এখন সময়:রাত ৩:৫৮- আজ: সোমবার-৩রা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৮ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:রাত ৩:৫৮- আজ: সোমবার
৩রা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৮ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

ম্রো জাতিসত্তার কিংবদন্তি ও লোকবিশ্বাস

আরফান হাবিব

বাংলাদেশ একটি বহু জাতির, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। এ দেশে বৃহত্তম বাঙালি জাতি ছাড়াও ৪৫টির অধিক আদিবাসী জাতি স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করে আসছে। তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের বেশি কেন্দ্রীভূত বসবাস রয়েছে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, বম, লুসাই, পাংখুয়া, খুমী, খ্যাং ও চাকসহ ভিন্ন ভাষাভাষী এ এগারটি ক্ষুদ্র জাতির আবাসভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম। ভিন্ন ভাষাভাষির এ সকল আদিবাসী জাতিসমূহ সমষ্টিগতভাবে ‘জুম্ম’ নামে সমধিক পরিচিত। এসব আদিবাসী জাতিসমূহ যুগ যুগ ধরে নিজস্ব সমৃদ্ধ সমাজ, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, ধর্ম-ভাষা ও স্বতন্ত্র নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি নিয়ে এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। তাদের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস, সামাজিক রীতিনীতি, ভৌগোলিক পরিবেশ, দৈহিক-মানসিক গঠন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনযাত্রা ইত্যাদি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

অপরুপ প্রকৃতির মতোই আদিবাসীদের জীবনধারা ও সংস্কৃতি সুন্দর এবং বৈচিত্র্যময়। বৈচিত্র্যময় তাদের ভাষা, রীতি-নীতি, পোশাক-পরিচ্ছদ ও উৎসব-অনুষ্ঠান। বিশ্বায়নের প্রভাব, তথাকথিত আকাশ-সংস্কৃতি ও নানা অপসংস্কৃতির ছোবলে আদিবাসীদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আজ চরম হুমকির মধ্যে রয়েছে। অপরদিকে তথাকথিত আধুনিকায়নের অপচেষ্টায় বিভিন্ন আদিবাসী জাতির স্বকীয় সংস্কৃতি বিবর্ণ হতে চলেছে। সংস্কৃতির সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও বিকাশে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আদিবাসীদের সমৃদ্ধশালী সংস্কৃতি বিপন্ন হতে চলেছে। কোনো কোনো আদিবাসী জাতির সংস্কৃতি ও তাদের নাচ-গান, পোশাক-পরিচ্ছদ, ঐতিহ্য, উৎসব এবং তাদের মাতৃভাষা ধ্বংসপ্রায়। আদিবাসীদের এসব সমৃদ্ধশালী সংস্কৃতি ও তাদের ঐতিহ্যবাহী নাচ-গান, তাদের ভাষা, সাহিত্য এবং তাদের উৎসব, প্রথা সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

 

আদিবাসীদের স্বকীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হলো আদিবাসীদের জাতিগত পরিচয় এবং স্বাতন্ত্র্যতার প্রতীক। আদিবাসীদের এসব ঐতিহ্য, প্রথা, ভাষা ও কৃষ্টি তথা সংস্কৃতি এদেশের সংস্কৃতি ভাণ্ডারের অমূল্য রত্ন ও সম্পদ। আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে তাদের ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি লালন করে আসছে এবং পাশাপাশি এ দেশের বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্রময়তাকে তারা সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু আজ বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর প্রবল আগ্রাসনে তাদের সেই ভাষা ও সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর লোকেরা আদিবাসীদের সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি সম্পর্কে খুব কম জানে। ফলে আদিবাসীদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, রীতিপদ্ধতি ও মূল্যবোধ সম্পর্কে অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে থাকে। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও স্বীকৃতির অভাবের কারণে আদিবাসীদের সংস্কৃতি আজ হুমকির মুখে। আদিবাসীরা ধীরে ধীরে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য হারাচ্ছে। হারাচ্ছে তাদের সংস্কৃতি, রীতি-প্রথা,গান প্রভৃতি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ১১টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ম্রো জনগোষ্ঠী অন্যতম। বাংলাদেশ ছাড়াও মায়ানমারে আরাকান রাজ্যে বিপুল সংখ্যা ম্রো জনগোষ্ঠীর লোক বাস করে। নৃ-তাত্ত্বিক বিচারে ম্রোরা মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত তিব্বতী বার্মান দলের অন্তর্গত। ‘ম্রো’ শব্দের অর্থ মানুষ। ম্রোদের বাঙালিরা চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যারা মুরুং বলে এবং মায়ানমার-আরাকানে মিয়ো বলে।

পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থাৎ বান্দরবান পার্বত্য জেলার সর্বত্র ম্রোদের বসতি দেখা যায়। এছাড়া রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার দক্ষিণে কাপ্তাই এর পার্শ্বে ভার্যাতলী মৌজায়ও ম্রোদের বসতি ছিল। সেখান থেকে তারা ১৯৮৫ সালে বান্দরবানে স্থানান্তরিত হয়েছে। তারা জমি চাষ এবং জুম চাষ উভয় পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করে। তাই তাদেরকে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় এবং সমতল ভূমিতেও দেখা যায়।

ম্রো জনগোষ্ঠী অন্যদের কাছে নিজেদের ‘ম্রো’ নামে পরিচয় দেয়। ম্রোদের জনসংখ্যা ১৯৬১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদন অনুসারে ২১,৬০৩ জন ছিল। বর্তমানে তাদের লোকসংখ্যা ৩৮০২২। (আদমশুমারি ২০১১) দশ-পনেরটি পরিবার মিলে তারা একটি গ্রাম তৈরি করে এক জায়গায় বসতি স্থাপন করে। অসংখ্যা ঝর্ণা ও ছোট নদীর ধারে, খাড়া পাহাড়ের ঢালুতে এরা নিজেদের ঘর-বাড়ি তৈরি করে নেয়। ম্রোরা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকে আলাদাভাবে জীবন যাপন করছে। তাই তারা সাধারণত একটু ভীরু প্রকৃতির।

ম্রোরা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। জর্জ গির্য়াসন এর মতে— ম্রো ভাষা বর্মি দলের অন্তর্ভুক্ত। এ ভাষার সঙ্গে কুকি-চিন ভাষাগুলোর অধিক মিল রয়েছে। তাদের ভাষা টিবেটো-বর্মন দলের একটি ভাষা।

কালের প্রবাহে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা তাদের পরম্পরা সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে প্রাণময় করে রেখেছে। বৈচিত্র্যময় ও জীবনধারার স্বাতন্ত্র্য ম্রো জাতিসত্তাকে করেছে অনন্য। গো-হত্যা ও বাঁশি নিয়ে ম্রোদের রয়েছে চমৎকার কিংবদন্তি—

ম্রো জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে বহুল আলোচিত ও ঐতিহ্যবাহী একটি আচার হলো গো-হত্যা অনুষ্ঠান বা চিয়াপদ পই। এ আচার মূলত ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে পালিত হয়, যখন পাহাড়ি অঞ্চলে জুমের ফসল কাটা শেষ হয় এবং জনপদে উৎসবমুখর আবহ তৈরি হয়। তখন ম্রো সমাজের মানুষরা রিয়াচাওয়া বা অনুষ্ঠান-পরিচালনা কমিটির নেতৃত্বে এ আয়োজন সম্পন্ন করে। গো-হত্যা অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হলো মানত পূরণ ও দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। তাদের বিশ্বাস, গরুর মধ্যে এক ধরণের শত্রুত্মা বিরাজ করে, যে মানুষের অকল্যাণ ডেকে আনে। তাই এ অনুষ্ঠানে তিনটি গরু বলি দেওয়া হয়, যাতে অশুভ শক্তি পরাভূত হয়।

গো-হত্যা অনুষ্ঠানকে ঘিরে ম্রো সমাজে নানা সামাজিক নিয়মও প্রচলিত। রিয়াচাওয়া সদস্যরা অনুষ্ঠান চলাকালীন নিরামিষ ভোজনে অভ্যস্ত থাকেন, কারণ এই সময়ে আমিষ খাওয়া হলে অনুষ্ঠানকে অপবিত্র ধরা হয়। পাহাড়ি জনপদের কুয়াশাচ্ছন্ন রাত, শীতল বাতাস, ঝরনার কলকল ধ্বনি আর বাঁশির সুর—সব মিলিয়ে অনুষ্ঠানটির পরিবেশ হয়ে ওঠে এক গভীর রহস্যময় ও অপার্থিব আবহে ভরপুর।

ম্রো সমাজে গো-হত্যা আচারটির পিছনে যে ধর্মীয় বিশ্বাসটি কাজ করে, তা এক প্রাচীন এবং মর্মস্পর্শী কল্পকাহিনীর সঙ্গে গেঁথে আছে। ম্রোদের ধারণা, চাঁদ-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রসহ পৃথিবীর সমস্ত জীবজগতের স্রষ্টা একটি মহাশক্তিমান ব্যক্তিত্ব—থাকে তাঁরা থুরাই নামে অভিহিত করে থাকেন—একদিন তাঁর সৃষ্ট প্রজাসমূহকে সঠিক পথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে বর্ণমালা-সম্বলিত একটি ধর্মগ্রন্থ দান করবেন। সেই গ্রন্থ হস্তান্তরের উৎসবে পৃথিবীর সকল জাতির নেতা-নায়ককে উপস্থিত থাকার জন্য আহ্বান করা হয়; কিন্তু জুমের ফসল কাটার ব্যস্ততায় ম্রো জাতির প্রতিনিধি নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে পারেননি। ফলে অন্যান্য জাতির নেতারা গ্রন্থ হাতে গ্রহণ করে চলে গেলে ম্রোরা ঠিক সময়ে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হলে গ্রন্থ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়।

পরবর্তী প্রভাতে থুরাই ম্রোদের কাছে গ্রন্থ পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি গরুকে প্রেরণ করেন। গরু দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এক মহাবটীর ছায়ায় বিশ্রাম নিতে গিয়ে অনিচ্ছায় সেই পবিত্র পুস্তকটি খেয়ে ফেলে। ফলে গ্রন্থভিত্তিক বর্ণমালা ও ধর্মীয় নির্দেশাবলী ম্রোদের কাছে পৌঁছায় না; পরিবর্তে গরুটি বিভ্রান্তিকর ও বানোয়াট কথা প্রচার করে। বিষয়টি যখন ভগবানের নিকট প্রতিষ্ঠিত হয়, তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে গরুকে দণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত নেন—নির্দেশ দেন, যতদিন ম্রো জাতি বর্ণমালা-সম্বলিত গ্রন্থপ্রাপ্ত হবে না ততদিন ম্রোরা গরুকে শাস্তিপ্রাপ্ত করবে। সেই শাস্তির প্রতীকেরূপে গরুকে পাড়ার মধ্যস্থলে আনয়ন করে নৃত্য-গান শেষে সকালে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে খুঁটির শীর্ষে তার জিহ্বা নিবেদন করার রীতি গড়ে ওঠে।

এই পৌরাণিক কাহিনির ধারাবাহিক বিশ্বাস থেকেই গরুকে এক প্রকার অসুরাত্মা ভাবা হয় এবং গো-হত্যা অনুষ্ঠানের প্রথা প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে সময়ের সঙ্গে ধর্মীয় জ্ঞান ও অনুশীলনে পরিবর্তন আসায়—বিশেষত যারা ক্রামা ধর্ম গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে—এই আচারটি অনেক স্থানেই পালিত হয় না; কেননা তাদের কাছে ধর্মগ্রন্থ পৌঁছে যাওয়ায় গরুকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করার কারণ নেই। এভাবে ম্রো সমাজের ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও পরিবর্তনের সংমিশ্রণই গো-হত্যা আচারটির অন্তরাত্মাকে গঠন করে।

 

ম্রো জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে বাদ্যযন্ত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সমাজে বাঁশি-জাতীয় যন্ত্র বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। এসব বাদ্যযন্ত্র কেবল বিনোদন নয়, আচার-অনুষ্ঠান, নৃত্য ও সামাজিক সমাবেশেও অপরিহার্য। প্রধানত তিন ধরনের বাঁশি তাদের জীবনে বিশেষ স্থান দখল করেছে—

পুং (বাঁশি)

ম্রো সমাজের সবচেয়ে প্রচলিত ও প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্র হলো পুং। বিশেষত গো-হত্যার অনুষ্ঠান এবং নৃত্যের পরিবেশনায় এটি অপরিহার্য। তাছাড়া গান গাওয়ার সময়ও রিনা পুং নামের এক প্রকার বাঁশি ব্যবহৃত হয়।

এই বাঁশি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় ডলু বাঁশ এবং সাচ্চু নামের এক ধরনের পামগাছের বাকল। সাচ্চুর শাল রোদে শুকিয়ে ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে হারমোনিয়ামের রিডের মতো পাত তৈরি করা হয়। এরপর শুকনো বাঁশের এক প্রান্ত বন্ধ করে, তাতে মোম ব্যবহার করে রিড বসানো হয়। তারপর তিতা লাউয়ের খোলসের ভেতরে বাঁশের নল লাগিয়ে মোম দিয়ে আটকে দিলে তৈরি হয় পুং। লাউয়ের মুখে ফুঁ দিলে বাতাস রিডে গিয়ে কম্পন সৃষ্টি করে এবং সুমধুর সুর বের হয়।

তবে যে কেউ ইচ্ছে করলেই এ বাদ্যযন্ত্র বানাতে পারে না। এর জন্য দক্ষ কারিগরের প্রয়োজন, কারণ পুং তৈরির কাজ নিখুঁত না হলে কাঙ্ক্ষিত সুর পাওয়া যায় না।

প্লাই পুং (নৃত্যের বাঁশি)

প্লাই পুং মূলত নৃত্যের জন্য ব্যবহৃত বাঁশি। বিশেষ করে গো-হত্যার অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশনের সময় এটি অপরিহার্য। এক সেট প্লাই পুংয়ে প্রায় ২০২৫টি বাঁশি থাকে। একসঙ্গে বাজালে চারপাশের পাহাড়ি বনভূমি যেন সুরের দোলায় কেঁপে ওঠে।

এই বাঁশির তালে তালে ম্রো মেয়েরা দল বেঁধে নৃত্য পরিবেশন করে। তাল সৃষ্টি করাই এর মূল বৈশিষ্ট্য, যা নৃত্যের ছন্দকে জীবন্ত করে তোলে।

রিনা পুং (কলেরা বাঁশি)

ম্রো সমাজের অন্যতম আকর্ষণীয় বাঁশি হলো রিনা পুং। তবে এর পেছনে রয়েছে এক কিংবদন্তি। প্রবীণদের মতে, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ম্রো অধ্যুষিত এলাকায় ভয়াবহ কলেরা মহামারি দেখা দেয়। অনেকেই এ রোগে প্রাণ হারান। সেই সময় রিংক্লাং নামের এক যুবকও মারা যায়, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে পরে সে জীবিত ফিরে আসে। রিংক্লাং সবার সামনে জানায়, মৃত্যুর পর সে স্বপ্নের মতো এক সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে ছিল। দূর থেকে একটি জাহাজ এসে তাকে তুলে নেয়। জাহাজে অনেক তরুণ-তরুণী গান গাইছিল, বাঁশি বাজাচ্ছিল। তাদের মধ্য থেকে একজন তাকে এক অদ্ভুত বাঁশি দেয় এবং বাজানোর কৌশল শেখায়। হঠাৎ জাহাজ থেকে পড়ে যাওয়ার পর তার জ্ঞান ফেরে, আর সে দেখে যে লোকজন তাকে দাহ করতে নিয়ে যাচ্ছে। পরে বাড়ি ফিরে রিংক্লাং স্বপ্নে পাওয়া সেই অদ্ভুত বাঁশি তৈরি করে। যেহেতু ঘটনাটি কলেরা মহামারির সময় ঘটেছিল, তাই বাঁশিটির নাম হয় রিনা পুং—‘রিনা’ মানে কলেরা, আর ‘পুং’ মানে বাঁশি।

এই বাঁশি শুধুমাত্র গানের আসরে বাজানো হয়। আনন্দঘন মুহূর্তে তরুণ-তরুণীরা একত্রিত হয়ে রিনা পুং বাজায়, যা ম্রো সমাজে এক অনন্য সাংস্কৃতিক আবেগের প্রতীক।

 

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১১টি আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য প্রায় একই সূত্রে গ্রথিত। একই আলোবাতাসে চিন্তা-চেতনায় উদ্ভাসিত। এখানকার আদিবাসী জুম্ম সংস্কৃতি ঐতিহ্যরূপ অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় বা অন্যান্য জাতির সত্তা থেকে পৃথক ও স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বহন করে। এদের চাষাবাদ পদ্ধতি, পূজা-পার্বণ, লোক-কাহিনি, কিংবদন্তি, আচার-অনুষ্ঠান প্রায় এক ও অভিন্ন। নববর্ষ ‘সাংগ্রাই’ উৎসব পাহাড়ি আদিবাসীদের একই কাতারে এবং পরমানন্দের সম্মিলন ক্ষেত্র বলা চলে। এছাড়াও গৃহ নির্মাণ, বিবাহ পদ্ধতি, সামাজিক কাঠামো, লোকসাহিত্য ইত্যাদি এক জনগোষ্ঠীর সাথে অপর জনগোষ্ঠীর বহুলাংশে মিল পরিলক্ষিত হয়। এ আদিবাসীরা অনন্তকাল থেকে এ পার্বত্য অরণ্য ভূমি-প্রকৃতিকে আপন করে বসবাস করে আসছে। এরা প্রকৃতিকে ভালোবেসে পরিবেশের ভারসাম্য যাতে নষ্ট না হয় তার জন্য স্বীয় সংস্কারের পদ্ধতি নানাবিধ পূজা-অর্চনা করে থাকে। যার কারণে আদিবাসীদেরকে পাহাড়ের নিভৃত সন্তান বলা চলে। আদিবাসীরা কোন পুঁথি পত্র থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করলেও পূর্ব-পুরুষের কাছ থেকে, প্রকৃতি থেকে স্বাভাবিক শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে এবং দৃষ্টির দর্শনে বন ও পরিবেশ সংরক্ষণের কৌশল রপ্ত করেছে নানাভাবে। ঝড়-তুফান, বন্যা-প্লাবন, রোগ-মহামারি, দুর্যোগ-দুর্ঘটনা, দুর্দিন-দুর্বিপাকে কিভাবে রক্ষা পেতে হয় তা তাদের অজানা নয়। তারা বনে খাদ্য-দ্রব্য সংগ্রহ ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বনজ দ্রব্য সংগ্রহ করেছে বটে, কিন্তু নিজেদের বাঁচার তাগিদেই তারা বনও রক্ষা করেছে। তারা জানে বন না থাকলে তাদের জীবিকা বিপন্ন হবে নানাভাবে।

সময়ের সাথে সাথে সব কিছু পরিবর্তনশীল। পৃথিবীর সকল উন্নত ও অনুন্নত বা উন্নয়নশীল জাতিগোষ্ঠীর  মতো বাংলাদেশি মানুষের মধ্যে পরিবর্তন দৃশ্যমান। তেমনি পৃথিবীর কম অগ্রসর আদিবাসীদের মধ্যেও পরিবর্তন বিকাশমান। বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন আদিবাসী মানুষের মধ্যে পরিবর্তন ক্রমবর্ধমান। পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের মাঝে যেমন এটি ঘটছে, তেমনি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত আদিবাসীদের মাঝেও এই স্বাভাবিক ধারা লক্ষণীয়।

 

 

আরফান হাবিব, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাহিত্য-গবেষণার আলোকবর্তিকা

শাহেদ কায়েস   আহমদ রফিক (জন্ম: ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-মৃত্যু: ২ অক্টোবর ২০২৫) বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুবনে আহমদ রফিক একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে

অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

আন্দরকিল্লা ডেক্স \ চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের আত্মজীবনী ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

ফেরা

সৈয়দা মাসুদা বনি   নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন   রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু! মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে

চিরহরিৎ বৃক্ষের গল্প

সুজন বড়ুয়া   ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়।