি সেসব মনে পড়ছে। চোখ দুটোতে জল এসে জমেছিল। সেটা দেখে ফেলল লীলা। কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, ‘তোর খুব নার্ভাস লাগছে? ভয় করছে? বিশ্বাস কর আমি জীবনে তোকে কোনোদিন কষ্ট দেব না। তোর মতো এত ভালো ছেলেকে কষ্ট দিতে পারব না। আমি তোকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হিসেবে দেখতে চাই।’
কথার শেষের দিকে ওর গলাটা ধরে এলো। মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল। আমার মতো তারও চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে মনে হয়।
রাতের বেলা দেওয়ানবাজার কাজির অফিস খুঁজে পাওয়া গেল না। এত রাতে কাজিকে ফোন করা উচিত হবে না ভেবে আমরা রিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়ালাম। দিদার মার্কেটের সামনে একটা টংয়ের দোকানে যখন পঞ্চমবারের মতো চা খেতে বসলাম তখন রাত তিনটা প্রায়। চা শেষ করে সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়েছি সে সময় একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল দোকানের সামনে। গাড়ির পেছন থেকে ঝাপ দিয়ে নামলো পাঁচ কনস্টেবল। সামনের সিট থেকে নামলেন তাদের দলপতি। সম্ভবত সাব ইনস্পেক্টর টাইপের কেউ।
সরাসরি আমাদের সামনে এসে বললেন, ‘এত রাতে আপনারা এখানে কী করছেন?’
দুজনেই উঠে দাঁড়ালাম। এমন পরিস্থিতিতে কী বলতে হবে জানা নেই। আমাদের সঙ্গে চা খাচ্ছিল এমন দু-চারজন চোখের পলকে সটকে পড়ল।
‘রাতের শহর দেখতে বেরিয়েছি’- বললাম আমি।
‘ইনিও কি আপনার সঙ্গে?’ লীলার দিকে তাকিয়ে বললেন।
সঙ্গে সঙ্গে লীলা বলল, ‘না উনি আমার সঙ্গে এসেছেন।’
ভদ্রলোক আমাদের দুজনকে আপাদমস্তক দেখলেন। ওয়াটকি নাড়াতে নাড়াতে বললেন, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে বাড়ি থেকে পালিয়েছেন। চলেন থানায়। গাড়িতে ওঠেন।’ সিপাইদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এদের গাড়িতে তোলো।’
আমাদের ডিউটি অফিসারের জিম্মায় দিয়ে গাড়িটি আবার বের হয়ে গেল থানা থেকে। তবে যাওয়ার আগে দুজনের মধ্যে নিম্নস্বরে কিছু কথাবার্তা হলো।
রাতে থানার চেহারা ভিন্ন। চোর, মাতাল আর দেহজীবী নারীদের ধরে ধরে আনা হচ্ছে আর গারদে ঢোকানো হচ্ছে। চিৎকার-চেঁচামেচি। কোথাও কাউকে পেটানো হচ্ছে। একটা আর্তনাদের মতো শোনা যাচ্ছে।
আমরা বসে আছি ডিউটি অফিসারের রুমে সোফার একটা কোণায়। কোনো অজ্ঞাত কারণে আমাদের গারদে ঢোকানো হয়নি। মাঝখানে ডিউটি অফিসার আমাদের কাছে জানতে চাইলেন ঘটনা। এদের মধ্যে একজন নারীও আছেন। আমরা সেই একই কথা বললাম। রাতের শহর দেখতে বের হয়েছি। তবে বাবার নাম-ধামসহ বিশদ পরিচয় ও ঠিকানা জানাতে হলো। তারা সেসব লিখে রাখলেন।
লীলা বেশ স্বাভাবিকভাবেই আছে। পুরো ঘটনাটি যেন উপভোগ করছে। বাবার কানে গেলে পরিস্থিতি কী হতে পারে তা ভেবে আমি পুরোদস্তর ঘামছি। এরমধ্যে যারা রুমে ঢুকেছেন তারা খুব অবাক চোখে আমাদের দেখছেন। কেউ কেউ আবার ইঙ্গিতপূর্ণভাবেও তাকাচ্ছেন। এরমধ্যে পুলিশের পোশাকপরা এক ভদ্রলোক রুমে ঢুকলেন বেশ ভারিক্কি চালে। আমাদের দেখিয়ে বললেন, এরা কেন এসেছে?
ডিউটিরত মহিলাটি ঘটনাটি বলার পর বেশ উচ্চকণ্ঠে বললেন, লকারে না ঢুকিয়ে এখানে বসিয়ে রেখেছো কেন?
মহিলা তার কাছে গিয়ে কিছু বলার পর লোকটি বের হয়ে গেলেন।
লীলা হঠাৎ বলল, ‘আচ্ছা তুই বিসিএসটা দিলি না ক্যান? শালার ডাইরেক্ট অ্যাসিসটেন্ট কমিশনার হইতে পারতি।’
এই প্রথম মেজাজটা খারাপ হলো আমার। বললাম, ‘এ প্রসঙ্গে আলাপ করার আর সময়ে পেলি না?’
‘এমন বিপদে পড়লে কাজে লাগত’।
বললাম, ‘ফাজলামো রাখ।’
সকাল আটটায় একজন কনস্টেবল এসে বলল, ‘ডিসি স্যার যাইতে বলছেন আপনাদের।’
শুনে একটু খটকা লাগলো। ডিসি স্যার কেন?
রুমে ঢোকার আগে নেমপ্লেটে দেখলাম এটা ওসির রুম। ভিতরে ঢুকে একটু অবাক হলাম। চেয়ারে যিনি বসে আছেন তাঁকে ওসি নয় আরও উচ্চ পদস্থ কেউ বলে মনে হলো কাঁধে ও বুকে নানা কিসিমের মেডেল দেখে, রুমের জৌলুস দেখে মনে হলো কোনো শিল্পপতির রুম। ওসির টেবিলের সামনে দুটো চেয়ার আর রুমের অন্য তিন পাশে দামি সোফা। রুমে ঢুকতেই তিনি বসতে বললেন।
তারপর সরাসরি জানতে চাইলেন ‘পালিয়েছেন?’
দুজনেই প্রায় একসঙ্গে বললাম, ‘মানে?’
‘মানে, ঘর থেকে পালিয়েছেন? আপনাদের গার্জিয়ানদের ফোন করা হবে। ওদের জিম্মায় আপনাদের ছেড়ে দেওয়ার হবে। তবে এটা প্রথম এবং শেষবার। আরেকবার এ কাজ করলে ডাইরেক্ট জেল।’
রুমে ঢুকে একেবারে বদলে গেল লীলা। প্রচণ্ড ঝড়ের পরে সাগর যেভাবে শান্ত হয়ে যায় তেমনই শান্ত হয়ে গেল প্রগলভ মেয়েটি। ভাবলাম এটা নার্ভাসনেস। এই পরিস্থিতিতে দুজনের কেউ কখনো পড়িনি।
টেবিলের ওপাশে বসা ভদ্রলোক মিটিমিটি হাসছেন। আর আড়চোখে আমাকেও দেখছেন। কারো বিপদে কেউ এভাবে নির্ভার থাকতে পারে, হাসতে পেরে দেখে রাগে-দুঃখে আমার অ্যাসিডিটি বেড়ে যাচ্ছে। সারারাত ঘুমাইনি কিন্তু অন্তত দশ কাপ চা আর বিশটা সিগারেট শেষ করেছি। বিবমিষা লাগছে।
‘ঠিক আছে আজকের মতো ছেড়ে দেওয়া হলো।’
মনে হলো যেন কোথাও থেকে গায়েবি আওয়াজ ভেসে এলো। আমি আর লীলা পরস্পরের দিকে তাকালাম। দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠলাম,
‘যেতে পারব?
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’
বের হবার জন্য দরজা পর্যন্ত এসেছি। সে সময় পেছন থেকে তিনি বলে উঠলেন,
‘সোজা বাসায় যাও লীলা। তোমার দুশ্চিন্তায় মামা-মামী সারা রাত ঘুমাতে পারেননি। আমাকেও ঘুমাতে দেননি।’
লীলা এই প্রথম কাউকে ভদ্রভাবে জবাব দিল,
‘জি আচ্ছা।’
ভদ্রলোক আবার বললেন,
‘ডিউটি অফিসারের কাছ থেকে তোমাদের জিনিসপত্র নিয়ে যেও।’
কীভাবে থানা থেকে বের হলাম মনে নেই। বাইরে এসে একটা রিকশায় উঠে বসল লীলা।
বলল, ‘ওঠ, দেখে আছিস কী?’
মূল সড়ক দিয়ে না গিয়ে রিকশাচালককে বলল, পাথরঘাটা হয়ে রহমতগঞ্জ যেতে। আমি চুপ থাকলাম। আপাতত লীলার হাত থেকে পালাতে চাইছি।
আমার নীরবতা দেখেই হয়ত লীলা নিজে থেকে বলল, ‘ভদ্রলোক কে জানিস? আমার ফুফাতো ভাই। পুলিশের ডেপুটি কমিশনার। ঢাকায় ছিল। আজকালের মধ্যে মনে হয় চট্টগ্রামে বদলি হয়ে এসেছেন।’
আমি হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে বলল, ‘আমি চিনতে পারি নাই। সরি। অনেকদিন পরে দেখা তো।’
ফুফাতো ভাইকে চিনতে পারস নাই? এইটা বিশ্বাসযোগ্য?’
আমাকে মৃত্যুদণ্ডের সংবাদ দেওয়ার মতো করে বলল, ‘ওর সঙ্গেই আমার বিয়ে হওয়ার কথা। তবে আজকের পর নিশ্চয়ই ও সিদ্ধান্ত বদলাবে।’
রিকশা তখন আমানত শাহের মাজারের সামনে। আমি রিকশা স্লো করতে বললাম চালককে।
লীলা অবাক হয়ে বলল, কেন?’
চলন্ত রিকশা থেকে লাফ দিতে দিতে বললাম, ‘মাজার জেয়ারত করব। আল্লাহ সারাজীবনের জন্য বিপদ থেকে বাঁচাইছে…
তখনও জানতাম না আমাদের পিছনে দ্রুতগতিতে একটা বাইক আসছিল!
কামরুল হাসান বাদল, কবি, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার




