নূর সালমা জুলি
এত বৃষ্টি!!!
প্রায় শুকিয়ে আসা দিঘিটা টইটম্বুর। দীর্ঘ সিঁড়ির প্রথম ধাপটা কেবল দেখা যাচ্ছে। দিনের মধ্যভাগ। আকাশটা সকালের মতো উজ্জ্বল। বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটার সঙ্গে এই উজ্জ্বলতা কেমন এক অদ্ভুত মেলবন্ধন তৈরি করেছে। ছেলেপুলেদের সঙ্গে মধ্যবয়সিরাও পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করছে। ঘরের জানালা দিয়ে এই দৃশ্য দেখছিলাম। খুব ইচ্ছে করছে ভিজতে। কিন্তু পা এগোয় না। কেন আটকে আছি বুঝতে পারছি না। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যে। অনেকেই উঠে যাচ্ছে। চারপাশটা অন্ধকার হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টিটা আরেকটু ঘন হয়ে আসবে। আমি ঘরের মধ্যে এলোমেলোভাবে হাঁটতে থাকি। সূত্রহীন চিন্তার জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসি। না, আমাকে দিঘির পারে যেতেই হবে। নিজের তৈরি করা বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে চলে আসি প্রথমবারের মতো। এসে দিঘির পাড়ে বসি। কিন্তু আমাকে হতাশ করে বৃষ্টি ধরে আসে। দিন তখন বিকেলের দিকে। ঈশাণ কোণে মেঘ জমলেও ঝরে পড়বার সম্ভাবনা কম। আধভেজা আমি কয়েকটা উঠতিবয়সি ছেলের বিশ্রী রকমের রসিকতা সহ্য করতে করতে ভাবি চলে আসি। কিন্তু আজ আমি আমাকে অতিক্রম করার ইচ্ছেতে বশীভূত। ভয় দেখালাম…মনে যা এলো বলে।
দেখি সত্যিকার অর্থেই তারা ভয় পেয়ে ক্ষমা চাওয়া শুরু করেছে। চারদিকে কেমন একটা ভূতুড়ে আবহ তৈরি হয়েছে। সূর্যাস্তের আগেই সন্ধ্যা নামায় হয়তো এমন লাগছে কিংবা বাতাসটা বেশ ঠান্ডা হওয়ার জন্যও হতে পারে কিংবা চারপাশ জনশূন্য হয়ে গেছে বলেও হতে পারে। আসলে মানুষের পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া থাকাটা খুবই ভয়াবহ। আসলে কী তাই! হ্যাঁ বা না দুটোই হতে পারে। জনবহুল একটা দেশের অধিবাসী হওয়ার জন্য হয়তো আমার মনের গঠনটা এমন। মন্ট্রিয়ালের সেই সকালটার কথা প্রায় আমাকে ভীষণ কাতর করে তোলে। টরন্টো থেকে প্রায় মাঝরাতে মন্ট্রিয়ালে আসি। সকালে ঘুম ভেঙে হোটেলের জানালায় দাঁড়িয়ে তো আমার নিশ্বাস আটকে যাওয়ার উপক্রম। চারদিক সাদা বরফে ঢাকা। একটা মানুষও যদি চোখে পড়ে! রাস্তায় পার্ক করা গাড়িগুলোর অবয়ব বোঝা যাচ্ছে কেবল। মনে হচ্ছিলো একটা পাষাণপুরীতে চলে এসেছি! এক তীব্র শীতল অনুভব আমার রক্তের প্রবাহে মিশে গিয়ে আমাকে অভাবিতপূর্ব বোধে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল অনেকক্ষণ। এখন অনেকদিন পর তেমন লাগছে। হঠাৎ আমার ভীষণ ভয় ভয় করতে লাগে। আমি এপাশ-ওপাশ করতে করতে জেগে উঠি। ঘামে প্রায় নেয়ে উঠেছি। বুঝতে পারি, স্বপ্ন দেখছিলাম। ইদানীং এমনসব স্বপ্ন দেখি এত স্পষ্ট আর এত স্পর্শকাতর যে অনায়াসে গুলিয়ে যায় তা বাস্তবতার সঙ্গে। দুপুরের দিকে ঘুমালেই এমন স্বপ্নেরা আসে কেবল…
একটু ধাতস্থ হয়ে যত্ন করে চা বানাই। কাপ হাতে বারান্দায় দাঁড়াই। সামনের রাস্তাটা ভেজা। কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়েছে বোঝা যায়। মাধবীলতা গাছের একটা ডাল কীভাবে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গ্রীলের পাশ দিয়ে দূরে চলে যাওয়ার জন্য মুখ বাড়িয়েছে। ভঙ্গিটা বেশ ঔদ্ধত্যপূর্ণ। এত সতেজ! আমার বেশ লাগলো। আস্তে আস্তে আলতো হাতে ওটাকে গ্রীলের সঙ্গে পেঁচিয়ে দিয়ে মুখটা বার করে দিলাম। যাতে নিশ্চিত আশ্রয়টায় সে শাখা-প্রশাখায় ভরিয়ে তুলতে পারে। নিচের দিকে উঁকি দিয়ে দেখি গোধূলির আলো-আঁধারির মধ্যে প্রস্ফুটিত মাধবীলতা এক কোমল, নরোম স্নিগ্ধতায় চারপাশ আলো করে রেখেছে। সেদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে বারান্দায় এসেছিলাম। আমার নাকে একদম ধাক্কা দেবার মতো করে এর ঘ্রাণ এসে লেগেছিল। এই ফুলটার মধ্যে একাধিক রঙের মিশ্রণ যে শেড তৈরি করে তা আমার চোখে বিস্ময় আনে। গাঢ় গোলাপির সঙ্গে সাদার এক অদ্ভুত মেলবন্ধন তৈরি করে আছে অনেকটা সোলমেটের মতো। আচ্ছা, বাস্তবে কি সোলমেট বলে কিছু হয়? কিংবা টুইন ফ্লেম?
বাড়িতে বসেও আজ বই খুলতে ইচ্ছে করে না। আগে এমন হতো না। এখন কেন হয় বুঝি না। প্রিয় কাজটার উপর থেকে মন উঠে গেলে বাঁচবো কী নিয়ে? আমি কী ক্লান্ত? ফোনটা হাতে তুলে নিই। সোস্যালমিডিয়ায় ঢুকে র্যানডম স্ক্রল করতে থাকি:
‘মিয়া খলিফার স্তনের সাইজ বড় হয়ে গেছে’
‘১২ দিনে ২৫ কেজি ওজন কমানোর উপায়’
‘৬০ দিনে ইংরেজিতে কথা বলার দক্ষতা অর্জনের সুযোগ’
‘জনৈক নায়িকার মন খারাপ হলে পথকুকুরদের সঙ্গে সময় কাটান’
‘সুখী দাম্পত্যের রহস্য’
‘…অভিনেত্রী ব্রান্ডের নাম ভুল উচ্চারণ করে ভাইরাল হয়েছে’
‘ঋণের কিস্তি দিতে না পারায় অটোরিকশাচালকের আত্মহত্যা’
‘ম্যানহোলের মধ্যে নিখোঁজ তরুণী’
‘শহরের জলাবদ্ধতা বিপদসীমা অতিক্রম করেছে’
‘শ্বশুরের পুরুষাঙ্গ কেটে দিয়েছে বৌমা’
‘মেডিটেশন করে আমি ভালো আছি, আপনি?’
‘গাইস, খুব বিপদে পড়েছি’ এই শিরোনামটা দেখে ক্লিক করি…
বন্ধুরা এখনই কমেন্টে জানাও, প্লিজ। আমার হাতের দুটো শাড়ির কোনটা পরবো? আমি হানিমুনে সুইজারল্যান্ড এসেছি। ৩০ মিনিটের মধ্যে সাইটসিয়িং-এ যাবো। আমি কনফিউজড। প্লিজ, বন্ধুরা জানাও…কোন শাড়িটায় আমাকে বেশি আকর্ষণীয় লাগবে? বুঝতেই পারছো নতুন বর। এই তরুণীর বন্ধুরা হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না। মানে শেষ কথাটা ‘নতুন বর। আর বিপদের ধরনটাও।
স্ক্রল বন্ধ করে উঠে আসি। ডিনার তৈরি করে নিই ঝটপট। এবার নিজেকে কিছুটা নির্ভার লাগে। আমি একটু আর্লি ডিনার করি। খেতে খেতে ভাবছিলাম নতুন বইগুলোর কথা। নতুন বই ছুঁয়ে দেখতে বেশ লাগে। গন্ধটাও। ইদানীং এলার্জি বেড়ে যাওয়ায় আর গন্ধটা নেওয়া হয় না।
বাড়িতে এসে নতুন বইয়ের র্যাক থেকে তুলে নিই ‘তোত্তোচান’। জানালার ধারের ছোট্ট মেয়েটির গল্পে কখন মধ্যরাত পেরিয়েছে খেয়ালই করিনি। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। এক পশলা ঠান্ডা বাতাস প্রিয় কোনো অনুভবের মতো মন আর শরীরকে ছুঁয়ে দিল। জানালায় এসে দাঁড়াই…বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগছে। পাশের বাড়ির নারিকেল গাছের পাতাগুলো চিকচিক করছে। আকাশে আলো। আজ কি পূর্ণিমা?
বৃষ্টির তীব্রতা কমে আসলে দূর থেকে ভেসে এলো…
‘তুই ফেলে এসেছিল কারে মন মনরে আমার……’
নূর সালমা জুলি, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক




