এখন সময়:বিকাল ৩:১৮- আজ: বৃহস্পতিবার-৬ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২১শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:বিকাল ৩:১৮- আজ: বৃহস্পতিবার
৬ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২১শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

বর্ষা ক্ষত

পলি শাহীনা

গত কয়েকদিন ধরে প্রকৃতির শিরা বেয়ে একটানা বৃষ্টি ঝরছে। দিনগুলো যেনো এক অতলান্ত অন্ধকারে ডুবে আছে। বর্ষার বৃষ্টি কী ভীষণ মায়া, কী গভীর স্পর্শ, তবুও রেবার বড় তৃষ্ণা লাগে। কী এক গভীর বেদনায় ওর শরীর দুলে ওঠে। সূর্যের মুখ দেখা না গেলেও ভ্যাপসা গরম লাগছে। রেবা গায়ের শালটা খুলে কাঠের আলনায় তুলে রাখে। হাতের কাছে রাখা ‘শীর্ষেন্দুর শ্রেষ্ঠ গল্প’ বইটি চোখের সামনে মেলে ধরে। বৃষ্টিতে নিশিকান্ত – গল্পটির প্রথম লাইন ‘ কেচ্ছা কেলেংকারির মতো বৃষ্টি হচ্ছে কদিন ‘ লাইনটি পড়ে ও আকাশের দিকে তাকায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির গতির সঙ্গে কেচ্ছা কেলেংকারির সম্পর্ক কেমন? বোঝার চেষ্টা করে। চরাচর ব্যাপি বৃষ্টির গতি কেলেংকারির মত দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। লেখক বোধহয় এমন ভাবনা হতেই এমন বাক্য লিখেছেন। লেখকের ভাবনার সঙ্গে কিছুটা যুক্ত হতে পেরে মনে মনে ও খুশি হয়। জমাট মেঘে ঢাকা মধ্যাহ্নের আকাশটি যেন মহাকালের মতো ওর দিকে চেয়ে আছে। মোবাইলে পলাশের টেক্সট ম্যাসেজ পাওয়ার পর হতে রেবা অন্যরকম বোধ করছে, হেলুসিনেশন হচ্ছে, এবং গত রাতে দেখা স্বপ্নের মাঝে তলিয়ে যেতে থাকে।

 

স্বপ্নটি ছিল এমন, ‘ অঝোর বৃষ্টি ঝরছে। একটা বিরাট জল ছুপছুপ মাঠে ও হাঁটছে। আচমকা টের পায় কেউ একজন ওর পেছন দিক হতে মাথার উপর ছাতা মেলে ধরেছে। ছাতা মেলে ধরতেই ঝুরঝুর বেলি ফুল ঝরে পড়ছে আপাদমস্তকে। ঘাড় ঘুরিয়ে কাউকে দেখতে পায় না। ভয়ে ওর গলার কাছটা শুকিয়ে আসে। মনে মনে ভাবে, রায়হান ছাড়া আর কে হবে? ও ছাড়া কে এমন পাগলামী করবে? বেলি ফুল ওর প্রিয়, রায়হান ব্যাতিরেক অন্য কেউ জানেও না। বুকে সাহস সঞ্চয় করে রেবা, রায়হান, রায়হান বলে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। হঠাৎ একটু দূরে ঝাপসা ভেসে উঠে রায়হানের মুখ। শ্রাবণের অন্ধকারাচ্ছন্ন বাদল প্রকৃতিকে ঢেকে রাখলেও মৃদু বাতাস ওর চুলে রাশি রাশি ঢেউ তুলছে। একটা অপার্থিব আলোর প্রতিসরণ খেলছে ওর মুখাবয়ব জুড়ে, যেন গোটা পৃথিবীকে পেছনে রেখে আলোর নেকাব ঢেকে রেখেছে ওর মুখখানি। রেবা কাছে যেতেই ওর মুখটা দিক বদল করে ক্রমশ আকাশের গায়ে মিলিয়ে যায়। অতঃপর, রেবার ঘুম ভেঙে যায়। ‘

 

স্বপ্নের দৃশ্যগুলো ভেবে রাতের মতো এখনও টেবিলে রাখা পানির বোতলের ছিপি খুলে ও ঢকঢক করে পানি গিলে খায়।

 

স্বপ্নের ঘটনাটা রেবা কিছুতেই মন হতে সরাতে পারছে না। গত কয়েকদিন ভারি বৃষ্টিপাতের সঙ্গে ঝোড়ো বাতাসও বইছিল। একেকটি ভারি জলের ফোঁটা আকাশ থেকে ছুটে এসে যেন মাটির শরীর ফুঁড়ে চলে যায় গহীনে। বৃষ্টিজাল শীতের কুয়াশার মতো চতুর্দিক আবৃত করে রেখেছে। খানিক দূরে কিছু দেখা যায় না। বৃষ্টির এমন বাড়াবাড়ি দেখে মনে হয় যেনো মানুষজন, জীবজন্তু, দোকানপাট সহ রাস্তাঘাট সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

 

এমন বৃষ্টিভেজা দিনে, এমন অসময়ে কেনো যে মা ঠান্ডা তেল দিতে চাইছেন মাথায়, রেবার কোনোভাবে বুঝে আসে না। মা চারপাশে পায়চারি করছেন আর বারবার বলছেন বারান্দা ছেড়ে তাঁর রুমে যেতে। দুপুর শেষে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। সন্ধ্যার গায়ে ঝুপঝুপে বৃষ্টি ফোঁটা যেন ছবি আঁকছে। এ ছবি দেখা যায়, ধরা যায় না। বারান্দার গ্রীলে বৃষ্টি ফোঁটা সবুজ ঘাসের ডগায় ঝুলে থাকা শিশিরের মতো ঝুলে আছে। রেবা হাত বাড়িয়ে আদর করে ওদের ছুঁয়ে দেয়। খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে টের পায় বাইরে বৃষ্টির গতি আরো বেড়েছে। আকাশের কী এমন শূন্যতা? কেন এমন আর্তনাদে ফেটে পড়ছে? কোন তীব্র দহনে আকাশ পুড়ছে? কে জানে। মাথা হতে আকাশের ভাবনা ঝেড়ে রেবার বৃষ্টিপ্রবণ মন চোখ বুঁজে বৃষ্টির মধ্যে ডুবে থাকে। সূঁচালো বৃষ্টির মধ্যে যেন দেখতে পায় রায়হানের হাতজোড়া ওর মুখের সামনে। এমন বৃষ্টিভেজা দিনে রায়হান লাজুক মুখে আঁজলা ভরে বেলি ফুল দিয়ে প্রথম ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়েছিল। রেবা চোখ বুঁজে স্পষ্ট যেনো দৃশ্যটি দেখছে, আর বেলি ফুলের মৌ মৌ ঘ্রাণে তলিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় মা এসে রুমের আলো জ্বালিয়ে কাঁধে হাত রাখলে ও ঘোর হতে বাস্তবে ফিরে আসে। মা চাইছেন রেবা রুম হতে বের হোক, কথা বলুক। চার দেয়ালের মাঝে, বারান্দায় একাকী না থাকুক। রেবার অনুভূতিগুলো মা বুঝতে পারে। মাকে দেখে রেবা অলিভ ওয়েলের সঙ্গে রোজমেরি ওয়েল মিশিয়ে তাঁর চুলে সব সময়ের মতো ম্যাসেজ করে দেয়। মায়ের ঘাড়, কপাল টিপে দেয়। মা চোখ বুঁজে রেবার সঙ্গে মিশে থাকে। তেল দেয়া শেষে ওকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে মা আদর করে। সারাদিন রেবা তেমন কিছু খায় নি, এ সময় চা পেলে হয়ত খাবে, এ ভেবে মা ওর পছন্দের এলাচ চা বানিয়ে আনে। রেবা চা হাতে পুনরায় বারান্দায় এসে বসে।

 

রায়হানও এলাচ চা ভালোবাসে, ওকে খুব মনে পড়ছে। ওদের দু’জনের পছন্দে অনেক মিল আছে। চা পানের সময় রায়হানের ঠোঁটে বাচ্চাদের মতো চা লেগে থাকতো, রেবা টিস্যু দিয়ে মুছে দিত। এ নিয়ে রেবা হাসাহাসি করলে ও বলতো, ‘তোমার জন্য কিছু চা রাখি ঠোঁটের ভাঁজে, কিছু রাখি ঠোঁটে।’ রায়হানের প্রখর বুদ্ধি ছিল। ওর সঙ্গে কথায় কিংবা যুক্তিতে সর্বদা রেবা হেরে যেত। বর্ষার বৃষ্টিমুখর দিনে রায়হান খুব আড্ডায় মজে থাকতো। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে এলাচ চা সঙ্গে সরিষার তেল, লাল পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ দিয়ে চানাচুর -মুড়ি মাখিয়ে খেত। ওদের দু’জনেরই বর্ষা মৌসুম এবং বৃষ্টি খুব প্রিয়। ঝমঝমে বৃষ্টি নামার আগেই রায়হান কেমন করে যেনো বৃষ্টির গন্ধ পেতো, অমনি চঞ্চল হয়ে উঠতো।

 

মনে পড়ছে সেদিন বিকেলের কথা। টং দোকানের বারান্দা থেকে খরগোশের মত লাফাতে লাফাতে রায়হান উঠে এসেছিল এ বারান্দায়। কাকের মত গায়ের জল ঝাড়তে ঝাড়তে এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। বললো, ‘চল কাগজ কেটে নৌকা বানাই, সেগুলো জলের স্রোতে ভাসিয়ে দিই।’ সেবার জলের স্রোত প্রায় উঠে এসেছে বারান্দা অবধি। যে ভাবনা সে কাজ। দু’জন মিলে রঙ বেরঙের কাগজ কেটে নৌকা বানায়। নৌকাগুলো ভাসিয়ে দেয় বৃষ্টিজলে। বাতাসের তোড়ে কোনটা ডুবে যায়, কোনটা কাত হয়ে থাকে, কোনটা আবার তরতর ভেসে যেতে থাকে। ওরা দু’জন হাত ধরে সে অভূতপূর্ব দৃশ্যের দিকে চেয়ে থাকে।

 

জল থৈ থৈ বর্ষা ঋতুর ভুরভুর গন্ধ ওদের বিভোর করে তোলে। রায়হানের পাল্লায় পড়ে রেবাও চঞ্চল হয়ে উঠে। বর্ষাদিনে বৃষ্টিতে ভিজে কতো যে জ্বর-সর্দি বাঁধিয়েছে, হিসেব নেই। রায়হান খুব যত্মশীল ছিল রেবার প্রতি। একবার ওর ভীষণ কাশি হলে রায়হান তাল মিছরি নিয়ে আসে। তাল মিছরি দেখে রেবার মা তো অবাক। কারণ, কয়েক সপ্তাহ আগে উনি পায়েস রান্নার জন্য বাজারের কয়েকটি দোকান খুঁজে তাল মিছরি পান নি। ওদের দু’জনকে তাল মিছরি কড়মড় করে খেতে দেখে বললেন, মিছরি মুখে রেখে খেতে হয়। কে শুনে মায়ের কথা। ওরা আয়েশ করে ছোট বাচ্চার মতো দাঁত দিয়ে ভেঙে তাল মিছরি খেয়েছে।

 

রেবাদের বাড়ির পশ্চিম পাশে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা জায়গা। শুকনো মৌসুমে সেখানে ধানের চাষ করা হলেও বর্ষা মৌসুমে জায়গাটি বৃষ্টির পানিতে টইটম্বুর এক বিলে রুপান্তরিত হয়। এ সময় পাড়ার দুরন্ত বাচ্চারা এখানে সাঁতার কাটে। একদিন রায়হান এসে বললো, মাঠের অঢেল জলরাশিতে নৌকায় ঘুরতে যাবে। সেদিনও ঝুম বৃষ্টি ছিল। বর্ষার বেড়া ভেঙে বৃষ্টি ছাপিয়ে ওরা দু’জন চলে যায় মাঠের মাঝখানে। রায়হান এর আগেও এমন সব অদ্ভূত কান্ড ঘটিয়েছে, অনেকবার। হয়ত ঝুম বৃষ্টিতে নয়ত গাছের মগডালে শূন্যে বসে ও রেবাকে ভালোবাসার কথা বলেছে। সেই সব মুহূর্তে রেবার প্রতি ওর ভালোবাসার রশ্মিতে মেঘলা দিনেও প্রকৃতির বুকে যেন আলোর ঢেউ খেলে যেতো। ওর এমন পাগলামি রেবার ভালো লাগে। সেদিন মাঠের মধ্যখানে গিয়ে কোনো কথা না বলে রায়হান ওর হাত ধরে চুপচাপ ধ্যানীর মতো মুখের দিকে চেয়ে থাকে।

 

‘আমার প্রাণের প্রাণ পাখি

আমার হিরামন পাখি

তোরে কোথায় রাখি

পাখিরে সবই মিছে আর ফাঁকি… ‘

 

ওদের পাশ ঘেঁষে এক অচেনা মাঝি পল্লীগীতিটি গাইতে গাইতে চলে যায় দূরে। লোকটি দৃষ্টিসীমা হতে লীন হয়ে গেলে রায়হান পল্লীগীতিটি কন্ঠে তুলে নেয়। ওর গানের গলা চমৎকার। অন্যরকম এক আবেশে রেবা চোখ বুঁজে গান শুনতে থাকে।

 

– এত পরে কেনো এলে জীবনে?

– তুমি ছিলে সদা আমার একান্ত স্বপনে।

– কতদিন ঝরে গেছে দিনপঞ্জি হতে?

– তাইতো, অহর্নিশি আনন্দে হৃদয় ভরিয়ে দিই।

– হে প্রিয়, মনের মতো থাকবে তো জীবনভর?

 

– আমার মনের তারে তুমিহীন সুর বাজে না।

 

আকাশে তীব্র বজ্রপাতের শব্দে ওদের কথোপকথনের মধ্যে ছেদ পড়ে, বৃষ্টিও কমে আসে। বর্ষার টলটলে জলে ওদের বিহ্বল সময়ের স্মৃতি চিহ্ন রেখে জীবনের ছবি আঁকতে আঁকতে ওরা ফিরে আসে স্থলে।

 

কয়েক বছর ধরে এভাবে ছুটিয়ে প্রেম করেছে ওরা।  দুই পরিবারের সম্মতিক্রমে গত মাসে ওদের এনগেজমেন্ট হয়। ওদের ইচ্ছেমতো বিয়ের দিন ধার্য্য করা হয় সতেরো শ্রাবণ। রেবা, রায়হানের গভীর সম্পর্কের কথা যেমন ওদের পরিবার জানে, তেমনি ওদের প্রিয় যে বর্ষা ঋতু সে কথাও জানে। গত সপ্তাহে যখন ওদের দেখা হলো তখন দেখতে ভারি সুন্দর একটি দোলনচাঁপার গাছ উপহার দিয়েছিল রায়হান। রেবা গাছটিকে বারান্দার সামনের খোলা জায়গায় টবে লাগিয়ে দেয়। যত্ন নেয় নিয়ম করে। ফুল আসি আসি করেও আসছে না। ও প্রতিদিন গাছটির দিকে তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে, এখনও তাকিয়ে আছে। ফুল ফুটতে দেরি হচ্ছে দেখে ওর অভিমান হয়। কিছুটা হতাশা নিয়ে গাছটির গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। গাছের শরীরে হাত বুলাতেই যেন ও রায়হানের মুখরতা টের পায়। গাছটিকে ও বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে। মনের ঘরে বেজে উঠে রবীন্দ্র সংগীত।

 

‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে

পাগল আমার মন জেগে উঠে… ‘

 

হতাশা ঝেড়ে রেবা এবার মুগ্ধ চোখে তাকায় গাছটার দিকে। গাছটি এবার যেন ওর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে,

 

‘রেবা আমার কথা ছাড়ো

এবার ভিন্ন কিছু ভাবো

ভেবেছিলাম দেব ফুলের সমুদ্র,

স্বর্বস্বান্ত আজ এ অন্ধকারে

আর তাকিও না ফিরে

বরং শীতল হও বৃষ্টিজলে

ক্ষমা করো এ আমাকে।’

 

দোলনচাঁপা আর রেবার যৌথ গাঢ় আড্ডার মাঝখানে রেবার মা আসে রুমে। ঘন আঁধার আঁকড়ে রেখেছে চারপাশ। ঠান্ডা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মা অভিমান করেন, একটুও খায় নি বলে। মায়ের অভিমান ভাঙাতে কপালে চুমু খেলে, মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বিছানায় এনে শুইয়ে দেয়।

 

মা রুম হতে প্রস্থান করার কিছু সময় পর রুমের আলো না জ্বালিয়েই রেবা তোরঙ্গ খুলে বসে। ছোপ ছোপ অন্ধকারের মাঝে, এনগেজমেন্টের দিন রায়হানের দেয়া নীল জামদানী শাড়িটি নক্ষত্রের মতো ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছে। তোরঙ্গে সযত্নে তুলে রাখা শাড়িটি বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে, কোলের উপর রেখে শাড়ির গায়ে হাত বুলাতে থাকে। ও অপলক শাড়িটির দিকে তাকিয়ে থেকে ভেতরে একটা অন্যরকম শিহরণ বোধ করে। শাড়ির শরীর ফুঁড়ে রায়হানের গায়ের ঘ্রাণ এসে লাগে নাকে। রেবা ভাবে, আশ্চর্য তো, এতদিন আগের শাড়ির গায়ে কেমন করে এখনও রায়হানের গন্ধ লেগে আছে?

 

ওর মনে পড়ে রায়হান বলেছে, ‘বিয়ের পর বৃষ্টিদিনে কদম ফুলের গন্ধ, কচুরিপানার নীল নীল ফুলের গন্ধ, মাটির সোঁদা গন্ধ মেখে, এই নীল জামদানি শাড়িটির সঙ্গে মিলিয়ে নীল পাঞ্জাবী পরে ওরা একসঙ্গে ভিজবে। অধিক বৃষ্টিপাত হওয়া সিলেট অঞ্চলে হানিমুনে যাবে। ভাবনাগুলো ভাবতেই রেবার হৃদপাঁজরে হি হি কাঁপন উঠে। ও শাড়িটিকে বুকের সঙ্গে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ঠিক ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভিজে পাঠশালায় যাওয়ার সময় সহজ পাঠ বইটি যেমন করে বুকে জড়িয়ে ধরতো, তেমন করে।

 

শাড়িটি বুকের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা অবস্থায় ও রায়হানের গলার গমগম আওয়াজ শুনতে পায়। রায়হান বলছে,  ‘মেঘ করেছে। মেঘের রঙ তোমার শাড়ির মত নীল।’ রেবাও ওর সঙ্গে স্বর মিলিয়ে বলছে, ‘মেঘ করেছে। মেঘের রঙ তোমার শাড়ির মত নীল।’ মেঘে ঢাকা আকাশটা যেন হাঁ করে ওদের দিকে দৈত্যের মত চেয়ে আছে, আর ওদের সময়গুলো নিয়ে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে দূর দিগন্তে। রেবা কোনমতে একটা মুহূর্তে গ্রীল আটকে ধরে উঁকি মেরে দেখে, বাতাসের বুকে লেখা হচ্ছে ওদের প্রেমের পদ্য, কী অদ্ভুত সুন্দর কথাগুলো। পদ্যের স্পর্শে জলে ফোটা লাল পদ্ম আরো লাল হয়েছে। রেবার চারপাশে ঘুরে ঘুরে বৃষ্টির ঝনঝন শব্দের মতো রায়হান হাসছে। আঁধার রাতের জোনাকির মত রায়হানের মুখ ঠিকরে আলো ফুটছে।

 

কদমের ছায়া ডিঙিয়ে রায়হান এবার রেবার হাতটি ধরে সম্মুখে দ্রুত ছুটছে। মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির গতি দেখে মনে হয় শ্রাবণ যেন সবটা নিয়ে ঝরে পড়ছে ধরণীতে। বর্ষা মৌসুমে ওদের জন্ম বলেই হয়ত এমন তীব্র ভালোবাসে বৃষ্টিকে।  বৃষ্টির লয়ে লয় মিলিয়ে ওরা ধুন্ধুমার ছুটে চলছে আনন্দ অবগাহনে। বৃষ্টির দাপটের কাছে কিছুটা পরাজিত হয়ে ওরা আশ্রয় নেয় কৃষ্ণচূড়ার নিচে। বাতাসের তীব্র ঘূর্ণিতে আচমকা দু’জন দু’দিকে ছিটকে পড়ে। ঠিক তখনই বারান্দার রেলিঙের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে রেবা মুহুর্মুহু দুলে উঠে।

 

এ কেমন বিভ্রম? ও কেন ছিটকে পড়বে রায়হানের কাছ হতে? একটা শূন্যতার অসীম ঢেউ এসে ভেঙে পড়ে ওর বুকের জাজিমে। দুলতে দুলতে ওয়াশরুমে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চোখেমুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দেয়। রায়হান ওর কাছ হতে, কিংবা ও রায়হানের কাছ হতে ছিটকে পড়েছে, এ বিষয়টি মাথার ভেতর লাটিমের মত ঘুরতে থাকে। মনের মধ্যে ও আশ্চর্য এক ক্ষতের গভীরতা টের পায়। এই প্রথম অনর্গল বৃষ্টি এবং বর্ষা ঋতুকে ওর অসহ্য ঠেকে। এমন বর্ষা ঋতু, এমন বৃষ্টি, এমন ঘূর্ণি বাতাস ও চায় না, যে সময়টা ওকে রায়হানের কাছ হতে দূরে সরিয়ে দেয়। একটা দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে যেন অন্য কোনো জগৎ থেকে। বুক ভারি হয়ে আসে। রায়হান কখনো ওকে দূরে কোথাও ছিটকে পড়তেই দেবে না, এ বলে নিজের মনকে প্রবোধ দেয়, কিংবা ভাবনা অন্যদিকে ঘোরাবার চেষ্টা করে রেবা।

 

পড়ার টেবিলে বসে মৃদু নীল আলোর ল্যাম্পপোস্ট জ্বালিয়ে রেবা ডায়েরি খুলে বসে। গুছিয়ে কিছুই লিখতে পারছে না। অগোছালো কথারা ক্যাসেটের আটকে পড়া ফিতার মতো শুধু জড়িয়ে আসে। মস্তিষ্কের খাঁজে খাঁজে জড়িয়ে থাকা অনুভূতিগুলোকে কোনভাবেই বাক্যে রুপান্তরিত করতে পারছে না। ডায়েরি লিখতে বসে আগে কখনো তো এমন হয় নি। এত অনুভূতির ভীড়েও আজকে লিখতে না পারার এমন বিরল ঘটনায় ও স্তব্ধ হয়ে যায়। বাইরের অঝোর শ্রাবণ ধারা নদী হয়ে বয়ে যায় চোখের বিলে। বেদনার তীব্র স্রোতে ওর সমস্ত পৃথিবী টলে উঠে। একদম ভালো লাগছে না এ শ্রাবণ ধারা, ওর বড় হাসফাঁস লাগে। বৃষ্টির এমন রিনঝিন শব্দ মুগ্ধতার বদলে ওর কানে ঝাঁ ঝাঁ লাগে। রেবা টেবিল ছেড়ে উঠে কক্ষের দরজা,জানালা বন্ধ করে দেয়। এক গ্লাস শীতল জল পান করে। অতঃপর, এক টুকরো প্রশান্তি অনুভূত হলে ও পুনরায় টেবিলে ফিরে এসে ডায়েরি বন্ধ করে শীর্ষেন্দুর গল্পের বই পড়ায় মন দেয়। পড়তে পড়তে বইটির বুকে মাথা গুঁজে  ঘুমিয়ে পড়ে।

 

রেবার ঘুমের চারপাশেও উঁকি দেয় রায়হান। ও বলছে, ‘রাতভর বৃষ্টি হয়েছে, কামিনী কেমন সুবাস ছড়াচ্ছে, রেবা চলো ওই কামিনীর ঝোঁপে ঢুঁ মারি। দেখো সবুজ পাতারা তিরতির দুলছে, একলা একা ঘু ঘু উদাস ডাকছে। কত আওয়াজ, কত অপেক্ষা, চোখ মেলো। চলো একটু ঘুরে আসি দুজনে।’

 

রেবার বড্ড শীত লাগছে। ও যেতে অসম্মতি জানালে রায়হান জলের বুকে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে একাকী হেঁটে হেঁটে এক সময় দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়। ও দৃষ্টি থেকে সরে গেলে রেবার মনে হয় ও একা, ভয়ংকর রকমের একা। ও যেন এক গভীর অন্ধকারে ডুবে গেছে। বিদ্যুৎ ঝলকে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে যেন আগুন লেগেছে। ভয়ে ওর শরীর অসাড় হয়ে আসে। আগুন, আগুন বলে রেবা চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে ওঠে।

 

ভোরের আলো তখনো ভালোমতো ফোটে নি। রায়হান বলতো, ‘পাখির ডাক আজানের মতো, আর বৃষ্টির শব্দ মন্দিরের ঘন্টার মতো।’ না, ঘুম ভেঙে আজ ও পাখির ডাক কিংবা বৃষ্টির শব্দ কিছুই শোনে নি। চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানায় বসে ভোরের অস্ফুট আলোয় দেখতে পায়, রায়হানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পলাশকে। ওর পেছনে দাঁড়িয়ে রেবার মা মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে কাঁদছে আর বলছে, ‘তুমি ওকে বুঝাও, বাবা। গতকাল তোমার থেকে রায়হানের খবর পাওয়ার পর হতে মেয়েটা কেমন পাথর হয়ে গেছে। রায়হানকে দেখতে যেতে বলেছি,  রাজি হয় নি। কথা বলে না, কাঁদেও না। কারো ফোন ধরে না। ওর বন্ধু তমা, শিলা এসেছিল, ওদের সঙ্গেও কথা বলে নি।

পলাশ পত্রিকায় রায়হানের ছবি দেখিয়ে বললো, ‘দেখ রেবা ও আর নেই, অনন্তে মিশে গেছে। টানা বৃষ্টির ঢলে আমাদের বাজারে ঢোকার রাস্তা ধ্বসে পড়েছে। সে ধ্বসে পড়া রাস্তা ধরে যাওয়া বাস উল্টে রায়হানের বাইকের উপর পড়েছে। ওর অর্ধমৃত শরীরটা দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার জানায়, ও আর বেঁচে নেই।’

 

কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে পলাশ। রেবা কারো মুখের দিকে তাকায় না। ও অনন্তের দিকে চেয়ে থাকে। ওর মুখে কোন ভাবান্তর পর্যন্ত নেই। যেন পলাশের কথা ও কানেই তোলে না। পলাশ ওকে ঝাঁকি দিয়ে বলে, ‘রায়হান আর কোথাও নেই, এ দেখ পত্রিকার পাতা, ওর ছবি।’ পত্রিকা হাতে নিয়ে রায়হানের ছবিতে চোখ রেখে রেবা হাসতে হাসতে বলে, ‘রায়হান আমাকে ফেলে কোথাও যেতেই পারে না। ও ফিরবে, নিশ্চয়ই ফিরবে আমার কাছে। আমি অপেক্ষা করছি, নীল জামদানি পরে ওর বাইকে চড়ে আমরা বর্ষার ঝুম বৃষ্টিতে ভিজবো। বর্ষা আমাদের প্রিয় ঋতু। বর্ষার পানি কোনোভাবেই রায়হানকে আমার কাছ হতে দূরে ভাসিয়ে নেবে না। মা, পলাশ দেখো, আমার হাতে ওর হাত, আমার আঙুলে ওর পরানো আংটি।’

 

রায়হানের ছবিতে হাত বুলিয়ে রেবা ঘন ঘন শ্বাস নিতে থাকে, গলা ফাটিয়ে হাসতে থাকে, হাসতে হাসতে বিছানায় ঢলে পড়ে।

 

জ্ঞান ফিরে এলে রেবা দেখে মাথার পাশে দাঁড়িয়ে পলাশ চোখ মুছছে, মা জল ঢালছেন মাথায়। মাকে জড়িয়ে ধরে রেবা কান্নায় ভেঙে পড়ে। মা ওকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখে, কিন্তু ওর বাঁধভাঙা কান্না থামানোর কোন চেষ্টা করে না। মা জানেন, রেবার এ বুকফাটা কান্নায় রায়হান আর ফিরে আসবে না, তবুও, এ কান্নায় বুকের ভারি পাথরটা কিছুটা তো সরবে। রায়হানের প্রস্থানে ওর মধ্যে যে বধিরতা তৈরি হয়েছে, মা চান কান্নার স্রোতে তার কিছুটা ভেসে যাক।

 

স্মৃতির চেয়ে যেমনি বড় সম্বল নেই জীবনে, তেমনি শেষ বলেও সত্যিই কিছু নেই জগতে। রেবা বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। ওর পা জোড়া সামনে চলছে না। পায়ের সঙ্গে পা জড়িয়ে আসে। পলাশের কাঁধে ভর করে ও বারান্দায় গিয়ে বসে। দেখে, শ্রাবণের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে আছে। যে কোনো সময় বৃষ্টি নামবে।

 

 

পলি শাহীনা, গল্পকার

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাহিত্য-গবেষণার আলোকবর্তিকা

শাহেদ কায়েস   আহমদ রফিক (জন্ম: ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-মৃত্যু: ২ অক্টোবর ২০২৫) বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুবনে আহমদ রফিক একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে

অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

আন্দরকিল্লা ডেক্স \ চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের আত্মজীবনী ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

ফেরা

সৈয়দা মাসুদা বনি   নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন   রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু! মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে

চিরহরিৎ বৃক্ষের গল্প

সুজন বড়ুয়া   ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়।