ড. মুহাম্মদ আবুল কাসেম
ইংরেজ কবি ইয়েটস (ড ই ণবধঃং ১৯৬৫-১৯৩১)এর মতে, কবিতাকে হতে হবে রহফরারফঁধষ, হধঃরড়হধষরংঃরপ ধহফ ড়পপঁষঃ; অর্থাৎ কবিতা হবে ব্যক্তি সত্তার প্রকাশ, স্বজাত্যবোধে সঞ্জীবিত ও নিগূঢ় রহস্যময়তায় আবৃত। কবি আল মাহমুদ বলেন, ‘গভীরতম শেকড় আছে যে কবিতায়, পাঠকের ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত সেখানে এসে দাঁড়ায়। … যে কবিতা মাটির শিকড়ের সাথে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেই কবিতার কাছে কবিরা এসে দাঁড়ায়, পাঠকেরা এসে দাঁড়ায়, মানুষের সমস্ত ভালোবাসা এখানে এসে দাঁড়ায়, কবিকে জিতিয়ে দেয়।’ শুধু তাই নয়, এই কবিতাই মানুষকে আনন্দ দেয়, মোহিত করে। মানুষ আপ্লুত হয়, তাড়িত হয় আবেগে, আত্মমগ্ন হয় সৌন্দর্যে। এ কাজে কবিরা যুগে যুগে ভাব ভাষা ছন্দ উপমা উৎপ্রেক্ষা চিত্রকল্পের বিচিত্রতা এনে পাঠককে মোহিত করেন। পৃথিবীর আদি কবি এনহেদুয়েন্না থেকে আজ পর্যন্ত জগৎজুড়ে কবিতার এই বৈচিত্র্য কত যে অগণিত বাঁক বদলের কসরৎ দেখিয়েছে— তার ইয়াত্তা নাই। বাংলা কবিতায় সেই চর্যাপদ থেকে আজ পর্যন্ত আধুনিক বাংলা কবিতা— লিরিক সনেট হাইকু লিমেরিক রুবাইয়াত গদ্যকবিতা ইত্যকার নানা রূপে বৈচিত্র্যে পাঠক-মন জুগিয়ে আসছে। শুধু তাই নয়, এখনও জোগাচ্ছে, পাঠকের মন অনন্তকাল কবিতায় ছুঁয়ে
যাবে। কথাগুলো মনে আসছিলো কবি নুরল আমিনের কাব্যগ্রন্থ জীবনবোধের কাব্য নিয়ে ভাবতে গিয়ে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ধারার (আশির দশক নব্বই’র দশক) কবিতায় কবি নুরুল আমিন স্বতন্ত্র স্বরের কবি। বলা যায়, বর্তমান বাংলা সাহিত্যে ড. নুরুল আমিন এক ভিন্নধারার কাব্য-সাধনায় নিয়োজিত। জীবনের সৌন্দর্য অভিব্যক্তিকে উপমার নান্দনিকতায় উদ্ভাসিত করেন তিনি। চোখে দেখা, পথ চলতে চলতে আত্মস্থ করা সত্যকে ভাষার সারল্যে ব্যঞ্জনাময় করে তোলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। তাই জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে শিল্প-সৌন্দর্যের রূপকল্পে কবিতায় তিনি উপমা চিত্রকল্পে ফুটিয়ে তোলেন। কবিতার ক্যানভাসে নির্মাণ করেন এক অজানা মায়াময় ইঙ্গিতময়তা। এভাবে কবি নুরুল আমিনের কবিতা হয়ে ওঠে সত্যের অবগাহনে স্নিগ্ধ। এ কথার সাক্ষ্য মেলে তাঁর সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ জীবনবোধের কাব্য (২০২৩) গ্রন্থটিতে। এর ‘রহস্যময়ী তুমি’ কবিতায় তিনি বলেছেন-
জীবনের মুখোমুখি বসেছো
না কি, জীবনেই তুমি একাকার?
বলো, রহস্যময়ী তুমি কার?
-জীবনবোধের কাব্য, পৃ. ৪৮
প্রকৃত একজন কবি এই রহস্যময়ীর মায়াজালেই সারা জীবন ঘুরে বেড়ান, বিশ্বজগৎ ও জীবনের রহস্য খুঁজে ফিরেন।
*লেখক, গবেষক ও শিক্ষক : অ্যালেন স্কুল অফ হেলথ সায়েন্স (ব্রুকলীন ক্যাম্পাস) নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।
প্রাবন্ধিক ও গবেষক ড. নুরুল আমিন গদ্য রচনায় যেমন মননধর্মী হয়েও সরল-সাবলীল, তেমনি কবিতায়ও সারল্যে সাবলীল। তাঁর কবিতায় রসবোধ, উপমা-উৎপ্রেক্ষার সাবলীলতা সমকালীন বাস্ততাকে ছুঁয়ে যায়। আবার রোমান্টিক ভাব-বলয়েও তিনি উদ্বেলিত হতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। এক অনুসন্ধানী সত্যাগ্রহী দৃষ্টিতে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন সমাজ রাষ্ট্র দেশ ও মানবজীবনকে। অনাবিল সারল্য ও প্রাঞ্জলতার মননশীলতায় তাঁর গদ্য ও কাব্য ভাষা সঞ্চরমাণ । সামাজিক অবক্ষয়, মনুষ্যত্বের সংকট, মূল্যবোধের বিপর্যয়ে তিনি দু:খবোধে ক্ষতবিক্ষত। সেই দু:খবোধের প্রকাশে তাঁর কবিতা যুগপৎ বেদনা ও প্রতিবাদে বাক্সময়। ২০২২ ডিসেম্বরে লেখা ‘কোন দেশে যে আছি’ কবিতায় তাঁর স্পষ্ট ক্ষোভ :
ঘুষ ছাড়া আর হয় না কিছু, কোন দেশে যে আছি!
স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল ঘুষমুক্ত স্বাধীন দেশে বাঁচি,
আমলা হবে দেশের সেবক
জজ ব্যারিস্টার ন্যায় বিচারক
কাম্য ছিল, স্বাধীনভাবে ভোট প্রদানে সঠিক নেতাই বাছি!
কী চেয়েছি, কী হয়েছে, কোন দেশে যে আছি!
-জীবনবোধের কাব্য, পৃ. ৪৪
ইত:পূর্বে ২০১৮ ফেব্রুয়ারিতে লেখা ‘না-বলা বাণী’ কবিতায়ও তাঁর দু:খবোধের স্নিগ্ধ-প্রকাশ লক্ষ করা গেছে। যেখানে তিনি বলেছিলেন :
ধনের এমন অশুভ প্রতিযোগিতা তো আমার কাম্য ছিল না!
শিক্ষার নামে অশিক্ষা মূল্যবোধের অবক্ষয় তো আমি চাইনি!
বাংলার ঘাস লতাপাতা নদী এমন কেন সজীবতা হারাচ্ছে!
আর কত ধূলিকণা রাসায়নিক বর্জ্য তার পেলবতা চুষে খাবে?
ডিজিটালের রাজ্যে পাখিরা কি বাঁচবে না?
প্রকৃতির নানা রং মনুষ্য ডিজাস্টারেই উবে যাবে?
-জীবনবোধের কাব্য,পৃ. ১৫
কবি নুরুল আমিনের কবিতায় ছন্দের উজ্জ্বল্য ও চিত্রকল্পের উজ্জ্বল্য প্রবহমান নদীর মতো তরঙ্গায়িত। তা তাঁর এই নবম কাব্যগ্রন্থে যেমন, তেমনি তাঁর প্রথমদিকের কাব্যেও সমভাবে অক্ষুণ্ন ছিল। উদাহরণ স্বরূপ তাঁর লেগে আছে শ্যামল ছায়ার “এই শহরে বৃষ্টি” কবিতাটি তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না— যেখানে তিনি লিখেছেন :
বৃষ্টি তো নয় এমন বৃষ্টি তেজস্ক্রিয়ায়
ফলতে থাকে মধ্য রাতে মধ্য শীতে—
ফুটপাথের ঐ শুয়ে থাকা মানুষগুলো
লাশের মতো জমতে থাকে বিআরটিসি-র
ছাউনি তলে, পাশেই আবার মিশ্কা হোটেল
মদ্যপায়ী ফুলেল বাবুর স্বর্গপুরী—
এই শহরে, বৃষ্টি পড়ে গুড়ি গুড়ি ।
-নির্বাচিত কবিতা, পৃ. ৫২
স্বরবৃত্ত ছন্দের দ্রুত পদাঘাতে সমাজ-সভ্যতার বৈষম্য-বৈসাদৃশ্যের চিত্ররূপ তুলে ধরতে এ-কবির অসাধারণ কৃতিত্ব লক্ষ করা যায়। তেমনি ‘জীবনবোধের কাব্য’ গ্রন্থেও এরকম প্রমাণের অভাব নেই।
আজীবন মানব জীবনের গূঢ় রহস্যের সন্ধানে ব্যাপৃত কবি নুরুল আমিন খুঁজে বেড়ান কাব্যের অবয়বে জীবনের ভাঙাগড়ার দোলাচলবৃত্তির রহস্যময় রূপ। জীবনের শুরুতে কিংবা প্রাথমিক পর্যায়ের মানবচিত্তের রহস্যময়তার খুঁজে ১৯৭৭ সালে তরুণ কবি জীবন রহস্যের অন্বেষায় “চিত্ত নামের হরিণী” কবিতায় নির্মাণ করেছিলেন অসাধারণ চিত্রকল্প। বলেছিলেন :
চর্যার হরিণীর মতো এ চিত্ত বিষম হেঁয়ালি—
যৌবনের রূপ নিটোল বসন্তে ফেটে পড়ে
ডালিমের অমৃত রসভরা ঠোঁটের মতো,
আবার এমনও হয় : আপণা মাংসে হরিণা বৈরী;
-লৌকিক অলৌকিক, নির্বাচিত কবিতা, পৃ.১৩
২০২২-এর ডিসেম্বরে ষাটোর্ধ্ব কবি জীবনের রহস্য খুঁজিতে গিয়ে আত্ম-অন্বেষা কিংবা আত্ম-জিজ্ঞাসায় বলে ওঠেন :
বিপুলা এই পৃথিবীতে সুখেদুখে সত্তা আমার ভাসে,
তারও আগে কোথায় ছিলাম
হাজার বছর কাটিয়ে দিলাম
কোন বা গ্রহে কোন স্বরূপে সত্তা নেমে আসে!
এসব ভেবে কূল-হারা হই, পাশে তিনি রহস্যতে হাসে!
-‘আমি’, জীবনবোধের কাব্য,পৃ. ৪৭
কবিতায় সারল্যে গভীরতার ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে পারঙ্গম কবি নুরুল আমিনের এই বৈশিষ্ট্যটিকে তুলে ধরে পশ্চিম বঙ্গের খ্যাতিমান লেখক আজহারউদ্দীন খান ১৯৮৮ সালে বলেছিলেন, ‘সহজ সরল পঙ্ক্তির মধ্যে গভীর ব্যঞ্জনা’ তিনি ফুটিয়ে তুলতে পারেন। আমরা কবির এই বৈশিষ্ট্যটিকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে দেখলাম কবির জীবনবোধের কাব্যে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কবি ও গবেষক ড. নুরুল আমিন দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর যাবৎ শিক্ষকতার পাশাপাশি কাব্যচর্চায় নিয়োজিত। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। অধ্যাপনার মাঝেও তিনি গবেষণার সাথে সাথে নিরলস কাব্য-চর্চা করে গেছেন। আজন্ম সত্য-সুন্দরের পূজারী কবির বসবাস কবিতার নান্দনিক বাগানে। এই বাগানেরই ৩৪টি কাব্য-ফসলের সম্ভার জীবনবোধের কাব্য। ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারির গ্রন্থমেলায় ঢাকার গ্রন্থরাজ্য এটি প্রকাশ করে। এর “অলৌকিক লাল গোলাপ”, “সুন্দরের বিচ্ছুরিত আলোয়” “পাহাড়ী বকুল”, “কাশ্মীরি ময়ূরের কান্না” প্রভৃতি কবিতা কবির সত্যান্বেষী কাব্য-চর্চার পরিচায়ক। কাব্যগ্রন্থটি কবির জীবনবোধের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার কাব্যিক ফসল বৈকি। তিনি শুনতে পান মানবতার ক্রন্দন ধ্বনি, তাই মানুষের প্রতি মমত্ববোধে তিনি ব্যাকুল।
বিচিত্র বিষয়ের ৩৪টি কবিতার সমন্বয়ে জীবনবোধের কাব্য একটি মনোমুগ্ধকর কাব্যগ্রন্থ। এর “গুরুত্রয়” কবিতাটি স্বরবৃত্ত ছন্দের রূপবৈচিত্র্যে নিটোল যেখানে কবির তিন গুরু- অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ড. আনিসুজ্জামান, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ড. জাহাঙ্গীর তারেক-কে তুলে ধরা হয়েছে। “অলৌকিক লাল গোলাপ” কবিতায় কবি ফিলিস্তিনে বর্বর হায়েনা দখলদার মানবতার দুশমন ইহুদি সেনার গুলিতে নিহত শহিদ সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহকে স্মরণ করে চমৎকার রূপকল্পে চিত্রিত করেছেন ইতিহাসকে। তেমনি “অলৌকিক ইন্শাল্লাহ” কবিতায় ৭ই মার্চের ভাষণের অলৌকিক আত্ম-প্রত্যয়ের শক্তিমত্তায় ইনশাআল্লাহর গুরুত্ব উচ্চকিত করেছেন কবি। এ-ভাবে লক্ষণীয়, জীবনবোধের কাব্য বিবিধ অনুষঙ্গে জীবন ও জগতের মর্মকথার চিত্রকল্পে ভরপুর। উত্তাল সময়ের গতিময়তা, জীবনের ছন্দপতন, মানবতার ক্রন্দন, পরাজয় হাহাকার, পৃথিবীব্যাপী করোনা মহামারির ছোবল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিনে ন্যাৎসি ইহুদির ধ্বংসযজ্ঞে বিপর্যস্ত মানবতার ক্রন্দন ইত্যাকার বিষয়-বৈভবে অভিনব এই কাব্য। এখানে কবিতার চিত্রকল্প নির্মাণে কবি নুরুল আমিন দক্ষ রূপকারের পরিচয় দিয়েছেন। যেমন :
(ক) আকাশ-তশ্তরি ভরে দিলে লোকে উন্মুক্ত উদার,
-(নিউক্লিয়াস বঙ্গবন্ধু)
(খ) অভাবে ঘুমন্ত পুরী কাঁদে বধুঁয়া তোমার !
– (উষ্ণতা)
(গ) আকাশ ছোঁয়া নীল গিরিতে মেঘের ভেলা ভাসে
পাহাড় ঘেঁষে সবুজ-শ্যামল সোনা রোদে হাসে।
-(পাহাড়ি বকুল)
(ঘ) তবু তো প্রিয়ে, তোমার বুকের কান্না
ধু ধু বালুচর হয়ে হৃদয়ে আমার বাজে!
-(পদ্মা)
(ঙ) ভোট হয়ে যায় তেলেসমাতি
কারসাজিতে চড়ুইভাতি!
-(নেতা হলে)
অতএব বলতে দ্বিধা নেই, কবি নুরুল আমিনের এ সব ভাষাচিত্রের অভিনবত্ব ও ব্যঞ্জনা পাঠকচিত্তকে আন্দোলিত করে, যার ফলে কবিতার পারম্পর্য, ভাষা নির্মাণের ধরন ও ইঙ্গিতময়তায় সৃষ্টি হয়েছে- তাঁর নিজস্ব এক কাব্য-ভুবন। তাই কবি গবেষক ড. সুমন হায়াতের মতো আমাদেরও বলতে হয়, ‘জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে সঞ্চিত অর্জনকে ভেঙে ভেঙে উপমার নান্দনিকতায় শিল্প-রসে গড়ে ওঠে কবির কবিতা। কবি নুরুল আমিনের কবিতার নির্মাণ-কৌশলই এই সত্যের জানান দেয়। আত্মমগ্ন সাধনা আর সুদীর্ঘ কাব্য-চর্চার ফলে কবির চিত্তভূমি হয়ে উঠেছে কবিতার বীজতলা। তাই কবি নুরুল আমিনের কবিতা পাঠককে শুধু মুগ্ধই করে না, মগ্নও করে।’
জীবনবোধের কাব্যের আর একটি বিশেষত্ব মনীষী-জীবনের প্রভাব। কবির তিন শিক্ষক ড. আনিসুজ্জামান, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও বহুভাষাবিদ ড. জাহাঙ্গীর তারেক এ ক্ষেত্রে তাঁর সরাসরি স্ব-স্বীকৃত গুরুজন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর আশৈশব একান্তে পাওয়া মনীষী। বিশেষ করে, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল রবীন্দ্রনাথের অভূতপূর্ব সৃষ্টিকর্মে আশৈশব মোহাচ্ছন্ন কবি। জীবনের পড়ন্ত বেলায়ও কবিকে আকৃষ্ট করে রেখেছে অবারিতভাবে। “আমার রবীন্দ্রনাথ” কবিতায় তাই কবি বলেছেন :
সেই শৈশবে দেখা আমাদের
বাড়ির উঠানে প্রত্যন্ত গাঁয়ে
‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে’।
… … …
যৌবনে তিনি হাতে হাত রেখে
পুরোটাই নিলেন কিনি;
সত্তা আমার প্রেমে গানে
একাকার যে হলো
তারই রেশ বয়ে গেলো
… …
জীবনের মধ্যহ্নে অপরাহ্নে,
-জীবনবোধের কাব্য,পৃ.৪৫
অপরদিকে কবি নজরুল সত্য-উপলব্ধির ‘উন্মত্ত’তায় ও ‘উচ্চমার্গের গজল গানে’ ‘সুরের জাদু কথার কলানৈপুণ্যে’ কবিকে বিভোর করে তোলে। এর ইঙ্গিতময়তা লক্ষণীয় “নজরুল যখন” কবিতায়। শুধু এখানে নয়, কবি নজরুল যে কবি আমিনের ব্যক্তি-সত্তায় তরঙ্গায়িত উপপ্লব রূপে সমগ্র বাংলাদেশকে ধারণ করার সামর্থ্য রাখে, তার প্রমাণ তিনি স্বপ্ন দেখি সুন্দরের কাব্যের “না টর্নেডো না হ্যারিকেন” কবিতায় দিয়েছিলেন। ১৯৯১-এর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় পররর্তী লেখা উক্ত কবিতায় তিনি বলেছিলেন :
নজরুল- না টর্নেডো না হ্যারিকেন
বাংলাদেশে এখন তোমার বড় প্রয়োজন।
-স্বপ্ন দেখি সুন্দরের, নির্বাচিত কবিতা,পৃ.৭১
সেই টর্নেডো-হ্যারিকেনের মতো প্রচণ্ড শক্তিমান ‘শব্দধানুকী নজরুল’ই দূষিত ও নির্যাতিত বাংলার ত্রাতা।
জগৎজুড়ে মানবতা আজ ভূলুন্ঠিত। মজলুমের কান্নায় ভারী হচ্ছে বাতাস। দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশ্ব-বিবেকের ঋণ। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মতো তাই কবি নুরুল আমিনও মানুষের সামরিক শক্তির দাম্ভিকতাকে চূর্ণ করে মানবতা-মনুষ্যত্বের জয়গান করতে আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, করোনা’য় যেখানে-
মরিছে মানুষ লাখে লাখে দিকদিশেহীন সদল বলে,
বাঁচাতে তো পারলে না তাদের, তবুও তোমার দম্ভ কীসে?
ছাড়ো এবার মারণাস্ত্র-যোগ, বাঁচাতে খুঁজো পথের দিশে।
তবেই তোমার লজ্জা কিছু ঘুচতে পারে মানুষ-নামের,
হে, শীর্ষে চলা সভ্য মানুষ, জীবন বলো কত দামের?
-হে সভ্য মানুষ, জীবনবোধের কাব্য, পৃ. ২৬
ড. নুরুল আমিন বাংলা সাহিত্যের একজন বস্তুনিষ্ঠ গবেষক হয়েও গভীর জীবনবোধের কবি। দেশ, কাল, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, মানুষের জীবনবোধকে তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁর কাব্য-রচনা, গবেষণা, সম্পাদনা বহুমাত্রিক পরিমণ্ডলে বিস্তৃত। জীবনবোধের কাব্য গ্রন্থটি ২০২৩ সালে একুশে গ্রন্থমেলায় ঢাকার গ্রন্থরাজ্য প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত। রুদ্র কায়সারের চমৎকার প্রচ্ছদে নিটোল বাঁধাই, চমৎকার কাগজ ও মুদ্রণে গ্রন্থটি মনোমুগ্ধকর। গ্রন্থটির মূল্য ২৫০ টাকা। আমি গ্রন্থাটির বহুল প্রচার কামনা করি।
ড. মুহাম্মদ আবুল কাসেম, গবেষক ও প্রাবন্ধিক




