গৌতম কুমার রায়
আজ থেকে ১৪৫ বছর আগের কথা। ১৮৩৩ সালের ২০ জুলাই। কালের গর্ভে জন্ম নিলেন কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার। পিতা হলধর মজুমদার এবং মাতা কমলিনী দেবী। তাঁর জন্মের ১ বছরের সময় ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে মাতা এবং ৭ বছরের মাথায় ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে পিতা মারা যান। তখনকার পাবনা। পরে নদীয়া যা এখন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর কুণ্ডুপাড়ায়। ছোট বয়সে পিতা-মাতাহীন কাঙ্গালের জীবনের শুরুটা কঠিন এক দারিদ্রতা দিয়ে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে পন্ডিত লোলিত মোহন বিদ্যাতর্কালঙ্কার টোল ঘর হতে শুরু এবং এখানেই শেষ। এই অনাথ শিশুটি বড় হয়ে একদিন ঘুণেধরা সমাজের বহুত অনিয়মের সমাজ, শাসন ও শোষন, গোড়ামি, কুসংস্কারের অন্তরমূলে আঘাত দিয়েছিলেন। আর এই আঘাতের শাণিত তরবারি ছিল গ্রামবার্ত্তা নামে একটি প্রতিবাদমুখোর সংবাদপত্র। এই সংবাদপত্রটি প্রকাশিত হতো প্রথমে হাতে লেখে পরে কাঙ্গাল কুঠিরে স্থাপিত মথুরানাথ প্রেস বা এমএন প্রেস থেকে। সে সময়ে অজপাড়াগাঁয়ের এই প্রেস থেকে প্রতিবাদি এ পত্রিকা প্রকাশ ছিল দেশ-সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি অনাবিল আস্থার কাছে সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতার আদর্শগত এক আত্মনিবেদন হিসেবে।
ঔপনিবেশিদের শাসিত জীবনের জ্বালা ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে অনেকের আত্মোৎস্বর্গের পরে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। মাস্টারদা সূর্য সেন. প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ক্ষুদিরাম বসু,রফিক, জব্বার, সালাম, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বাঘা যতীনসহ মুক্তি পাগল মানুষ, যুগে যুগে আত্মাহুতি দিয়ে আমাদের স্বাধীকারকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছেন। অন্তরে লালিত সে স্বপ্নধারায় গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার। যিনি ১৮৮০ সালের মে সংখ্যায় তাঁর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় লেখনির মাধ্যমে স্বাধীনতার বীজকে অঙ্কুরোদগম করেছিলেন এই বলে যে সে সময়ের সমাজ, সাংবাদিকতা এবং শাসনের শাসনের পর্যায়কে রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়ের কথায় বলতে পারি,
‘‘স্বাধীনতা” হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়
দাসত্ব শৃংঙ্খল বল কে পড়িবে পায় হে, কে পরিবে পায়।’’
সমকালীন শাসন, শোষণ এবং সমাজ বদলের উত্তরণ পেতে কাঙ্গাল হরিনাথ যে স্বপ্ন দেখে ছিলেন তার সরূপ উদ্ভাসিত করে তার সৃষ্টিতঃ ‘‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’’ পত্রিকা। সাংবাদিক হিসেবে লেখালেখির শুরুটা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা দিয়ে। একদিকে সমকালিন শাসন, শোষণ এবং সমাজ বদলের উত্তরণ পেতে, অন্যদিকে এই একজন বিচারক হিসেবে, সমাজহিতৈষি হিসেবে, দলিত মানুষের অবলম্বন হিসেবে সাংবদিকতার আদর্শকে উপস্থাপন করেছেন হরিনাথ। বাংলা ১২৬০ সালের কথা। কাঙ্গাল হরিনাথ হাতে লেখে প্রকাশ করলেন তার দ্বি-মাসিক গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা। যদিও পরে তা মাসিক এবং সাপ্তাহিকও করা হয়েছিল। পাশাপাশি তিনি লিখতে লাগলেন সংবাদ প্রভাকরে। তিনি কলকাতার অন্য কয়েকটি পত্রিকার এজেন্টও ছিলেন। কঠিন এক চ্যালেঞ্জ মোকাবলার মতো হাতে লেখা পত্রিকা দিন দিন পাঠক সমাদৃত হতে থাকে। ইংরেজি ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাস। কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন যন্ত্র থেকে গ্রামবার্ত্তা প্রথম মুদ্রিত হলো ছাপা যন্ত্রে। কুমারখালী থেকে কলকাতা বিস্তর দূরত্বে পত্রিকা ছাপার বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে কাঙালকে। মনে ইচ্ছে স্বপ্ন বুনন করে তোলেন নিজে প্রেস দেবেন হরিনাথ। তিনি মনে মনে সংকল্প করলেন। শাস্ত্রমন্ত্র বলে ‘সদিচ্ছা ফলবতী হয়ই হয়।’ ইচ্ছে পূরণ হলো কাঙাল হরিনাথের। ১৮৭৩ সাল, মথুরানাথ মুদ্রণযন্ত্র নামে পূর্ব বাঙলায় অতিপ্রাচীন (বর্তমানে) এক ছাপাখানা বসলো কাঙাল কুঠিরে। বাংলা ১২৮০ সালের ১৭ শ্রাবণ। কলকাতার অমৃতবাজার পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল তাতে পরিবেশিত হলো এই এম এন প্রেস বসানোর আনন্দের সংবাদটি।
প্রেসস্থাপন করে সামাজিক, রাজনৈতিক অবক্ষয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের দু:খ, দূর্দশাকে সামনে তুলে আনতে সাংবাদিকতার মাধ্যমে সংবাদপত্রকে হাতিয়ার করেন কাঙাল হরিনাথ। এবারে কলকাতার কোনো প্রতিনিধি হিসেবে নয়, একটি পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে ঘুণে ধরা পোকাগুলোকে বের করে আনতে দরকার হলো প্রেসের। আর সময় নষ্ট করে কলকাতা নয়। নিজের পত্রিকা নিজের প্রেসে ছাপা গেলে খরচও বাঁচবে। ক’জন মানুষের কাজের গতি হবে এবং মন ও কলম খুলে লেখাও যাবে। কাঙাল হরিনাথ মজুমদার তার ‘দিনলিপি’ বা আত্মজীবনীতে,প্রেসের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লিখেছেন,‘ … রাজীবলোচন মজুমদার আমার অতিবৃদ্ধ প্র-পিতামহ সারগ্রাহী পরম বৈষ্ণব, কুঞ্জবিহারী মজুমদারের প্র-পৌত্র। রাজীবলোচন মজুমদার আমার ছাত্র কৃষ্ণ মৈত্রেয়র মুখে শুনিয়াছিলেন, একটি মুদ্রণযন্ত্র বা প্রেস হইলে কুমারখালীর সংবাদ পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ ইহা অপেক্ষা ভালভাবে চলিতে পারে এবং উক্ত প্রেস ধরিয়া আমাদিগের ন্যায় অন্যূন সাত/আটটি পরিবার অনায়াসে অন্নসংগ্রহ করিতে পারিবে। তিনি বৃন্দাবন গমনের সময় কলিকাতায় কয়েকদিন অবস্থান করিয়াছিলেন। সেই সময়‘ গ্রামবার্ত্তা’ প্রেস ক্রয় করিতে আমার নিমিত্ত ৬০০(ছয়) শত টাকা…. আমার খুড়া নবীন চন্দ্র সাহার নিকট রাখিয়া গিয়াছিলেন।…. ‘উক্ত প্রেস করিবার নিমিত্ত শ্রীবৃন্দাবনে পত্র লিখিয়া তাঁহার নিকট অনুমতি প্রার্থনা করিলাম। তদুত্তরে তিনি লিখিলেন, ‘উক্ত টাকা প্রেস কিনিবার নিমিত্ত আমি তোমাকে দান করিয়াছি। তুমি প্রেস স্থাপন করিয়া কৃষ্ণচন্দ্রের কথানুসারে যতজন নিরন্ন দু:খি পরিবার প্রতিপালন এবং ভাল রূপে গ্রামবার্ত্তার কার্য চালাইতে পারিবে, আমি তোমার প্রতি ততই সন্তুষ্ট হইব।’ আমি উক্ত টাকা পত্রানুসারে টাকার অধিকারী হইলে ‘মথুরানাথ যন্ত্র’ নামে এই বর্তমান প্রেসটি, তৎকালে বন্ধুগণ ক্রয় করিয়া পাঠান।….আমি প্রেস স্থাপন ও তাহা হইতে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশ এবং নিজ পরিবার ও প্রেসের কর্মচারী অন্য ৬/৭টি পরিবারের অন্ন সংগ্রহ করিয়া খুড়া রাজীবলোচন মজুমদারের আদেশ পালন করিতে লাগিলাম। …. পূর্বে কেবল গ্রামবার্ত্তার নিমিত্ত চিন্তা ছিল, এখন তৎসঙ্গে প্রেস চালাইবার চিন্তা উপস্থিত হইল।…. এ সমসময় প্রেসের ব্যবসা করে অনেকেই লাভবান হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ ঈশ্বরচন্দ্রকে বলা যায়।
নেপথ্য কথা : কাঙালের বাড়ির আঙিনায় এক ছাপড়া ঘরে প্রেস বসান হলো। অভিষেক হলো ফুল-চন্দন-সিঁদুর দিয়ে। কথা লেখার এক আজব যন্ত্রটা দেখার জন্য ভিড় বাড়তেই লাগল। খোদ রাজার দেশের যন্ত্র। ভাব ও ভক্তিতে অনেকে হাটু গেড়ে প্রণামও করতে কুন্ঠিত হলো না। ডবল ক্রাউন সাইজের বিশাল মেশিন। ওজন আনুমানিক ৩৫ মন। দেখতে মানুষরূপী এক দানবের মতো। মেশিন চালু হলে দেখা যাবে মাথার উপরে ডানা প্রসারিত করে এক ঈগল পাখি উড়ে যাচ্ছে। আবার পাখিটি উড়ে এসে যথাস্থানে বসে পড়ছে পেছনে থাকা এক পরিটা উড়াল দিলেও পাখিটাকে ধরতে পারছে না। মেশিনের দু অংশে গম্বুজের গায়ে এক জোড়া হুরপরী আপন ভাবণায় দাড়িয়ে রয়েছে। অক্টোপাশে তাদেরকে ধরে রেখেছে হাঙ্গর মাছ। পরিরা চোখ টিপ্পনি দিয়ে তাদেরকে মুক্ত করতে ইশারা দেবে। কিন্তু আপনি একজন বীর পুরুষ হলেও তাদেরকে মুক্ত করতে পারবেন না। এই মেশিন চালিয়ে কাগজ বের করতে ৩ জন মানুষের প্রয়োজন হয়। ১ জন ইন্কম্যান, পেপার ইন ও আউটে ১ জন, ড্রাইভ ম্যান ১ জন। মেশিনের চার পায়ের থাবাটা আরো ভয়ঙ্কর। যেন তা আঁত্কে উঠার মতো এক সিংহের থাবা। মেশিনের বুকের মাঝখানে ডিম্বাকার চাত্কি আছে। তা স্বর্ণের রং এ জ্বল জ্বল করে এখানে ইরেজির বিভিন্ন লেটারে লেখা আছে, ঈড়ষঁসনরধহ চৎবভং, ঘড় ১৭০৬, ঊউডঅজউ ইঊ ঠঅঘ, খঅঞঊ: ঈষুসবৎ উওঢঙঘ ্ ঈঙ, ঙজএওঘঅখচঅঞঊঘঞঊঊঝ ্ গধহঁভধপঃঁৎবৎং ১০ ঋওঘঝইটজণ ঝঞ ১৮৬৭ খঙঘউঙঘ.
মেশিনটি যে ভাবে চলে : সেই সময়ের এই মেশিনটির কার্যক্রম দেখতে বেশ লাগে। মেশিনের পেটের ভেতর থেকে এক জোড়া রেল বেরিয়ে এসেছে। রেলের উপর একটা ফ্লাড। ফ্লাডের উপর মেটার বা ডায়িস আটা হয়। ফ্লাডের সাথে চপ্। এখানে কাগজ দিতে হয়। চপের সাথে ফ্রেস কার্ড বা ঝাপ। যা কাগজকে ধরে রাখে। তিন জন মানুষের মধ্যে প্রথম ধাপে মেটারে এক জন টাইপের মাথায় কালি লাগিয়ে দিচ্ছে। দ্বিতীয় ধাপে এক জন কাগজ দিচ্ছে ও নিচ্ছে। মেশিনম্যান তৃতীয় ধাপের ঝাপটা দ্বিতীয ধাপে এনে, তৃতীয় ও দ্বিতীয ধাপকে একসাথে প্রথম ধাপে শুইয়ে দিয়ে, মেশিনটাকে ড্রাইভ করে ফ্লাডসহ মেশিনের পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে এবং তা সোজা রেল ধরে। কাগজে প্রেশার দিতে হ্যান্ডেলে টান মারলে হাঙ্গর মাছটা ফ্লাডের উপরে তার লেজের চাপ রেখে হা করে, ডানা প্রসারিত ঈগল পাখিকে গিলে খেতে যায়। ধরি ধরি অবস্থায় ঈগলটা উড়াল দিলেই, কাগজে ছাপ লেগে পড়ে। মেশিন চালক হ্যান্ডেল ছেড়ে ফ্লাডকে উল্টো পাকে ফিরিয়ে এনে সবাইকে যথাস্থানে ফিরিয়ে দিচ্ছে। ছাপার কাজটা এভাবেই চলতে থাকে। সারাদিনে এভাবে তিন জন মানুষের পরিশ্রমে ১০০০ কাগজে ছাপ দেয়া সম্ভব হয়েছে। এই মেশিনে সমমানের ওজনের ছোট ছোট বুশ ও স্যাপ্ট দিয়ে তৈরি, কোনো বল বিয়ারিং, ¯িপ্রং, পিনিয়াম নেই। লাইন ধরে সব চললেও তবে কোন চাকা নেই। তবে মেশিন চালাতে কোনো কষ্ট না হলেও কাগজগুলোকে ৭-৮ ঘন্টা জলে ভিজিয়ে নরম করতে হয়। এত আগে সংবাদপত্রের এই ্আধুনিক ছোঁয়া ভারতের অন্য কোনো জেলাতে না লাগলেও কাঙাল হরিনাথ অজ এক পাড়া আকূল্য শহর কুমারখালীতে স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মহামতি এই কালপুরুষের দিব্যজ্যোতি অস্তমিত হয়েছিল ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল।
ফিরে দেখা : ইংরেজি ১৮৫৭ সাল। ভারতীয় ইংরেজ রাজের বিরুদ্ধে সিপাহী সৈন্যরা অস্ত্র ধারণ করে। যা সিপাহী বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহের সময়ে প্রচলিত আছে, কলকাতার কাছে গভীর জঙ্গলে রেখে, এই মেশিনটিকে বিদ্রোহীদের গোপন পোস্টার, হ্যান্ডবিল, প্রচার পত্র, পুস্তিকা ছাপার কাজে ব্যবহার করা হতো। পুলিশ এই মেশিনটা উদ্ধার করে। পরে সরকার মেশিনটাকে নিলাম ডাকের মাধ্যমে বিক্রি করে দিলে, এটাকে কাঙালের শিষ্য অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র পিতা মথুরানাথ মৈত্রের সহযোগিতায় কেনা সম্ভব হয়েছিল। যে জন্য কৃতজ্ঞতার আবদ্ধে কাঙাল এই মুদ্রণ যন্ত্রের নাম মথুরানাথের নামে রাখেন। তবুও]লোকমুখে এটি ‘কাঙাল প্রেস’ নামে পরিচিতি পেতে থাকে। এই প্রেস স্থাপনের পর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা (১৮৬৩) যেমন এখান থেকে ছাপা হত। আবার মীর মশাররফ হোসেনের প্রতিষ্ঠিত, হরিনাথ মজুমদারের আশীর্বাদপুষ্ট ও সতীশ চন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত ‘হিতকরী’ (১৮৯০) পত্রিকা এবং পাংশার রওশন আলী চৌধুরীর কোহিনুর (১৮৯৮) , দিনাজপুরের ‘বঙ্গীয় তিলি সমাজ পত্রিকা’ (?), সিরাজগঞ্জের এম নাজির উদ্দিনের ‘সোলতান’(১৯০০), শিব চন্দ্র বিদ্যার্ণবের ‘শৈবী’ (বাংলা ১৩০৩) এই ছাপা যন্ত্র থেকে ছাপা হয়েছে। এই প্রেসের কাজ ছিল তুলনামূলক কম খরচে এবং বেশ নিখুঁত মানের। কাঙালের হতে প্রেসের কাজের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পরে দ্রুত। বাংলা ১৩০৭ সালের চিঠির নকল খাতার সূত্রে জানা যায় রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, পাবনা এবং পশ্চিম বাংলার জলপাইগুড়ি, বর্ধমান থেকে অনেক ছাপার কাজের অর্ডার এসেছিল এই ছাপাখানায়।
কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ছিলেন একজন সজ্জন মানুষ এবং মানব দরদি ব্যক্তি। তাঁর পত্রিকায় লেখা হতো নিরীহ দুর্বল মানুষের কথা। তাদের দু:খ দূর্দশা, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা। তাঁর কথায়, গ্রাহকেরা ঠিকমত চাঁদা দিচ্ছেন না। হিতকাঙ্ক্ষী বিত্তশালীগণ প্রতিশ্রুত মূলধন দিতে কার্পণ্য করেছে। এজেন্টগণ পত্রিকা বিক্রি অন্তে টাকা পয়সা পাঠাননি। পাওনা আদায়ে অনেকে আদালতের দ্বারস্থ হতে পরামর্শ দিয়েছেন কাঙালকে। মানব দরদি হরিনাথ ভদ্রতা রক্ষা করতে তা করেননি। অবশেষে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার জ্যেষ্ঠপুত্র সতীশ চন্দ্র মজুমদার এবং ছাত্র প্রসন্ন কুমার বন্দ্যোপধ্যায়ের ওপর প্রেস ও পত্রিকা পরিচালনার দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন। এক্ষেত্রে প্রেসের ব্যবসার উন্নয়ন হলো পত্রিকার বিষয় তেমন হলো না।
মুদ্রণ শিল্পের যুগাবির্ভাবের সময়ে এমএন প্রেস এক অনন্য সৃষ্টি। শ্রদ্ধেয় মুর্তাজা আলীর কথায়, অনুমেয় ১৮৫৯ সালে স্থাপিত পূর্ব বাংলার প্রথম ছাপাখানা ঢাকার বাঙ্গালা মুদ্রণ যন্ত্র। পরের বছর ১৮৬০ সালে এই ছাপাখানায় ছাপা হয় দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ নাটক। তবে আর যা-ই হোকনা কেন, কালের প্রবাহে এমএন প্রেসটি আজ সচল না থাকলেও এক ইতিহাসের স্মারক সাক্ষীর সীলমোহর হয়ে, আজকের সংবাদপত্র এবং দেশের সাংবাদিকতার অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়ে
আছে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের পরে পেশাগত আদর্শ চ্যুত্যির মাঝে আজ সাংবাদিকতার মতো এক মহান পেশা যে, অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না। কলম ও কালির আচরিক শক্তি যে, সমাজ বদলের হাতিয়ার। ধর্মান্ধতা আর মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংবাদপত্র যে, মানবিকাতার লড়াই করে। তা আগেই দেখিয়ে গেছেন এক সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, তাঁর সংবাদপত্র গ্রামবার্ত্তা এবং তার সৃষ্টিত: শিল্প মথুরানাথ প্রেস।
গৌতম কুমার রায় : গবেষক, উদ্ভাবক ও পরিবেশবিজ্ঞানী।




