আরিফ চৌধুরী
মানব মনের দুর্মর এক অনুভূতির নাম প্রেম। মানবিক চেতনায় নর নারীর প্রেম ও আকাঙ্ক্ষার ইপ্সিত চেতনা জাগরুক থাকলেও প্রেমের সঙ্গে মন ও সৌন্দর্যবোধের সম্পর্ক কাল থেকে কালে মনোজগতে পরিক্রমায় ভিন্ন পরিবেশগত রুপান্তরে অন্তহীন প্রকাশ ঘটে নিত্য। যা মানুষের বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। মানুষের জীবনধারণ ও জীবনযাপনের নানান বেদনাবোধ বাক প্রতিমায় কবিকে অনুপ্রাণিত করে তোলে। প্রেমের ব্যাকুলতা, উন্মাদনা, মিলন, বিরহ,তার সম্ভোগ, শঙ্কা, প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যে ও কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা কবিতায় প্রেম ও প্রেমের অনুভূতিকে কবি নিজের মধ্যে অজান্তে মগ্ন হয়ে ওঠেন বিশেষত নর-নারীর তীব্র ও গভীর প্রেম ও আকাঙ্খার গভীরতায়।তবুও প্রেমানুভূতির গভীর ও ব্যাপ্ত প্রেমের সীমাবদ্ধতা থেকে কবিতাকে মুক্ত করে অনুভূতির তাড়নায় সর্বজনীন করে তুলতে পারেন। বাংলা কবিতায় মধূসুদন দত্ত থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের পথ ধরে প্রেম তার বৈচিত্র্যময় প্রকাশ নিয়ে ধরা দিয়েছে। রবীন্দ্র কাব্যে প্রেমের বহুবিধ প্রকাশ পাঠককে রীতিমত অবাক করে তুলে। তাই নতুনত্বের প্রকাশে আধুনিক চেতনা ও বাস্তবতার নিরিখে প্রেমের কবিতাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নতুনত্বের ছোঁয়ায় কবিরা ব্যাক্তিক যন্ত্রণা ও যুগ যন্ত্রণাকে কাটিয়ে মানুষের মনের উপজীব্য করে তোলেন বলেই প্রেমের কবিতা বাংলা সাহিত্যে সার্বজনীনবোধ ও ভিন্নতা অর্জন করেছে। মানুষ নিজেকে খুঁজে পেতে, নিজেকে বিলিয়ে দিতে, নতুন করে বুঝতে নিজের আকাঙ্ক্ষা ও আর্কষণের পূর্ণতায়।
সমকালে প্রেমের কবিতা রচিত হয়েছে সময়ের কবিদের হাত ধরে। যদিও প্রেমের কবিতার বিষয় ও প্রকাশভঙ্গিতে ভিন্নতা পরিবর্তন যুগে যুগে নতুন যোজনায় মানুষের অনুভূতিকে নাড়া দিয়ে গেছে। তিরিশের কবি অমিয় চক্রবর্তী উচ্চারণ করেছেন অকপটে প্রেমের অমিয় বাণী:
যেমন:
আমি যেন বলি, আর তুমি যেনো শোন
জীবনে জীবনে তার শেষ নেই কোনো।
দিনের কাহিনী কত, রাত চন্দ্রাবলী
মেঘ হয়, আলো হয়, কথা যাই বলি।
চিরন্তন অভিব্যাক্তিতে প্রেম, প্রেমানুভূতির প্রকাশ যেনো আবরণ ছেড়ে জীবনে জীবনে জীবনে নতুন হয়ে দেখা দেয়। প্রেমের চিরকালের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে যুগে যুগে কবিরা নিজস্ব চেতনায় ধারণ করে প্রেমের সৌন্দর্যবোধে প্রেমের কবিতাকে করেছেন চিরকালীন।
আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা, রাজনৈতিক সংকট,সামাজিক মূল্যবোধ, ও চেতনা প্রবাহের ধারক কবি শামসুর রাহমান। কবিতায় জাতীয় আন্দোলন, সংগ্রাম, নাগরিক জীবনের টানাপোড়েন, বেদনাবোধ ছাড়াও সমাজ সচেতন কবিমছিলেন শামসুর রাহমান। তবুও সব চেতনাকে ছাপিয়ে শামসুর রাহমান একজন রোমান্টিক কবি ছিলেন।তার কবিতায় নারী প্রেম, বেদনাবোধ, রোমান্টিকতার শব্দমালা নিয়ে তিনি সত্য, সুন্দর, মঙ্গলময় কল্যাণকর মানবিক দুঃসময়ের বেদনাবোধকে ধারণ করেছেন প্রেমের কবিতায়। নর- নারীর রোমান্টিক আবহের স্নিগ্ধতায় গীতল কথা ও ছন্দের ধারায় তার কবিতায় এমন কিছু উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় তা আমাদের প্রধাণ কবিদের মধ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ সময়ের সাথে শাশ্বতকে মেলানোর একটি আন্তরিক প্রয়াস বিশেষত প্রেমের কবিতার ক্ষেত্রে শামসুর রাহমানের এই প্রয়াস একেবারে স্বতন্ত্র ধারায় পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়। প্রেমের কবিতায় একেবারে নতুন ধারার সৃষ্টি করতে সক্ষম বলেই শামসুর রাহমান পরিপূর্ণরুপে প্রেমের কবিতায় নিজের নিজস্বতাকে মননে ধারণ করে তুলতে পেরেছিলেন।
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ” প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, থেকে শুরু করে উল্লেখযোগ্য কবিতাবলীতে প্রেমের স্বাতন্ত্র্য ও বিষয় বৈচিত্র্যময়তা লক্ষ করা যায়। নিটোল প্রেমের কবিতায় প্রেমের অনুষঙ্গের সাথে স্বদেশ ও সমাজ ও নাগরিকবোধ সব সময় উঠে এসেছে।কবি “তোমার নীরবতার কাছে” – কবিতায় বলেছেন-
‘বুকের চুঁড়ায় আকাঙ্খার চন্দ্রোদয়, শতবার
তোমার ওষ্েেঠর কাছে নত হয়ে দেবদূত কত
তোমার নিঃশ্বাসে গলে যায় কত প্রাচীন মিনার
তোমার গোপন হ্দে ঠোঁট রাখে শিল্পের সারস।
(তোমার নীরবতার কাছে- প্রেমের কবিতা)।
নারীর কাছে আকুতি, নারীর ওষ্ঠের কাছে, নারীর শরীরী নিঃশ্বাসে নত হয়ে যাওয়া সকল দ্বিধার প্রাচীর, নারীর প্রতি দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ কবিতাকে আলোড়িত করেছে। নিটোল প্রেম ও নারীর ঠোঁটের কাছে নতজানু মানবিকতা যেন জাগ্রত করে নতুন চেতনায়।
প্রেমের বিচ্ছিন্নতাবোধ কবির চেতনাকে নত করে নতুন আবেগের স্পর্শতায়, বিচ্ছেদের বেদনাবোধ প্রেমিক মনে নতুন করে চেতনা জাগায়,হাহাকার করে তোলে। তেমনি এক কবিতায় বেদনাবোধের জাগরণ প্রকাশ পেয়েছে।
যেমন:
তোমাকে না দেখে কাটে দিন, কাটে আর কত
রাত্রির ফুরোয় নিদ্রাহীন। শব যাত্রীর মতো
স্মৃতি ক্লান্ত পায়ে আসে, হাতে কিছু বিবর্ণ গোলাপ।
হঠাৎ কখনো যদি ডায়াল ঘোরাই টেলিফোনে
একটানা বেজে চলে,ওপারের নীরবতা বড় অত্যাচারী
দিন যায়, রাত কাটে তোমাকে না দেখে।
(তোমাকে না দেখে – প্রেমের কবিতাসমগ্র)
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটু একটু করে এগিয়ে যায় নতুন চেতনায়,নতুন সম্ভাবনায়। বর্তমানে বাংলাদেশের কবিদের মধ্য এক ধরনের নতুন কবিতা লেখার প্রবণতা তৈরি হয়, সকল দশকের কবিরাই নতুন উদ্দীপনা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। কবিদের লেখায় প্রেম ও একটি নতুন অনুষঙ্গ নিয়ে নতুন মাত্রায় ধরা দেয়। কবি শামসুর রাহমান ও তাঁর কবিতায় তেমনি একজন ছিলেন। তিনি মৌলিকতায় রাজনীতির সাথে প্রেমকে অনুষঙ্গ করে এক ধরনের নিজস্বতায় কবিতা লেখার প্রয়াস থেকে বেরিয়ে এসে পূর্ণ প্রেমের কবিতা নির্মাণে নিজেকে মনোনিবেশ করেন। সংকটাপূর্ণ দোশের নতুন পদধ্বনিতে শামসুর রাহমান রাজনীতির সাথে প্রেমের প্রকাশ নির্মোহ চিত্তে উচ্চারণ করেছেন।
তুমি বলেছিলে কবিতায় কবি বলেছেন-
আমাকে বাঁচাও এ বর্বর আগুন থেকে
আমাকে বাঁচাও,
আমাকে লুকিয়ে ফেলো চোখের পাতায়
বুকের অতলে কিংবা একান্ত পাঁজরে
আমাকে নিমেষে শুষে নাও চুম্বনে চুম্বনে।
(তুমি বলেছিলে- প্রেমের কবিতাসমগ্র)
কবি শামসুর রাহমান নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নারীর প্রতি প্রেমের প্রকাশভঙ্গি কবিতায় রূপায়ণ করেছেন চিরাচরিত রোমান্টিক ধারার বিপরীতে নিজের মতো করে রূপায়ণ করতে চেষ্টা করেছেন। প্রেমের নৈতিক মূল্যবোধও আধুনিক কবিতার জীবনধারাকে যেখাবে আয়ত্ত করুক না কেন প্রেম নিজেই হচ্ছে এক লক্ষ্যবিন্দু, যে বস্তুুর মূল্যমানের উর্ধে, এর কল্যাণকর দিক নিজের মধ্য নিহিত রয়েছে।
যেমন:
এই দ্যাখো আজ জোছনারাত
বাগানের সবচে’ সুন্দর গোলাপটি
দিলাম তোমার হাতে
‘ যতই আনো না কেন’ বললে তুমি,’ গোলাপ বকুল
অথবা রজনীগন্ধা, বৃথা সবই,
আমি তো চাইনে কোন ফুল,
তা হলে কী চাও তুমি? বলো তো কী ছাই-
পাশ পেলে হও খুশি? বললে মৃদু স্বরে,
‘ শুধুই তোমাকে চাই’।
(কথোপকথন-প্রেমের কবিতাসমগ্র)
মানব মানবীর সম্পর্কের সন্ধান প্রেমে মানব-মানবীর ভাবালোক, বিশ্বাস,কবিতায় মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন শামসুর রাহমান। কবিতায় নতুনভাবে বিষয় ও শব্দের আলোয় তিনি শ্যামল স্নিগ্ধতা কবিতায় ধ্বনিত করেছেন কন্ঠস্বরকে। পাঠকের চেতনাকে স্পর্শ করে তার কবিতায় বেদনাবোধ আলোড়িত করে তোলো। সুন্দর নিসর্গের মতো কবি কবিতায় প্রেমের প্রভা ছড়িয়ে দেন কবি।
যেমন:
কতকাল ধরে কন্ঠে তোমার মেয়ে
বইয়ে দিয়েছো চকিত ঝর্ণাধারা
যেন শীতার্ত প্রহরে পেয়েছে ফিরে
প্রাণের শিহরণ মৃত পুষ্পের চারা
কী করে তেমার রূপ বর্ণনা করি?
তোমার দু’চোখ কি সুন্দর ভাবি।
স্তনের ডৌল স্বর্গের উদ্ভাস
সোনালী চূঁড়ায় আমার কি আছে দাবী।
(” কতকাল পরে- প্রেমের কবিতাসমগ্র)।
নারীর প্রেম ও সৌন্দর্য বর্ণনায় অনুভবে, নারীর প্রেমের বিস্তার স্বকীয় সত্তায় উচ্চারণ করেছেন নতুন দ্যুতিতে। শামসুর রাহমানের প্রেম অনেকটা রক্ত মাংসের সংস্পর্শে না পেলেও অস্থিরতা ছড়িয়েছে।হাহাকার ও অস্থিরতা তার মনকে করেছে উদ্বেল।
কবির কোনো কোনো প্রেমের কবিতায় স্থিরতার বদলে অস্থিরতা বোধ হলেও কামনার রঙে রাঙিয়ে দয়িতার শরীর জ্বলে ওঠেনি।
কবি বলেছেন:
তোমার সান্নিধ্যে কিংবা তুমি হীনতায় কাটে বেলা
পরিত্যাক্ত নিঃসঙ্গ সৈনিক যেমন কম্পিত হাতে
রণ-ক্লান্ত ঠোঁটে রাখে শেষ সিগারেট
তেমনি আঁকড়ে ধরি একটি দিন আর ভাবি
সহসা তোমাকে হারানোর দুঃখ যেনো, হে মহিলা
কখনো না পাই।
কবি মিলনের কবি, কবি বিরহ ও বিচ্ছেদের কবি।হাহাকার ভরা বিচ্ছেদের মাঝে বাজে প্রেমিকের সাথে মিলনের অভিসার।কবির কবিতায় প্রেমের নানা মাত্রার বিচ্ছুরণ আছে।শরীরী প্রেম নয়, দয়িতার শরীর সংহার করার মৌল শক্তি কবি উচ্চারণ করেছেন কৌশলী শব্দের মালায়।
“হয়তো স্নান ঘরে নিজেকে দেখছো অনাবৃত
জানালার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টি ভেজা নর্তকীর মতো
গাছটিকে তীব্র দেখছিলাম তখন।
সাবানে ঘষছো তুমি বগলের সবুজাভ ভূমি
থালার মতো স্তন নাভিমূলে উরু
এবং ত্রিকোণ মাংসপিণ্ড, কী মন্জুল।
প্রেমিকের শরীরের বর্ণনায় হৃদয়াবেগের কামনা বাসনায় প্রেমের পথ খুঁজে পায় কবির মন।কবিকে প্রেমিকের সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করার শক্তি সন্ধান করে নিতে হয়।
তাইতো হাসপাতালে বেডে শুয়ে কবি উচ্চারণ করেছেন:
” কতকাল ছুঁই না তোমাকে।
কতকাল তোমার অধর থেকে আমার তুষা ওষ্ঠ বিচ্ছিন্ন এবং কাঁপে তোমার স্তন
বন কপোতীর মতো থরো থরো আমার মুঠোয়।
আমার নিঃশ্বাসে নেই বিষ
স্পর্শে যার গেলাপের বুকে
ছড়িয়ে পড়বে কীট।
আরিফ চৌধুরী, কবি ও প্রাবন্ধিক




