আলম খোরশেদ
এই সময়ের নাট্যভাষা একটি জটিল ও গম্ভীর জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রপঞ্চ, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দর্শন, বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, ইতিহাস, ভূগোলের মতো বহুবিধ বিষয়াবলি। প্রশ্ন উঠতে পারে ‘এই সময়’টি আসলে কার সময়, কোথাকার সময়? লেখার সুবিধার্থে একে আপাতত বাংলাদেশের সময় হিসেবেই বিবেচনা করতে পারি, যার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের, এমনকি গোটা ভারতেরই, এই সময় ও তার বাস্তবতার খুব একটা ফারাক থাকার কথা নয়। তা, আমাদের আলোচ্য ‘এই সময়’ এর বৈশিষ্ট্যগুলোকে কীভাবে চিহ্নিত করব আমরা?
মোটাদাগে ও চটজলদি এর কয়েকটি চোখে-পড়ার-মতো বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ তো করা যেতেই পারে। যেমন আমাদের এই সময়টা খুবই জটিল, জঙ্গম, দ্রুতগতিসম্পন্ন, বহুবিধ ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ায় সদা আকীর্ণ, অস্থির, অনিশ্চিত, সংঘাতপ্রবণ, অশান্তিময়, বিশৃঙ্খল, বিভেদ ও বিরোধিতায় পরিপূর্ণ, বস্তুগত ও বাণিজ্যমুখী, বিচিত্র ছলনাজালে পরিকীর্ণ, নৈরাশ্য ও নৈরাজ্যময় একটি সময়। আর এই সময়ের মানুষগুলো? তারা কমবেশি সবাই একা, বিচ্ছিন্ন, অসহায়, আত্মকেন্দ্রিক, আত্মপরতায় আচ্ছন্ন, কারণে কিংবা অকারণে সতত সংক্ষুব্ধ, সন্ত্রস্ত, স্বপ্নহীন ও সংশয়াকুল; অন্যদিকে সারাক্ষণ ব্যস্তসমস্ত, ছুটন্ত, প্রলুব্ধ, পরশ্রীকাতর, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপরায়ণ, উত্তেজিত, অসহিষ্ণু, অদূরদর্শী, অসংবেদী এমনকি একপ্রকার আত্মঘাতীও। তালিকা দুটো বেশ দীর্ঘই হয়ে গেল এবং এর মধ্যে হয়তো বেশ কিছুটা সরলীকরণ ও সামান্যকরণও রয়ে গেল, তবু এই সময় ও তার জাতকদের অন্তর্জগৎকে চিনে নেওয়ার জন্য মোটামুটি একটা ছবি বোধহয় এ থেকে পাওয়া সম্ভব।
এরকম একটি অদ্ভূতুড়ে সময় ও আষ্ঠেপৃষ্ঠে-বাঁধা মানুষদের জন্য রচিত ও মঞ্চস্থ নাটকের ভাষা নিশ্চয়ই পঞ্চাশোর্ধ¦ বছর আগে, আমাদের স্বাধীনতার পরপরই কলকাতার অনুকরণে যে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই সময়ের নাটকের ভাষা, বিষয় ও আঙ্গিকের অনুবর্তী থাকতে পারে না আর। তাহলে কী হতে পারে আমাদের এই সময়ের নাট্যভাষা? একটা উদাহরণ দিই। বছর কয়েক আগে যখন সমস্ত পৃথিবী করোনা নামক এক ভয়ংকর, প্রাণঘাতী অতিমারির আগ্রাসনে ছিন্নভিন্ন প্রায়, তখন তার প্রভাবে পৃথিবীর আর সব দেশের মতো আমাদের ঢাকা শহরের নাট্যমঞ্চগুলোও তালাবদ্ধ হয়ে একপ্রকার স্থবির ও স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। তখন এই ঢাকারই একজন মানুষ, একজন নাট্যঅন্তপ্রাণ, স্বপ্নবান চিন্তক ও কর্মী মানুষ, সৈয়দ জামিল আহমেদ, যাঁকে এক নামে ভারতবর্ষের নাট্যজগতের প্রায় সবাই চেনেন, তিনি আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে চাইলেন না। তিনি তখন এমন এক বিস্ময়কর নাট্যপ্রযোজনার কথা ভাবলেন, যার জন্য কোনো মঞ্চ, মিলনায়তন, দৃশ্যপট ইত্যাদি এমনকি একগাদা কুশীলব ও কর্মীরও প্রয়োজন হবে না। তিনি পত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে জানালেন প্রস্তাবিত এই নাটকটির জন্য তাঁর চাই পঁচিশ ফুট দীর্ঘ ও পনেরো ফুট প্রস্থ একটি আয়তকার জায়গা মাত্র। সাকুল্যে ত্রিশ চল্লিশজন দর্শক এর চারপাশে সারিবদ্ধভাবে বসবেন এবং তিনি তাঁদের সামনে তাঁদেরকে নিয়েই তাঁর নাটকটি মঞ্চস্থ করবেন। সেই জায়গাটি কারও বাড়ির বসার ঘর, ছাদ, অফিসের সভাঘর, কনফারেন্স কক্ষ, স্টুডিও, গ্যারাজ যেকোনো কিছু হতে পারে; তিনি সেখানকার আসবাবপত্র সরিয়ে নিয়ে চারপাশে চারটি বাতি জ্বালিয়ে দিব্যি তাঁর নাটকটি করে ফেলতে পারবেন।
তিনি তখন এই পদ্ধতিতে মঞ্চস্থ করা শুরু করেন তাঁর অত্যাশ্চর্য নাট্যনিরীক্ষা ‘বিস্ময়কর সবকিছু’, যার গল্পটি তিনি নিয়েছেন ব্রিটিশ নাট্যকার ডানকান ম্যাকমিলানের ২০১৩ সালে রচিত ঊাবৎু ইৎরষষরধহঃ ঞযরহম নাটকটি থেকে এবং সেটিকে নিজের মতো করে নির্মাণ করে নেন এই সময় এবং এই ঢাকা ও তার অধিবাসীদের উপযোগী করে। নাটকটির একজন মাত্র কেন্দ্রীয় কুশীলব মহসিনা আক্তার, যে তার নিজের অভিনয়ের পাশাপাশি উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে কাহিনির প্রয়োজনে দর্শকদের মধ্য থেকে আরও কয়েকটি চরিত্র বেছে নিয়ে তাদেরকে দিয়েই দিব্যি অভিনয় করিয়ে নেয় এবং নাটকটিকে তার কাঙ্ক্ষিত পরিণতিতে পৌঁছে দেয়, যা ছিল এককথায় অনন্য, অসাধারণ এবং দর্শকদের জন্য প্রকৃত অর্থেই দারুণ ‘বিস্ময়কর’ কিছু। প্রথম প্রদর্শনীর পর থেকেই নাটকটি বিপুল সাড়া ফেলে এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে তা মঞ্চায়নের আমন্ত্রণ আসতে থাকে। এপর্যন্ত এর প্রায় অর্ধশত প্রদর্শনী হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, করোনার অবসানের পরও কিন্তু এই নাটকের আবেদন বিন্দুমাত্র খর্ব হয়নি।
এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ঢাকার বীভৎস ও ভয়াবহ যানজট। ঢাকার হাতেগোনা যে কয়টি নাট্যমঞ্চ রয়েছে তার সবকটিই নগরীর একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত, যেকারণে ঢাকার অন্যান্য অঞ্চল, যেমন উত্তরা গুলশান বসুন্ধরা থেকে এরকম নারকীয় যানজট উজিয়ে নাটক দেখতে আসা নাগরিকদের জন্য এক প্রকার অসম্ভব হয়ে উঠেছে ইদানীং। এমতাবস্থায় সৈয়দ জামিল আহমেদ এবং তাঁর দল ‘স্পর্ধা’ আবারও ঘোষণা করলেন, তাঁর নাটক দেখার জন্য দর্শকদেরকে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে কষ্ট করে নাট্যমিলনায়তন অবধি আসতে হবে না, তিনিই বরং চলে যাবেন তাদের কাছে, একেবারে তাদের বাড়ির বসার ঘরে কিংবা আশেপাশেই কোনো সুবিধাজনক স্থানে, যেখানে তারা পরিবারের সদস্য এবং অন্যান্য আত্মীয়বন্ধুদের নিয়ে আরাম করে তাঁদের নাটক দেখতে পাবে। এবারও সাড়া মিলল প্রচুর। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে– উত্তরা, গুলশান, বনানী, মোহাম্মদপুর সর্বত্র তিনি তাঁর এই বিস্ময়কর নাটকটি মঞ্চস্থ করলেন; এমনকি পুরনো ঢাকার হাজারিবাগের এক পরিত্যক্ত ট্যানারির ছাদেও করেছেন একবার।
এবার নজর ফেরানো যাক, বিদেশের মঞ্চের দিকে। ২০১৯ সালে জার্মান সরকারের আমন্ত্রণে সারা পৃথিবীর বিশজন নাট্যকর্মী, নাট্যকার ও নাট্যসমালোচকদের একজন হিসাবে বার্লিনে অনুষ্ঠিত বিখ্যাত নাট্যোৎসব থিয়েটারট্রেফেন ৫৬ তে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল এই লেখকের। সেখানে আমার দেখা গোটা দশেক নাটকের মধ্যে তিনটি নাটকের কথা উল্লেখ করে আপাতত এই লেখার ইতি টানব। প্রথম নাটকটি দেখেছিলাম বার্লিনের ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী থিয়েটার ঠড়ষশংনঁযহব এ। নাটকটির নাম ঈড়সরহম ঝড়পরবঃু, আর এর রচয়িতা ও নির্দেশক বিশ্বখ্যাত সুজান কেনেডি। তো, নাটকের শুরুতেই, সমাগত দর্শকবৃন্দ তাদের আসনে বসতে না বসতেই, ঘোষণা শোনা গেল দর্শকদের সবাইকে মঞ্চে উঠে আসতে আহ্বান করা হচ্ছে। অবহিতজনেরা জানেন, ফোকসব্যুন থিয়েটারটি বিখ্যাত মূলত তার প্রাচীন স্থাপত্য এবং একটি বিশালয়তন ঘূর্ণমান মঞ্চের কারণে। তো, সেই ঘোষণা অনুযায়ী, আমরা দর্শকেরা ভীরুপায়ে মঞ্চে উঠে গেলাম এবং ঘুরন্ত গোলাকার মঞ্চের চারপাশে অবস্থান নিলাম। নাটক শুরু হলে দেখা গেল, দর্শকেরাও চলমান নাটক ও মঞ্চেরই মতোন নিজেরাই চলমান হয়ে উঠলেন, এবং হেঁটে হেঁটে মঞ্চের একেক অংশে ঘটমান নাটকের একেকটি দৃশ্য অবলোকন করতে থাকলেন তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী, যতক্ষণ ভালো লাগে এবং এইভাবে তিনি নিজেই নিজের নির্বাচন অনুযায়ী নাটকটির নিজস্ব ভাষ্য ও ব্যাখ্যা তৈরি করে তাঁর মতো করে সেটিকে উপভোগ ও বুঝে নিতে চাইলেন। এটি নিঃসন্দেহে নাটক দেখার এক নতুন পদ্ধতি, যেখানে দর্শক তাঁর নিজের শর্তে নাটক ও তার কুশীলবদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পারছেন। এমন অভিজ্ঞতা আর কারও কথা জানি না, আমার নিজের জন্য ছিল একেবারেই নতুন ও অভিনব, যা আমাকে এই সময়ের নাটকের ভাষা বিষয়ে নতুন করে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছে বইকি।
এরকমই বিচিত্র নিরীক্ষার নিদর্শন ছিল বাকি দুটো নাটক Oratorium I Dioûsos Stadt এর মঞ্চায়নে। প্রথমটি একটি বিশুদ্ধ ব্রেখটীয় ঘরানার নাটক, যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে দর্শকদের সঙ্গে সরাসরি ভাষিক সংযোগ গড়ে তোলা হয় এবং বলা চলে পুরো নাটকটিই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া, প্রশ্ন ও নিজস্ব অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার বিনিময়ের দ্বারা। নাটকের অন্যতম বিষয় ছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও সামাজিক সম্পত্তি ধারণার মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের ধারণা এবং তাতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ভূমিকা। বলাই বাহুল্য, এই বিষয়ের ওপর প্রত্যেক দর্শকেরই নিজস্ব কিছু অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি রয়েছে যার সমন্বয়ে নাটকটি একপর্যায়ে একটি যৌক্তিক পরিণতিতে গিয়ে পৌঁছায়, যেটি নাট্যকার কিংবা নাট্যনির্দেশকের চাপিয়ে দেওয়া নয়। অপর যে নাটক ও নিরীক্ষাটির কথা বলব এখন সেটি কিঞ্চিৎ লঘু ও ‘পলিটিকালি ইনকারেক্ট’ শোনালেও এর অন্তর্নিহিত বার্তাটি একেবারে ফেলনা নয় কিন্তু। গ্রিক মিথলজির সমকালীন উপস্থাপনা Dioûsos Stadt নাটকটির দৈর্ঘ্য ছিল মোট দশ ঘণ্টা এবং দীর্ঘ সময় ধরে নাটকের দর্শককুলকে ধরে রাখার জন্য একাধিক বিরতি ও হালকা খাবার সরবরাহের পাশাপাশি নাটক কর্তৃপক্ষ আরও একটি উদ্যোগ নেয় যা ছিল রীতিমতো পিলে চমকানো ব্যাপার। সেটি হচ্ছে, দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত বিপুলসংখ্যক ধূমপায়ীদের কথাও বিস্মৃত হননি তাঁরা। তাই মঞ্চের একপাশে একটি ধূমপান অঞ্চল তৈরি করেছিলেন তাঁরা, যেখানে ঘণ্টায় ঘণ্টায় সবুজ বাতি জ্বলে উঠত, আর তখন ধূমপায়ী দর্শকেরা গুটি গুটি পায়ে মঞ্চে উঠে আসতেন এবং সেই নির্দিষ্ট ধূমপান অঞ্চলে বসে মনের সুখে ধূমপান করতে করতে নাটকটি উপভোগ করতেন। কিছুক্ষণ পরে সেখানে লালবাতি জ্বলে উঠলে তাঁরা আবার নিচে নেমে এসে দর্শকসারিতে আসন নিতেন এবং এভাবে পুরো নাটকটি দেখে ফেলতে পারতেন, তাঁদের প্রিয় শখ কিংবা নেশাটিকে বিসর্জন না দিয়েও। ব্যাপারটি একটু ছেলেমানুষি শোনালেও, নাটকের দর্শকদের প্রতি সম্মান ও সুবিবেচনা প্রদর্শনের পাশাপাশি, দর্শক-খরার এই কালে একজন দর্শকও যে তাঁদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই দর্শকটিকে না হারানোর জন্য তাঁরা যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত, এই বার্তাটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য কিন্তু সুদূরপ্রসারী।
সে যাক, উপসংহারে শুধু এটুকুই বলার যে, সময় পালটেছে, দর্শকের রুচি, প্রত্যাশা, মানসিকতাও পালটেছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এবার নাটকের ভাষা, ভাবনা, বিষয়, শৈলী, উপস্থাপনা এই সবকিছুকেই পালটাতে হবে; তা নইলে আমাদের বর্তমান নাট্যচর্চার সংকট কাটবে না এবং বিশেষ করে দর্শকসংখ্যার এই আশঙ্কাজনক নিম্নগতি ঠেকানো যাবে না কিছুতেই। তবে আমি আশাবাদী, আমাদের নতুন প্রজন্মের নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক ও সর্বস্তরের নাট্যকর্মীরা তাঁদের মেধা, কল্পনাপ্রতিভা ও সৃজনশীলতার শক্তিতে এই সময়ের উপযোগী এবং এইকালের দর্শকের কাছে পৌঁছানোর উপযুক্ত নাট্যভাষাটিকে অদূর ভবিষ্যতে ঠিকই খুঁজে নিতে সক্ষম হবেন। আমরা সেই সুবর্ণ ‘সময়’ এর অপেক্ষায় রইলাম।
আলম খোরশেদ, অনুবাদক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক




