এখন সময়:সকাল ৯:২৬- আজ: বৃহস্পতিবার-৩০শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৪ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:সকাল ৯:২৬- আজ: বৃহস্পতিবার
৩০শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১৪ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন

 

রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু!

মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে কেন বোঝে না এই সকালবেলা ওর খেতে ভালো লাগে না প্রতিদিন এক যুদ্ধ! ও খেতে চাইবে না,আর মা না খেয়ে ওকে যেতে দেবে না। ওদিকে ট্রেন মিস করলে ভার্সিটি যাওয়া আরেক ঝামেলা। তবুুও মায়ের মন রাখতে সে মায়ের কাছে এসে হা করে। মা ভাত মাখিয়ে ওর মুখে ঢুকিয়ে দেয়। পাঁচ মিনিটের মধ্যে নাকে মুখে গিলে ও বেরিয়ে পড়ে। রেল স্টেশনে সে হেঁটেই যায়। উত্তর নালাপাড়া থেকে দশ মিনিটের পথ। পাভেল এতক্ষণে নিশ্চয় টেনশনে পড়ে গেছে। আজকে একটা ঝাড়ি খেতেই হবে। প্রতিদিনই খুব সকালে এসে সে শাটলে রুবার জন্য জায়গা রাখে। এটা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। একটা দিনও রুবা আগে আসতে পারে না। ওই যে মা, মায়ের জন্যই তো প্রতিদিন দেরি হয়। না খেয়ে মা কিছুতেই ঘর থেকে বেরুতে দেবে না। মনে মনে গজগজ করতে করতে সে প্ল্যাটফরমে এসে হাজির হয়। দূর থেকে পাভেল হাত নাড়ছে। সেও হাত নাড়ে।

কাছে পৌঁছাতেই পাভেল মিষ্টি হেসে বলে,

-আজকেও লেট? একদিনও কি তুমি ঠিক সময়ে আসবে না?

রুবা হেসে দেয়। ওই হাসিতে মিশে আছে দুঃখ প্রকাশ। ওই ভাষা বোঝে পাভেল। যাক বাবা,ঝাড়ির বদলে মিষ্টি হাসি

 

 

 

উপহার পেলো,মনে মনে ভাবে রুবা। এইজন্যই ছেলেটাকে এতো ভালো লাগে তার। খুব বুঝদার ও ধৈর্যশীল। শাটল বাঁশি বাজিয়ে আস্তে করে টান দিয়েছে। ওরা দুজন দ্রুত কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়ে। পাভেলের রাখা সিটে দুজন পাশাপাশি বসে। রুবা ভাবে,এইভাবে সবসময় তুমি আমাকে আগলে রাখবে তো পাভেল? পাভেল যেন অন্তর দিয়ে সে কথা শুনতে পায়। মনে মনে সেও বলে, আমি থাকতে তোমাকে কিছুটি নিয়ে ভাবতে হবে না রুবা। তোমার সব দায়িত্ব আমার। ওরা দুজন গল্পে মেতে ওঠে। আশেপাশের সতীর্থরা গানে মেতে আছে। ওদের দিকে চোখ পড়লেও ওদেরকে নিয়ে ভাবার সময় নেই। বাইরে থেকে দেখে ওদেরকে প্রেমিক জুটি মনে হলেও আসলে ওদের মধ্যে এখনো প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। দুজন একসাথেই পড়ে। ওদের সাবজেক্ট অর্থনীতি। ডিপার্টমেন্টেও সবাই ভাবে ওদের মধ্যে কিছু একটা আছে। রুবা ভাবে,আসলেই কি ওদের মধ্যে কিছু একটা নেই? যদি নাই থাকে তাহলে প্রতিদিন পাভেল ভোরে এসে শাটলে ওর জন্য সিট রাখে কেন? আর রুবাই বা আর কোথাও না বসে পাভেলের কাছে চলে আসে কেন? মুখে হয়তো ওরা কেউ কাউকে ‘ভালোবাসি’ কথাটি বলেনি,কিন্তু ওরা দুজনেই জানে ওরা পরস্পরকে গভীরভাবে ভালোবাসে। তাই ওরা পরস্পরের সান্নিধ্য উপভোগ করে। গল্পে গল্পে সময় কেটে যায়।

 

ট্রেন থেকে নেমে পাভেল বলে,

-চলো, চা সিঙারা খাই।

রুবা বলে,

-শুধু চা খাবো আমি। মা ভাত খাইয়ে দিয়েছে।

হো হো করে হাসে পাভেল,বলে,

-এখনো মা ভাত খাইয়ে দেয়? তারপর ফিসফিস করে নিজের মনেই বলে,

-আমি কিন্তু এসব করতে পারবো না।

রুবা ভ্রু কুঁচকে বলে,

-তুমি কী করতে পারবে না?

পাভেল হো হো করে হাসে। কিছু বলে না। রুবা মেয়েটাকে তার এতো ভালো লাগে,ইচ্ছে করে সারাদিন তার সাথে আঠার মতো লেগে থাকতে। একটি মুহূর্তের জন্য চোখের আড়ালে রাখতে ভয় লাগে। মনে হয়, এই বুঝি হারিয়ে গেলো! কিন্তু এখনো পর্যন্ত সাহসে কুলোয়নি ওকে ভালোবাসার কথা জানাতে। ভয় হয়,যদি মেয়েটি ফিরিয়ে দেয়। একবার মনে হয় রুবাও হয়তো ওকে সমান ভালোবাসে। আবার মনে হয়,না,ও হয়তো তাকে স্রেফ বন্ধুই ভাবে। তার চেয়ে এই ভালো,প্রিয় মানুষটিকে তো অন্তত সারাদিন কাছেই পাচ্ছে। বেশি বাড়াবাড়ি করতে গেলে হয়তো একেবারেই হারাতে হবে। এটা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না।

 

ঝুপড়ি দোকানে চা সিঙারা খেয়ে ওরা ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। কিন্তু আজ ক্লাসে কিছুতেই মন বসছে না রুবার। বার বার মন ছুটে যাচ্ছে পাভেলের দিকে। পাশের সারিতে থার্ড বেঞ্চে বসে আছে ও। খুব মন দিয়ে স্যারের লেকচার শুনছে। নোটও করছে খাতায়। ইশ! রুবার অস্তিত্ব যেন সে ভুলেই গেছে। কী যে ভালো লাগছে ওকে দেখতে! ইচ্ছে করছে ওর পাশে গিয়ে বসতে। ওর ঘন উসকোখুসকো চুলগুলোতে হাত বুলোতে। আচ্ছা, পাভেল কি বোঝে রুবা যে ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে! যদি বোঝে তাহলে ও কেন ভালোবাসার কথা বলে না? রুবা মেয়ে হয়ে কী করে মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা আগে বলবে?  পাভেল একবার বললেই তো ও রাজি হয়ে যেতো। আর কতদিন সে অপেক্ষা করবে পাভেলের মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটি শুনতে? কথায় বলে কেউ নাকি কারো দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে যার দিকে তাকিয়ে আছে সে টের পায়। কথাটি হয়তো সত্য। হঠাৎ পাভেল ঘাড় ফিরিয়ে রুবার দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়তে রুবা হেসে দেয়। কিন্তু রুবার তো জানা ছিল না স্যার অনেকক্ষণ যাবৎ তাকে লক্ষ্য করছিলেন। তাই হাসার সাথে সাথেই স্যার ধমকে ওঠেন,

-এই মেয়ে,এই,তুমি ওভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছো কেন? সমস্যা কী তোমার?

লজ্জায় রুবার মরে যেতে ইচ্ছে করে। ছি ছি, পুরো ক্লাসের জোড়া জোড়া চোখ এখন ওর দিকে। পাভেল কী করছে কে জানে। রুবা মাথা নিচু করে মুখ লাল করে বসে থাকে। স্যার আর কথা বাড়ান না। রুবার আর সাহস হয় না আড়চোখে পাভেলকে দেখতে। তারপর কী আর করা! স্যারের একঘেঁয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর লেকচার শুনে যেতেই হয়। একসময় ক্লাস শেষ হয়। সবাই হৈ হৈ করে বেরিয়ে যায়। পাভেল এগিয়ে আসে রুবার কাছে,বলে,

-খুব ধরা পড়লে স্যারের কাছে,তাই না?

রুবা লজ্জায় তাকাতে পারে না পাভেলের দিকে। ওকে সহজ করতে প্রসঙ্গ পাল্টায় পাভেল। বলে,

-চলো,চা খেয়ে আসি।

এ মুহূর্তে পাভেলের চোখ যেন স্বচ্ছ আয়না। ও চোখে চোখ রাখলেই রুবার গোপন প্রেম এক নিমিষে ধরা পড়ে যাবে। তাই লজ্জায় লাল হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রুবা বলে,

-চলো।

 

চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে পাভেল বলে,

-আজকে আর ক্লাস করবো না। পাশের গ্রামে আমার ফুফুর বাড়ি। ব্ািড়টা পুরানো আমলের, খুবই সুন্দর।  চলো,তোমাকে দেখিয়ে আনি।

রুবা একটু ইতস্তত করে হালকা স্বরে বলে,

-আর কেউ যাবে না?

পাভেল বলে,

-ইতি আর রানাকে নেওয়া যায়। চলো,ওদেরকে বলি।

ওরা চায়ের বিল দিয়ে আবার ডিপার্টমেন্টে আসে। ইতি আর রানাকে বললে ওরা এক কথায় রাজি হয়ে যায়। তারপর চারজন ব্যাটারি রিক্সা নিয়ে রওয়ানা দেয় পাশের গ্রামের উদ্দেশ্যে। ওই গ্রামে ঢুকে অবশ্য রিক্সা ছেড়ে দিতে হয়। ভাঙা ইটের রাস্তা। যে কোনো মুহূর্তে এ রিক্সা উল্টে যাবে। তার চেয়ে পায়ে হাঁটাই নিরাপদ। ওরা চারজন হাঁটতে থাকে। রাস্তার দুপাশে বড় বড় গাছ,তাই ছায়া আর বাতাসে রাস্তাটা শীতল হয়ে আছে। ইতি গান ধরেু গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ। রুবাও গলা মেলায়। আজকের দিনটা কখনো ভোলা যাবে না-মনে মনে ভাবে রুবা। ভাগ্যিস পাভেলের একটা ফুফুর এই গ্রামে বিয়ে হয়েছিল। নাহলে তো এখানে আসাই হতো না। কী যে ভালো লাগছে তার। এমন একটা জীবনই সে চেয়েছিল। যখন ইচ্ছে বের হয়ে যাবে,যেমন ইচ্ছে তেমন করে নিজেকে ভালো রাখবে,এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়ার নেই ওর। দামি বাড়ি, দামি গাড়ি এসবে তার কখনোই লোভ নেই। সে শুধু চায় নিজের মতো করে জীবনকে যাপন করতে। পাভেল তার ইচ্ছেগুলো পূরণ করছে। তাই ওকে এতো ভালো লাগে।  হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ওদেরকে থামতে হয়। পাশেই একটা প্রাইমারি স্কুল। সেই স্কুল মাঠে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রীরা জাতীয়সংগীত গাইছে। এত মিষ্টি করে ওরা প্রাণ খুলে গাইছে ওদের থমকে যেতে হয়। ওরা গাইছেু “ কী শোভা কী ছায়া গো,কী স্নেহ কী মায়া গো,কী আঁচল বিছায়েছো বটের মূলে,নদীর কূলে কূলে.”। ইতি আর রুবাও ওদের সাথে গলা মেলায়। রানা বুকে হাত দিয়ে গানের সুরে সুরে ঠোঁট নাড়ে। ওদের কাণ্ড দেখে ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়ে যায় পাভেলের। কী একটা গান! সেই গানকেও আবার এত ভক্তি দেখাতে হয়!  ওদের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে,

-এসব কী ন্যাকামি শুরু করলে তোমরা?

ওরা কেউ কথা বলে না। ওরা জানে জাতীয় সংগীত চলাকালে গলা না মেলালেও নীরব থাকতে হয়। ওদের নীরবতা অসহ্য লাগে পাভেলের। চরম বিরক্তির স্বরে বলে,

-আশ্চর্য! তোমরা এ গানটাকে এত ভক্তি দেখাচ্ছো কেন? এটা জাতীয় সংগীত হওয়ার মতো গান?

বিনা মেঘে যেন বজ্রপাত হয় রুবার কানে। সে কি ঠিক শুনছে? পাভেল বলছে এ কথা? তার কান ঝাঁ ঝাঁ করে। ঠিক তখনই জাতীয় সংগীত শেষ হয়। রুবা শীতল চোখে ভ্রু কুঁচকে পাভেলের দিকে তাকায়,বলে,

-কী বললে তুমি? জাতীয় সংগীত নিয়ে তুমি যেন কী বললে!

পাভেল দৃঢ় স্বরে বলে,

-কী বলবো? যা সত্যি, তাই বলেছি। এ গান তো আমরা জাতীয় সংগীত হিসেবে মানি না। এখানে বাংলাদেশের কথা নেই। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের গান কেন আমাদের জাতীয় সংগীত হবে? উনি তো ভারতের কবি। আমরা এটা মানি না।

 

রুবা কিছু বলার আগে ইতি বলে,

-কই,এতদিন তো এমন কথা বলোনি!

পাভেল রাগতস্বরে বলে,

– এতদিন বলার মতো পরিবেশ ছিল না,তাই বলিনি। কিন্তু এখন সময় এসেছে এ গান পাল্টানোর।

রুবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে পাভেলের দিকে। পাভেলকে কেমন অচেনা মনে হয়। ওর চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে। চোয়াল কেমন টান টান হয়ে আছে। এ কোন পাভেল? ওরা এটা মানে না মানে! ওরা কারা? স্বরকে নিচু অথচ দৃঢ় করে রুবা বলে,

-তোমরা মানো না মানে? তোমরা কারা?

পাভেল উচ্চ স্বরে বলে,

-আমরা নতুন প্রজন্ম।

রুবা অবাক হয়ে বলে,

-তাহলে আমরা কারা? আমরাও তো নতুন প্রজন্ম। আমরা তো আমাদের জাতীয় সংগীতকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসি। তিরিশ লক্ষ শহিদ,আর তিন লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা এটা পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা এ গান গেয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আজ এত বছর পর এসে তোমরা কেন এর বিরোধিতা করছো?

পাভেল চোয়াল আরও দৃঢ় করে কাটা কাটা স্বরে বলে,

-তোমাদের ওই এক প্রবলেম! কিছু বললেই মুক্তিযুদ্ধ।  আরে মুক্তিযুদ্ধ চটকিয়ে আর কতদিন চলবে? তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধটা সঠিক ছিল কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন।

ইতি অবাক স্বরে বলে,

-এই পাভেল,তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এসব কী বলছো?

রানা পাভেলের পিঠে হাত রাখে,বলে,

-দোস্ত,এসব কী বলছিস তুই? মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। আমাদের জিতে যাওয়ার গল্প। পাকিস্তানিদের দর্প চূর্ণ হওয়ার ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বললে কি এটাকে চটকানো বলে? তোর কী হয়েছে বল তো।

রুবা কিছু বলতে পারে না। তার গলা খুব ব্যথা করছে। বুকের গহিন থেকে এক থাল কষ্ট এসে যেন গলাটা চেপে ধরেছে। ওর পাভেল,ও যার জন্য উন্মাতাল সেই পাভেল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন করে বলছে! অথচ রুবার শরীরে মুক্তিযোদ্ধার রক্ত। ওর নানা মুক্তিযোদ্ধা আজগর আলীকে বীভৎসভাবে কুপিয়ে মেরেছিল রাজাকার নামক হায়েনারা। ওর মা তখন এক বছরের শিশু। মায়ের মুখে সারাক্ষণ নরঘাতকদের গল্প শুনতে শুনতে সে বড় হয়েছে। মায়ের মুখে সে শুনেছে রাজাকারদের বংশধররা নাকি মুক্তিযুদ্ধকে ভুল মনে করে। তবে কি পাভেল সেই গোত্রের?  এটা কী করে সম্ভব? এতদিন ধরে ওর সাথে বন্ধুত্ব, কখনো তো বোঝা যায়নি ওর মনমানসিকতা এমন! পাভেল আরও কীসব বলছে। ওর কানে কিচ্ছু ঢুকছে না। শুধু মনে হচ্ছে ও সব ভুল শুনেছে এতক্ষণ। হঠাৎ পাভেল ওর দুকাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দেয়। বলে,

-এই রুবা,কী হয়েছে তোমার?

রুবা যেন বাস্তবে ফিরে আসে। সে পাভেলের দিকে তাকিয়ে বলে,

-তুমি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করতে চাও? জাতীয় সংগীত না মানা মানে তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অস্বীকার করা।

পাভেল দৃঢ়তার সাথে বলে,

-ওসব পুরানো ইতিহাস। আমরা এখন নতুনভাবে দেশ নিয়ে ভাববো। আমাদের নতুন পতাকা হবে, নতুন জাতীয় সংগীত হবে। প্রয়োজনে দেশের নামটাও আমরা নতুন করে রাখবো।

রানা চিৎকার করে বলে,

-থাম তো,তোর মাথা আসলে বিগড়ে গেছে। এতদিন আমাদের বন্ধুত্ব। কই আগে তো কখনো এসব কথা বলিসনি। আজ এসব ফালতু কথা কেন বলছিস?

ইতিও মাথা নেড়ে সায় দেয় রানাকে। তারপর বলে,

চল চল, খিদে পেয়ে গেছে। এসব কথা থাক।

পাভেল বলে,

-হ্যাঁ,চল। ওই তো, আমার ফুফুর বাড়ি দেখা যাচ্ছে।

বলে গাছপালা ঘেরা একটা বাড়ির দিকে হাত তোলে। কিন্তু না,রুবা তো ওদের সাথে যাবে না। তার নানার রক্তে স্নাত এ বাংলাদেশ।  সেই বাংলাদেশের জন্মলগ্ন নিয়ে যার এত সন্দেহ, প্রাণপ্রিয় জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি যার এত বিদ্বেষ, তার সাথে সমঝোতা করে চলা রুবার পক্ষে অসম্ভব। হ্যাঁ,এই ছেলেটাকে সে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতো,কিন্তু এ মুহূর্তে তা মূল্যহীন। তিরিশ লাখ শহিদ এবং তিন লাখ মা বোনের আত্মদানকে যারা প্রশ্নের সম্মুখীন করে তাদের সাথে আপোষ করে চলা অন্তত রুবার পক্ষে সম্ভব নয়। সে উল্টোদিকে ঘুরে কঠিন স্বরে বলে,

-আমি কোথাও যাবো না রে। আমি ফিরে যাচ্ছি। তোরা যা।

পাভেল এক ঝটকায় ওর সামনে এসে বলে,

-তুমি কি পাগল হয়েছো? আমি তোমাকে একা ফিরতে দেবো? এসব প্রসঙ্গ থাক। আমাদের মধ্যে রাজনীতি আসবে কেন? এসব নিয়ে আর কখনো কথা বলবো না। এখন চলো আমাদের সাথে।

 

রুবা শূন্যদৃষ্টিতে পাভেলের দিকে তাকায়। বড্ড অচেনা লাগে ওকে। এই ছেলেটা ছিল তার হৃৎস্পন্দন। আজ সকালেও মনে হয়েছিল ওকে ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। সকালে কেন,কিছুক্ষণ আগেও তো তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ও অনেক দূরের কেউ। ভাগ্যিস ও আজ এখানে এসেছিল,নাহলে তো জানাই যেতো না ওর গোত্রপরিচয়। ওর কাছ থেকে অনেক দূরে সরে যেতে হবে। ফিরে যেতে হবে ‘৭১ এর কাছে। নাহলে ওর নানার রক্তের সাথে বেঈমানি করা হবে। তিরিশ লাখ শহিদ ও তিন লাখ মা বোনের অভিশাপে জর্জরিত হতে রুবা চায় না। সে হাত জোড় করে পাভেলকে বলে,

-প্লিজ,আমার ওপর জোর করো না। আমাকে যেতে দাও। এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমাকে আটকাতে এসো না।

বলে সে দ্রুত পায়ে সামনে এগোয়। ওর বলার মধ্যে এমন কিছু ছিল পাভেল থমকে যায়,একটু পিছু সরে ওর পথ ছেড়ে দেয়। ইতি আর রানাও রুবার পিছু নেয়। দুহাত মাথার পেছনে নিয়ে, মাথাটাকে সেই হাতের ওপর ঠেস দিয়ে ওদের ফিরে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে পাভেল।

 

 

বিচিত্রা সেন, কথাসাহিত্যিক

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাহিত্য-গবেষণার আলোকবর্তিকা

শাহেদ কায়েস   আহমদ রফিক (জন্ম: ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-মৃত্যু: ২ অক্টোবর ২০২৫) বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুবনে আহমদ রফিক একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে

অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

আন্দরকিল্লা ডেক্স \ চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের আত্মজীবনী ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

ফেরা

সৈয়দা মাসুদা বনি   নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন   রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু! মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে

চিরহরিৎ বৃক্ষের গল্প

সুজন বড়ুয়া   ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়।