এখন সময়:রাত ৩:৫৮- আজ: সোমবার-৩রা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৮ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:রাত ৩:৫৮- আজ: সোমবার
৩রা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৮ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

মাইকেল মধুসূদন দত্ত : অলিখিত মহাকাব্যের মহাকবি

আ.ম.ম. মামুন

মধ্যযুগের বাংলা কাব্যপ্রবাহে যে স্থবিরতা, বিবর্ণ বন্ধ্যাত্ব, রহস্যময় দৈববিশ্বাস, পদ্যপ্রবাহের উপর যে নির্জীবতা, গতিমান জীবনের যে অপ্রত্যাশিত অনুপস্থিতি আমরা লক্ষ করি তার সমূল অবসান ঘটে উনিশ শতকে।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত উনিশ শতকের সার্থক প্রতিনিধি। তিনিই নবজাগ্রত জীবন-চেতনার প্রতীক, মানসপুত্র। নিজভূমে পরবাসী এই যুগন্ধর কবির বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব হ্যালির ধূমকেতুর মতোই আকস্মিক। অসাধারণ প্রতিভার দীপ্তি নিয়ে চৈতন্যবান এই কবি সঞ্চরণশীল ছিলেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়। বস্তুত মধুসূদনই প্রথম জগৎ ও জীবন, মানুষ ও মানুষের আকুলতা, ঔৎসুক্য, অর্থাৎ মানবিক আচারের বিচিত্র বৈশিষ্ট্যে সাজালেন তার কাব্যলক্ষ্মীকে। চলিষ্ণু জীবনের চাঞ্চল্য এবং সবুজ সজীবতায় কবিতায় আনলেন প্রাণময়তার আবেদন। সাহিত্যের গতিপরিবর্তন, বিস্তৃত পরিসর এবং বহুমাত্রিক কোণ নির্মাণে তিনিই প্রথম স্রষ্টা, তিনিই পথিকৃৎ।

উনিশ শতকের যে দশকে মধুসূদনের আবির্ভাব তার আগে এ যুগের কেটে গেছে প্রায় অর্ধশত বছর। এ শতকের শুরুতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামচন্দ্র, অক্ষয় কুমার বড়াল বাংলা গদ্য সাহিত্যের এক অনাবিষ্কৃত শক্তি আবিষ্কার করেন। আর মধুসূদন আবিষ্কার করেন বাংলা কাব্যের অন্তর্নিহিত শক্তি। যে অন্তর্নিহিত শক্তির প্রাবল্যে সূচিত হলো বাংলা কাব্যের আধুনিক যুগ। সত্যিকারের সৃজনী প্রতিভা নিয়েই তিনি উত্তরপুরুষে দিয়ে গেলেন আধুনিকতার দীক্ষা, অপরিসীম সাহস। বলে গেলেন, প্রতিভার আপন সৃষ্টি নব নব রূপের পথে সাহিত্যকে নবনব ধারায় প্রবাহিত করে দেয়।

বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের উপস্থিতি ‘শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের মতো’। মধুসূদন দত্তের মূল্যায়ন করতে গিয়ে সাহিত্য সমালোচক ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁকে ‘প্রথম বিশ্বভিখারী ও ত্রাতা’ বলে অভিহিত করেছেন।

বলেছেন, ‘মধুসূদন আমাদের প্রথম মহান অধস্তন, যিনি নির্বিচারে বা বিশেষভাবে বিচার করে ঋণ করেছেন পশ্চিমের কাছে; কখনো ছুটে গেছেন গ্রিক কবির মন্দিরে, কখনো হাত পেতেছেন লাতিন কবির দরোজায়, আবার কখনো উপস্থিত হয়েছেন ইংরেজ কবির আঙিনায়। পশ্চিমের কবিতালোকের দরোজায় দরোজায় ফিরেছেন এ মহাভিখারী—মহাঋণী আর সে ঋণে গড়ে তুলেছেন নিজের পুঁজি। পুঁজির অপব্যবহার হয় অনেকের হাতে। কিন্তু সৌভাগ্য আমাদের ঋণের অপব্যবহার করেননি মধুসূদন বরং গড়ে তুলেছেন নতুন কালের নতুন সাহিত্য, যার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়বোধ না করলে বুঝতে হবে যে অন্তরের কোথাও পঙ্গু হয়ে পড়েছে।’’

 

হোমারের বিশ্ববিখ্যাত মহাকাব্য রচিত হবার প্রায় তিন হাজার বছর পর মহাকাব্য রচনার নি:শেষিত যুগে মধুসূদন রচনা করলেন মহাকাব্য। বস্তুত বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে তখন গীতি কবিতা ও পল্লবিত কথা সাহিত্যের (উপন্যাস) দীপ্ত পদচারণা। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনার (১৮৬১) মধ্য দিয়ে তিনি মুক্ত কবিতার সূত্রপাত ঘটান। এই কাব্য মধ্যযুগীয় তমসা থেকে বাংলা সাহিত্যকে মুক্তি দিলো। মঙ্গল কাব্যের সিংহাসন থেকে মানুষকে টেনে আনলেন মর্তলোকে একেবারে মাটির কাছাকাছি।

 

বড় কাব্যের কাব্যিক গুণ যাই হোক জাতির সাহিত্য ইতিহাসে এর একটা আলাদা স্থান থাকে। কারণ জাতির জীবনের এক একটি যুগ এতে নতুন ছন্দে, নতুন মাত্রায় মুদ্রিত হয়। শিল্প বিবেচনায় সে কাব্য যেমন বড় মাপের, তেমনি এতে জীবনের যাবতীয় আচার অপূর্ব বেদনায়, অসীম উল্লাসে উৎসারিত হয়।

বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ ও মহত্তম কল্পনা ও পরিকল্পনা মেঘনাদবধকাব্য যা বাংলা সাহিত্যের প্রথম এবং একমাত্র মৌলিক মহাকাব্য হিসেবে স্বীকৃত ও প্রশংসিত।

মেঘনাদবধ কাব্যকে মহাকাব্য হিসেবে স্বীকার করে নেবার পরও উপর্যুক্ত শিরোনামে সচেতন পাঠককে ভাবিত করবে নিশ্চয়ই। তবে কি সত্যিই মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য অলিখিত থেকে গেছে কিংবা শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে এর স্থান কোথায়? স্বয়ং কবি একে ‘মেঘনাদবধ মহাকাব্য’ না বলে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বললেন কেন? এ রকম একাধিক প্রশ্ন নিশ্চয়ই পাঠকের ভাবনাকে নাড়া দেয়। প্রশ্নের সমাধানে যাবার আগে আমরা মেঘনাদবধ কাব্যের সাংগঠনিক এলাকা দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত সফর করে দেখি মহাকাব্য হিসেবে এটি কতোটা সার্থক।

আঙ্গিক বিচারে মেঘনাদবধ মহাকাব্য। মহাকাব্য এজন্য যে, সংজ্ঞানুযায়ী মহাকব্যিক কানুন হতে অনুসৃত। গভীরতার বিবেচনায় এটা যতোটা মহাকাব্য, বিশালতা ও বিস্তৃতিতে ততটা নয়—এ রকম অভিযোগ কিশোর সমালোচক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তবে একটি আধুনিক মহাকাব্য রচনা করবার জন্য মধুসূদনকে হতে হয়েছে বিশ্ববিহারী, বিশ্বভিখারিও। বিশ্বসাহিত্যে কবির আনন্দময় অভিজ্ঞতা রূপায়িত হয়েছে। বাংলা কাব্যে নতুন জীবন ও চেতনা বোধের শিল্পরূপ নির্মাণের প্রয়োজনে তিনি কখনো হোমারের কখনো ভার্জিলের, কখনো দান্তে ও ট্যাসোর মহাকাব্যে আকণ্ঠ অবগাহন করেছেন। রামায়ণকে বিবেচনায় রেখে তিনি রচনা করেছেন আধুনিক রামায়ণ। এতে প্রতীকায়িত হয়েছে জীবনবোধ, ব্যক্তির বিয়োগান্ত পরিণতি। বাংলা রেনেসাঁর টুকরো টুকরো চেতনা দিয়ে রচিত মেঘনাদবধ একটি বহুমাত্রিক  মহাকাব্য। রামায়ণী ভাবকে বিপর্যস্ত করে তিনি ভাবের যে বিপ্লব ঘটালেন তা-ও মহাকাব্যিক। ভাষার ওজস্বীতায়ে, গাম্ভীর্যে, ছন্দস্বাছন্দে, উপমা, উৎপ্রেক্ষায়, বর্ণনারীতিতে, চরিত্র-চিত্রণের অপূর্ব কৌশলে, সর্গ সংখ্যার বিবেচনায় মেঘনাদবধ যথার্থ অর্থেই মহাকাব্য। শুধু রসের বিবেচনায় আমরা কিছুটা ওলট পালট লক্ষ করি। কবির সজ্ঞান ঘোষণা—

‘গাইব মা বীর রসে ভাসি মহাগীত।’—সর্বত্র রক্ষিত হয়নি। সারা কাব্যে মুদ্রিত হয়েছে নিয়তি নির্যাতিত রাবণের হৃদয়বিদীর্ণ হাহাকার। সুতরাং রসের বিবেচনায় মেঘনাদবধ বেদনা রসের। তবে মাঝে মাঝে বীর আর করুণ রসের মোহন মিলন মহাকাব্যিক।

মেঘনাদবধকে মহাকাব্য হিসেবে স্বীকার করে নেয়ার পরও বিষয়টি তর্কাতিত নয় নিশ্চয়ই। মেঘনাদবধ কাব্য মহাকাব্যের ছাঁচে রচিত হলেও কবি এর শিরোনামে মহাকাব্যের পরিবর্তে কাব্য বলেই আখ্যায়িত করেছেন। মহাকাব্য হিসেবে যেহেতু মেঘনাদবধ ত্রুটিমুক্ত নয়, সেহেতু একটি বিশুদ্ধ মহাকাব্য লিখবার পরিকল্পনা বা আকাঙ্ক্ষা কবির থেকে থাকবে হয়তো এবং সে হিসেবে মেঘনাদবধকে কবির মহাকাব্য লেখার প্রস্তুতি পর্ব বলেও চিহ্নিত করা যেতে পারে। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনার প্রাক্কালে আত্মপ্রতিভাসচেতন কবি তাঁর বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে লিখেন—তিনি প্রকৃত বীর রসের কাব্য লিখার জন্য হাত পাকাচ্ছেন।

Let me write a fwe Epiclings and thus acquire pucca-fist.”

 

মেঘনাদবধ কাব্য যে সেই প্রস্তুতিপর্বের কাজ তাতে সন্দেহ নেই। যদিও এ কাব্যের অভিনবত্ব শ্রেষ্ঠত্ব সর্বজনবিদিত এবং স্বীকৃত।

পরবর্তীকালে আমরা লক্ষ করি কবি তাঁর একাধিক নিকট বন্ধুর অনুরোধে মহাকাব্য রচনার চেষ্টা করেছেন। একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন—

”……Maû of our friends are at me to dash out again. But the question is of what subject. Jitindra Proposes the battles of the Kaurava and Pundub prnices. Another friends the abduction of usha (উষাহরণ) ঘড়ি ও ধস for your wmsnj weRq I am afraid at will not be an  easy thing to beat Maghnad. but there is no harm in trying.

 

মেঘনাদবধকে ছাড়িয়ে শ্রেষ্ঠতর কিছু রচনা করা অসম্ভব এবং একটা সংশয় কবির মনের ভেতর জাগ্রত ছিল। তবুও কবি মহাকাব্য ঘোষণা দিয়ে একাধিক মহাকাব্য শুরু করেছিলেন। তার মধ্যে ‘পাণ্ডব বিজয়’ এর প্রথম পঙক্তি—‘কেমনে সংহারি রণে কুরুকুল রাজে/

কুরুকুল রাজাসন লভিয়া দ্বাপরে/ধর্মরাজ সে কাহিনী, সে মহাকাল/

নবরঙে বঙ্গজনে উবিএ আসরে/কহ দেবি।’

‘দেবদানবীয়ম’ মহাাকাব্যের প্রথম সর্গে তিনি লিখেছেন—

কাব্যখানি রচিবারে চাহি/কবে কি ছন্দে: পছন্দ দেবি/মহীষ বৃন্তে এ সুবঙ্গ দেশে/

তোমার বীমা দেহ মোর হাতে/বাজাইয়া তার যশস্বী হবে/অমৃতরূপে তব

কৃপাবারি/ দেহো জননী গো, ঢালি এ পেটে।’’

 

এ পর্যন্তই। তারপর তিনি আর এগোতে পারেননি। এ দুটো ছাড়াও তিনি ‘সুভদ্রাহরণ’ ‘দ্রৌপদী সয়ম্বর’ ও ‘সিংহল বিজয়’ নামে আরো তিনটি মহাকাব্য শুরু করেছিলেন, কিন্তু সবগুলোই অলিখিত থেকে গেছে। বৈরী বাস্তবের প্রচণ্ড প্রতিকূলতায় হাত পাকাবার পূর্বেই কবির জীবন সায়াহ্ন ঘনিয়ে এসেছে। কবির পূর্বোক্ত ঘোষিত বীর রসের কাজ বাংলা সাহিত্যে আর রচিত হলো না। যে মহাকাব্য লিখবার জন্য মধুসূদন চঁপপধ-ঋরংঃ’ এর অপেক্ষায় ছিলেন তা আভাসেই রয়ে গেলো। মাইকেল মধুসূদন দত্ত সেই অলিখিত মহাকাব্যের মহাকবি!

 

তথ্যসূত্র :

১. ক্ষেত্রপুত্র: মধুসূদনের কবি আত্মা ও কাব্যশিল্প

২. অধ্যাপক মুখার্জী ও অধ্যাপক ব্যনার্জী সম্পাদিত: মেঘনাদবধকাব্য

৩. সুরেশচন্দ্র মৈত্র সম্পাদিত : মধুসূদন রচনাবলী

৪. হুমায়ুন আজাদ: আধার ও আধেয়

 

 

আ.ম.ম. মামুন, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, সরকারি হাটহাজারী কলেজ, চট্টগ্রাম

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাহিত্য-গবেষণার আলোকবর্তিকা

শাহেদ কায়েস   আহমদ রফিক (জন্ম: ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-মৃত্যু: ২ অক্টোবর ২০২৫) বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুবনে আহমদ রফিক একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে

অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

আন্দরকিল্লা ডেক্স \ চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের আত্মজীবনী ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

ফেরা

সৈয়দা মাসুদা বনি   নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন   রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু! মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে

চিরহরিৎ বৃক্ষের গল্প

সুজন বড়ুয়া   ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়।