মোহাম্মদ ইউনুছ
গ্রামে বেড়ে উঠা জীবনের স্বপ্নীল অনিন্দ্য শৈশবের নির্মল আবেগে- আবেশে, রমিত-উদ্বেলিত অতল নির্জন প্রেমময় দুরন্তপনা ‘লালন’-ই কালক্রমে হয়ে উঠে আলোক-ঝলমল কান্তিময় ঐশ্বর্যে নির্মিত রাঙ্গাময় শহুরের নাগরিক জীবনসারথী কর্মতৎপর ‘পেশকার ইউনুছ’ অথবা কর্মচঞ্চল ‘বড় মিয়া’ কিংবা জেলা প্রশাসন অফিসের কর্ম-উদ্দীপ্ত ইউনুছ। আমিই সেই অকিঞ্চনজন- মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।
বলতে দ্বিধা নেই, আমার এ পথ চলা কখনোই কুসুমাচ্ছাদিত ছিল না বরং ছিল কন্টাকাকীর্ণ।
মোগল সাম্রাজ্য বিস্তৃতির আগেই ইসলাম ধর্ম বিস্তৃতির আর ঐতিহ্যের শ্রীপুর, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রপুরোধা শ্রীমতি কল্পনা দত্তের বিপ্লবী শ্রীপুর গ্রামেই আমার জন্ম। কর্ণফুলির বহমান কলতানের সাথে জীবন মিশে থাকা, সহজ সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত অথচ গ্রামের মেঠোপথে ডানপিঠে আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে এ জনপদে; লেখাপড়া, বেড়ে উঠাও এর মধ্য দিয়ে।
স্নাতক শেষ করেই জীবন ও জীবিকার সন্ধানে বন্দরনগরীর এই ব্যস্ত শহরে পদার্পন। জীবনের লক্ষ্য ছিল ব্যাংকার হবার। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অশেষ মেহেরবাণীতে হয়ে গেলাম সরকারী চাকুরে। তবে এর পেছনে আমার পুরো চাকুরীজীবি পরিবারের
অনুপ্রেরণা কম ছিল। ব্যাংকার হওয়ার অমলিন বাসনা নিয়ে গিয়েছিলাম ঢাকা অবধি। ইতোমধ্যে পরিবারের ইচ্ছেতে দেয়া আবেদনের ডাক আসে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে চাকরির পরীক্ষার। আর চাকরির জন্য এই পরীক্ষাই ছিল জীবনের প্রথম ও শেষ পরীক্ষা। বাবা-মা, শুভাকাঙ্ক্ষীর দোয়াতে সফলতা ধরা দেয়। শুরু হয় কর্মচঞ্চল নতুন জীবন । চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে চাকরি। দেশের ইতিহাসে প্রাচীন জনপদের ঐতিহ্যবাহী এই সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি, গৌরব আর মর্যাদার সাথে নিজেকে জড়াতে পেরে প্রভূর দরবারে আজীবন কৃতজ্ঞ আমি। আলহামদুলিল্লাহ!
বাবা বলেছিলেন, “মানুষের জন্য কাজ করার সমুহ সম্ভাবনা এ চাকরিতে”। সে পথ ধরে এগিয়ে গেলাম। বাবার স্বপ্নের এ যাত্রা জনপ্রশাসনের চাকরির থিমের সাথে মিলেই গেল। “জনসেবায় জনপ্রশাসন বা সেবার জন্য প্রশাসন”। কোর্টের পেশকার কিংবা রাজস্ব শাখার বড় মিয়া কিংবা প্রশাসনিক কর্মকর্তা, যে চেয়ারেই ছিলাম- দল-মত, ধর্ম-বর্ণের উর্ধ্বে উঠে যাঁরাই আমার কাছে এসেছেন, সেবা পরামর্শ বা কাজ সুচারু রূপে সম্পাদন করার চেষ্টা করেছি। এ সেবাতে আনন্দ পেয়েছি, বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছি; মোটের ওপর আমার কাছে রাষ্ট্রের দেয়া দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পেরেছি বলে অন্ততঃ আমার আত্মতুষ্টি আছে।
তবে এ পথটি মোটেও মসৃণ ছিল না। এ যাত্রা ছিল ভঙ্গুর। পদে পদে বিপদ। মানুষের দোয়া ও ভালবাসায় সকল সমস্যা সাবলীলভাবে উত্তরণ করেছি। নিজের বলতে শ্রেষ্ঠ অর্জন ছেলে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষিত করে দেশ ও মানুষের সেবার ব্রতে নিয়োজিত করার চেষ্টা। এ চেষ্টাতে আল্লাহ আমার একমাত্র ফেরত সন্তানকে ব্যারিস্টার, মেযেকে চিকিৎসক, কনিষ্ঠ মেয়েও সে পথে আপনাদের দোয়াতে এগিয়ে যাচ্ছে।
ডিসি অফিসের দীর্ঘ চাকুরিকালীন সময়ে কালে ভদ্রে যাঁরাই এসেছেন কাজ বা পরামর্শ নিয়ে – অন্ততঃ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কাউকে ফেরত যেতে হয়নি।
মনোনিবেশ করেছি নন ক্যাডার কর্মকর্তা, কর্মচারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। আমার চাকরির যাত্রাকালীন প্রারম্ভিক বাস্তবতা ছিল কঠিন। আমাদের সমমর্যাদার চাকরিজীবিদের প্রমোশন ছিল কদাচিৎ। এ কঠিন যাত্রাকে সহজ করতে কাজ করেছি সহযোগীদের নিয়ে। সফলও হয়েছি। এখন আর প্রমোশনে কদাচিৎ নেই, অহরহ হচ্ছে । বিষয়টি শুধু চট্টগ্রামে নয়, সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়ে সহকর্মীদের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়েছি। তাছাড়া তাদের সাংগঠনিকভাবে দক্ষ করে গড়ে তুলে অধিকার আদায়ে মসৃণ পথের সন্ধান দিয়েছি। যা-চাকরি জীবনে আমার অন্যতম সেরা অর্জন।
এত কিছুর পরও, জীবনের চরম সত্য হলো- একদিন সবাইকে ছেড়ে যেতে হয়। আমিও আজ চাকরির শেষ প্রান্তরেখায় দাঁড়িয়ে। এই সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় শেষ বিন্দুতে এসে নস্টালজিক হয়ে পড়ছি। জাবর কাটতে গিয়ে দেখি, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে যে সম্মানের চেয়ারে বসিয়েছেন- তার সবকিছুর জন্য মানুষ ও আমার চাকরি জীবনে আসা শ্রদ্বেয় স্যারদের প্রতি আমার কমিটমেন্ট, অধীনস্থদের প্রতি আমার দরদ- আমাকে এ অর্জনের ভাগীদার করেছে।
সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও ডেডিকেটেড হয়ে দেশের ও মানুষের জন্য অক্লান্ত হয়ে কাজ করেছি। আর এতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে মানুষের ভালোবাসা, স্যারদের স্নেহ, আদেশ উপদেশ ও নির্দেশনা, সহকর্মীদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা। এটা সত্য, ভালো কাজের মূল্যায়ন সবাই করতে পারে না বা জানে না। ঈর্ষান্বিত হয়ে সততার দুয়ারে আঘাত করে। আর এই সততা, কর্মনিষ্ঠা ও মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসায় ঈর্ষান্বিত হয়ে কিছু মানুষ আমার বিরুদ্ধে
উস্কানিমূলক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার চালাতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। সুতরাং তাদের রোষানলে পড়ে আমি ক্ষতবিক্ষত হয়েছি বটে, তবে নিজের সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার দিয়ে নিজের কাজ করে গেছি। যদিও খারাপ মানুষের মিথ্যাচার, উড়োচিঠি এবং সাম্প্রতিক সময়ের আবিষ্কার ফেসবুকে ফেক আইডি খুলে চরিত্রহনন ক্ষণে ক্ষণে থামিয়ে দিতে চেয়েছে এ অগ্রযাত্রা, বিব্রত করেছে মনন ও সৃজনকে। তারপরও তারা পেরে উঠেনি- জয়ী আল্লাহ আমকেই করেছেন। দিনশেষে বিশ্লেষণে গিয়ে দেখলাম- আমার থেকে উপকার নিয়ে, একসাথে বসে চা-ভাত খাওয়া শতকরা ২/৩ ভাগ অকৃতজ্ঞ মানুষই আমার জয়যাত্রা থামাতে ব্যস্ত ছিলেন। এখনও সমানতালে অব্যাহত রেখেছেন। আমি তাদের জন্য দিনশেষে দোয়া করি এবং আমল করি পবিত্র কোরআনের এই দোয়াটি পড়ি তাদের হেদায়েতের উদ্দেশ্য “আল্লাহুম্মা ইন্না নাজআলকা ফি নুহুরিহিম ওয়া নাউজুবিকা মিন শুরুরিহিম” তারা যেন মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে সামনে আনতে পারে কারণ দুনিয়ার আদালতে পার পেলেও সৃষ্টিকর্তার আদালত থেকে পার পাওয়া কঠিন হবে।
আমার এ চাকরি জীবনের বিদায়ক্ষণে বারবার ফিরে তাকাতে হচ্ছে বৃটিশদের গড়া ডিসি অফিসের লাল দালানটিকে। এখানের প্রতিটি ইট, বালিকণা, মেঝেতে জড়িয়ে আছে আমার অসমাপ্ত জীবনের রোজনামচা, জনসেবার হালখাতা আর ভালবাসা ভাললাগার অনিন্দ্য সুন্দর গল্পগুলো। চলতে গিয়ে মাটি ব্যথা পাবে বলে জোরে হাঁটিনি, কথার শব্দে দেয়ালে কস্পন হবে বলে জোরে কথা বলিনি, চোখের ভাষায় মানুষতো দূরের কথা, পোঁকা মাকড় আর অন্য প্রাণিদের বিব্রত করিনি, আর্শিবাদের পরম শান্তির জন্য ধীরে নিঃস্বাস ফেলিয়েছি- এটাই আমার স্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তিত্ব ও জীবনবোধ। আমার অজান্তে সংঘটিত সকল ভুল-ত্রুটির জন্য আমাকে যেন আমার চিন্তা চেতনা ক্ষমা করে; আমি চিরতরে যাব না-আবার আসব, বারবার আসব; এ জনপথে- এ বিস্তৃত উঠোনে, লাল দালানে; কাগজের প্রতিটি কলমের কালিতে, আসব আমি পাখি হয়ে কুহুতানে, ফুল হয়ে সৌরভে, বাতাস হয়ে শান্তির পরশে, নদীর জলের কলতানে।
মনে রেখো- শুধুই মনে রেখো শত বছরে। আর যদি নাই রেখো, অনারবোর্ডের খোদাই করা নামটি- অযন্তে অবহেলায় অঝোরে কাঁদবে
“সময়ের হাত ধরে
যদি দুরে যাও সরে
স্মৃতির আয়নাতে মুখ দেখো
তবু মনে রেখো ৃ..”
আল্লাহ সকলের মঙ্গল করুন আমীন
মোহাম্মদ ইউনুছ, সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা




