ইতিহাস
সনতোষ বড়ুয়া
ইতিহাস তো রয়ে গেল ইতিহাসের পাতায়
কেমন করে এমন হল ঢুকছে না তো মাথায়।
জানান দেয়ায় ফাঁকি ছিল, কার কি ছিল কম্ম
ইতিহাসে মূর্খ ভীষণ নতুন প্রজন্ম।
ঠিক চেনে না বায়ান্ন আর একাত্তরের দিন
এমন মেধার পাচ্ছি দেখা গা করে ঘিন ঘিন।
জানতে হবে দেশ ভাগ হওয়া, পরের আন্দোলন
কে ভেঙেছে সহজ সরল এ বাঙালির মন।
কে জাগালো বাঙালি কে, কোন সে নেতা বীর,
কে ঠেকালো পাকিস্তানের বিষ মাখানো তীর।
নেতার সাথে অনেক ছিল সহকর্মী তার
পাকিস্তান কী এমনি পালায়? হিসাব নিবে আর-
মনের ভেতর রাখবে তাদের শ্রদ্ধাসহ স্মরণ
এ বাঙালির মাঝেই তারা ছিলেন অসাধারণ।
=========================
স্বরূপা
শঙ্খশুভ্র পাত্র
‘স্বরূপা’ নামের কোনও রূপময়ী শান্ত বালিকাকে
সুস্মিত দেখেছি, খণ্ড, কথা তার আমলকি-স্মৃতি
উড়িজলকরে যেন উড়ে-উড়ে নদীটার বাঁকে
দু’দণ্ড জিরিয়ে নেয় এই তার আত্মগত-প্রীতি
কোমলস্বভাব এত যে আমল দেয় ঘন-দেয়া
দেয়ালের বিপ্রতীপে শিশুর দেয়ালা নিয়ে বাঁচে
শব্দে তাকে কী খেয়ালে ধরে রাখে আটপৌরে খেয়া
তরঙ্গ চিনেছে জল, ছল বুঝি আনাচে-কানাচে!
‘স্বরূপা’ বোধের! সে যে রৌদ্রস্নাত-অনিন্দ্যকুসুম,
বালুকাসম্ভব, নদী- বালিকার নিরবধি টান
শিখাকে মিলায়, খুশি, পদাবলি, কীর্তনের ধুম
গোধূলি রঞ্জিত করে, ঘরে-ফেরা পাখিদের গান
আঁধার-কণিকা যেন একে চন্দ্র, তারাময়ী, তারা
আকুল গগনে আত্মা-নিবেদিত সম্মোহিত ধারা…
আলো হাতে অন্ধকারে
দুলাল সরকার
ইচ্ছার দৃঢ়তা নিয়ে বলো
এ পৃথিবী সাহসী মানুষের,
রৌদ্র হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে যারা
আগুনের ডানা হতে পারে;
এ পৃথিবী শুদ্ধ বিবেকবান মানুষের
সৃষ্টির প্রেরণা যার বুকের মৃত্তিকা
সাম্য চেতনায় ঋদ্ধ যে সব মানুষ
আলো হাতে অন্ধকারে অবিচল
লক্ষ্যের মুখে।
=========================
প্রশান্তির ঘুম
দিলীপ কির্ত্তুনিয়া
ক্লান্তির ঘুম একরকম
কিন্তু প্রশান্তির ঘুম সম্পূর্ণ আলাদা।
ক্লান্তির ঘুমে আর কয়টা গোলাপ ফোটে
প্রশান্তির ঘুমে শত শত গোলাপ।
ক্লান্তির ঘুম অনেকটা বাধ্যতামূলক
শরীর পারে না আর
কষ্টের ভার বহন করতে —
তখন দু’চোখের পাতায়
ঘুম নেমে আসে।
তারও একটা সুখদ মর্যাদা আছে
সে ঘুমও দামি
পুনরুজ্জীবনে
বেঁচে থাকার জন্যে।
কিন্তু একশো রোগীকে অপারেশন শেষে
চোখের আলো ফিরিয়ে দিয়ে
সারাদিনের প্রাপ্ত প্রশান্তির ঘুম —
মানুষকে সেবা দিয়ে অপরিসীম ভালো লাগার ঘুম —
অস্ত্রের প্রেমে অন্যের বাগানে দৃষ্টি গোলাপ
ফোটানোর ঘুম —
মানুষ থেকে প্রাপ্ত দোয়া আশীর্বাদের ঘুম —
আকাশ জোড়া সে ঘুমের পরিধি
তুলনাহীন সে ঘুমের স্বপ্ন আনন্দ উচ্ছ্বাস
সে ঘুম চোখের অমৃত পানের মত!
কথাগুলো বলছিলেন দেশের খ্যাতনামা চিকিৎসক
চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. রবিউল হোসেন
পিন পতন নিঃস্তব্ধতায়
যখন তার ভাষণ চলছিল
তাঁর লেখা বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে।
=========================
মৃন্ময়ী
মাহমুদ নজির
একেকটি কবিতার
ভেতর থেকে তোমাকে খুঁজি-
তোমার স্পর্শ, মায়া, মমতা।
শব্দে শব্দে, অক্ষরে অক্ষরে
লেগে আছে মধুর ছোঁয়া!
অথচ তুমি থেকেও নেই,
বহুদিন অনুপস্থিত আমার হৃদয়ে।
এই পোড়া দেশে
কবিতার চেয়ে সত্য ও বলিষ্ঠ কোনো
উচ্চারণ হয় না শোনো –
জীবনকে ভেঙেচুরে জাগিয়ে তোলার
সকল কাজেই শঠতা, চাটুকারিতা
বৈষম্য, বিভাজনের সুর।
এগিয়ে যাওয়ার পথে
ক্রমশ প্রতিবন্ধকতা, প্রতিযোগিতার।
মৃন্ময়ী সময় যাচ্ছে না ভালো,
চতুর্দিকে কুয়াশা,থমথমে অন্ধকার!
এইবার এসো দুইয়ে মিলে
সুন্দর স্বপ্নের কথা বলি,
দুইয়ে মিলে পাতি কবিতার সংসার।
দ্বীপ জ্বেলে দিই বাংলার ঘরে ঘরে,
আলোকিত হোক মনোরমা –
হৈমন্তিক সোনালি প্রান্তর।
=========================
জমা রেখে যেও
শহিদ মিয়া বাহার
কোথাও কোন ফুল নেই নিঝুম বাগানে
গীতিহীন সরোদ ডালে বাজে না কখনো গোলাপী সাকুরার মিথ
তবু তুমি হলুদ ফ্রেসিয়া
দূরের রাধাচূড়ায় বাজে তোমার চৈতালি পায়েল!
আমি এক সুদূর মোহনা
আকন্ঠ পান করি লিলাক অধরের থৈ থৈ নীল
জলাশয়ে তোমার অর্কিড ঘ্রাণের নিরুপম গীত!
মালতী বাগানে বৃন্তের ভেতর সারারাত জেগে থাকি আলোর সারথি
জিন্দেগির মৈথুন নিয়ে
প্রতীক্ষায়!
ছেড়ে যাবার আগে মেঘ-বারি-আকাশের দেশে জমা রেখে যেও
প্যনোরমিক প্রেম
আমি সৌরজগত ফুঁড়ে রঙধনু হব!
=========================
দহন (দুই)
সুশান্ত হালদার
চাঁদ থেকে নেমে এসে দেখি তুমি নেই শিউলী তলে
ঘটনাক্রমে জানতে পেলাম তমসার ঠিক লগ্নচ্যুত প্রহরে
অন্ধকার রাত নেমে এসেছিল জোছনামুখর চাতালে,
তারপর……
সম্ভ্রম হারাবার ভয়ে পালিয়েছে সে কাউকে কিছু না বলে
ডুবেছে সূর্য ঘনঘোর অন্ধকারে
কে আছ ভাই? হাঁকিছে আজ বিপ্লব চেতনার মশাল মিছিলে
মরেছে যারা আগুন উপাস্য সুখানন্দ পাহাড়ে
হাড় কটকট রৌদ্র এসে শুনিয়েছে গান একাত্তরে
সালাম তাদের, বেয়নেট বিদ্ধ দেহে এঁকেছে ‘বাংলাদেশ’ নিঃসন্দেহে,
আমি কি ভেবেছি পঞ্চাশ উপনীত সময়ে
ধর্ষক মহড়ায় নেমে আসবে অন্ধকার প্রেয়সীর ধূপগন্ধী চাতালে?
এখানে বন মোরগের ডাকে যদিওবা সন্ধ্যা নেমে আসে
দেবী বিদায়ের শরৎ যে মরালের ডাক ভুলেছে
সে কথা চাউর হয়েছে হুক্কাহুয়া শেয়াল ডাকা প্রহরে,
এখন আমি ভয়ে কাতর পঞ্চাশোর্ধ বয়সে
খালি বুক, উলঙ্গ পরিচ্ছদ দেখে যদি ফ্যালে মাংসাশী শেয়ালে
কি হবে উপায় এই স্বাধীন সার্বভৌম জননী আব্রু রহিতে?
এসেছি ত্রস্ত পায়ে, রিক্ত হস্ত, আবহ সঙ্কট কোঁচড়ে ভর করে
যে দেবার সে দেবে তিস্তা গোমতী গঙ্গার মতো করে,
যে দেবে না সে শত্রুপক্ষ, ভাগাড় বিস্তৃত চিল শকুনে;
জানি বলেই মাতম করিনি নিরুদ্দেশ প্রেয়সীর আত্মহনন দহনে!
=========================
হাওয়ার মেশিনে দমের খেলা
রবি বাঙালি
হাওয়ার মেশিন বিকল হলে বন্ধ হবে দমের খেলা
রঙ তামাশা রঙ্গলীলা সাঙ্গ হবে ভবের মেলা।
কে বানাইলো দেহ কেসিন
ভরে তাতে হাওয়ার মেশিন।
ও ভোলা মন মন রে বুঝাও মেয়াদ শেষে করবে হেলা,
হাওয়ার মেশিন বিকল হলে বন্ধ হবে দমের খেলা
রঙ তামাশা রঙ্গলীলা সাঙ্গ হবে ভবের মেলা।
পরে রবে বাড়ি-গাড়ি
সোনা দানা গয়না কড়ি,
সন্ধ্যাবেলায় পার ঘাটেতে
ভিড়বে যখন পারের তরী।
তিন কাপড়ের সাদা শাড়ি
সাড়ে তিন হাত মাটির বাড়ি।
ও ভোলা মন মন রে বুঝাও ওই আঁধারে একলা থাকার ঠেলা,
হাওয়ার মেশিন বিকল হলে বন্ধ হবে দমের খেলা
রঙ তামাশা রঙ্গলীলা সাঙ্গ হবে ভবের মেলা।
=========================
একটা অসম্ভব প্রিয় শব্দের জন্য
আইনাল হক
একদিন আমার পছন্দের শব্দরা
পাখি হয়ে উড়তে লাগলো গোধূলির আকাশে
বিশাল সমুদ্রে অবগাহন শেষে ভোরের গা ছুঁয়ে
ফিরে আসলো পৃথিবীর মানুষের কাছে
পরম মমতা ও সীমাহীন ভালোবাসায়
ঠাঁই পেল টেবিল, সেলফ ও বারান্দার বুক পকেটে
তদুপরি আকাশ সমান প্রসারিত বাহু অপেক্ষামাণ
একটা অসম্ভব প্রিয় শব্দের জন্য
না, ভালোবাসি টালোবাসির ন্যাকামি নয়
খুব আদুরে ও ভীষণ মায়ায় গড়া দুই বা ততোধিক বর্ণের
=========================
প্রতীতি জাগুক
খুকু আহমেদ
ছন্দের দোলা নাগের ফণায়
অধরা রাগিণী কবিতার সুরে
জলবতী মেঘ যমুনায় নামে
মন্দ্রিত তালে বৃষ্টি নূপুরে;
আকাশে উড়াই জীবনের ঘুড়ি
অজর নাটাই মন্ত্রের জোরে,
অশুভ পুড়ুক ইন্দ্র আলোয়,
প্রতীতি জাগুক রঞ্জিত ভোরে।
=========================
আমি হইনি প্রজাপতি অপু হয়নি ঘাসফুল
নন্দিনী সোমা
অপুর সাথে শেষবার যখন দেখা
আমি তখন প্রজাপতি নই অপুও নয় ঘাসফুল।
শুধু হয়েছিলো কিছু ইশারায় কথা
জলসিঁড়ি বা ধানসিঁড়ি ছুঁয়ে নয়
একটা সময় আমাদের দেখা হয়েছিলো মনসিঁড়ি ছুঁয়ে
পাঁজরের অলিগলি পেরিয়ে হাজার কবিতার পঙ্ক্তি মাড়িয়ে
হয়েছিলাম দুটি পাখি বন্য
প্রেম অথবা মহাশূন্য।
এখন অপুর একলা বিকেল কাটে আমাকে ছাড়া,
অগোছালো ঘর আরও বেশি অগোছালো
আমাকে ছাড়া
এবং আমি ভালোই আছি,
যতোটা ভালো থাকলে আমাকে আর প্রজাপতি হতে হবেনা
অপুকেও হতে হয়না বিকেলের ঘাসফুল।
শেষবার যখন আমাদের দেখা, যেনো বিরহের ক্যানভাসে আঁকা
চোখে চোখ ভাবনা চিবুক, পুরনো স্মৃতি।
অপুর চারপাশে এখন অজস্র প্রজাপতি
সে এখন কারও বিকেল কারও গোধূলিতে মাখা ভুল
আর আমার হারানো স্মৃতিতে
অজানা, অচেনা এক ঘাসফুল।।
=========================
মূল্যবোধের মৃত্যু
চন্দনা চক্রবর্তী
মানুষ এখন মুখোশ পরে, মিথ্যে হাসি দেয়,
সত্য কথা বললে তাতে উপহাসে নেয়।
সততা আজ হারায় পথে স্বার্থের ভিড়ে,
মানবতা ক্লান্ত হয়ে পড়ে ধোঁয়ার নীড়ে।
ভালোবাসা হিসাব করে, মন হয় ক্ষুদ্র আজ,
বিবেক ঘুমায়, জেগে থাকে লোভেরই সমাজ।
তবু কিছু প্রাণ জ্বালিয়ে যায় আলোর প্রদীপ,
তাদের জন্যই টিকে আছে মানব রূপের দ্বীপ।
==============
বাবার ফটোগ্রাফ
শানু মজুমদার
আমার ফ্ল্যাটের উত্তরের ছোট একটি কক্ষের
দেয়াল সেঁটে
আমার বাবার একটি রঙিন ছবি
টাঙানো আছে।
সেই নিরিবিলি কক্ষটিতে
আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায়
কিংবা রাতে একবার গিয়ে
বাবার মুখোমুখি দাঁড়াই ।
আমি দক্ষিণমুখী হয়ে বাবার দিকে তাকালেই
বাবা সজীব হয়ে উঠেন
আমি লক্ষ করি তখন ফটোফ্রেমটি নড়ে চড়ে ওঠে
তারপর স্বভাবসুলভ মৃদু হেসে
আমাকে জিজ্ঞেস করেন সস্নেহে —
“কেমন আছিস রে খোকা,
তোর মুখটা এতো শুকনো কেন?
মাথার ঝাকড়া চুলের জায়গায়
এতো ছোট ছোট চুল, কখন হলো এমন ” ?
আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন —
“তোর তো চুল পেকে গেছে,
কপালে রঙধনুর মতো বলিরেখা
সেদিনকার খোকা তুই
এরই মধ্যে এতোটা বুড়ো হয়ে গেলি?
আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে নারে”!
তাঁর ম্লান মুখে কিছুটা উদ্বেগ লক্ষ্য করি
কিছুটা চঞ্চল হয়ে ওঠেন।
আমি অপলক দৃষ্টিতে বাবার ছবির দিকে
তাকিয়ে থাকি। কোন কথা বলি না।
আমার মনে হয় বাবা, আমার মুখ -গাল -ঠোঁটে
হাত বুলিয়ে আদর করছেন!
আমি স্পষ্ট বাবার স্পর্শ টের পাই
সেই পরিচিত হাত, হাতের আঙুল, পরিচিত স্পর্শ
আমি আবেগে আপ্লূত হয়ে বলি–
“বাবা তুমি বেঁচে আছো,
তাহলে তোমার মৃত্যু আমাদের
জাগতিক কোন ভুল “?
আমার কথা শুনে বাবা মুচকি হাসেন।
আমি একা একা এই ছোট্ট কক্ষটিতে এলে
কিভাবে জানি বাবা টের পেয়ে যান!
===========
মানব জীবন
স্বর্ণা তালুকদার
মানব জীবন কল্যাণে যে জীবন
সেবিছে সে ঈশ্বর নিজ নিবেদন,
তথাগত ভাবনায় সদা জাগ্রত
হৃদয় যেন হয় সাম্য শাণিত,
সে জীবন সুন্দর সততায়
সকলে তাকে শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানায়।
নিজ গুণ হয়েছে যে আলোকিত,
বিনয়ী সে জন সমাজে গৌরবান্বিত।
============
কুয়াশা ভেজা মন
টিপলু বড়ুয়া
বৃষ্টিঝরা কুয়াশা অঝোরে ঝরছে
হাঁড়কাঁপা শীতে, ভোর প্রভাতে
ভেজা পাতারাও কাঁপছে।
ঘাসে জমা শিশির কণা
ঝলমলিয়ে নাচছে।
কুয়াশা ভেজা এ মন শুধু
তোমার কথা ভাবছে।
খোলা চুলে ষোড়শীর মতো
খেজুর গাছের যৌবন-রস
বাড়ছে অনবরত।
শুকনো পাতার মিছিল দেখে
কাঁদছে বৃক্ষগুলো,
ধূসর আকাশে হঠাৎ যেন-
বইছে প্রেমের ধূলো।




