জ্যোতির্ময় নন্দী
হাঙ্গেরীয় কথাশিল্পী লাস্লো ক্রাস্নাহোরকাই এ বছরের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, এ খবর এখন পুরোনো। নোবেল একাডেমির ঘোষণায় বলা হয়েছে, একাত্তর বছর বয়সী এই লেখককে এবার পুরষ্কৃত করা হল, কারণ তাঁর “হৃদয়গ্রাহী এবং ভবিষ্যদর্শী রচনাবলী প্রলয়ঙ্করী সন্ত্রাসের মাঝখানেও শিল্পের শক্তিমত্তাকে আবারো নিশ্চিত করে দেয়”।
আরো অনেক নোবেলজয়ী কবি-সাহিত্যিকদের মতো ক্রাস্নাহোরকাইয়ের নাম বা তাঁর রচনাবলীর সাথে আমাদের মতো আমজনতার কাতারের পাঠকরা তেমন পরিচিত নন। হাঙ্গেরীয় ভাষায় লেখা তাঁর মূল লেখাগুলোর ইংরেজি অনুবাদের ছিটেফোঁটা বাংলা পুনরনুবাদ যে হয় নি তা নয়, তবে সেগুলো বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর হাতে পৌঁছেছে বলে মনে হয় না। তবে নোবেল প্রাপ্তির সুবাদে এখন এই শক্তিমান কথাসাহিত্যিকের আরো কিছু লেখা আর জীবনবৃত্তান্ত বাংলায় অনূদিত হয়ে আমপাঠকের হাতে এসে পৌছাচ্ছে, এটা নিশ্চয় সুখের বিষয়।
প্রায়শই উত্তরাধুনিক লেখক হিসেবে উল্লিখিত ক্রাস্নাহোরকাইকে বলা হয় বিপর্যয়ের, প্রবল দুঃশাসন আর নৈরাজ্যবাদের, দুঃস্বপ্নলোকের আর গভীর বিষাদের রূপকার। লতিয়ে লতিয়ে এগিয়ে যাওয়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর বাক্যের ও অনুচ্ছেদের লেখক হিসেবেও তিনি সুপরিচিত। ১৯৮৫-তে প্রকাশের সাথে সাথে বিরাট সাড়া ফেলে দেয়া তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘স্যাটানটাঙ্গো’র মোট বারোটি অধ্যায়ের প্রতিটি রচিত একটিমাত্র অনুচ্ছেদ দিয়ে। ১৯৮৯-এ প্রকাশিত তাঁর তিনশ পৃষ্ঠার উপন্যাস ‘প্রতিরোধের বিষাদ’ (‘আস্ এলেনালাস মেলানকোলিয়াইয়া’ বা ‘দা মেলানকলি অব রেজিস্ট্যান্স’)-এ অনেকসময় একেকটা অনুচ্ছেদ একাধিক অধ্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে। তবে সম্ভবত কথাসাহিত্যে দীর্ঘতম বাক্যের বা অনুচ্ছেদের উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করেছেন, ২০২১ সালে প্রকাশিত তাঁর চারশ পৃষ্ঠার অনতিবৃহৎ উপন্যাস ‘হার্শ্ট্ ০০৭৭৬৯’, যেটি তিনি বিস্ময়করভাবে রচনা করেছেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটিমাত্র বাক্য দিয়ে।
নিজের লিখনশৈলী নিয়ে কী বলবেন, এ প্রশ্নের জবাবে ক্রাস্নাহোরকাই ২০১৫ সালে বুকার জেতার পর গার্ডিয়ান পত্রিকাকে এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, “অক্ষরের পর অক্ষর, তারপর অক্ষর থেকে শব্দ, তারপর শব্দের পর শব্দ দিয়ে কিছু ছোট ছোট বাক্য, তারপর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর বাক্য, এবং প্রধানভাবে অতিদীর্ঘ সব বাক্য, ৩৫টি বছর ধরে। সৌন্দর্য ভাষায়, মজা নরকে।” এ
প্রথম উপন্যাস স্যাটানটাঙ্গোতে ক্রাস্নাহোরকাই এক অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ১৯৮৫-তে প্রকাশিত বইটিতে তিনি বলেছিলেন, পরবর্তী চার বছরের মধ্যেই হাঙ্গেরিতে কম্যুনিস্ট সরকারের পতন ঘটবে, এবং বিস্ময়করভাবে তা সত্যে পরিণত হয়। তাঁর দূরদৃষ্টির এই নির্ভুলতা সুধি সাহিত্যানুরাগীদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করে উপন্যাসটি। প্রকাশের দীর্ঘ তিরিশ বছর পরও যে স্যাটানটাঙ্গো গুরুত্ব হারায় নি তার প্রমাণ ২০১৫-তে বইটির আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার অর্জন। ক্রাস্নাহোরকাইয়ের দুটো সিগনেচার উপন্যাস স্যাটানটাঙ্গো ও দা মেলানকলি অব রেজিস্ট্যান্সকে যথাক্রমে ১৯৯৪ ও ২০০০ সালে চলচ্চিত্রে রূপায়িত করেন প্রখ্যাত হাঙ্গেরীয় চলচ্চিত্র পরিচালক বেলা তার। তারের বানানো স্যাটানটাঙ্গো ছবিটার ব্যাপ্তিকাল সুদীর্ঘ সাতটি ঘণ্টার, এবং এটাও একটা রেকর্ড বটে।
লাস্লো ক্রাস্নাহোরকাইকে অনেকে আগে তেমন না চিনলেও, নোবেল প্রাপ্তির সুবাদে এখন তো চিনেছেন। তাঁরা অনেকে হয়তো এখন তাঁর লেখা পড়তে চান, কিন্তু তাঁর সুবিপুল রচনা সম্ভার থেকে ঠিক কোন্ বইগুলো সর্বাগ্রে পড়বেন বা পড়া উচিত সেটা তাঁরা হয়তো বুঝতে পারছে না। তাঁদের কথা ভেবেই নোবেল কমিটি ক্রাস্নাহোরকাইয়ের অবশ্যপাঠ্য চারটি বইয়ের নাম সুপারিশ করেছে, যেগুলোর মধ্যে পূর্বোক্ত তিনটি বই ছাড়াও রয়েছে ‘সেইয়োবো দেয়ার বিলো’ (২০০৮)’র নাম।
১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির গিয়ুলায় জন্ম নেয়া ক্রাস্নাহোরকাই নোবেল পাওয়ার পর বলেছেন, “নোবেল পুরস্কার পেয়ে আমি আনন্দিত, কারণ এ পুরস্কার সর্বোপরি প্রমাণ করে যে, বিভিন্ন অসাহিত্যিক প্রত্যাশার বাইরে সাহিত্য এখনও তার নিজের মধ্যে টিকে আছে, এবং তা এখনও পড়া হয়। আর যাঁরা এটা পড়েন, তাঁদের কাছে এটা একটা নিশ্চিত আশা তুলে ধরে যে, সৌন্দর্য, মহত্ত্ব ও মহিমা তাদের নিজেদের স্বার্থেই এখনও টিকে আছে। যারা জীবনের ঝিলিক দেখেন নি বললেই চলে, এটা তাদেরকেও আশার ঝলক দেখাতে পারে।”
ক্রাস্নাহোরকাইকে ফ্রানৎস কাফকা আর টমাস বার্নহার্ডের যোগ্য উত্তরসুরী বলেও মনে করা হয়। এ দুুই মহান সাহিত্যিকের হাতে মধ্য ইউরোপীয় মহাকাব্যিক কথাসাহিত্যের ধারার লক্ষণীয় বিস্তার ঘটেছে, ক্রাস্নাহোরকাইও সে-ধারারই একজন বড় মাপের ধারক।
লাস্লো ক্রাস্নাহোরকায়ের অনেক লেখায়, বিশেষ করে দা মেলানকলি অব রেজিস্ট্যান্সে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির প্রতিচ্ছবি শিহরিত করে তোলার মতোই। তাঁর রচনাশৈলীর আপাতকঠিন খোসা ভাঙতে পারলেই, ভেতরের সারগর্ভ সারবস্তুসম্পন্ন শাঁস পাঠকের চেতনাকে অবশ্যই তৃপ্ত ও উদ্দীপিত করে তুলবে, এ কথা জোরগলায় বলা যেতে পারে।
জ্যোতির্ময় নন্দী, কবি ও অনুবাদক




